টিআইয়ের প্রতিবেদন, দুর্নীতি ও অন্যান্য by মাহমুদুর রহমান মান্না

গত কিছু দিনের পত্রপত্রিকার খবর পড়ে নিশ্চিত করে বলা যায় যে পদ্মা সেতু আবার আটকে গেছে। পদ্মা সেতু এ দেশের সাধারণ মানুষের কাছে একটি স্বপ্নের সেতু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর দেশের ভূখণ্ডকে উত্তর-দক্ষিণ দুই ভাগে ভাগ করেছে যে নদী, এর তীরবর্তী বা দুই পারের জনগোষ্ঠীর কাছে সেতুটি স্বপ্নের চেয়ে অধিক কিছু।
জীবনের ক্ষেত্রে নতুন এক পরিবর্তন নিয়ে আসার আভাস ছিল পদ্মা সেতুর মধ্যে। দেশের অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন সাধিত হতে পারত পদ্মা সেতুর বদৌলতে। অনেক মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস সৃষ্টি হতো। হতে পারত দক্ষিণের অর্থনীতি আরো গতিশীল, যা দেশের মোট অর্থনীতিতে যোগ করতে পারত উল্লেখযোগ্য অংশ। আর এসব সম্ভাবনা রয়েছে যেখানে, সেখানেই তো রাষ্ট্র হাতে নেয় শত শত কোটি টাকার প্রকল্প। কিন্তু কিছুই হলো না। কেন হলো না? দেশের মানুষ গত বছর দেড়েক ধরে পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক ও আমাদের সরকারের মধ্যকার মধুর-তিক্ত সে নাটক-বৈঠক দেখে আসছে।
দুদক যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল, সে কমিটি ৮৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে ১০ জনকে মূলত দুর্নীতির দায়ে দায়ী করা হয়েছিল। যার মধ্যে রয়েছেন আবুল হোসেনও। আমরা আবুল হোসেনকে নিয়ে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে এর আগেও মতানৈক্য দেখেছি, এমনকি চুক্তির মেয়াদ বাতিল হতেও দেখলাম। তখন প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের কাছে আর হাত পাতবেন না। দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থায়নে সেতু বানাবেন। এমন আরো অনেক আশার কথা বা আশ্বাসের বাণী শুনেছি। কিন্তু বাস্তবতা যে কঠিন এবং তা আবেগের আশ্বাস-বিশ্বাসে হয় না, তা বুঝতে সময়ক্ষেপণ বেশি করতে হয়নি সরকারকে। বিশ্বব্যাংকের মর্জিমতো আবুল হোসেনকে সরানো হলো, মসিউর রহমানকেও ছুটিতে পাঠানো হলো। সে তো সবই দেশবাসীর মনে আছে। বিশ্বব্যাংকও কি জন্য যে বাংলাদেশের ওপর হঠাৎ এমন খেপে গেল, কে জানে! তবে আমরা অনেকেই বিশ্বব্যাংককেও ছেড়ে কথা বলিনি। তারা যে ধোয়া তুলসী পাতা নয়, এটাও বলতে বাধেনি। ধোয়া তুলসী পাতা দুনিয়ায় কেউ নয়। কিন্তু দেশের স্বার্থ নিয়ে যেখানে কথাবার্তা, সে ক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক থাকা উচিত ছিল। আমরা তা থাকিনি।
যা হোক, দুদকের দেওয়া প্রতিবেদন অনুসারে আবুল হোসেন ১০ জনের তালিকায় থাকলেও দুদকের দাবি, আবুল হোসেনকে বাদ দিয়ে তালিকা প্রণয়ন করতে ও তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। বিশ্বব্যাংক তাতে রাজি না হওয়ায় বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদের সঙ্গে দুদকের বৈঠক ভেঙে যায়। পদ্মা সেতুর ভবিষ্যৎ আবার অনিশ্চিত হয়ে ওঠে।
এই সরকারের সময়ে শেয়ারবাজারে ধস নামল। লাখ লাখ দরিদ্র বিনিয়োগকারী পথে বসল, এমনকি আত্মহত্যাও করেছে একজন, যা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। শেয়ারবাজারের সেই অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি তদন্ত করেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তাঁর রিপোর্টে যাদের নাম এলো, সেসব নামও প্রকাশ করা হলো না। অর্থমন্ত্রীকে সংসদে নাম প্রকাশের কথা বলা হলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন- তাঁদের নাম প্রকাশ করা যাবে না। কারণ তাঁদের হাত অনেক লম্বা, যেখানে আমার হাতও যাবে না। এ কথার অর্থ কী দাঁড়ায়! অর্থমন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রীর পরই বিবেচনা করা হয়। আর অর্থমন্ত্রীই যদি বলেন এ কথা, তা হলে কী ভাবতে পারে মানুষ। এসব দুর্নীতিবাজের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দল ও সরকারের জন্য কি দুর্নামের নয়, অবমাননাকর নয়?
পদ্মা সেতুর দুর্নীতিও হলো এ ধরনের স্পষ্ট পক্ষপাতের ফল। আবুল হোসেন প্রধানমন্ত্রীর প্রিয়পাত্র হতে পারেন; কিন্তু জাতির প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সম্পাদন করতে হবে সর্বাগ্রে। তিনি যতই বলেন আবুল হোসেন দেশপ্রেমিক, জনগণ যদি তা না মানে, বিশ্বাস না করে, তবে তাঁর মর্যাদা কি বাঁচল?
চার বছরের সরকার যেন কোনো কিছুতেই তোয়াক্কা করছে না। শেয়ারবাজার, হলমার্ক, পদ্মা সেতুসহ সবকিছু মিলে সরকারের জনপ্রিয়তা বানের পানির মতো নেমে যাচ্ছে। অথচ সরকার নির্বিকার। খোদ প্রধানমন্ত্রী এখন সমালোচনার মুখে পড়ছেন। অথচ প্রধানমন্ত্রী সব সময় মুখে একটা তৃপ্তির হাসি ঝুলিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। কেন?

দুই.
টিআইবিতে যাঁরা বাংলাদেশে কাজ করেন, তাঁরা বাংলাদেশের সংসদ সদস্যদের দুর্নীতিবাজ বলেছিলেন। এ জন্য তাঁদের অনেক কথা শুনতে হয়েছিল, অনেক জায়গা থেকে। বর্তমান সরকার সংসদ সদস্যদের যথেষ্ট ক্ষমতাধর করেছে। নিজের এলাকায় তাঁরা তাঁদের ক্ষমতা ব্যবহারও করছেন। কারো চাকরি, সরকারি সাহায্য-সহায়তা, এলাকার উন্নয়ন- কোনো কিছুই সংসদ সদস্যের অনুমতি ছাড়া হয় না। এসব এলাকায় গিয়ে টিআইবি রিপোর্ট তৈরি করেছিল যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেই। কিন্তু খেপে গিয়েছিলেন সংসদ সদস্যরা। তাঁরা দুর্নীতি করেন না, অথচ টিআইবি তাই বলছে। টিআইবির মতলবটা কী?
এখন ৫ ডিসেম্বর ঢাকার ব্র্যাক ইন সেন্টারে উপস্থাপিত দুর্নীতিবিষয়ক বৈশ্বিক জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম, আগের অবস্থানেই। কিন্তু উন্নতির দিক থেকে ১৭৬ দেশের মধ্যে এবার হয়েছে ১৪৪তম- যা আগের চেয়ে অনেক নিচে নেমে গেছে, কেন? টিআই বলেছে, দুর্নীতি বৃদ্ধির কারণে। মন্ত্রীর গাড়িতে টাকা পাওয়া গেল অথচ দুদক তাঁকে নির্দোষ সার্টিফিকেট দিয়ে দিল। হলমার্ক, ডেসটিনি- এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক সম্পদশালী হলেন। তা কিভাবে সম্ভব হলো, কে বলবে? দুদক তো এসব ব্যাপার নিয়ে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে।
দুদকের চেয়ারম্যান আগে বলেছিলেন, দুদককে নখদন্তহীন বাঘে পরিণত করা হয়েছে। এখন তিনিই সুরঞ্জিত সেনের সার্টিফিকেট দিচ্ছেন। এসব কারণে দুদক তো ইতিমধ্যে বিতর্কিত সংস্থা হিসেবে পরিচিত। এভাবে সর্বক্ষেত্রে জাতীয় সম্পদ নিয়ে দুর্নীতি হতে থাকলে দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে নিঃসন্দেহে। আর তাতে ধনীদের কিছুই হবে না। গরিবের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠবে ট্যাঙ্, ভ্যাট ইত্যাদির কারণে। মজার খবর পত্রিকায় পড়লাম, আওয়ামী লীগের কোনো কোনো মন্ত্রী-নেতা বলেছেন, আমরা তো ভালোই আছি। নিচে তো নামিনি। সেই যে জরিপ বলেছে, নিম্নক্রম অনুসারে আমরা আগের অবস্থানেই আছি।

তিন.
নতুন নির্বাচন কমিশন নতুন করে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করছে। আমার সর্বশেষ লেখার প্রতিপাদ্য বিষয় এটি। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি, গণতন্ত্র নির্মাণের জন্য, গণতন্ত্রকে একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আমাদের দেশে এমন একটা পরিস্থিতি হয়েছে, সব কিছুই বিতর্কিত হয়ে পড়ে। বিগত যে নির্বাচন কমিশন ছিল, সেটি যথেষ্ট প্রশংসা অর্জন করেছিল। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে তারা। তবু সেই নির্বাচন কমিশনও বিতর্কের উর্ধ্বে থাকতে পারেনি। আমি মনে করি, কিছু কিছু অভিযোগের অবশ্যই ভিত্তি রয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে যতটুকু সম্ভব বিতর্কের উর্ধ্বে রাখা যায়, ততই গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল। নির্বাচন কমিশন যত শক্তিশালী হয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে (বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার যেমন বলেছিলেন, তাঁরা কোনো রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বহন করেন না) ততই ভালো। নির্বাচন কমিশন এ পর্যন্ত কী করেছে তার একটি পর্যালোচনা প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশন যেসব আচরণবিধি ও নীতিমালা তৈরি করেছিল, সেসব বিধিবিধান কতটুকু কার্যকর হয়েছে, তার একটা হিসাব-নিকাশ বা সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ প্রয়োজন। তা করা হলে ভবিষ্যতে গৃহীত পদক্ষেপ আরো যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত হবে। গত নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল দলের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে বলে। বিএনপি ভাঙার কাজে নির্বাচন কমিশন সহযোগিতা করেছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল, যখন মান্নান ভঁূইয়াকে কমিশন সমর্থন দিয়েছিল।
নির্বাচন কমিশন যে বিধি জারি করেছিল মনোনয়নের জন্য দলে সক্রিয়ভাবে তিন বছর থাকার, সেটা তারা নিজেরাও রক্ষা করতে পারেনি। যেমন- কাপাসিয়ার উপনির্বাচনে যখন সিমিন হোসেন রিমি প্রার্থী হলেন, তখন এ কথা উঠেছিল। তিনি তিন বছর কোনো রাজনৈতিক দলের সংস্পর্শে ছিলেন না। এমনকি নির্বাচনের তিন মাস আগে খবর প্রকাশিত হয়েছিল এই মর্মে যে রিমি বলেছেন, তিনি কোনো দল করেন না। কিভাবে তিনি তাহলে প্রার্থী হলেন? এই নির্বাচন কমিশন কি তাঁকে আটকাতে পেরেছে? পারেনি। কমিশন নিজে যে আইন বাস্তবায়ন করতে পারবে না, সে আইন করবেই বা কেন? হতে পারে যেটাকে ন্যায্য মনে করি, সেটা হয়তো বাস্তবায়িত করা কঠিন। তবু ন্যায়টি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করাই উচিত। নির্বাচন কমিশন কি তাই করেছিল?
নির্বাচন কমিশন আইন করেছিল কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী হতে পারবেন না। কিন্তু কেন পারবেন না, তার কোনো যৌক্তিক কারণ কি রয়েছে? যেকোনো দলের ভেতর সমস্যা হতেই পারে। যেহেতু রাজনীতি মত ও পথের বিষয়।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে জনাব সাক্কু বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন। বিএনপি তাঁকে বহিষ্কার করেছিল। কিন্তু নির্বাচনে জয়ী হয়ে এলে বিএনপি তাঁকে আবার দলে অন্তর্ভুক্ত করে। এমন নজির আওয়ামী লীগেরও আছে। টাঙ্গাইলে বিদ্রোহী প্রার্থী আমানুর রহমান খান রানা বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ফুলের তোড়া নিয়ে এসে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এসব প্রাসঙ্গিক কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি এ জন্য যে, আওয়ামী লীগ ৫ ডিসেম্বর আবার কমিশনের সঙ্গে দেখা করে তাদের এই অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে। তারা আরেকটি প্রস্তাব করেছে- বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার কারণে দল থেকে কাউকে বহিষ্কার করলে তিনি পরপর দুই টার্মের জন্য প্রার্থী হতে পারবেন না।
এখানে কি গণতন্ত্রের গলা কাটা হচ্ছে না? একজন মানুষের যদি প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা থাকে এবং কোনো মামলার আসামি বা অন্য প্রধান কোনো কারণ না থাকে, যা থাকলে প্রচলিত আইনেই তাঁর প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যায়; এমন কোনো আপত্তিকর কিছু কারো না থাকলে অবশ্যই প্রার্থী হওয়ার অধিকার যেকোনো নাগরিকের আছে। অতএব, এই বিধি কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধক হয়ে যাচ্ছে না? আশা করি এসব খুঁটিনাটি বিষয়ে সচেতন মানুষ ও রাজনীতিবিদরা নজর দেবে, আর নির্বাচন কমিশন তো অবশ্যই গণতন্ত্রের কথা বিবেচনা করেই আইন প্রণয়ন করবে।
বড় দুদলের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা যে নেই, তা দেশের মানুষ আজ বুঝতে পেরেছে। আওয়ামী লীগ কি দলের মধ্যে অধিক সংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থীর আশঙ্কা করছে? তারা তো মনোনয়নদানে তৃণমূল গণতন্ত্র চর্চা করে না। বিষয়টি অবশ্যই গণতন্ত্রকামী মানুষের বোঝা উচিত। মনোনয়ন-বাণিজ্য বলে একটি সত্য এখন প্রতিষ্ঠিত। এই বাণিজ্যের যূপকাষ্ঠে সৎ, ত্যাগী রাজনীতিবিদ বলি হয়ে যেতে পারেন। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের তো সোচ্চার হওয়া দরকার মনে করি। তা না হলে গণতন্ত্রের ভিত্তি কোনোদিন রচিত হবে না।

লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক, নাগরিক ঐক্য
mrmanna51@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.