স্মরণ-শহীদ আবদুল্লাহ-হিল-বাকী
আবদুল্লাহ-হিল-বাকী। নিজের প্রাণকে ভালোবাসেননি, যতটুকু ভালোবেসেছেন বাংলার মাটিকে। একদিন বাকী তাঁর বাবাকে বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন, আমি আমার মায়ের পরেই ভালোবাসি আমার দেশকে, তাই দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে জীবন উৎসর্গ করেছেন।
১৯৭১ সালের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সময় অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ আত্মঘাতী সমিতি, যার দ্বিতীয় প্রধান ছিলেন বাকী। সেই সময়কার একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। ২ মার্চ ১৯৭১। মহান দেশপ্রেমিক বাকী নিজ হাতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে শতাধিক যুবকসহ দিনের বেলায় খিলগাঁও থেকে শহর পাড়ি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় হলে আ স ম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজের কাছে পতাকাটি হস্তান্তর করেন। বাকী তাঁর নেতৃত্বে একটি ছোট দল নিয়ে ৮ মার্চ গভর্নর হাউস (বর্তমান বঙ্গভবন) আক্রমণ করেন। পর পর তিনটি বোমার আঘাতে একটি ভবনের কিছু অংশের ক্ষতি হয়। তিনি অসহযোগ আন্দোলনের সময় ঢাকার কোনো এক জায়গায় নিজ হাতে বোমা বানিয়ে অধিক রাতে বাড়ি ফিরতেন। ২৫ মার্চ কালরাত্রি, রাতের অন্ধকারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল বাঙালির ওপর। ১৮ এপ্রিল বাংলাকে শত্রুমুক্ত করবেন, এই উদ্দেশ্যে তিনি পাড়ি জমালেন মুক্ত এলাকায়।
ভারতে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়ে দিনের বেলায় ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যস্ততম এলাকা মতিঝিলে কিছু লক্ষ্যবস্তুর ওপর বোমা মেরে পৃথিবীকে জানিয়ে দেন বাঙালিরা ভীরু নয়। চাকুলিয়ায় ট্রেনিং গ্রহণ করে বিরাট এক দলের ইউনিট কমান্ডের গুরুদায়িত্ব নিয়ে দেশে ফিরে এলেন বাকী। একের পর এক আঘাত হানতে থাকলেন। উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বোমার আঘাতে উড়িয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তান সরকারের নথিপত্রে ঠাসা কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভবন। ওই সব অপারেশন করার সময় হঠাৎ একদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়লেন বাকী। কিন্তু কৌশলে নিজেকে মুক্ত করে পালিয়ে এলেন।
বাকী ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে ইউনিট কমান্ডার ছিলেন। আবদুল্লাহ-হিল-বাকীর নামেই ইউনিটের নামকরণ করা হয়েছিল ‘বাকী ইউনিট’। বাকীর গেরিলা ইউনিট শেষবারের মতো এসে হাজির হলো ঢাকার উপকণ্ঠে। তাঁর সহযোদ্ধাদের মধ্যে ইসমাইল হোসেন (বেঙ্গল), শহীদ শফিক, বাবুল, লুৎফর, আতিক, নান্টু, জাহাঙ্গীর, নীলুসহ নাম না জানা অনেকে। সেদিন রাতেই ছিল নির্ধারিত অপারেশন। ঢাকার খিলগাঁও তালতলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে হঠাৎ করে বাকী এসে হাজির হলেন তাঁর বাবা-মায়ের সামনে। বিদায় মুহূর্তে, বেশ অনেক দিন পর বাসায় এসে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বাবা আপনি খুশি হননি?’। বাবা তখন বলেছিলেন, ‘আমার ছেলে যে বাংলার জন্য নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধ করে যাচ্ছে, তারই সাফল্য দেখে পৃথিবীতে আমার চেয়ে কে বেশি সুখী হতে পারে!’
বাবার কাছ থেকে আশীর্বাদ নিয়ে চলে গেলেন বাকী তাঁর আস্তানায়, কিন্তু ফিরে এসেও স্থির হয়ে থাকতে পারলেন না। সহযোদ্ধাদের উঠিয়ে নিয়ে এলেন শহরের উপকণ্ঠে। রাতের অভিযানে বাকী তাঁর সহযোগীদের নিয়ে এগিয়ে চলছেন, এমন সময় আঁধারের কঠিন রূঢ়তা ছেদ করে কোথা হতে একঝাঁক গুলি চলে গেল ওদের মাথার ওপর দিয়ে। দুটি বুলেট এসে বিদ্ধ হলো বাকীর পবিত্র মাথায় ও তাঁর সহকারী বাবুলের। অন্য যোদ্ধারা কোনো রকমে আত্মরক্ষা করলেন। তখনো বাকীর প্রাণ চলে যায়নি সত্যের এই পৃথিবী থেকে। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম বাকীর পরিচয় জানতে চাইল। তাঁর আস্তানার হদিস বলতে বলল। বাকী নীরব, চোখে অশ্রু নেই। উত্তর না পেয়ে তাঁর পাঁজড়ে বেয়নেট চার্জ করে নিষ্ঠুরভাবে আঘাত হানল।
পরদিন ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১। একাত্তরের বিজয় দিবসের মাত্র ১১ দিন আগে ঢাকার খিলগাঁও এলাকার রেললাইনের পাশে একটি পুলের নিচের জলাভূমিতে পড়ে থাকা বেয়নটের খোঁচায় খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত দুই বীর মুক্তিযোদ্ধার লাশ দেখে এলাকাবাসী শিউরে উঠল। কী বীভৎস এই দৃশ্য! আমাদের বাকী সেদিন কি তৃপ্তির আশ্বাদ পায়নি? তার পবিত্র আত্মা কি বলে দেয়নি, তুমি তোমার রক্ত দিয়ে যে পবিত্র বীজ রোপণ করে গেলে, তাই একদিন অঙ্কুরিত হবে স্বাধীনতার জয়গান গেয়ে। শহীদ বাকীর ছোটবেলা থেকেই স্বাদ ছিল, তিনি দৈনিক হবেন। পরবর্তীকালে সার্থক আত্মার স্বাদ মিটিয়েছিলেন বাংলার স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। সৈনিক হতে গিয়ে বাকী আজ নেই। তাঁর আদর্শ, তাঁর চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে স্বপ্নের সোনার বাংলাকে গড়ব—এই আমাদের একমাত্র আশা। এই মহান দেশপ্রেমিককে আজিমপুর কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়। ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৩ সাল বাংলাদেশ সরকারের গেজেটে বাকীকে ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য মাকে লেখা বাকির চিঠি
১৮/৪/’৭১
মা,
আপনি এবং বাসার সবাইকে সালাম জানিয়ে বলছি, দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে আমি ঘরে বসে থাকতে পারি না। তাই ঢাকার আরও ২০টা যুবকের সঙ্গে আমিও পথ ধরেছি ওপার বাংলায়। মা, তুমি কেঁদো না, দেশের জন্য এটা খুব ন্যূনতম চেষ্টা। মা, তুমি এ দেশ স্বাধীনের জন্য দোয়া করো। চিন্তা করো না, আমি ইনশাল্লাহ বেঁচে আসব। আমি ৭ দিনের মধ্যেই ফিরে আসতে পারি, কি বেশিও লাগতে পারে। তোমার চরণ মা, করিব স্মরণ। আগামীতে সবার কুশল কামনা করে খোদা হাফেজ জানাচ্ছি।
তোমারই বাকী (সাজু)
মঞ্জুর-উর-রহমান
ভারতে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়ে দিনের বেলায় ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যস্ততম এলাকা মতিঝিলে কিছু লক্ষ্যবস্তুর ওপর বোমা মেরে পৃথিবীকে জানিয়ে দেন বাঙালিরা ভীরু নয়। চাকুলিয়ায় ট্রেনিং গ্রহণ করে বিরাট এক দলের ইউনিট কমান্ডের গুরুদায়িত্ব নিয়ে দেশে ফিরে এলেন বাকী। একের পর এক আঘাত হানতে থাকলেন। উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বোমার আঘাতে উড়িয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তান সরকারের নথিপত্রে ঠাসা কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভবন। ওই সব অপারেশন করার সময় হঠাৎ একদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়লেন বাকী। কিন্তু কৌশলে নিজেকে মুক্ত করে পালিয়ে এলেন।
বাকী ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে ইউনিট কমান্ডার ছিলেন। আবদুল্লাহ-হিল-বাকীর নামেই ইউনিটের নামকরণ করা হয়েছিল ‘বাকী ইউনিট’। বাকীর গেরিলা ইউনিট শেষবারের মতো এসে হাজির হলো ঢাকার উপকণ্ঠে। তাঁর সহযোদ্ধাদের মধ্যে ইসমাইল হোসেন (বেঙ্গল), শহীদ শফিক, বাবুল, লুৎফর, আতিক, নান্টু, জাহাঙ্গীর, নীলুসহ নাম না জানা অনেকে। সেদিন রাতেই ছিল নির্ধারিত অপারেশন। ঢাকার খিলগাঁও তালতলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে হঠাৎ করে বাকী এসে হাজির হলেন তাঁর বাবা-মায়ের সামনে। বিদায় মুহূর্তে, বেশ অনেক দিন পর বাসায় এসে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বাবা আপনি খুশি হননি?’। বাবা তখন বলেছিলেন, ‘আমার ছেলে যে বাংলার জন্য নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধ করে যাচ্ছে, তারই সাফল্য দেখে পৃথিবীতে আমার চেয়ে কে বেশি সুখী হতে পারে!’
বাবার কাছ থেকে আশীর্বাদ নিয়ে চলে গেলেন বাকী তাঁর আস্তানায়, কিন্তু ফিরে এসেও স্থির হয়ে থাকতে পারলেন না। সহযোদ্ধাদের উঠিয়ে নিয়ে এলেন শহরের উপকণ্ঠে। রাতের অভিযানে বাকী তাঁর সহযোগীদের নিয়ে এগিয়ে চলছেন, এমন সময় আঁধারের কঠিন রূঢ়তা ছেদ করে কোথা হতে একঝাঁক গুলি চলে গেল ওদের মাথার ওপর দিয়ে। দুটি বুলেট এসে বিদ্ধ হলো বাকীর পবিত্র মাথায় ও তাঁর সহকারী বাবুলের। অন্য যোদ্ধারা কোনো রকমে আত্মরক্ষা করলেন। তখনো বাকীর প্রাণ চলে যায়নি সত্যের এই পৃথিবী থেকে। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম বাকীর পরিচয় জানতে চাইল। তাঁর আস্তানার হদিস বলতে বলল। বাকী নীরব, চোখে অশ্রু নেই। উত্তর না পেয়ে তাঁর পাঁজড়ে বেয়নেট চার্জ করে নিষ্ঠুরভাবে আঘাত হানল।
পরদিন ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১। একাত্তরের বিজয় দিবসের মাত্র ১১ দিন আগে ঢাকার খিলগাঁও এলাকার রেললাইনের পাশে একটি পুলের নিচের জলাভূমিতে পড়ে থাকা বেয়নটের খোঁচায় খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত দুই বীর মুক্তিযোদ্ধার লাশ দেখে এলাকাবাসী শিউরে উঠল। কী বীভৎস এই দৃশ্য! আমাদের বাকী সেদিন কি তৃপ্তির আশ্বাদ পায়নি? তার পবিত্র আত্মা কি বলে দেয়নি, তুমি তোমার রক্ত দিয়ে যে পবিত্র বীজ রোপণ করে গেলে, তাই একদিন অঙ্কুরিত হবে স্বাধীনতার জয়গান গেয়ে। শহীদ বাকীর ছোটবেলা থেকেই স্বাদ ছিল, তিনি দৈনিক হবেন। পরবর্তীকালে সার্থক আত্মার স্বাদ মিটিয়েছিলেন বাংলার স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। সৈনিক হতে গিয়ে বাকী আজ নেই। তাঁর আদর্শ, তাঁর চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে স্বপ্নের সোনার বাংলাকে গড়ব—এই আমাদের একমাত্র আশা। এই মহান দেশপ্রেমিককে আজিমপুর কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়। ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৩ সাল বাংলাদেশ সরকারের গেজেটে বাকীকে ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য মাকে লেখা বাকির চিঠি
১৮/৪/’৭১
মা,
আপনি এবং বাসার সবাইকে সালাম জানিয়ে বলছি, দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে আমি ঘরে বসে থাকতে পারি না। তাই ঢাকার আরও ২০টা যুবকের সঙ্গে আমিও পথ ধরেছি ওপার বাংলায়। মা, তুমি কেঁদো না, দেশের জন্য এটা খুব ন্যূনতম চেষ্টা। মা, তুমি এ দেশ স্বাধীনের জন্য দোয়া করো। চিন্তা করো না, আমি ইনশাল্লাহ বেঁচে আসব। আমি ৭ দিনের মধ্যেই ফিরে আসতে পারি, কি বেশিও লাগতে পারে। তোমার চরণ মা, করিব স্মরণ। আগামীতে সবার কুশল কামনা করে খোদা হাফেজ জানাচ্ছি।
তোমারই বাকী (সাজু)
মঞ্জুর-উর-রহমান
No comments