কায়রোতে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু কে by ডেভিড ইগনেটিয়াস
কায়রোর মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে ওয়াশিংটনের বন্ধুত্ব হয় কিভাবে? প্রশ্নটি আরবেরও অনেকে জিজ্ঞেস করেন এবং তাঁরা এর জবাবও প্রত্যাশা করেন। বিশেষ করে যে মুহূর্তে কায়রোতে প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুরসির বাহিনী ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসী মানুষের ওপর নির্যাতন চালায়, তখন এই প্রশ্নটা আরো জোরালো আকারে দেখা দেয়।
মুরসি ও তাঁর নেতৃত্বাধীন ব্রাদারহুড প্রায় এক দশক সেখানে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এবং নির্যাতনের মধ্যে দিনযাপনের পর ক্ষমতার স্বাদ পায় সম্প্রতি। আর মুরসি যে তাঁর নতুন অবস্থানে যেতে পেরেছেন, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে গত সেপ্টেম্বর মাসে তিনি যখন জাতিসংঘে এসেছিলেন। এমনকি তাঁর উঁচু অবস্থান আবারও প্রমাণিত হয় মাত্র গত মাসে। গাজায় যুদ্ধবিরতির কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় তিনি যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সহযোগী হলেন, তখন বিষয়টা আরো পরিষ্কার হয়ে যায়। ব্রাদারহুডের এই নেতা বিচ্ছিন্ন অবস্থা থেকে কিভাবে সুপারস্টারে পরিণত হলেন- এগুলোই তার বড় প্রমাণ।
সত্যি বলতে কী, মুরসিকে বিশাল ক্ষমতাধর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে ওবামা প্রশাসনের বড় অবদান আছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। বিশেষ করে তাঁদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক কূটনীতিতে তাঁদের অবস্থান আরো সুদৃঢ় করার ইচ্ছায়ই এই সহযোগিতা। গত সপ্তাহে তাঁর প্রতিনিধি ওয়াশিংটন সফর করে গেছেন। তাঁদের আলোচনায়ই বেরিয়ে এসেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁদের নেতার সম্পর্ক কতটা ঘনিষ্ঠ। বিশেষ করে গাজায় শান্তি ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে দুই নেতার মধ্যে টেলিফোন আলোচনার পর প্রতিনিধিদের মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
মুরসিও হয়তো শান্তিপ্রক্রিয়ায় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারেন। তাঁর মাধ্যমেও হয়তো বড় কিছু অর্জন হয়ে যেতে পারে। আর এমন ভাবনা থেকেই হয়তো ওয়াশিংটন বিপ্লব-পরবর্তী এই শক্তির সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছে।
কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার বলে একটা কথা ভুলে গেলে হবে না। দীর্ঘ এক দশক অপেক্ষার পর যখন মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতার স্বাদ পায়, তখনই তাদের আসল রূপ বেরিয়ে আসতে থাকে। এটা কি আমেরিকার সহযোগিতা পাওয়ার মানসিকতা থেকেই এসেছে? মুরসির জারি করা প্রেসিডেন্টের ডিক্রি তেমনই চিন্তার জন্ম দেয়। তিনি ডিক্রি জারি করলেন, প্রেসিডেন্টের ডিক্রির ওপর আদালতেরও কিছু বলার থাকবে না। তাঁর অনুসারীরা এই ডিক্রি জারির পক্ষে বললেন। তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের আমলে নিযুক্ত বিচারকদের হাত থেকে মিসরকে রক্ষার জন্যই এমন করা হয়েছে। কিন্তু এই যুক্তি যে যথার্থ নয় তা প্রমাণ হয়ে গেল, যখন মুরসির নেতৃত্বাধীন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যক্তি প্রতিবাদস্বরূপ পদত্যাগ করে। আর হাজার হাজার মানুষের রাস্তায় নেমে আসার পর নিশ্চয়ই বিষয়টি আরো খোলাসা হয়ে যায়। মুসলিম ব্রাদারহুড সমর্থকরাও বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলে পড়ে।
এই উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির পর ওবামা প্রশাসন বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্বসহ বিবেচনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ভিক্টোরিয়া নুলেন্ড স্পষ্টত বলেছেন, 'আমরা বিবদমান গ্রুপগুলোকে আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন শান্ত হয়। তারা যেন ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের সমস্যাগুলো মোকাবিলা করে। গণতান্ত্রিকভাবে সংলাপের মাধ্যমে তারা তাদের নিজেদের সমস্যাগুলো সমাধান করুক- এটা আমাদের প্রত্যাশা। সমস্যা সমাধানের জন্য চলমান পদ্ধতি সঠিক বলে আমরা মনে করি না।'
মুরসির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এই সমর্থনসূচক বক্তব্যের পেছনে কারণ কী? বলতে পারেন আপনি? এমন এক প্রশ্নের জবাবে আরবীয় কর্মকর্তা আমাকে লিখেছেন, যেহেতু মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন নেতা মিসরের প্রেসিডেন্টের আসনে বসেছেন, সে কারণে তিনি কিছু সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারেন, যা তাঁর ক্ষমতা দেখানোর প্রয়োজনে জরুরি বলে তাঁরা মনে করছেন। দেখতে হবে, হোসনি মুবারকের একনায়কতন্ত্রের তুলনায় এই ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রচেষ্টাটি কতটা ক্ষতিকর। এই কর্মকর্তা কিছুটা অবাকই হয়েছেন বলে মনে হলো। তাঁর অবাক হওয়ার কারণ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সর্বশেষ বক্তব্য। তিনি মনে করেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র কি তাদের নতুন বন্ধুর ব্যাপারে আস্থা হারাতে শুরু করেছে।
কিন্তু পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বলেছেন, এটা যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ব্যাপার নয়। মিসর এবং অন্য আরব দেশগুলো তাদের নতুন ইতিহাস তৈরির কাজ শুরু করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ পোষণকারীদের পক্ষে থাকা প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে প্রতিবাদকারীদের প্রতিপক্ষ যারা আছে, তারা তো যুক্তরাষ্ট্রেরও মিত্র হিসেবে গণ্য হয়েছে। সুতরাং এখন দেখার বিষয়, যুক্তরাষ্ট্র কোন দিকে যায়।
ইরাকের ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার বিষয় আছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই বলেছিলেন, ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকি একজন ষড়যন্ত্রকারী। ইরাকের অনেকেই জানিয়েছিলেন, মালিকি যদি ভিন্ন দিকে মোড় নেন, তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এমনকি তিনি ইরানের সঙ্গেও আঁতাত করে বসতে পারেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। তারা মালিকিকেই সমর্থন জোগাতে থাকে। কিন্তু ২০১০ সালে সেই মালিকিকে ইরাকের মানুষ নির্বাচনে সেভাবে সমর্থন দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে।
যখন আরব বিশ্বে কোনো অশান্তি সৃষ্টি হয়, তখন আমাদের মনে রাখতে হবে, সেখানকার শান্তি ফিরে আসতে দশক কালও পেরিয়ে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র যখনই কাউকে সমর্থন জোগায় তার আগে বুঝতে হবে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সংরক্ষণে কতটা আন্তরিক হবেন। আর মুরসির কথা যদি বলি, তাহলে তাঁর নিজের আচরণ দিয়েই প্রমাণ করতে হবে, তিনি একজন গণতন্ত্রী এবং তিনি জনগণের আস্থা অর্জনেও সক্ষম।
লেখক : ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক।
ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে ভাষান্তর করেছেন মোস্তফা হোসেইন
সত্যি বলতে কী, মুরসিকে বিশাল ক্ষমতাধর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে ওবামা প্রশাসনের বড় অবদান আছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। বিশেষ করে তাঁদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক কূটনীতিতে তাঁদের অবস্থান আরো সুদৃঢ় করার ইচ্ছায়ই এই সহযোগিতা। গত সপ্তাহে তাঁর প্রতিনিধি ওয়াশিংটন সফর করে গেছেন। তাঁদের আলোচনায়ই বেরিয়ে এসেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁদের নেতার সম্পর্ক কতটা ঘনিষ্ঠ। বিশেষ করে গাজায় শান্তি ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে দুই নেতার মধ্যে টেলিফোন আলোচনার পর প্রতিনিধিদের মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
মুরসিও হয়তো শান্তিপ্রক্রিয়ায় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারেন। তাঁর মাধ্যমেও হয়তো বড় কিছু অর্জন হয়ে যেতে পারে। আর এমন ভাবনা থেকেই হয়তো ওয়াশিংটন বিপ্লব-পরবর্তী এই শক্তির সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছে।
কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার বলে একটা কথা ভুলে গেলে হবে না। দীর্ঘ এক দশক অপেক্ষার পর যখন মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতার স্বাদ পায়, তখনই তাদের আসল রূপ বেরিয়ে আসতে থাকে। এটা কি আমেরিকার সহযোগিতা পাওয়ার মানসিকতা থেকেই এসেছে? মুরসির জারি করা প্রেসিডেন্টের ডিক্রি তেমনই চিন্তার জন্ম দেয়। তিনি ডিক্রি জারি করলেন, প্রেসিডেন্টের ডিক্রির ওপর আদালতেরও কিছু বলার থাকবে না। তাঁর অনুসারীরা এই ডিক্রি জারির পক্ষে বললেন। তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের আমলে নিযুক্ত বিচারকদের হাত থেকে মিসরকে রক্ষার জন্যই এমন করা হয়েছে। কিন্তু এই যুক্তি যে যথার্থ নয় তা প্রমাণ হয়ে গেল, যখন মুরসির নেতৃত্বাধীন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যক্তি প্রতিবাদস্বরূপ পদত্যাগ করে। আর হাজার হাজার মানুষের রাস্তায় নেমে আসার পর নিশ্চয়ই বিষয়টি আরো খোলাসা হয়ে যায়। মুসলিম ব্রাদারহুড সমর্থকরাও বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলে পড়ে।
এই উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির পর ওবামা প্রশাসন বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্বসহ বিবেচনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ভিক্টোরিয়া নুলেন্ড স্পষ্টত বলেছেন, 'আমরা বিবদমান গ্রুপগুলোকে আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন শান্ত হয়। তারা যেন ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের সমস্যাগুলো মোকাবিলা করে। গণতান্ত্রিকভাবে সংলাপের মাধ্যমে তারা তাদের নিজেদের সমস্যাগুলো সমাধান করুক- এটা আমাদের প্রত্যাশা। সমস্যা সমাধানের জন্য চলমান পদ্ধতি সঠিক বলে আমরা মনে করি না।'
মুরসির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এই সমর্থনসূচক বক্তব্যের পেছনে কারণ কী? বলতে পারেন আপনি? এমন এক প্রশ্নের জবাবে আরবীয় কর্মকর্তা আমাকে লিখেছেন, যেহেতু মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন নেতা মিসরের প্রেসিডেন্টের আসনে বসেছেন, সে কারণে তিনি কিছু সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারেন, যা তাঁর ক্ষমতা দেখানোর প্রয়োজনে জরুরি বলে তাঁরা মনে করছেন। দেখতে হবে, হোসনি মুবারকের একনায়কতন্ত্রের তুলনায় এই ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রচেষ্টাটি কতটা ক্ষতিকর। এই কর্মকর্তা কিছুটা অবাকই হয়েছেন বলে মনে হলো। তাঁর অবাক হওয়ার কারণ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সর্বশেষ বক্তব্য। তিনি মনে করেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র কি তাদের নতুন বন্ধুর ব্যাপারে আস্থা হারাতে শুরু করেছে।
কিন্তু পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বলেছেন, এটা যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ব্যাপার নয়। মিসর এবং অন্য আরব দেশগুলো তাদের নতুন ইতিহাস তৈরির কাজ শুরু করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ পোষণকারীদের পক্ষে থাকা প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে প্রতিবাদকারীদের প্রতিপক্ষ যারা আছে, তারা তো যুক্তরাষ্ট্রেরও মিত্র হিসেবে গণ্য হয়েছে। সুতরাং এখন দেখার বিষয়, যুক্তরাষ্ট্র কোন দিকে যায়।
ইরাকের ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার বিষয় আছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই বলেছিলেন, ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকি একজন ষড়যন্ত্রকারী। ইরাকের অনেকেই জানিয়েছিলেন, মালিকি যদি ভিন্ন দিকে মোড় নেন, তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এমনকি তিনি ইরানের সঙ্গেও আঁতাত করে বসতে পারেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। তারা মালিকিকেই সমর্থন জোগাতে থাকে। কিন্তু ২০১০ সালে সেই মালিকিকে ইরাকের মানুষ নির্বাচনে সেভাবে সমর্থন দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে।
যখন আরব বিশ্বে কোনো অশান্তি সৃষ্টি হয়, তখন আমাদের মনে রাখতে হবে, সেখানকার শান্তি ফিরে আসতে দশক কালও পেরিয়ে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র যখনই কাউকে সমর্থন জোগায় তার আগে বুঝতে হবে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সংরক্ষণে কতটা আন্তরিক হবেন। আর মুরসির কথা যদি বলি, তাহলে তাঁর নিজের আচরণ দিয়েই প্রমাণ করতে হবে, তিনি একজন গণতন্ত্রী এবং তিনি জনগণের আস্থা অর্জনেও সক্ষম।
লেখক : ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক।
ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে ভাষান্তর করেছেন মোস্তফা হোসেইন
No comments