কে কার মুখ দেখতে চাননি? by আবদুল লতিফ সিদ্দিকী
পাঠক, প্রথমেই কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না, অনুরোধ আমার। বাধ্য হয়ে কিছু স্পর্শকাতর বিষয়ের অবতারণা করতেই হচ্ছে। মন্ত্রী হওয়ার পর পত্রিকায় লেখালেখি বন্ধ করে দিয়েছি। বিতর্ক না হয়ে তর্ক-তাণ্ডব, কোলাহল-হলাহলের সূত্রপাত ঘটে বলে।
আমার ছোট ভাই বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম 'বজ্র'র লেখা কখনো কখনো পড়ি। আজকেও বাংলাদেশ প্রতিদিনে 'মুখ দেখা হলো না' শিরোনামের লেখাটি পড়লাম। একই গ্রুপের পত্রিকা কালের কণ্ঠের সম্পাদক স্নেহভাজন মিলনের 'দেশের মানুষ চায় দুই নেত্রীর সমঝোতা' পড়লাম। বেশ কয়েক দিন দেশের বাইরে ভিয়েতনাম-চীনে ছিলাম। ও দুটিও দেশ, আমাদেরটাও দেশ। কিন্তু ও দেশের মানুষের স্বভাব আর আমাদের দেশের মানুষের স্বভাবের ভিন্নতা সহজেই অনুমেয়। সে বিষয়ের ফিরিস্তি চীনে বাংলাদেশ দূতাবাসের গাড়িচালক মানিক মিয়ার জবানিতে দেওয়াই ভালো। মানিক আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত। এখনো তার কাছে আমি 'স্যার' হইনি। তার ভাষায়, 'দাদা, চীনের যে উন্নতি, এর কারণ খুব সহজ। ওরা সৎ, কর্মঠ, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।'
পাঠক, এবার নিজেই বিচার করুন, মানিকের এই কথার সঙ্গে আমাদের ফারাক কতখানি। বজ্রর লেখার হাত যুদ্ধকালে তার গতির মতোই তীব্র-তীক্ষ্ন-তির্যক ও 'প্রাণহানিকর'। বর্ণনা ও গাঁথুনির বিশেষ ধাঁচের কারণে প্রিয়পাঠ্য, আকর্ষণীয়। এ কারণেই তাকে অনুরোধ-বিনোরোধ করেই হয়তো বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রতি সপ্তাহে তার লেখা ছাপে। ব্যক্তিগত-পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে কথা বলাটা আমার কাছে বিব্রতকর বলে আমি সজাগ-সচেতনভাবে, সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করি। আজকে সারা দিন চেষ্টা করেও এড়িয়ে যেতে ব্যর্থ হলাম, তাই এই লেখা।
বজ্রর লেখা বেলুনের মতো। আলপিনের একটু ঘা লাগলে বেলুনের অস্তিত্ব থাকে না। বাতাসে মিশে যায়। তেমনি কেউ যদি বজ্রর লেখা নিয়ে ভাবে, সব কিছুই অহং আর আত্মযন্ত্রণায় হাত-পা কামড়ানোর প্রতিফলন, তাহলে তার এই সুন্দর বর্ণনাগুলো বেলুনের মতোই গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। 'সশস্ত্রবাহিনী দিবস' একটি আনুষ্ঠানিক বিষয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতাবাদ, একাত্তরের স্বাধীনতা- এই ধারাবাহিকতায় অনেক সংগ্রাম, অনেক উৎপীড়ন, অনেক নির্যাতন আর হাজারও মানুষের জীবনদানের পরিণাম স্বাধীনতা। ভারত উপমহাদেশ খণ্ডিত হয়ে ভূগোল চিহ্নিত হয়েছে, পতাকা ও জাতীয় সংগীত নির্ধারিত হয়েছে। সংবিধানও প্রণীত হয়েছে। তবে মানসিকতার খুব যে একটা পরিবর্তন হয়েছে, তেমন লক্ষগোচর হয় না।
২১ নভেম্বর সশস্ত্রবাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানও পূর্ব ধারাবাহিকতার প্রতিফলন। সরকারপ্রধান আসবেন, তিনি কী করবেন, তা সশস্ত্রবাহিনীর নিয়মবিধিতে বিধিবদ্ধ আছে। গত ২১ নভেম্বর সশস্ত্রবাহিনী দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা যা করেছেন, তা বিধিবদ্ধ, নিয়মবহির্ভূত কিছু নয়। বরং বজ্র যাকে অভিনন্দিত করেছে, বোনের আচরণের বিরুদ্ধে সেই ভাবির প্রতি তা-ই অভব্যতা- নিয়মবহির্ভূত, অরুচিকর।
আমন্ত্রিত অতিথি যাঁরা, আমন্ত্রণকারীর সঙ্গে কুশল বিনিময়ের জন্য সব অনুষ্ঠানেই অপেক্ষা করেন। এ ক্ষেত্রে সেই নিয়মের ব্যতিক্রম করে বজ্রর ভাবি কেন প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়া পর্যন্ত অবস্থান করলেন না- এ প্রশ্ন যখন বজ্রর বিবেচনায় আসে না, তখন মনে হয়, বোনের প্রতি ব্যক্তিগত ক্ষোভ-অভিমান আক্রোশে পরিণত হয়েছে, যা থেকেই একহাত নেওয়া। এ ধরনের মতামত কোনো সুস্থ মস্তিষ্ক মানুষের লক্ষণ হতে পারে না। সমালোচনা যদি এ ক্ষেত্রে কাউকে করতে হয়, তা বজ্রর ভাবিরই হওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী কোনো ব্যক্তি নন, প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিকতা প্রতিপালন করতেই হয়। তাঁর আদেশেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয় বটে, আদেশটি যাঁরা কার্যকর করেন তাঁরা কিন্তু প্রতিষ্ঠিত কিছু নিয়মের ভিত্তিতেই করেন। প্রশ্ন যখন এসেই গেল, আরেকটি বিষয়ের অবতারণা করা যাক।
তার ভাবি বিরোধী দলের নেতা হিসেবেই ওই অনুষ্ঠানে বিশেষভাবে আমন্ত্রিত। এখন কেউ যদি স্বাধীনতাযুদ্ধের বীর উত্তম, সশস্ত্রবাহিনীর সাবেক প্রধানের স্ত্রী, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, শহীদ রাষ্ট্রপতির পত্নী হিসেবে মাথায় রাখেন, তাহলে কিন্তু অন্য ব্যাপার এসে যায়। সংসদে বিরোধী দল অংশগ্রহণ করে না। সুযোগ-সুবিধা নেয়- এ নিয়ে সমালোচনা করার মতো নোংরা মানসিকতা আমার নেই। গরু মেরে জুতা দানে আমি বিশ্বাস করি না। জনগণ যে রায় দিয়েছে, সে রায় বজ্রর ভাবি মানছেন না- এটাই হলো ধ্রুবসত্য। ধ্রুবসত্য সংসদ কার্যপ্রণালীবিধি ও সংবিধানের প্রতি বজ্রর ভাবির অনাস্থা প্রদর্শন। বজ্র নিজেও ধ্রুপদী গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে কি না সে বিষয়ে আমার মধ্যে যথেষ্ট সংশয় আছে। বাংলাদেশে এখন বজ্রকে আমার চেয়ে বেশি দিন দেখার লোক জীবিত নেই। বজ্র মানুষের ভালো চায়, দেশের উন্নতি চায়। স্বাধীনতাযুদ্ধের যোদ্ধাদের সম্মানিত করতেও চায়। কিন্তু কিভাবে তা করা যায়, সে বিষয়ে তার কোনো স্পষ্ট ধারণা আজ পর্যন্ত প্রকাশ করতে পারেনি। তার একটি দল আছে। দলের ঘোষণাপত্রে যা বর্ণনা আছে, তা আর দশ-পাঁচটি গণতান্ত্রিক দলের কর্মসূচির চেয়ে ব্যতিক্রমী কিছু নয়। আমাদের অভিজ্ঞতা ঘোষণাপত্রের কর্মসূচি অনুযায়ী কেউ কিন্তু তেমন কিছু করছে না। স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনা ও প্রেরণা বজ্রর মধ্যে এখন অবশিষ্ট আছে কি না তা নিয়েও আমি ধন্ধে পড়ে গেছি। লেখার এক স্থানে খুনি গোলাম আযমপুত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে 'জনাব গোলাম আযম' উল্লেখ করাই আমার এই ধন্ধের কারণ। খুনি গোলাম আযমপুত্র 'আজমী' ভদ্র-সভ্য রুচিশীল হতেই পারে। কিন্তু বাবার স্বাধীনতাবিরোধী, মানবতাবিরোধী, হত্যাকারী কর্মকাণ্ডকে সে কিন্তু অকাতরে সমর্থন করছে। তাই তার ভদ্রতা-শিষ্টাচার, শোভনতা-রুচিশীলতা স্বাধীনতাযুদ্ধের সন্তানহারা মায়ের, স্বামীহারা নারীর, পিতাহারা সন্তানের ও পাঞ্জাবি-ধর্ষিতাদের কাছে 'আজমী' খুনিপুত্র ছাড়া আর কিছু নয়।
বজ্রর সারাটা লেখাই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারমূলক। এই ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখে আমার একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে- আজ পর্যন্ত বজ্রর ব্যাপারে ভালোমন্দ, পক্ষে-বিপক্ষে আমার নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলিনি। কারণ বজ্র বীর, বীর হলেই কেন যেন তারা দাম্ভিক ও অহংকারী হয়। আমি দাম্ভিক, অহংকারী লোকদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখি। আমি সাধারণ মাপের মানুষ- চাটুকারিতা, তোষামোদ ও স্তাবকতা করতে পারি না, ইনিয়েবিনিয়ে কারো মনোরঞ্জনও আমার দ্বারা সম্ভব না। তাই দূরত্ব বজায় রাখাটাই শ্রেয়তর মনে করি। জনসম্মখে বজ্র আমার পা ছুঁয়ে সালাম করে। এই দৃশ্য দেখে অনেকেই ভাবে আমাদের সম্পর্ক খুবই মধুর। সম্পর্ক অবশ্যই গভীর ও মধুর। এ জীবনে বজ্র ও আমার সম্পর্কের বিভাজন সম্ভব নয়। আমরা একই মায়ের নাড়িছেঁড়া ধন। আমি বয়সে বড়। আমাদের পরিবারে বড়র প্রতি ছোটর শ্রদ্ধাবোধ অপরিসীম, তাই শত বিচ্ছেদের পরও বজ্র আমাকে সম্মান প্রদর্শন করে। আমিও খোলা মনে অপত্যস্নেহে ওকে বুকে ধারণ করি। ওর এই আচরণ লোক দেখানো তা আমি মনে করি না। লোক ঠকানো তো নয়ই। নীতির প্রশ্নে, লক্ষ্য অর্জনের প্রশ্নে আমি কখনোই বজ্রকে ছাড় দিইনি, কখনো দেবও না। স্বাধীনতার পর সারা বাংলাদেশে যখন বজ্রকে নিয়ে ধন্য ধন্য ধ্বনিতে মুখরিত, তখনো বলেছি বজ্র একজন বীর, কিন্তু নেতা নয়। বীর ঘটনাক্রমের সৃষ্টি, নেতা প্রক্রিয়াজাত। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়েও বজ্রর সঙ্গে আমার মতভেদ হয়েছে এবং আমি তার কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে দেশে চলে এসে কারা-নির্যাতন ভোগ করেছি। আমি অনেক সময় বজ্রর প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছি, এটা যেমন সত্য, তার চেয়েও কঠিন সত্য বজ্র কখনো তার মনের কথা বা কী করতে চায় আমাকে বলেনি। ১৯৯১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সে যখন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে তখনো সে আমাকে জানায়নি, সে এক মাসের পারমিট নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে নথিবদ্ধ আছে ওই পারমিটটির কথা। 'জগলু' নামে বজ্রর এক চেলা এই পারমিট ইমিগ্রেশনের কাছে হস্তান্তর করেছিল বলে শুনেছি। আমাকে বিষয়টি জানানো হলে আমি কাগজটি ছিঁড়ে বাথটাবে ফেলে দিতাম। ১৯৯১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের যে অবস্থা ছিল, তাতে বজ্রকে গ্রেপ্তার করার সাহস বা ক্ষমতা সাহাবুদ্দীন সরকারের ছিল না।
বজ্র যখন দল গঠন করে তখনো সে আমার কাছে এসেছিল। দাবি করেছিল আমি তার সঙ্গে যেন থাকি। আমি তাকে সেদিন স্পষ্ট করে বলি, 'বজ্র, এত দিন তুই আমার দল করেছিস। এখন তুই বড় হয়েছিস, বুদ্ধি-বিবেচনা হয়েছে, তুই তোর ইচ্ছামতো চলতে পারিস। আমি আমার দল ছাড়ব না। দলে আমার অবস্থান যতই নড়বড়ে ও গুরুত্বহীন হোক। এ দল গঠনে আমার কৈশোর, আমার যৌবন ও জীবনের অনেক আনন্দ-ভোগ বিসর্জন দিয়েছি।' পাঠকের জানার জন্য বলি, ২০০১ জাতীয় নির্বাচনে বজ্র যখন মনোনয়নপত্র বাছাই অনুষ্ঠানে আমাকে দেখতে পায়, তখনো আমার পা ছুঁয়ে সালাম করে। আমিও ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খাই। এমনকি নির্বাচনের দিন সামরিক বাহিনীর কাছে মিথ্যা অভিযোগ করে আট-দশটি ভোটকেন্দ্রে আমার ভোটারদের বিতাড়িত করার ব্যাপারে প্রতারণামূলক মিথ্যার আশ্রয় নেওয়ার পরও ওর সামনে পড়ে যাওয়ায় ও আমাকে পা ছুঁয়ে সালাম করে। মরহুম আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর জানাজায় এই প্রথম প্রকাশ্যে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করা নয়। ওই দিন যে বিভ্রাট ঘটল সেটি হলো, জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার আমার পাশে দাঁড়ানো ছিলেন। বজ্র আমাকে সালাম করে ওঠার পর সে বলে, 'আমাকে সালাম করলে না, কাদের?' এ ধরনের আচরণ শোভন-অশোভন কি না তা পাঠকই বিচার করবেন। তবে বজ্রর মতো লোক কেন কর্নেল শওকতকে সালাম করবে, সত্যিকার অর্থে তা আমারও বোধগম্য নয়। বিষয়টা স্পর্শকাতর।
মূল আলোচনায় ফিরে আসা যাক। শুধু এই লেখাটিই নয়, বজ্রর প্রত্যেক লেখাতেই আমার নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিষোদগার থাকবেই। এটা লক্ষ করে আমি একটা ধারণা করছি। সে ধারণাটির কথাই নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিবেদন করছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি নীলকণ্ঠ- বঙ্গবন্ধু ও আপনাকে যারা ধোপার পাটে আছড়েছে বছরের পর বছর, তাদেরও আপনি আওয়ামী লীগে স্থান দিয়েছেন। বজ্র বঙ্গবন্ধুর অনুসারী-অনুগামী, এখনো মুজিব কোট ছাড়েনি। আপনার এই 'সহোদর' ভাইটিকে একবার ডাকবেন কি? ডাকে যদি সাড়া দেয়, জিজ্ঞেস করবেন কি, 'তোর পাকা ধানে আমি কি মই দিয়েছি?' সাড়া যদি না দেয় তাহলে তো যা চলছে তেমনি চলতে থাকবে- সমস্যা তো কিছু নেই। বজ্র এখনো যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পর্কে তার সিদ্ধান্ত স্পষ্ট করতে পারেনি এ আমার কাছে এক বিস্ময়! বিরোধী দলের নেত্রী জিয়াপত্নী খালেদার প্রতি তার আসক্তির প্রকাশে কোনো রকম রাখঢাক নেই। বিজয়ের মাসে আমরা বজ্রকে কোন আঙ্গিকে মূল্যায়ন করব? মুক্তিযোদ্ধারা মাটিতে বসে থাকে, আমলা-ফৈইলারা উচ্চাসনে পা নাচায়- এ দৃশ্য দেখে ভাই বজ্রর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। কিন্তু শত শত মুক্তিযোদ্ধা যখন 'স্যারের' বাসভবনের দরজায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে, তখন কি তার মনে একটুও ভাবনা হয় না, এদের কারণেই আমি বীর উত্তম?
এবার আমি আরেক স্নেহভাজন ইমদাদুল হক মিলনের 'মানুষ চায় দুই নেত্রীর সমঝোতা' এই বিষয়ের অবতারণা করছি। মিলন কালের কণ্ঠে মাহমুদুর রহমান মান্নার ৩০ তারিখের লেখার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করেছেন, "এই পরিস্থিতির কোনো নিষ্পত্তি হওয়ার জায়গা খুঁজে পাচ্ছি না আমি। যেকোনোভাবেই হোক একটা হস্তক্ষেপ অবশ্যম্ভাবী, সেটা প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য, সামরিক কিংবা বেসামরিক, দেশি কিংবা বিদেশি, তা বলতে পারব না। এই দুই প্রচণ্ড জেদি নেত্রী যে রকম 'ষাঁড়ের লড়াইয়ে'র প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাতে হস্তক্ষেপ ছাড়া নিষ্পত্তির সম্ভাবনা আমি দেখি না।" এ কী কথা জনগণ-অন্তঃপ্রাণ মান্নার! হস্তক্ষেপ করার অধিকার সামরিক বাহিনীর নেই, আর বিদেশি হস্তক্ষেপ কি সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি নয়? যাঁরা আধিপত্যবাদ ও প্রভুত্বকামিতার বিরুদ্ধে এত সরব, তাঁরা জনগণকে ছেড়ে শক্তিমানের পো ধরছেন কেন? জনগণের প্রতি আস্থা হারানো অপরাধ। মিলন ড. কামাল হোসেনের একটি সাক্ষাৎকারের উদ্ধৃতিও দিয়েছেন, আমি আর সেটি আনতে চাই না। ভাই মিলন, তুমি যাঁদের উদ্ধৃতি দিয়েছ, তাঁরা কিন্তু মানুষ নন, তাঁরা মানুষের নেতা। পত্র-পত্রিকার কলাম-লেখক, বৈদ্যুতিক মাধ্যমের টকশোর আলোচক- তাঁরা জ্ঞানী-গুণী-বুদ্ধিজীবী, সবাই অসাধারণ। তাঁদের মতামতে সাধারণের গন্ধ কোথায় পেলে বুঝতে পারলাম না। বাংলাদেশের মানুষের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমার যা ধারণা, তাই এবার বলি। মানুষ ঐক্য চায়, শান্তি চায়, স্বস্তি চায়, সমঝোতা চায়। কিন্তু যাঁরা নেতা, যাঁরা জ্ঞানী, যাঁরা বুদ্ধিজীবী-আলোচক, তাঁরা শান্তি-স্বস্তি-ঐক্য-সমঝোতা কোনোটাই চান না। তাঁরা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চান। আসলে মানুষের সমস্যা কি ভোটের সমস্যা, মানুষের সমস্যা কি তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নাকি মানুষের সমস্যা খালেদা জিয়ার বাড়ি ছাড়ার বেদনা? মানুষের সমস্যা কি স্বাধীনতার পরাজিত যুদ্ধাপরাধী শক্তির বিচারে অন্তরায় সৃষ্টির পাঁয়তারা? আমার বিচারে, মানুষের সমস্যা শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি, স্বাস্থ্যসেবার আধুনিকায়ন ও উন্নতিসাধন, কর্মসংস্থানের নব নব ক্ষেত্র প্রস্তুত। আর রাষ্ট্রের মৌলিক সমস্যা যুদ্ধাপরাধীর বিচার। এই মৌলিক সমস্যাগুলোর প্রতি যাদের নজর নেই, নজর শুধুই রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে, আসলে তারাই প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, সামরিক-বেসামরিক, দেশি-বিদেশি হস্তক্ষেপ কামনা করে। জনগণের ওপর তাদের আস্থা নেই। এ দেশে ভোটরঙ্গ শুরু ১৯৩৭ সাল থেকে। '৩৭, '৪৬, '৫৪, '৭০, '৭৩, '৯৬ ও ২০০৮ জনগণ যতবার স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পেরেছে, কখনোই ভুল রায় দেয়নি। সমঝোতাটা কার সঙ্গে কার হবে, হস্তক্ষেপটা কে করবে, কার ওপর করবে? এ কথা কি পরিষ্কার নয়, এক পক্ষ স্বাধীনতার পক্ষশক্তি, আরেক পক্ষ স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি? যাঁরা জ্ঞান বিতরণ করছেন তাঁরা কার পক্ষাবলম্বন করছেন?
অকপটে স্বীকার করি, স্বাধীনতার পক্ষশক্তির মধ্যে অনেক ত্রুটিই শুধু নয়, স্খলনও আছে। কিন্তু মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি আনুগত্য, লাখো নারীর সম্ভ্রমহানির প্রতি সম্মান-প্রদর্শনে কোনো ঘাটতি নেই। অন্যদিকে যারা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে জামাতি জঙ্গিবাদী ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তৎপর, তারা মুক্তিচেতনায় বিশ্বাসী স্বাধীন দেশের মানুষকে অন্ধকারে ধাবিত করার কুহক রচনা করছে। একদিকে সত্য-সুন্দর-মঙ্গল, আরেকদিকে কুহক ও কুহকিনী- এর মধ্যে সমঝোতা আর সেই সমঝোতার জন্য দেশি-বিদেশি হস্তক্ষেপ, সামরিক-বেসামরিক চাপ যাদের কাম্য, তারা কী চায়, আমার বোধগম্য নয়। তবে এটুকু বুঝি, লাঙলের মাথায় জোয়াল বাঁধতে হয়, সেই জোয়াল গরুর ঘাড়ে পরাতে হয়। গরুর আগে যদি জোয়াল বেঁধে দেওয়া হয়, দুর্ঘটনা ঘটবেই।
দেশ কোনো ভয়াবহ সংকটে নিপতিত নয়। তবে জামায়াত-শিবির, স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি, ধর্মীয় জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি, সামাজিক বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠানে অরাজকতা সৃষ্টির জন্য প্রতি মুহূর্তে ঘৃণ্য পাঁয়তারা করছে। যারা স্বাধীনতার পক্ষশক্তি, যারা মুক্তিচেতনায় বিশ্বাসী, তারা যদি বিবেকবান হয়, তাদের জ্ঞানবুদ্ধি যদি লোপ না পেয়ে থাকে, তাহলে তারা একবাক্যে মানবে, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রতি মুক্তিকামী মানুষের আস্থা এতই দৃঢ়মূল যে তাঁর নেতৃত্বেই স্বাধীনতার পরাজিত অপশক্তি খতম করে স্বাধীনতা-শহীদদের ত্যাগে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়া সম্ভব। বিজয়ের মাসে মানুষের ঐক্যের ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, 'আমাদের রাজনীতি হচ্ছে মানুষের জন্য। আমরা চাই মানুষের আর দেশের উন্নতি।' এ পথে যারা বাধা, তাদের মোকাবিলা করে প্রধানমন্ত্রীর হাতকে শক্তিশালী করাই আজকের বার্তা। ব্যক্তিগত মান-অভিমান ভুলে স্বাধীনতাকামী-স্বাধীনতাকামীতে সমঝোতা করে হস্তক্ষেপহীন, চাপহীন পরিস্থিতি নিশ্চিতকরণই আজকের জনদাবি। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী নির্মূল এবং স্বাধীনতার সুফল বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার প্রত্যয়দীপ্ত শপথের মধ্য দিয়ে বাঙালি এবারের বিজয় দিবস উদ্যাপন করবে।
লেখক : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী
পাঠক, এবার নিজেই বিচার করুন, মানিকের এই কথার সঙ্গে আমাদের ফারাক কতখানি। বজ্রর লেখার হাত যুদ্ধকালে তার গতির মতোই তীব্র-তীক্ষ্ন-তির্যক ও 'প্রাণহানিকর'। বর্ণনা ও গাঁথুনির বিশেষ ধাঁচের কারণে প্রিয়পাঠ্য, আকর্ষণীয়। এ কারণেই তাকে অনুরোধ-বিনোরোধ করেই হয়তো বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রতি সপ্তাহে তার লেখা ছাপে। ব্যক্তিগত-পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে কথা বলাটা আমার কাছে বিব্রতকর বলে আমি সজাগ-সচেতনভাবে, সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করি। আজকে সারা দিন চেষ্টা করেও এড়িয়ে যেতে ব্যর্থ হলাম, তাই এই লেখা।
বজ্রর লেখা বেলুনের মতো। আলপিনের একটু ঘা লাগলে বেলুনের অস্তিত্ব থাকে না। বাতাসে মিশে যায়। তেমনি কেউ যদি বজ্রর লেখা নিয়ে ভাবে, সব কিছুই অহং আর আত্মযন্ত্রণায় হাত-পা কামড়ানোর প্রতিফলন, তাহলে তার এই সুন্দর বর্ণনাগুলো বেলুনের মতোই গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। 'সশস্ত্রবাহিনী দিবস' একটি আনুষ্ঠানিক বিষয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতাবাদ, একাত্তরের স্বাধীনতা- এই ধারাবাহিকতায় অনেক সংগ্রাম, অনেক উৎপীড়ন, অনেক নির্যাতন আর হাজারও মানুষের জীবনদানের পরিণাম স্বাধীনতা। ভারত উপমহাদেশ খণ্ডিত হয়ে ভূগোল চিহ্নিত হয়েছে, পতাকা ও জাতীয় সংগীত নির্ধারিত হয়েছে। সংবিধানও প্রণীত হয়েছে। তবে মানসিকতার খুব যে একটা পরিবর্তন হয়েছে, তেমন লক্ষগোচর হয় না।
২১ নভেম্বর সশস্ত্রবাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানও পূর্ব ধারাবাহিকতার প্রতিফলন। সরকারপ্রধান আসবেন, তিনি কী করবেন, তা সশস্ত্রবাহিনীর নিয়মবিধিতে বিধিবদ্ধ আছে। গত ২১ নভেম্বর সশস্ত্রবাহিনী দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা যা করেছেন, তা বিধিবদ্ধ, নিয়মবহির্ভূত কিছু নয়। বরং বজ্র যাকে অভিনন্দিত করেছে, বোনের আচরণের বিরুদ্ধে সেই ভাবির প্রতি তা-ই অভব্যতা- নিয়মবহির্ভূত, অরুচিকর।
আমন্ত্রিত অতিথি যাঁরা, আমন্ত্রণকারীর সঙ্গে কুশল বিনিময়ের জন্য সব অনুষ্ঠানেই অপেক্ষা করেন। এ ক্ষেত্রে সেই নিয়মের ব্যতিক্রম করে বজ্রর ভাবি কেন প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়া পর্যন্ত অবস্থান করলেন না- এ প্রশ্ন যখন বজ্রর বিবেচনায় আসে না, তখন মনে হয়, বোনের প্রতি ব্যক্তিগত ক্ষোভ-অভিমান আক্রোশে পরিণত হয়েছে, যা থেকেই একহাত নেওয়া। এ ধরনের মতামত কোনো সুস্থ মস্তিষ্ক মানুষের লক্ষণ হতে পারে না। সমালোচনা যদি এ ক্ষেত্রে কাউকে করতে হয়, তা বজ্রর ভাবিরই হওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী কোনো ব্যক্তি নন, প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিকতা প্রতিপালন করতেই হয়। তাঁর আদেশেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয় বটে, আদেশটি যাঁরা কার্যকর করেন তাঁরা কিন্তু প্রতিষ্ঠিত কিছু নিয়মের ভিত্তিতেই করেন। প্রশ্ন যখন এসেই গেল, আরেকটি বিষয়ের অবতারণা করা যাক।
তার ভাবি বিরোধী দলের নেতা হিসেবেই ওই অনুষ্ঠানে বিশেষভাবে আমন্ত্রিত। এখন কেউ যদি স্বাধীনতাযুদ্ধের বীর উত্তম, সশস্ত্রবাহিনীর সাবেক প্রধানের স্ত্রী, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, শহীদ রাষ্ট্রপতির পত্নী হিসেবে মাথায় রাখেন, তাহলে কিন্তু অন্য ব্যাপার এসে যায়। সংসদে বিরোধী দল অংশগ্রহণ করে না। সুযোগ-সুবিধা নেয়- এ নিয়ে সমালোচনা করার মতো নোংরা মানসিকতা আমার নেই। গরু মেরে জুতা দানে আমি বিশ্বাস করি না। জনগণ যে রায় দিয়েছে, সে রায় বজ্রর ভাবি মানছেন না- এটাই হলো ধ্রুবসত্য। ধ্রুবসত্য সংসদ কার্যপ্রণালীবিধি ও সংবিধানের প্রতি বজ্রর ভাবির অনাস্থা প্রদর্শন। বজ্র নিজেও ধ্রুপদী গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে কি না সে বিষয়ে আমার মধ্যে যথেষ্ট সংশয় আছে। বাংলাদেশে এখন বজ্রকে আমার চেয়ে বেশি দিন দেখার লোক জীবিত নেই। বজ্র মানুষের ভালো চায়, দেশের উন্নতি চায়। স্বাধীনতাযুদ্ধের যোদ্ধাদের সম্মানিত করতেও চায়। কিন্তু কিভাবে তা করা যায়, সে বিষয়ে তার কোনো স্পষ্ট ধারণা আজ পর্যন্ত প্রকাশ করতে পারেনি। তার একটি দল আছে। দলের ঘোষণাপত্রে যা বর্ণনা আছে, তা আর দশ-পাঁচটি গণতান্ত্রিক দলের কর্মসূচির চেয়ে ব্যতিক্রমী কিছু নয়। আমাদের অভিজ্ঞতা ঘোষণাপত্রের কর্মসূচি অনুযায়ী কেউ কিন্তু তেমন কিছু করছে না। স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনা ও প্রেরণা বজ্রর মধ্যে এখন অবশিষ্ট আছে কি না তা নিয়েও আমি ধন্ধে পড়ে গেছি। লেখার এক স্থানে খুনি গোলাম আযমপুত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে 'জনাব গোলাম আযম' উল্লেখ করাই আমার এই ধন্ধের কারণ। খুনি গোলাম আযমপুত্র 'আজমী' ভদ্র-সভ্য রুচিশীল হতেই পারে। কিন্তু বাবার স্বাধীনতাবিরোধী, মানবতাবিরোধী, হত্যাকারী কর্মকাণ্ডকে সে কিন্তু অকাতরে সমর্থন করছে। তাই তার ভদ্রতা-শিষ্টাচার, শোভনতা-রুচিশীলতা স্বাধীনতাযুদ্ধের সন্তানহারা মায়ের, স্বামীহারা নারীর, পিতাহারা সন্তানের ও পাঞ্জাবি-ধর্ষিতাদের কাছে 'আজমী' খুনিপুত্র ছাড়া আর কিছু নয়।
বজ্রর সারাটা লেখাই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারমূলক। এই ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখে আমার একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে- আজ পর্যন্ত বজ্রর ব্যাপারে ভালোমন্দ, পক্ষে-বিপক্ষে আমার নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলিনি। কারণ বজ্র বীর, বীর হলেই কেন যেন তারা দাম্ভিক ও অহংকারী হয়। আমি দাম্ভিক, অহংকারী লোকদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখি। আমি সাধারণ মাপের মানুষ- চাটুকারিতা, তোষামোদ ও স্তাবকতা করতে পারি না, ইনিয়েবিনিয়ে কারো মনোরঞ্জনও আমার দ্বারা সম্ভব না। তাই দূরত্ব বজায় রাখাটাই শ্রেয়তর মনে করি। জনসম্মখে বজ্র আমার পা ছুঁয়ে সালাম করে। এই দৃশ্য দেখে অনেকেই ভাবে আমাদের সম্পর্ক খুবই মধুর। সম্পর্ক অবশ্যই গভীর ও মধুর। এ জীবনে বজ্র ও আমার সম্পর্কের বিভাজন সম্ভব নয়। আমরা একই মায়ের নাড়িছেঁড়া ধন। আমি বয়সে বড়। আমাদের পরিবারে বড়র প্রতি ছোটর শ্রদ্ধাবোধ অপরিসীম, তাই শত বিচ্ছেদের পরও বজ্র আমাকে সম্মান প্রদর্শন করে। আমিও খোলা মনে অপত্যস্নেহে ওকে বুকে ধারণ করি। ওর এই আচরণ লোক দেখানো তা আমি মনে করি না। লোক ঠকানো তো নয়ই। নীতির প্রশ্নে, লক্ষ্য অর্জনের প্রশ্নে আমি কখনোই বজ্রকে ছাড় দিইনি, কখনো দেবও না। স্বাধীনতার পর সারা বাংলাদেশে যখন বজ্রকে নিয়ে ধন্য ধন্য ধ্বনিতে মুখরিত, তখনো বলেছি বজ্র একজন বীর, কিন্তু নেতা নয়। বীর ঘটনাক্রমের সৃষ্টি, নেতা প্রক্রিয়াজাত। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়েও বজ্রর সঙ্গে আমার মতভেদ হয়েছে এবং আমি তার কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে দেশে চলে এসে কারা-নির্যাতন ভোগ করেছি। আমি অনেক সময় বজ্রর প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছি, এটা যেমন সত্য, তার চেয়েও কঠিন সত্য বজ্র কখনো তার মনের কথা বা কী করতে চায় আমাকে বলেনি। ১৯৯১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সে যখন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে তখনো সে আমাকে জানায়নি, সে এক মাসের পারমিট নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে নথিবদ্ধ আছে ওই পারমিটটির কথা। 'জগলু' নামে বজ্রর এক চেলা এই পারমিট ইমিগ্রেশনের কাছে হস্তান্তর করেছিল বলে শুনেছি। আমাকে বিষয়টি জানানো হলে আমি কাগজটি ছিঁড়ে বাথটাবে ফেলে দিতাম। ১৯৯১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের যে অবস্থা ছিল, তাতে বজ্রকে গ্রেপ্তার করার সাহস বা ক্ষমতা সাহাবুদ্দীন সরকারের ছিল না।
বজ্র যখন দল গঠন করে তখনো সে আমার কাছে এসেছিল। দাবি করেছিল আমি তার সঙ্গে যেন থাকি। আমি তাকে সেদিন স্পষ্ট করে বলি, 'বজ্র, এত দিন তুই আমার দল করেছিস। এখন তুই বড় হয়েছিস, বুদ্ধি-বিবেচনা হয়েছে, তুই তোর ইচ্ছামতো চলতে পারিস। আমি আমার দল ছাড়ব না। দলে আমার অবস্থান যতই নড়বড়ে ও গুরুত্বহীন হোক। এ দল গঠনে আমার কৈশোর, আমার যৌবন ও জীবনের অনেক আনন্দ-ভোগ বিসর্জন দিয়েছি।' পাঠকের জানার জন্য বলি, ২০০১ জাতীয় নির্বাচনে বজ্র যখন মনোনয়নপত্র বাছাই অনুষ্ঠানে আমাকে দেখতে পায়, তখনো আমার পা ছুঁয়ে সালাম করে। আমিও ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খাই। এমনকি নির্বাচনের দিন সামরিক বাহিনীর কাছে মিথ্যা অভিযোগ করে আট-দশটি ভোটকেন্দ্রে আমার ভোটারদের বিতাড়িত করার ব্যাপারে প্রতারণামূলক মিথ্যার আশ্রয় নেওয়ার পরও ওর সামনে পড়ে যাওয়ায় ও আমাকে পা ছুঁয়ে সালাম করে। মরহুম আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর জানাজায় এই প্রথম প্রকাশ্যে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করা নয়। ওই দিন যে বিভ্রাট ঘটল সেটি হলো, জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার আমার পাশে দাঁড়ানো ছিলেন। বজ্র আমাকে সালাম করে ওঠার পর সে বলে, 'আমাকে সালাম করলে না, কাদের?' এ ধরনের আচরণ শোভন-অশোভন কি না তা পাঠকই বিচার করবেন। তবে বজ্রর মতো লোক কেন কর্নেল শওকতকে সালাম করবে, সত্যিকার অর্থে তা আমারও বোধগম্য নয়। বিষয়টা স্পর্শকাতর।
মূল আলোচনায় ফিরে আসা যাক। শুধু এই লেখাটিই নয়, বজ্রর প্রত্যেক লেখাতেই আমার নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিষোদগার থাকবেই। এটা লক্ষ করে আমি একটা ধারণা করছি। সে ধারণাটির কথাই নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিবেদন করছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি নীলকণ্ঠ- বঙ্গবন্ধু ও আপনাকে যারা ধোপার পাটে আছড়েছে বছরের পর বছর, তাদেরও আপনি আওয়ামী লীগে স্থান দিয়েছেন। বজ্র বঙ্গবন্ধুর অনুসারী-অনুগামী, এখনো মুজিব কোট ছাড়েনি। আপনার এই 'সহোদর' ভাইটিকে একবার ডাকবেন কি? ডাকে যদি সাড়া দেয়, জিজ্ঞেস করবেন কি, 'তোর পাকা ধানে আমি কি মই দিয়েছি?' সাড়া যদি না দেয় তাহলে তো যা চলছে তেমনি চলতে থাকবে- সমস্যা তো কিছু নেই। বজ্র এখনো যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পর্কে তার সিদ্ধান্ত স্পষ্ট করতে পারেনি এ আমার কাছে এক বিস্ময়! বিরোধী দলের নেত্রী জিয়াপত্নী খালেদার প্রতি তার আসক্তির প্রকাশে কোনো রকম রাখঢাক নেই। বিজয়ের মাসে আমরা বজ্রকে কোন আঙ্গিকে মূল্যায়ন করব? মুক্তিযোদ্ধারা মাটিতে বসে থাকে, আমলা-ফৈইলারা উচ্চাসনে পা নাচায়- এ দৃশ্য দেখে ভাই বজ্রর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। কিন্তু শত শত মুক্তিযোদ্ধা যখন 'স্যারের' বাসভবনের দরজায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে, তখন কি তার মনে একটুও ভাবনা হয় না, এদের কারণেই আমি বীর উত্তম?
এবার আমি আরেক স্নেহভাজন ইমদাদুল হক মিলনের 'মানুষ চায় দুই নেত্রীর সমঝোতা' এই বিষয়ের অবতারণা করছি। মিলন কালের কণ্ঠে মাহমুদুর রহমান মান্নার ৩০ তারিখের লেখার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করেছেন, "এই পরিস্থিতির কোনো নিষ্পত্তি হওয়ার জায়গা খুঁজে পাচ্ছি না আমি। যেকোনোভাবেই হোক একটা হস্তক্ষেপ অবশ্যম্ভাবী, সেটা প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য, সামরিক কিংবা বেসামরিক, দেশি কিংবা বিদেশি, তা বলতে পারব না। এই দুই প্রচণ্ড জেদি নেত্রী যে রকম 'ষাঁড়ের লড়াইয়ে'র প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাতে হস্তক্ষেপ ছাড়া নিষ্পত্তির সম্ভাবনা আমি দেখি না।" এ কী কথা জনগণ-অন্তঃপ্রাণ মান্নার! হস্তক্ষেপ করার অধিকার সামরিক বাহিনীর নেই, আর বিদেশি হস্তক্ষেপ কি সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি নয়? যাঁরা আধিপত্যবাদ ও প্রভুত্বকামিতার বিরুদ্ধে এত সরব, তাঁরা জনগণকে ছেড়ে শক্তিমানের পো ধরছেন কেন? জনগণের প্রতি আস্থা হারানো অপরাধ। মিলন ড. কামাল হোসেনের একটি সাক্ষাৎকারের উদ্ধৃতিও দিয়েছেন, আমি আর সেটি আনতে চাই না। ভাই মিলন, তুমি যাঁদের উদ্ধৃতি দিয়েছ, তাঁরা কিন্তু মানুষ নন, তাঁরা মানুষের নেতা। পত্র-পত্রিকার কলাম-লেখক, বৈদ্যুতিক মাধ্যমের টকশোর আলোচক- তাঁরা জ্ঞানী-গুণী-বুদ্ধিজীবী, সবাই অসাধারণ। তাঁদের মতামতে সাধারণের গন্ধ কোথায় পেলে বুঝতে পারলাম না। বাংলাদেশের মানুষের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমার যা ধারণা, তাই এবার বলি। মানুষ ঐক্য চায়, শান্তি চায়, স্বস্তি চায়, সমঝোতা চায়। কিন্তু যাঁরা নেতা, যাঁরা জ্ঞানী, যাঁরা বুদ্ধিজীবী-আলোচক, তাঁরা শান্তি-স্বস্তি-ঐক্য-সমঝোতা কোনোটাই চান না। তাঁরা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চান। আসলে মানুষের সমস্যা কি ভোটের সমস্যা, মানুষের সমস্যা কি তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নাকি মানুষের সমস্যা খালেদা জিয়ার বাড়ি ছাড়ার বেদনা? মানুষের সমস্যা কি স্বাধীনতার পরাজিত যুদ্ধাপরাধী শক্তির বিচারে অন্তরায় সৃষ্টির পাঁয়তারা? আমার বিচারে, মানুষের সমস্যা শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি, স্বাস্থ্যসেবার আধুনিকায়ন ও উন্নতিসাধন, কর্মসংস্থানের নব নব ক্ষেত্র প্রস্তুত। আর রাষ্ট্রের মৌলিক সমস্যা যুদ্ধাপরাধীর বিচার। এই মৌলিক সমস্যাগুলোর প্রতি যাদের নজর নেই, নজর শুধুই রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে, আসলে তারাই প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, সামরিক-বেসামরিক, দেশি-বিদেশি হস্তক্ষেপ কামনা করে। জনগণের ওপর তাদের আস্থা নেই। এ দেশে ভোটরঙ্গ শুরু ১৯৩৭ সাল থেকে। '৩৭, '৪৬, '৫৪, '৭০, '৭৩, '৯৬ ও ২০০৮ জনগণ যতবার স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পেরেছে, কখনোই ভুল রায় দেয়নি। সমঝোতাটা কার সঙ্গে কার হবে, হস্তক্ষেপটা কে করবে, কার ওপর করবে? এ কথা কি পরিষ্কার নয়, এক পক্ষ স্বাধীনতার পক্ষশক্তি, আরেক পক্ষ স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি? যাঁরা জ্ঞান বিতরণ করছেন তাঁরা কার পক্ষাবলম্বন করছেন?
অকপটে স্বীকার করি, স্বাধীনতার পক্ষশক্তির মধ্যে অনেক ত্রুটিই শুধু নয়, স্খলনও আছে। কিন্তু মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি আনুগত্য, লাখো নারীর সম্ভ্রমহানির প্রতি সম্মান-প্রদর্শনে কোনো ঘাটতি নেই। অন্যদিকে যারা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে জামাতি জঙ্গিবাদী ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তৎপর, তারা মুক্তিচেতনায় বিশ্বাসী স্বাধীন দেশের মানুষকে অন্ধকারে ধাবিত করার কুহক রচনা করছে। একদিকে সত্য-সুন্দর-মঙ্গল, আরেকদিকে কুহক ও কুহকিনী- এর মধ্যে সমঝোতা আর সেই সমঝোতার জন্য দেশি-বিদেশি হস্তক্ষেপ, সামরিক-বেসামরিক চাপ যাদের কাম্য, তারা কী চায়, আমার বোধগম্য নয়। তবে এটুকু বুঝি, লাঙলের মাথায় জোয়াল বাঁধতে হয়, সেই জোয়াল গরুর ঘাড়ে পরাতে হয়। গরুর আগে যদি জোয়াল বেঁধে দেওয়া হয়, দুর্ঘটনা ঘটবেই।
দেশ কোনো ভয়াবহ সংকটে নিপতিত নয়। তবে জামায়াত-শিবির, স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি, ধর্মীয় জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি, সামাজিক বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠানে অরাজকতা সৃষ্টির জন্য প্রতি মুহূর্তে ঘৃণ্য পাঁয়তারা করছে। যারা স্বাধীনতার পক্ষশক্তি, যারা মুক্তিচেতনায় বিশ্বাসী, তারা যদি বিবেকবান হয়, তাদের জ্ঞানবুদ্ধি যদি লোপ না পেয়ে থাকে, তাহলে তারা একবাক্যে মানবে, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রতি মুক্তিকামী মানুষের আস্থা এতই দৃঢ়মূল যে তাঁর নেতৃত্বেই স্বাধীনতার পরাজিত অপশক্তি খতম করে স্বাধীনতা-শহীদদের ত্যাগে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়া সম্ভব। বিজয়ের মাসে মানুষের ঐক্যের ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, 'আমাদের রাজনীতি হচ্ছে মানুষের জন্য। আমরা চাই মানুষের আর দেশের উন্নতি।' এ পথে যারা বাধা, তাদের মোকাবিলা করে প্রধানমন্ত্রীর হাতকে শক্তিশালী করাই আজকের বার্তা। ব্যক্তিগত মান-অভিমান ভুলে স্বাধীনতাকামী-স্বাধীনতাকামীতে সমঝোতা করে হস্তক্ষেপহীন, চাপহীন পরিস্থিতি নিশ্চিতকরণই আজকের জনদাবি। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী নির্মূল এবং স্বাধীনতার সুফল বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার প্রত্যয়দীপ্ত শপথের মধ্য দিয়ে বাঙালি এবারের বিজয় দিবস উদ্যাপন করবে।
লেখক : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী
No comments