বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চেয়ে প্রস্তাব নেওয়া উচিত by হামিদ মীর
১৯৭১ সালে সামরিক অভিযান চালিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জনগণের কাছে কেন ক্ষমা চাওয়া উচিত পাকিস্তানের? সেনা অভিযানের জন্য?
সম্প্রতি বাংলাদেশের মিরপুরে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের খেলাকে ঘিরে এ নতুন বিতর্কের জন্ম হয়েছে। স্পর্শকাতর এই বিতর্কের সূত্রপাত করেছেন পাকিস্তানের তরুণদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদ হওয়া ইমরান খান।
ইমরান খান এ কারণে জনপ্রিয় নন যে তাঁর অধিনায়কত্বে ১৯৯২ সালে পাকিস্তান বিশ্বকাপ জিতেছে। তিনি জনপ্রিয় তাঁর ক্যানসার হাসপাতালের জন্য, গ্রামীণ এলাকায় তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য, সেনাশাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফের বিরুদ্ধে তাঁর সোচ্চার ভূমিকার জন্য। মোশাররফ এ জন্য ২০০৭ সালে তাঁকে জেলে পুরেছিলেন। আশ্চর্যের যে ইমরান খান ২৩ মার্চ এ বিতর্কের সূত্রপাত করেন। বাংলাদেশের খুব কম লোকই ২৩ মার্চের গুরুত্ব জানেন। এটাও কাকতালীয় যে মিরপুর স্টেডিয়াম যাঁর নামে তাঁর নামও অধিকাংশ পাকিস্তানিদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস। এ দিন সরকারি ছুটি। এবার সবাই বসে ছিলেন টেলিভিশন সেটের সামনে। ৭১ বছর আগে অভিভক্ত বাংলার প্রথম মুসলমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেরেবাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক লাহোরে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সম্মেলনে উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা আবাসভূমির দাবিতে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। আর ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান নামের একটি আলাদা আবাসভূমির জন্ম হয়। শেরেবাংলা ১৯৬২ সালে মারা যান। কিন্তু ইসলামাবাদের মানুষ এখনো তাঁর নামের সঙ্গে পরিচিত। জিয়ো টিভির কার্যালয়গুলো এবং জং গোষ্ঠীর সংবাদপত্রগুলো করাচির এ কে ফজলুল হক সড়কে অবস্থিত।
২৩ মার্চ মিরপুরের শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে পাকিস্তান ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে খেলছিল। জিয়ো নিউজ বারবার শেরেবাংলার সাদাকালো ছবিটি দেখাচ্ছিল। এ ছবি পাকিস্তানের অনেক শিক্ষার্থীর কাছেও পরিচিত। কারণ, তারা এ ছবি তাদের পড়ার বইয়ে দেখে। মিরপুরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তানের মধ্যে ওই ম্যাচের কয়েক মিনিট আগে জিয়ো নিউজ ও জিয়ো সুপারে প্রচারিত একটি বিশেষ সরাসরি টিভি অনুষ্ঠানে আমি ইমরান খানের সঙ্গে কথা বলছিলাম। একই অনুষ্ঠানে কয়েক দিন আগে ইমরান খান আমাকে বলেছিলেন যে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে পাকিস্তান সহজেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারাতে পারবে। ২৩ মার্চ পাকিস্তান ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হয়েছে। আমি এই ক্রিকেট-কিংবদন্তিকে জিজ্ঞেস করেছি, তাঁর কী ধারণা? ইমরান খান হাসতে হাসতে বলেছেন, ‘পাকিস্তানের অধিনায়ক শহীদ আফ্রিদি তার দলে অবশ্যই তিনজন স্পিনারকে অন্তর্ভুক্ত করবে এবং আমরা এই ম্যাচটি সহজেই জিতব।’ আমি তাঁকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, কেন? ইমরান বললেন, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ স্পিনে বেশ দুর্বল। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানিরা সেখানে নিজেদের মাঠ বলেই মনে করবে। কারণ, বাংলাদেশি দর্শকেরা আমাদের দলকে সমর্থন করবে।’ আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন তারা আমাদের সমর্থন দেবে?’ ইমরান খান বললেন, বাংলাদেশিরা ক্রিকেটপ্রিয় জাতি এবং তিনি নিজেও ঢাকায় তাঁর ক্রিকেট খেলার সময় তাঁদের ভালোবাসা পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আজ আমরা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেব। কয়েক দিন আগেই একই স্টেডিয়ামে তারা আমাদের ভাইদের হারিয়েছে।’
ইমরান খান এটা বারবার বলেছেন, ‘তারা আমাদের ভাইবোন, তারা আমাদের সমর্থন করবে।’ আমি তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কি মনে করেন না, ১৯৭১ সালে সেনা অভিযানের সময় সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের জন্য এখনই আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার সময়। ইমরান খান স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাকে অবাক করে উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, বাংলাদেশিদের কাছে পাকিস্তানের অবশ্যই ক্ষমা চাওয়া উচিত।’ তিনি জানতেন এটা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটা পুরোনো দাবি। তিনি আরও বললেন, তিনি ১৯৭১ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে লাহোরের অনূর্ধ্ব ১৯ ক্রিকেট দলের হয়ে ঢাকার অনূর্ধ্ব ১৯ ক্রিকেট দলের সঙ্গে একটি ম্যাচ খেলেছেন। ওই দলের তরুণ খেলোয়াড়েরা তাঁকে বলেছেন যে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি বেশ আতঙ্কজনক। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ এ সম্পর্কে অবগত নয়। এটাই ছিল তাদের সঙ্গে তাঁর শেষ কথোপকথন। এর কয়েক মাস পর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি ইংল্যান্ডে চলে যান এবং সেখানে বসে তিনি যাঁরা প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরিচালিত হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে জানতে পারেন। তিনি বলেন, সেই সেনা অভিযান কেবল ঘৃণা ও বেদনা সৃষ্টি করেছে। এটা ছিল একটা অপরাধ, এটা ছিল একটা গুরুতর ভুল। ইমরান বলছিলেন, ‘আমাদের অবশ্যই ক্ষমা চাওয়া উচিত, অতীত ভুলত্রুটি থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত এবং বেলুচিস্তান ও আদিবাসী এলাকায় সেনা অভিযান বন্ধ করা উচিত।’
মিরপুরে ক্রিকেট ম্যাচ শুরু হওয়ার সময় আমাদের এই লাইভ শো শেষ হয়। আমরা স্টুডিও থেকে বের হয়ে পড়ি এবং উভয়েই মুঠোফোনে খুদেবার্তা ও কল পেতে শুরু করলাম। অধিকাংশ পাকিস্তানি ইমরান খানের দাবিকে সমর্থন ও সাধুবাদ জানিয়েছেন। তবে তাঁদের অনেকে ছিলেন বিভ্রান্ত। তাঁরা জিজ্ঞেস করেছেন, ১৯৭১ সালে আসলে কী ঘটেছিল? দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তানের অনেকে শেরেবাংলা সম্পর্কে জানে। তবে তারা জানে না, কেন এবং কীভাবে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল? আল্লাহকে ধন্যবাদ এ জন্য যে টিভি চ্যানেলে ইমরান খানের ছোট একটি বক্তব্য পাকিস্তানি তরুণদের মধ্যে নতুন করে বিতর্ক শুরু করে দিয়েছে। পাকপ্যাশন ডট নেটসহ অধিকাংশ ব্লগে পাকিস্তানি ক্রিকেট দলের সমর্থনে গঠিত সমর্থকেরা এই বিতর্ক শুরু করেছে যে কেন পাকিস্তানকে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে?
অধিকাংশ পাকিস্তানি এখন অনুধাবন করছে, আমাদের অবশ্যই বাংলাদেশি ভাইবোনদের কাছে সামরিক স্বৈরশাসকদের অতীত অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। কারণ, দুর্ভাগ্যবশত আমাদের চার সামরিক স্বৈরশাসকের কেউ তাঁদের অপরাধের জন্য শাস্তি পাননি। তাঁরা ১৯৭১ সালে বাঙালিদের হত্যা করেছিলেন। ১৯৮৩ সালে সিন্ধুতে, ২০০৬ সালে বেলুচিস্তানে এবং তারপর ২০০৭ সালে পাখতুনে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছেন। পাকিস্তানের গণতন্ত্রপ্রেমী কেউ এই কসাইদের অতীত অপরাধের পক্ষে অবস্থান নেবে না। তাঁরা বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয়েরই শত্রু। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের সময় কাটিয়ে আসা পাকিস্তানের অনেক অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, আমলা ও সিনিয়র সাংবাদিক ইমরান খানের দাবিকে সমর্থন করছেন। সামরিক প্রতিষ্ঠানের ঘনিষ্ঠ কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশিরা ১৯৭১ সালের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে অতিরঞ্জিত করেছে। তাদের একজন আমাকে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতীয় বাঙালি লেখক শর্মিলা বসুর (সুভাষ চন্দ্র বসুর আত্মীয়) সর্বশেষ গবেষণা ইন্টারনেটে পড়ে দেখো। তিনি (শর্মিলা) ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও ধর্ষণের সব অভিযোগকে স্পষ্টত অস্বীকার করেছেন।’
আমি এসব লোককে অনুরোধ করেছি, এটি পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বিষয়। এখানে একজন ভারতীয়কে টেনে আনবেন না। কেন তিনি (শর্মিলা বসু) ওয়াশিংটনের উইড্র উইলস সেন্টার (Woodrow Wilson Center) দ্বারা পরিচালিত হচ্ছেন? কেন তিনি আমেরিকানদের পৃষ্ঠপোষকতা উপভোগ করেন? ১৯৭১ সালে বেসামরিক মানুষ নিহত হওয়ার সংখ্যা নিয়ে আমার মতপার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু সেনা অভিযানে ১৯৭১ সালে বহুসংখ্যক নিরপরাধ মানুষ নিহত হয়েছে—আমরা এটা অস্বীকার করতে পারি না। বেলুচিস্তান ও পশতু আদিবাসী এলাকার যাদের সঙ্গে আমি সাক্ষাৎ করেছি, তাদের প্রত্যেকে আমাকে বলেছে, কীভাবে তাদের প্রিয় মানুষগুলো সেনা অভিযানে নিহত হয়েছে। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর গোলাবর্ষণে গত বছর খাইবার এলাকার তিরাহ (Tirah) উপত্যকায় ৫০ জন নিরপরাধ মানুষ নিহত হয়েছিল। পরের দিন আমাদের সেনাপ্রধান নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। আমরা এখনো সামরিক অভিযানের নামে গুরুতর ভুল করছি। কীভাবে আমরা ১৯৭১ সালে গুরুতর ভুলের বিষয় অস্বীকার করতে পারি?
আমি মনে করি, সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানির উচিত সরকারের কাছে চিঠি লেখা যে ২৩ মার্চ মিরপুরে যাঁরা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সমর্থন দিয়ে আমাদের হূদয়-মন জয় করেছেন, তাঁদের কাছে পাকিস্তানকে অবশ্যই ক্ষমা চাইতে হবে। এ ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি আমাদের দুর্বল করবে না; বরং আমাদের শক্তিশালী করবে।
৩০ মার্চ যখন আমাদের ক্রিকেট দল মোহালিতে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষে খেলবে, তখন আমরা বাংলাদেশি সমর্থকদের অনুভব করব। এখনই সময় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পার্থক্য করা। ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে আমরা অনেক কিছু করতে প্রস্তুত। সাবেক স্বৈরশাসক পারভেজ মোশাররফ কাশ্মীর বিষয়ে জাতিসংঘের প্রস্তাবও ভুলে যেতে প্রস্তুত ছিলেন। আর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের কাছে কেবল ক্ষমাসূচক কিছু শব্দ দাবি করা হয়েছে। যা এক ভাইয়ের কাছে আরেক ভাইয়ের ক্ষমা চাওয়ার মতো। তারা এখনো আমাদের ভালোবাসে। বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে অবশ্যই একটি প্রস্তাব পাস করা উচিত। আজ ২৬ মার্চ যারা স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন করছে, এ প্রস্তাব তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে দৃঢ় করবে। আমার বাংলাদেশি ভাইবোনদের প্রতি রইল স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা। ৩০ মার্চ ভারতে তোমাদের অভাব অনুভব করব আমরা।
ইংরেজি থেকে অনূদিত সাইফুল সামিন এবং এ এইচ এম ইয়াসিন।
হামিদ মীর: পাকিস্তানের জিয়ো নিউজের নির্বাহী সম্পাদক।
সম্প্রতি বাংলাদেশের মিরপুরে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের খেলাকে ঘিরে এ নতুন বিতর্কের জন্ম হয়েছে। স্পর্শকাতর এই বিতর্কের সূত্রপাত করেছেন পাকিস্তানের তরুণদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদ হওয়া ইমরান খান।
ইমরান খান এ কারণে জনপ্রিয় নন যে তাঁর অধিনায়কত্বে ১৯৯২ সালে পাকিস্তান বিশ্বকাপ জিতেছে। তিনি জনপ্রিয় তাঁর ক্যানসার হাসপাতালের জন্য, গ্রামীণ এলাকায় তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য, সেনাশাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফের বিরুদ্ধে তাঁর সোচ্চার ভূমিকার জন্য। মোশাররফ এ জন্য ২০০৭ সালে তাঁকে জেলে পুরেছিলেন। আশ্চর্যের যে ইমরান খান ২৩ মার্চ এ বিতর্কের সূত্রপাত করেন। বাংলাদেশের খুব কম লোকই ২৩ মার্চের গুরুত্ব জানেন। এটাও কাকতালীয় যে মিরপুর স্টেডিয়াম যাঁর নামে তাঁর নামও অধিকাংশ পাকিস্তানিদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস। এ দিন সরকারি ছুটি। এবার সবাই বসে ছিলেন টেলিভিশন সেটের সামনে। ৭১ বছর আগে অভিভক্ত বাংলার প্রথম মুসলমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেরেবাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক লাহোরে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সম্মেলনে উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা আবাসভূমির দাবিতে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। আর ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান নামের একটি আলাদা আবাসভূমির জন্ম হয়। শেরেবাংলা ১৯৬২ সালে মারা যান। কিন্তু ইসলামাবাদের মানুষ এখনো তাঁর নামের সঙ্গে পরিচিত। জিয়ো টিভির কার্যালয়গুলো এবং জং গোষ্ঠীর সংবাদপত্রগুলো করাচির এ কে ফজলুল হক সড়কে অবস্থিত।
২৩ মার্চ মিরপুরের শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে পাকিস্তান ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে খেলছিল। জিয়ো নিউজ বারবার শেরেবাংলার সাদাকালো ছবিটি দেখাচ্ছিল। এ ছবি পাকিস্তানের অনেক শিক্ষার্থীর কাছেও পরিচিত। কারণ, তারা এ ছবি তাদের পড়ার বইয়ে দেখে। মিরপুরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তানের মধ্যে ওই ম্যাচের কয়েক মিনিট আগে জিয়ো নিউজ ও জিয়ো সুপারে প্রচারিত একটি বিশেষ সরাসরি টিভি অনুষ্ঠানে আমি ইমরান খানের সঙ্গে কথা বলছিলাম। একই অনুষ্ঠানে কয়েক দিন আগে ইমরান খান আমাকে বলেছিলেন যে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে পাকিস্তান সহজেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারাতে পারবে। ২৩ মার্চ পাকিস্তান ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হয়েছে। আমি এই ক্রিকেট-কিংবদন্তিকে জিজ্ঞেস করেছি, তাঁর কী ধারণা? ইমরান খান হাসতে হাসতে বলেছেন, ‘পাকিস্তানের অধিনায়ক শহীদ আফ্রিদি তার দলে অবশ্যই তিনজন স্পিনারকে অন্তর্ভুক্ত করবে এবং আমরা এই ম্যাচটি সহজেই জিতব।’ আমি তাঁকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, কেন? ইমরান বললেন, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ স্পিনে বেশ দুর্বল। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানিরা সেখানে নিজেদের মাঠ বলেই মনে করবে। কারণ, বাংলাদেশি দর্শকেরা আমাদের দলকে সমর্থন করবে।’ আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন তারা আমাদের সমর্থন দেবে?’ ইমরান খান বললেন, বাংলাদেশিরা ক্রিকেটপ্রিয় জাতি এবং তিনি নিজেও ঢাকায় তাঁর ক্রিকেট খেলার সময় তাঁদের ভালোবাসা পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আজ আমরা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেব। কয়েক দিন আগেই একই স্টেডিয়ামে তারা আমাদের ভাইদের হারিয়েছে।’
ইমরান খান এটা বারবার বলেছেন, ‘তারা আমাদের ভাইবোন, তারা আমাদের সমর্থন করবে।’ আমি তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কি মনে করেন না, ১৯৭১ সালে সেনা অভিযানের সময় সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের জন্য এখনই আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার সময়। ইমরান খান স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাকে অবাক করে উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, বাংলাদেশিদের কাছে পাকিস্তানের অবশ্যই ক্ষমা চাওয়া উচিত।’ তিনি জানতেন এটা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটা পুরোনো দাবি। তিনি আরও বললেন, তিনি ১৯৭১ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে লাহোরের অনূর্ধ্ব ১৯ ক্রিকেট দলের হয়ে ঢাকার অনূর্ধ্ব ১৯ ক্রিকেট দলের সঙ্গে একটি ম্যাচ খেলেছেন। ওই দলের তরুণ খেলোয়াড়েরা তাঁকে বলেছেন যে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি বেশ আতঙ্কজনক। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ এ সম্পর্কে অবগত নয়। এটাই ছিল তাদের সঙ্গে তাঁর শেষ কথোপকথন। এর কয়েক মাস পর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি ইংল্যান্ডে চলে যান এবং সেখানে বসে তিনি যাঁরা প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরিচালিত হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে জানতে পারেন। তিনি বলেন, সেই সেনা অভিযান কেবল ঘৃণা ও বেদনা সৃষ্টি করেছে। এটা ছিল একটা অপরাধ, এটা ছিল একটা গুরুতর ভুল। ইমরান বলছিলেন, ‘আমাদের অবশ্যই ক্ষমা চাওয়া উচিত, অতীত ভুলত্রুটি থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত এবং বেলুচিস্তান ও আদিবাসী এলাকায় সেনা অভিযান বন্ধ করা উচিত।’
মিরপুরে ক্রিকেট ম্যাচ শুরু হওয়ার সময় আমাদের এই লাইভ শো শেষ হয়। আমরা স্টুডিও থেকে বের হয়ে পড়ি এবং উভয়েই মুঠোফোনে খুদেবার্তা ও কল পেতে শুরু করলাম। অধিকাংশ পাকিস্তানি ইমরান খানের দাবিকে সমর্থন ও সাধুবাদ জানিয়েছেন। তবে তাঁদের অনেকে ছিলেন বিভ্রান্ত। তাঁরা জিজ্ঞেস করেছেন, ১৯৭১ সালে আসলে কী ঘটেছিল? দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তানের অনেকে শেরেবাংলা সম্পর্কে জানে। তবে তারা জানে না, কেন এবং কীভাবে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল? আল্লাহকে ধন্যবাদ এ জন্য যে টিভি চ্যানেলে ইমরান খানের ছোট একটি বক্তব্য পাকিস্তানি তরুণদের মধ্যে নতুন করে বিতর্ক শুরু করে দিয়েছে। পাকপ্যাশন ডট নেটসহ অধিকাংশ ব্লগে পাকিস্তানি ক্রিকেট দলের সমর্থনে গঠিত সমর্থকেরা এই বিতর্ক শুরু করেছে যে কেন পাকিস্তানকে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে?
অধিকাংশ পাকিস্তানি এখন অনুধাবন করছে, আমাদের অবশ্যই বাংলাদেশি ভাইবোনদের কাছে সামরিক স্বৈরশাসকদের অতীত অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। কারণ, দুর্ভাগ্যবশত আমাদের চার সামরিক স্বৈরশাসকের কেউ তাঁদের অপরাধের জন্য শাস্তি পাননি। তাঁরা ১৯৭১ সালে বাঙালিদের হত্যা করেছিলেন। ১৯৮৩ সালে সিন্ধুতে, ২০০৬ সালে বেলুচিস্তানে এবং তারপর ২০০৭ সালে পাখতুনে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছেন। পাকিস্তানের গণতন্ত্রপ্রেমী কেউ এই কসাইদের অতীত অপরাধের পক্ষে অবস্থান নেবে না। তাঁরা বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয়েরই শত্রু। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের সময় কাটিয়ে আসা পাকিস্তানের অনেক অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, আমলা ও সিনিয়র সাংবাদিক ইমরান খানের দাবিকে সমর্থন করছেন। সামরিক প্রতিষ্ঠানের ঘনিষ্ঠ কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশিরা ১৯৭১ সালের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে অতিরঞ্জিত করেছে। তাদের একজন আমাকে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতীয় বাঙালি লেখক শর্মিলা বসুর (সুভাষ চন্দ্র বসুর আত্মীয়) সর্বশেষ গবেষণা ইন্টারনেটে পড়ে দেখো। তিনি (শর্মিলা) ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও ধর্ষণের সব অভিযোগকে স্পষ্টত অস্বীকার করেছেন।’
আমি এসব লোককে অনুরোধ করেছি, এটি পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বিষয়। এখানে একজন ভারতীয়কে টেনে আনবেন না। কেন তিনি (শর্মিলা বসু) ওয়াশিংটনের উইড্র উইলস সেন্টার (Woodrow Wilson Center) দ্বারা পরিচালিত হচ্ছেন? কেন তিনি আমেরিকানদের পৃষ্ঠপোষকতা উপভোগ করেন? ১৯৭১ সালে বেসামরিক মানুষ নিহত হওয়ার সংখ্যা নিয়ে আমার মতপার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু সেনা অভিযানে ১৯৭১ সালে বহুসংখ্যক নিরপরাধ মানুষ নিহত হয়েছে—আমরা এটা অস্বীকার করতে পারি না। বেলুচিস্তান ও পশতু আদিবাসী এলাকার যাদের সঙ্গে আমি সাক্ষাৎ করেছি, তাদের প্রত্যেকে আমাকে বলেছে, কীভাবে তাদের প্রিয় মানুষগুলো সেনা অভিযানে নিহত হয়েছে। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর গোলাবর্ষণে গত বছর খাইবার এলাকার তিরাহ (Tirah) উপত্যকায় ৫০ জন নিরপরাধ মানুষ নিহত হয়েছিল। পরের দিন আমাদের সেনাপ্রধান নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। আমরা এখনো সামরিক অভিযানের নামে গুরুতর ভুল করছি। কীভাবে আমরা ১৯৭১ সালে গুরুতর ভুলের বিষয় অস্বীকার করতে পারি?
আমি মনে করি, সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানির উচিত সরকারের কাছে চিঠি লেখা যে ২৩ মার্চ মিরপুরে যাঁরা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সমর্থন দিয়ে আমাদের হূদয়-মন জয় করেছেন, তাঁদের কাছে পাকিস্তানকে অবশ্যই ক্ষমা চাইতে হবে। এ ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি আমাদের দুর্বল করবে না; বরং আমাদের শক্তিশালী করবে।
৩০ মার্চ যখন আমাদের ক্রিকেট দল মোহালিতে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষে খেলবে, তখন আমরা বাংলাদেশি সমর্থকদের অনুভব করব। এখনই সময় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পার্থক্য করা। ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে আমরা অনেক কিছু করতে প্রস্তুত। সাবেক স্বৈরশাসক পারভেজ মোশাররফ কাশ্মীর বিষয়ে জাতিসংঘের প্রস্তাবও ভুলে যেতে প্রস্তুত ছিলেন। আর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের কাছে কেবল ক্ষমাসূচক কিছু শব্দ দাবি করা হয়েছে। যা এক ভাইয়ের কাছে আরেক ভাইয়ের ক্ষমা চাওয়ার মতো। তারা এখনো আমাদের ভালোবাসে। বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে অবশ্যই একটি প্রস্তাব পাস করা উচিত। আজ ২৬ মার্চ যারা স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন করছে, এ প্রস্তাব তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে দৃঢ় করবে। আমার বাংলাদেশি ভাইবোনদের প্রতি রইল স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা। ৩০ মার্চ ভারতে তোমাদের অভাব অনুভব করব আমরা।
ইংরেজি থেকে অনূদিত সাইফুল সামিন এবং এ এইচ এম ইয়াসিন।
হামিদ মীর: পাকিস্তানের জিয়ো নিউজের নির্বাহী সম্পাদক।
No comments