কালের যাত্রা by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়
ভারতের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি বাংলাদেশে বেড়িয়ে গেলেন। উত্তর-পূর্ব ভারতের চার রাজ্যের চারজন মুখ্যমন্ত্রীও ছিলেন তাঁর সঙ্গে। থাকার কথা ছিল পাঁচজনের। কিন্তু শেষ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেঁকে বসলেন। এলেন না। প্রায় সাড়ে তিন মাস আগে পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী বামদুর্গে ধস নামিয়ে ক্ষমতায় এসে যে মমতা সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন, তাঁকে নিয়ে বাংলাদেশে আগ্রহের কমতি ছিল না।
তৃণমূলকর্মীদের প্রিয় 'দিদি' ঢাকায় আসছেন, এই জন্য অনেক রকম প্রস্তুতিও ছিল বাংলাদেশে। তা ছাড়া আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও তাঁর সখ্যের কথা অজানা নয়। তাই পাশের বাড়ির দিদির আপ্যায়নে হয়তো আলাদা প্রস্তুতিও ছিল। যা হয়তো রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতায় প্রটোকলের বাইরে। তবু তিনি এলেন না। সবাই বিস্মিত হলেন। মাসের পর মাস ধরে বিভিন্ন পর্যায়ে নীতি নির্ধারকদের দফায় দফায় আলোচনা-বিশ্লেষণ ইত্যাদি শেষে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়ার কথা ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময়। এগুলোর ভেতর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল খরস্রোতা তিস্তা নদীর জলভাগ। সেই সঙ্গে ফেনী নদীর জল ভাগাভাগির ব্যাপারটিও ছিল। দুই নদীর জলের ভাগ নিশ্চিত হওয়াটা ছিল বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি। শুকনো মৌসুমে সেচের জল পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া, বর্ষায় বন্যানিয়ন্ত্রণ করে শস্যহানি ও অন্যান্য ক্ষতি আটকানো এবং জলবিদ্যুৎ তৈরি_তিস্তার জলের ভাগ পেলে এ সব বিষয়ে আমরা লাভবান হব। ভারতও নিশ্চয় নিজের ক্ষতি করে তিস্তা চুক্তি করবে না এবং চুক্তির খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একেবারেই অজানা ছিল, তাই বা ভাবি কী করে! বিষয়টি নিয়ে তো অনেকদিন ধরেই আলোচনা চলে আসছিল নীতি-নির্ধারক-বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে তিস্তার জলের ওপর পশ্চিমবঙ্গের ছয়টি জেলার জলসেচের কাজ নির্ভর করে। তা ছাড়া শিলিগুড়ি পৌর এলাকার পানীয়জল সরবরাহ হয় তিস্তা থেকেই। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার নিশ্চয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এসব নিয়ে আগে থেকেই কথাবার্তা বলে আসছিল এবং মমতাও, আশা করি, তাঁর রাজ্যের ক্ষতি যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রেখেই তিস্তা চুক্তিতে সম্মতি দিয়েছিলেন। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন বাংলাদেশে এসে তিস্তার জলবণ্টনের মতো সংবেদনশীল চুক্তির খসড়া প্রায় চূড়ান্ত করে কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনায় বসেন ৩১ আগস্ট। সঙ্গে ছিলেন কেন্দ্রীয় জনসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক পদস্থ কর্মকর্তা। কলকাতার এক দৈনিক পত্রিকার খবর থেকে জেনেছি, মমতা খসড়া চুক্তিতে সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর উদ্বেগের কথাও তিনি মেননকে বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গ যেন জল সংকটে না পড়ে। মেনন-মমতার আলোচনায় ফেনী নদীর জলবণ্টন নিয়েও ঐকমত্য হয়েছে বলেও খবর ছাপা হয়েছিল দৈনিকটিতে। তা ছাড়া মাত্র কয়দিন আগে কলকাতায় আসা দিলি্লর প্রধানমন্ত্রীও নাকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাংলাদেশ সফরের বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন। এত কিছুর পর সফরের ঠিক আগ মুহূর্তে মমতার বাংলাদেশে না আসার ঘোষণা সর্বমহলেই বিস্ময় সৃষ্টি করবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক কূটনীতির সংস্কৃতিতে বিষয়টি অস্বাভাবিকও বটে। প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংও কি এ কারণে বিব্রত হননি! প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর পর মনমোহন সিংয়ের সফরই ছিল বাংলাদেশে কোনো ভারতীয় রাষ্ট্রনেতার সবচেয়ে আলোচিত সফর। ইন্দিরার সফরের সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর মনমোহনের সময় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রজ্ঞা, ব্যক্তিত্ব এবং দেশপ্রেমের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তা কূটনৈতিক বিশ্বে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে সম্মানজনক অবস্থানে প্রতিষ্ঠা করেছিল। আর এবার প্রত্যাশিত তিস্তার জলবণ্টনে মীমাংসা না হওয়ায় ভারতের কাঙ্ক্ষিত ট্রানজিটের ব্যাপারে শেখ হাসিনা যে দৃঢ়তা দেখালেন, তা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর কূটনৈতিক প্রজ্ঞাকেই কেবল প্রতিষ্ঠিত করেনি; একই সঙ্গে শেখ হাসিনার অনন্য দেশপ্রেম এবং আপসহীন বলিষ্ঠ রাজনৈতিক চরিত্রেরই উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটিয়েছে। বিএনপি, জামায়াত এবং অন্যান্য ভারতবিদ্বেষী বিরোধী দলকে শেখ হাসিনা ফেলে দিয়েছেন মহাবিপদে। তারা আর তাদের ভাঙা ঢাকে বেসুরো বোল তুলে বলতে পারছে না যে শেখ হাসিনা ভারতের একান্ত অনুগত। ভারতের সঙ্গে যা তারা কখনো করতে পারেনি এবং পারত না তাই করে দেখিয়েছেন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু এবং হাজার বছরের লড়াকু জাতির যথার্থ উত্তরসূরি হয়ে তিনি কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও ভদ্রতা বজায় রেখে পরাক্রমশালী ভারতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যেন বলেছিলেন, হলামই না হয় ছোট, তাই বলে ন্যায্য অধিকার ছাড় দেওয়ার মতো দুর্বল আমরা নই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই ভূমিকা, আমি নিশ্চিত, বিশ্বের অপেক্ষাকৃত ছোট ও অনুন্নত দেশ ও জাতির কাছে নতুন আলো জ্বেলে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তাদেরও অধিকার অর্জনে সাহসী করবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরে মীমাংসিত হয়েছে বেশ কিছু দীর্ঘকালীন সমস্যা। তাতে উভয় দেশই লাভবান হবে। তা ছাড়া এই সফরের ফলে দুই দেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে যে ইতিবাচক দেওয়া-নেওয়া হলো, তাও বা কম কিসে। তা ছাড়া যা এবার অমীমাংসিত রয়ে গেল তা নিকট-ভবিষ্যতে মীমাংসিত হবে, এমন কথাই তো বলেছেন উভয় দেশের নেতারা। ড. মনমোহন সিং, তাঁর স্ত্রী এবং সফরসঙ্গীদের দুই দিনের ঢাকা অবস্থানের সময় যে পারস্পরিক আন্তরিকতা ও হৃদ্যতার খবর গণমাধ্যম থেকে সবাই জেনেছে, তা ভবিষ্যতের শুভ অর্জনের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। তাই বিরোধী দলের পুরনো ঢাকে ভারত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে যে বিষোদ্গারের বাজনা বাজিয়ে আসর মাত করার চেষ্টা হচ্ছে, তাতে খুব একটা লাভ হবে না।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments