সেনাবাহিনী বসে থাকবে না, যথাসময়ে দায়িত্ব পালন করবে by কাফি কামাল ও জিয়া শাহীন
বগুড়ায় পুলিশের গুলিতে নিহতদের সমবেদনা
জানাতে গিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা
করেছেন। তিনি বলেছেন, সেদিন সেনাবাহিনী এসেছিল। প্রতিবাদী মানুষকে লক্ষ্য
করে তারা গুলি চালায়নি। এজন্য তাদের ধন্যবাদ।
তারা শান্তি
মিশনে গিয়ে অন্য দেশের মানুষের জীবন রক্ষায় কাজ করে। আর নিজের দেশের
মানুষকে গুলি করে হত্যার দৃশ্য তারা চেয়ে চেয়ে দেখতে পারে না। প্রয়োজনের
সময় তারাও দায়িত্ব পালন করবে। গতকাল বগুড়ার মাটিডালি বিমান মোড়ে শোকসভায়
তিনি এসব কথা বলেন। পুলিশের গুলিতে নিহতদের স্মরণে স্থানীয় ১৮ দলীয় জোট এ
সভার আয়োজন করে। সরকার পতনের একদফার আন্দোলনের ইঙ্গিত দিয়ে খালেদা জিয়া
বলেন, এত দিন নির্দলীয় সরকার পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছি। এখন বলছি, এ
সরকারকে বিদায় নিতে হবে। ২৬শে মার্চের পর থেকে সরকার পতনের নতুন কর্মসূচি
শুরু হবে। সোমবার (আজ) এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ থাকার
আহ্বান জানিয়ে সারাদেশ অচল করে দেয়ারও হুঁশিয়ারি দেন তিনি। পরে খালেদা
জিয়া জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে শালাইপুর হাইস্কুল মাঠে এক শোকসভায় অংশ নেন।
শোকার্ত মানুষকে সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি সেখানেও এক দফার আন্দোলনে যোগ
দিতে উপস্থিত জনতার প্রতি আহ্বান জানান। বিকাল চারটার দিকে ফের বগুড়ায় এসে
সার্কিট হাউজে বিশ্রাম নেন। পরে গাবতলীর সোনারায়ের বামুনিয়া পূজামণ্ডপ
পরিদর্শন ও রামেশ্বরপুরে নিহত একজনের বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের
সমবেদনা জানানো শেষে তিনি শাহজাহানপুরে এক শোকসভায় বক্তব্য রাখেন।
খালেদা জিয়া শোকার্ত মানুষের উদ্দেশে বলেন, আমরা আর চোখের পানি ফেলবো না, এবার প্রতিরোধ গড়ে তুলবো। ‘সরকার দেশে গণহত্যা চালাচ্ছে’ অভিযোগ করে তিনি বলেন, এ গণহত্যা বন্ধ করতে হবে। এরা কোন দলের লোক নয়। এরা নিরীহ সাধারণ জনগণ। নিরীহ মানুষকে তারা গুলি করে হত্যা করেছে। ১৭০ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। এই গণহত্যার জন্য এ সরকারকে একদিন জবাবদিহি করতে হবে। গণহত্যার বিচার করা হবে। প্রতিটি জীবন অত্যন্ত মূল্যবান। যে হারায় সেই শুধু বোঝে সে কি হারিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারকে এখন পদত্যাগ করতে হবে। বিদায় নিতে হবে। এতদিন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করেছি। এখন দেখছি, এই সরকার পাখির মতো গুলি করে মানুষ হত্যা করছে। এজন্য এমন আন্দোলন করতে হবে, যাতে এ সরকারকে বিদায় নিতে হয়।
বেগম জিয়া বলেন, এই সরকার ক্ষমতায় আসার পরই একদিকে ভয়াবহ সন্ত্রাস, অন্যদিকে লাগামহীন দুর্নীতি করে চলেছে। এই সরকারের সময় কোন উন্নয়ন হয়নি। কেবল লুটপাট হয়েছে। শেয়ারবাজার, হল-মার্ক, ডেসটিনি, পদ্মা সেতুসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির খতিয়ান তুলে ধরেন তিনি। বলেন, পদ্মা সেতু এই সরকারের সময়ে একটি বড় কাজ হবে ভেবেছিলাম। কিন্তু সেখানে কাজ শুরুর আগেই দুর্নীতি হয়েছে। বিশ্বব্যাংক সে দুর্নীতি ধরে ফেলেছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে ধরতে বললেও তা সরকার করেনি। কারণ আসল রাঘব বোয়ালরা ধরা পড়ে যাবে। তাই বিশ্বব্যাংকসহ সব দাতা বরাদ্দ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এখন পদ্মা সেতুর নামে নামফলকের পাথর বসানোর চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, যমুনা সেতু আমরা করেছিলাম। আর তখন আওয়ামী লীগ দাতারা যাতে চুক্তি করতে না আসতে পারে, সেজন্য চুক্তির দিনে হরতাল দিয়েছিল।
আওয়ামী লীগের দুঃশাসন সম্পর্কে জানতে ৭২-৭৫’র ওপর লেখা বই পড়তে যুব সমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ওই সময়ে তারা অসংখ্য মানুষ হত্যা করেছে। এসব বই পড়লে তোমরা জানতে পারবে আওয়ামী লীগ কি জিনিস। আওয়ামী লীগ বেঈমান, মোনাফেক, হত্যাকারী, লুটেরা। তারা মানুষের রক্ত খেতে পারে। দেশ বিক্রি করে দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে পারে।
মানিকগঞ্জে মাওলানা নাসির উদ্দিন নামে এক বৃদ্ধের দাড়ি ধরে বন্দুক গায়ে ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যার দৃশ্য পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ দেখিয়ে তিনি বলেন, সেখানে পুলিশের গুলি একটি বাড়ির দেয়াল ভেদ করে বিছানায় শোয়া এক নারীর গায়ে লাগে। তবে আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিতে গিয়ে একজন ধর্মভীরু বৃদ্ধ মুসলমান মাওলানা নাসির পুলিশের কাছে সাহায্য চাইতে গেলে তাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়।
ইস্যু সৃষ্টি করতে সরকার সারাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের উপসনালয় ও বাড়িঘরে হামলা করছে অভিযোগ এনে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ সব ধর্মের শত্রু। তারা মুসলমানদের হত্যা করছে। হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মন্দিরে হামলা করছে। আমি মুন্সীগঞ্জে গিয়ে ঘৃণ্য হামলার শিকার হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়িয়েছি। সরকার সেখানে যায়নি। আমরা বলেছি, ক্ষমতায় এলে আমরা মন্দির করে দেবো। পূজা করতে প্রতিমা যাতে আবার বসাতে পারে, সেজন্য আমরা টাকা দিয়েছি। আওয়ামী লীগ মানুষ মারতে পারে, ধ্বংস করতে পারে, কিছু গড়তে পারে না। তিনি বলেন, এ সরকার বর্বর ও অপদার্থ। তারা দেশ চালাতেও পারে না। প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে তিন দিন শোক দিবস ঘোষণা করলেও বৃহস্পতিবার অফিস খোলা ছিল। অর্ধদিবস অফিস করার পর ছুটি ঘোষণা করা হয়। আমরা শোক পালন করেছি। বগুড়ার শনিবারের সভা পিছিয়ে রোববার করেছি। কিন্তু, মেহেরপুরে বোমা মেরে বিএনপির এক নেতা ও তার মেয়েকে ওইদিনই তারা হত্যা করেছে। মহেশপুরে যুবদল নেতাকে হত্যা করেছে। আমরা শোক দিবস পালন করি, আর আওয়ামী লীগ শোকের নামে মানুষ খুন করে। ‘গুম-খুনের জবাব এ সরকারকে দিতে হবে’ জানিয়ে তিনি বলেন, চৌধুরী আলম, ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত তাদের ফেরত পাইনি। রফিককে গুপ্ত হত্যা করা হলো। বিডিআর বিদ্রোহের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতার জন্য মানুষ খুন করেন। যিনি মানুষ খুন করেন, এমনকি সীমান্তরক্ষীকেও খুন করেন, তিনি এদেশের প্রধানমন্ত্রী হন কিভাবে? তিনি বলেন, জেনারেল জাহাঙ্গীরের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করতে হবে। সেখানে অনেক সত্য ঘটনা উঠে এসেছে। সেটা প্রকাশ করলেই অনেক কিছু বেরিয়ে যাবে। সরকার যত চেষ্টাই করুন না কেন সাক্ষী-সাবুদ আছে। শোকসভার শুরুতেই খালেদা জিয়া বগুড়ায় নিহত সাতজনের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেন। পুলিশের গুলিতে নিহত এই সাতজন হলেন- টিটু রহমান, আবদুল্লাহ আল মামুন বাদল, জলিল মিয়া, বাবু মিয়া, সাবের আলী, ধনু মোল্লা ও জিয়াউর রহমান।
বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি ভিপি সাইফুল ইসলামের সভাপতিত্বে শোকসভায় বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ড. আবদুল মঈন খান, জামায়াতের আনম শামসুল আলম, জেলা আমীর প্রফেসর শাহাবুদ্দিন, ইসলামী ঐক্যজোটের জেলা সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার শামসুল ইসলাম, জেলা বিএনপির সম্পাদক জয়নুল আবদিন চান প্রমুখ বক্তব্য দেন।
একটু জোরে ধাক্কা দিলেই পড়ে যাবে সরকার: এদিকে জয়পুরহাটের পাঁচবিবির শোকসভায় খালেদা জিয়া বলেছেন, সরকারের সময় শেষ হয়ে এসেছে। একটু জোরে ধাক্কা দিলেই পড়ে যাবে। সরকারকে বিদায় করতে চূড়ান্ত আন্দোলনের ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, আপনাদের একবার ঢাকায় যেতে বলেছিলাম। তখন সরকার হোটেল, রাস্তাঘাট, যানবাহন সব বন্ধ করে দিয়েছিল। আবার ঢাকায় যাবেন। এবার সরকারকে বিদায় করে তারপর ফিরবেন। রক্ত দিয়েছেন, রক্ত আরও দেবেন, তবে আমরা রক্ত চাই না। আওয়ামী লীগকে বিদায় করতে আগামীকাল কর্মসূচি দেয়া হবে। এ কর্মসূচিতে বাধা দিলে, গুলি চালালে পরিণতি হবে ভয়ঙ্কর। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, আওয়ামী লীগ জনগণের সরকার দাবি করলেও তারা স্বৈরাচারী ও খুনি সরকার। এই সরকারের হাতে শুধু রক্ত আর রক্ত। তাদের আর ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই। তিনি বলেন, এই গ্রামে যাদেরকে হত্যা কারা হয়েছে তারা কোন দল করে না। এরা সাধারণ মানুষ। খুন করে এদের পোস্টমর্টেম করা হয়নি যাতে রেকর্ড না থাকে। কিন্তু রেকর্ড আমাদের কাছে আছে। সরকার ১৫ দিনে ১৭০ জনকে হত্যা করেছে- যাকে আন্তর্জাতিকভাবেই গণহত্যা বলা হয়েছে। এই গণহত্যার জন্য ট্রাইব্যুনাল করে বিচার করা হবে। তিনি বলেন, দুর্নীতি, গণহত্যা, বিডিআর হত্যার খতিয়ান আমাদের কাছে আছে। ভেবেছেন পালিয়ে যাবেন? কোথায় যাবেন? পৃথিবীর যে প্রান্তেই যান না কেন সেখান থেকে ফিরিয়ে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। বিএনপির সমাবেশে গুলি ও কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশি তাণ্ডবের চিত্র তুলে ধরে খালেদা জিয়া বলেন, পুলিশ দিয়ে বিএনপি কার্যালয় থেকে বোমা উদ্ধারের নাটক সাজানো হয়েছে। জনগণের দল বিএনপির বোমা লাগে না। বিএনপির বোমার নাম জনগণ। তিনি বলেন, কত বড় অত্যাচারী এই সরকার- তারা ১৮ দলের নেতাদের ডান্ডাবেড়ি পরিয়েছে। আপনারা সারা জীবন ক্ষমতায় থাকবেন না, এই ডান্ডাবেড়ির জন্য জবাব দিতে হবে। ডান্ডাবেড়ি যখন চালু করলেন আপনাদের লোকদেরও এই ডান্ডাবেড়ি পরতে হবে। খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতার লেবাস পরলেও তাদের হাতে কোন ধর্ম ও ধর্মের মানুষই নিরাপদ নয়। তারা মুসলমানদের মসজিদে তালা মারছে, হিন্দুদের মন্দির ভাঙচুর করছে, বৌদ্ধদের প্যাগোডা জ্বালিয়ে দিয়েছে, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর জেলায় খ্রিষ্টানদের গির্জায় বোমা হামলা করে ২০ জনকে হত্যা করেছে। তারা মানুষের সামনে চোখের জল ফেলে, পেছনে হত্যার নির্দেশ দেয়। তারা মানুষ খুন করে আনন্দ পায়। তাই সারাদেশে গণহত্যার শিকার নিরীহ জনগণের পাশে তারা দাঁড়ায়নি।
বগুড়া-জয়পুরহাট মহাসড়ক লোকারণ্য: খালেদা জিয়ার উত্তরাঞ্চল সফরকে কেন্দ্র করে বগুড়া-জয়পুরহাট মহাসড়ক লোকারণ্য হয়ে পড়ে। প্রতিটি পয়েন্টে বিভিন্ন এলাকায় মানুষ হাতে ব্যানার নিয়ে রাস্তার দু’পাশে অবস্থান নেয়। তারা সামপ্রতিক সময়ে বগুড়া ও জয়পুরহাটে সংঘটিত গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে স্লোগান দেয়। বৃদ্ধ থেকে শিশু সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। রাস্তায় নারীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বগুড়া-জয়পুরহাটের ৫০ কিলোমিটার রাস্তায় এত জনসমাগম আগে কখনও ঘটেনি। খালেদা জিয়ার গাড়িবহর অন্তত ১০টি স্পটে আটকে যায় ব্যাপক জনসমাগমের কারণে।
গাবতলীতে মন্দির পরিদর্শন: খালেদা জিয়া বগুড়ার গাবতলীতে সোনারায় ও রাশ্বেরপুর ইউনিয়নের হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাঙচুর করা মন্দির পরিদর্শন করেন। এসময় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের সঙ্গে কথা বলে তাদের সান্ত্বনা দেন। পরিদর্শন শেষে তিনি রামেশ্বরপুর ও সোনারায়ের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। খালেদা জিয়া বলেন, সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতেই হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির আওয়ামী লীগ নিজেরাই ভেঙে মানুষের দৃষ্টিকে অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করছে। এ ব্যর্থ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। শোকসভা শুরুর আগে পুলিশের গুলিতে নিহত ৩ জনের পরিবারের সদস্যদের সমবেদনাসহ নগদ ১ লাখ টাকা করে অনুদানের ঘোষণা দেন।
খালেদা জিয়া শোকার্ত মানুষের উদ্দেশে বলেন, আমরা আর চোখের পানি ফেলবো না, এবার প্রতিরোধ গড়ে তুলবো। ‘সরকার দেশে গণহত্যা চালাচ্ছে’ অভিযোগ করে তিনি বলেন, এ গণহত্যা বন্ধ করতে হবে। এরা কোন দলের লোক নয়। এরা নিরীহ সাধারণ জনগণ। নিরীহ মানুষকে তারা গুলি করে হত্যা করেছে। ১৭০ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। এই গণহত্যার জন্য এ সরকারকে একদিন জবাবদিহি করতে হবে। গণহত্যার বিচার করা হবে। প্রতিটি জীবন অত্যন্ত মূল্যবান। যে হারায় সেই শুধু বোঝে সে কি হারিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারকে এখন পদত্যাগ করতে হবে। বিদায় নিতে হবে। এতদিন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করেছি। এখন দেখছি, এই সরকার পাখির মতো গুলি করে মানুষ হত্যা করছে। এজন্য এমন আন্দোলন করতে হবে, যাতে এ সরকারকে বিদায় নিতে হয়।
বেগম জিয়া বলেন, এই সরকার ক্ষমতায় আসার পরই একদিকে ভয়াবহ সন্ত্রাস, অন্যদিকে লাগামহীন দুর্নীতি করে চলেছে। এই সরকারের সময় কোন উন্নয়ন হয়নি। কেবল লুটপাট হয়েছে। শেয়ারবাজার, হল-মার্ক, ডেসটিনি, পদ্মা সেতুসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির খতিয়ান তুলে ধরেন তিনি। বলেন, পদ্মা সেতু এই সরকারের সময়ে একটি বড় কাজ হবে ভেবেছিলাম। কিন্তু সেখানে কাজ শুরুর আগেই দুর্নীতি হয়েছে। বিশ্বব্যাংক সে দুর্নীতি ধরে ফেলেছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে ধরতে বললেও তা সরকার করেনি। কারণ আসল রাঘব বোয়ালরা ধরা পড়ে যাবে। তাই বিশ্বব্যাংকসহ সব দাতা বরাদ্দ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এখন পদ্মা সেতুর নামে নামফলকের পাথর বসানোর চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, যমুনা সেতু আমরা করেছিলাম। আর তখন আওয়ামী লীগ দাতারা যাতে চুক্তি করতে না আসতে পারে, সেজন্য চুক্তির দিনে হরতাল দিয়েছিল।
আওয়ামী লীগের দুঃশাসন সম্পর্কে জানতে ৭২-৭৫’র ওপর লেখা বই পড়তে যুব সমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ওই সময়ে তারা অসংখ্য মানুষ হত্যা করেছে। এসব বই পড়লে তোমরা জানতে পারবে আওয়ামী লীগ কি জিনিস। আওয়ামী লীগ বেঈমান, মোনাফেক, হত্যাকারী, লুটেরা। তারা মানুষের রক্ত খেতে পারে। দেশ বিক্রি করে দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে পারে।
মানিকগঞ্জে মাওলানা নাসির উদ্দিন নামে এক বৃদ্ধের দাড়ি ধরে বন্দুক গায়ে ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যার দৃশ্য পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ দেখিয়ে তিনি বলেন, সেখানে পুলিশের গুলি একটি বাড়ির দেয়াল ভেদ করে বিছানায় শোয়া এক নারীর গায়ে লাগে। তবে আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিতে গিয়ে একজন ধর্মভীরু বৃদ্ধ মুসলমান মাওলানা নাসির পুলিশের কাছে সাহায্য চাইতে গেলে তাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়।
ইস্যু সৃষ্টি করতে সরকার সারাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের উপসনালয় ও বাড়িঘরে হামলা করছে অভিযোগ এনে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ সব ধর্মের শত্রু। তারা মুসলমানদের হত্যা করছে। হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মন্দিরে হামলা করছে। আমি মুন্সীগঞ্জে গিয়ে ঘৃণ্য হামলার শিকার হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়িয়েছি। সরকার সেখানে যায়নি। আমরা বলেছি, ক্ষমতায় এলে আমরা মন্দির করে দেবো। পূজা করতে প্রতিমা যাতে আবার বসাতে পারে, সেজন্য আমরা টাকা দিয়েছি। আওয়ামী লীগ মানুষ মারতে পারে, ধ্বংস করতে পারে, কিছু গড়তে পারে না। তিনি বলেন, এ সরকার বর্বর ও অপদার্থ। তারা দেশ চালাতেও পারে না। প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে তিন দিন শোক দিবস ঘোষণা করলেও বৃহস্পতিবার অফিস খোলা ছিল। অর্ধদিবস অফিস করার পর ছুটি ঘোষণা করা হয়। আমরা শোক পালন করেছি। বগুড়ার শনিবারের সভা পিছিয়ে রোববার করেছি। কিন্তু, মেহেরপুরে বোমা মেরে বিএনপির এক নেতা ও তার মেয়েকে ওইদিনই তারা হত্যা করেছে। মহেশপুরে যুবদল নেতাকে হত্যা করেছে। আমরা শোক দিবস পালন করি, আর আওয়ামী লীগ শোকের নামে মানুষ খুন করে। ‘গুম-খুনের জবাব এ সরকারকে দিতে হবে’ জানিয়ে তিনি বলেন, চৌধুরী আলম, ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত তাদের ফেরত পাইনি। রফিককে গুপ্ত হত্যা করা হলো। বিডিআর বিদ্রোহের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতার জন্য মানুষ খুন করেন। যিনি মানুষ খুন করেন, এমনকি সীমান্তরক্ষীকেও খুন করেন, তিনি এদেশের প্রধানমন্ত্রী হন কিভাবে? তিনি বলেন, জেনারেল জাহাঙ্গীরের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করতে হবে। সেখানে অনেক সত্য ঘটনা উঠে এসেছে। সেটা প্রকাশ করলেই অনেক কিছু বেরিয়ে যাবে। সরকার যত চেষ্টাই করুন না কেন সাক্ষী-সাবুদ আছে। শোকসভার শুরুতেই খালেদা জিয়া বগুড়ায় নিহত সাতজনের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেন। পুলিশের গুলিতে নিহত এই সাতজন হলেন- টিটু রহমান, আবদুল্লাহ আল মামুন বাদল, জলিল মিয়া, বাবু মিয়া, সাবের আলী, ধনু মোল্লা ও জিয়াউর রহমান।
বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি ভিপি সাইফুল ইসলামের সভাপতিত্বে শোকসভায় বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ড. আবদুল মঈন খান, জামায়াতের আনম শামসুল আলম, জেলা আমীর প্রফেসর শাহাবুদ্দিন, ইসলামী ঐক্যজোটের জেলা সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার শামসুল ইসলাম, জেলা বিএনপির সম্পাদক জয়নুল আবদিন চান প্রমুখ বক্তব্য দেন।
একটু জোরে ধাক্কা দিলেই পড়ে যাবে সরকার: এদিকে জয়পুরহাটের পাঁচবিবির শোকসভায় খালেদা জিয়া বলেছেন, সরকারের সময় শেষ হয়ে এসেছে। একটু জোরে ধাক্কা দিলেই পড়ে যাবে। সরকারকে বিদায় করতে চূড়ান্ত আন্দোলনের ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, আপনাদের একবার ঢাকায় যেতে বলেছিলাম। তখন সরকার হোটেল, রাস্তাঘাট, যানবাহন সব বন্ধ করে দিয়েছিল। আবার ঢাকায় যাবেন। এবার সরকারকে বিদায় করে তারপর ফিরবেন। রক্ত দিয়েছেন, রক্ত আরও দেবেন, তবে আমরা রক্ত চাই না। আওয়ামী লীগকে বিদায় করতে আগামীকাল কর্মসূচি দেয়া হবে। এ কর্মসূচিতে বাধা দিলে, গুলি চালালে পরিণতি হবে ভয়ঙ্কর। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, আওয়ামী লীগ জনগণের সরকার দাবি করলেও তারা স্বৈরাচারী ও খুনি সরকার। এই সরকারের হাতে শুধু রক্ত আর রক্ত। তাদের আর ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই। তিনি বলেন, এই গ্রামে যাদেরকে হত্যা কারা হয়েছে তারা কোন দল করে না। এরা সাধারণ মানুষ। খুন করে এদের পোস্টমর্টেম করা হয়নি যাতে রেকর্ড না থাকে। কিন্তু রেকর্ড আমাদের কাছে আছে। সরকার ১৫ দিনে ১৭০ জনকে হত্যা করেছে- যাকে আন্তর্জাতিকভাবেই গণহত্যা বলা হয়েছে। এই গণহত্যার জন্য ট্রাইব্যুনাল করে বিচার করা হবে। তিনি বলেন, দুর্নীতি, গণহত্যা, বিডিআর হত্যার খতিয়ান আমাদের কাছে আছে। ভেবেছেন পালিয়ে যাবেন? কোথায় যাবেন? পৃথিবীর যে প্রান্তেই যান না কেন সেখান থেকে ফিরিয়ে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। বিএনপির সমাবেশে গুলি ও কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশি তাণ্ডবের চিত্র তুলে ধরে খালেদা জিয়া বলেন, পুলিশ দিয়ে বিএনপি কার্যালয় থেকে বোমা উদ্ধারের নাটক সাজানো হয়েছে। জনগণের দল বিএনপির বোমা লাগে না। বিএনপির বোমার নাম জনগণ। তিনি বলেন, কত বড় অত্যাচারী এই সরকার- তারা ১৮ দলের নেতাদের ডান্ডাবেড়ি পরিয়েছে। আপনারা সারা জীবন ক্ষমতায় থাকবেন না, এই ডান্ডাবেড়ির জন্য জবাব দিতে হবে। ডান্ডাবেড়ি যখন চালু করলেন আপনাদের লোকদেরও এই ডান্ডাবেড়ি পরতে হবে। খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতার লেবাস পরলেও তাদের হাতে কোন ধর্ম ও ধর্মের মানুষই নিরাপদ নয়। তারা মুসলমানদের মসজিদে তালা মারছে, হিন্দুদের মন্দির ভাঙচুর করছে, বৌদ্ধদের প্যাগোডা জ্বালিয়ে দিয়েছে, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর জেলায় খ্রিষ্টানদের গির্জায় বোমা হামলা করে ২০ জনকে হত্যা করেছে। তারা মানুষের সামনে চোখের জল ফেলে, পেছনে হত্যার নির্দেশ দেয়। তারা মানুষ খুন করে আনন্দ পায়। তাই সারাদেশে গণহত্যার শিকার নিরীহ জনগণের পাশে তারা দাঁড়ায়নি।
বগুড়া-জয়পুরহাট মহাসড়ক লোকারণ্য: খালেদা জিয়ার উত্তরাঞ্চল সফরকে কেন্দ্র করে বগুড়া-জয়পুরহাট মহাসড়ক লোকারণ্য হয়ে পড়ে। প্রতিটি পয়েন্টে বিভিন্ন এলাকায় মানুষ হাতে ব্যানার নিয়ে রাস্তার দু’পাশে অবস্থান নেয়। তারা সামপ্রতিক সময়ে বগুড়া ও জয়পুরহাটে সংঘটিত গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে স্লোগান দেয়। বৃদ্ধ থেকে শিশু সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। রাস্তায় নারীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বগুড়া-জয়পুরহাটের ৫০ কিলোমিটার রাস্তায় এত জনসমাগম আগে কখনও ঘটেনি। খালেদা জিয়ার গাড়িবহর অন্তত ১০টি স্পটে আটকে যায় ব্যাপক জনসমাগমের কারণে।
গাবতলীতে মন্দির পরিদর্শন: খালেদা জিয়া বগুড়ার গাবতলীতে সোনারায় ও রাশ্বেরপুর ইউনিয়নের হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাঙচুর করা মন্দির পরিদর্শন করেন। এসময় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের সঙ্গে কথা বলে তাদের সান্ত্বনা দেন। পরিদর্শন শেষে তিনি রামেশ্বরপুর ও সোনারায়ের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। খালেদা জিয়া বলেন, সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতেই হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির আওয়ামী লীগ নিজেরাই ভেঙে মানুষের দৃষ্টিকে অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করছে। এ ব্যর্থ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। শোকসভা শুরুর আগে পুলিশের গুলিতে নিহত ৩ জনের পরিবারের সদস্যদের সমবেদনাসহ নগদ ১ লাখ টাকা করে অনুদানের ঘোষণা দেন।
No comments