বাংলাদেশের ইতি-নেতি by জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী
আমরা
স্বাধীনতার ৪০ বছর উদ্যাপন করছি। এই মুহূর্তে আমাদের আত্মজিজ্ঞাসার
প্রয়োজন যে আমরা কী করতে পারিনি, কী করতে পেরেছি। গত ৪০ বছরে নানা ক্ষেত্রে
আমাদের বেশ কিছু অর্জন আছে। শিক্ষার প্রসার ঘটেছে। নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক সাফল্য এসেছে। বহির্বিশ্বে আমাদের পদচারণ বেড়েছে।
বাঙালির জন্য বাইরের দরজা খুলে গেছে। তারা নিজেদের জীবন-জীবিকা নিশ্চিত
করার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকেও পরিপুষ্ট করছে। এসবই স্বাধীনতার সুফল।
কিন্তু ১৯৭১ থেকে ২০১১—এই ৪০ বছরে আরেকটি নেতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করলাম, সেটি হলো নৈতিকতার অধঃপতন। স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের রাজনীতি, সমাজ, শিক্ষাঙ্গন—সর্বত্র নৈতিকতার সর্বগ্রাসী অবক্ষয় লক্ষ করা গেছে। স্বাধীনতার সময়ে আমাদের মনে উত্তুঙ্গ আশা ছিল দেশটি নতুন করে গড়ার। যেভাবে আমরা গড়তে চেয়েছি, সেভাবে গড়তে পারিনি। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাফল্য-ব্যর্থতা কিংবা কতটা দারিদ্র্য বিমোচন হয়েছে, তার চুলচেরা বিশ্লেষণে আমি যাব না। এ ক্ষেত্রে ইতি-নেতি দুটোই আছে। কিন্তু একটি বিষয়ের ব্যাখ্যা আমি খুঁজে পাই না—সেটি হলো নীতি-নৈতিকতার সমূহ পতন কেন ঘটল?
আমরা দেখেছি, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের যে অভিঘাত আমাদের সমাজে পড়েছিল, তা নৈতিকতাকে অনেকখানি নাড়িয়ে দিয়েছে। এরপর সাতচল্লিশের দেশভাগ এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও আরেকবার অভিঘাত সৃষ্টি করে। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তো ছিল নৈতিক মানদণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের এবং অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর কেন আমরা নৈতিকতার যুদ্ধে হেরে যাব?
গত ৪০ বছরে বেসরকারি ক্ষেত্রে অনেক অর্জন আছে। ওষুধশিল্পের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। তৈরি পোশাক খাতে আমাদের অগ্রগতিও বিশাল। বিদেশে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক সমাদৃত। এর পাশাপাশি আমরা সাহিত্য, নাটক, চিত্রকলাও দেশের বাইরে ছড়িয়ে দিতে পেরেছি। ক্রিকেট নিয়ে আমাদের গর্বের সীমা নেই। আমাদের ক্রিকেট দল যখন জয়ী হয় তখন সারা দেশ আনন্দে ভাসে, যখন পরাজিত হয়, দুঃখ-কষ্টের শেষ থাকে না। এই আবেগ আমরা জাতির চিন্তা-চেতনা তথা মানস গঠনেও কাজে লাগাতে পারি।
আমার একটা বিষয় মনে হয়, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি উন্নত মানের হতেন, তাহলে আমরা আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতাম। গত ৪০ বছরে সে ধরনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব আমরা পাইনি।
শিক্ষার মানেরও মারাত্মক অবনতি হয়েছে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য শিক্ষাই হলো প্রধান শক্তি। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে মধ্যবিত্ত বাঙালি যে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করতে পেরেছিল, তা তো শিক্ষার কারণেই।
আরেকটি কথা, স্বাধীনতার পর আমাদের মধ্যবিত্তের চিত্তের প্রসার না ঘটলেও বিত্তের প্রসার ঘটেছে। এই যে রাতারাতি কিছু মানুষ অনেক বিত্তের মালিক হয়েছেন। তাঁরা কীভাবে ধনসম্পদ বাড়ালেন, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। আর এভাবে যাঁরা ধনী হন, তাঁরা প্রচণ্ডভাবে ভোগবাদী হন, দেশ ও সমাজের কথা ভাবেন না।
নতুন প্রজন্মকে আমি খুব কাছ থেকে জানি না। তবু তাদের ব্যাপারে আশাবাদী। নতুন প্রজন্মের মধ্যে যদি এই ধারণা দেওয়া যায়—ভবিষ্যতে তারাই দেশকে নেতৃত্ব দেবে, তারা সুনাগরিক হিসেবে তৈরি হলে দেশ বদলাবে—তাহলে তারা নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবে। সুশিক্ষা ও নৈতিক শক্তিই পারে একটি জাতিকে এগিয়ে নিতে। মানুষ কতটা মানুষ, তাও নির্ভর করে এই নৈতিকতার ওপর।
প্রশ্ন হলো কোথায় তারা এই শিক্ষাটি পাবে। একটি হতে পারে বিদ্যায়ন, আরেকটি বিদ্যায়নের বাইরে। একসময় শিক্ষার্থীদের বইয়ের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। পাড়ায় পাড়ায় পাঠাগার ছিল। আমরা যেন এমন একটি পরিবেশ তৈরি করি, যাতে তরুণ প্রজন্ম বই ও জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী হয়। তাদের হাতে প্রচুর বই পৌঁছে দিতে হবে। বই মানুষকে আত্মশক্তি জোগায়। পাড়ায় পাড়ায় ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি গড়ে তোলা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কাজ হয়নি। আমরা আশা করব, ভবিষ্যতে হবে।
বর্তমানে শিক্ষাঙ্গনে লজ্জাজনকভাবে দলীয়করণ হচ্ছে। এ থেকে পিছিয়ে আসতে হলে শিক্ষক নিয়োগ থেকে প্রশাসন পরিচালনা—সর্বক্ষেত্রে মানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন শিক্ষককেই নিয়োগ করতে হবে, যিনি মানসম্পন্ন শিক্ষা দিতে সক্ষম। শিক্ষাঙ্গন হয়তো রাজনীতিমুক্ত করা যাবে না। তবে সেই রাজনীতি হবে নীতি ও আদর্শের। ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে যাতে শিক্ষাঙ্গন ব্যবহূত না হয়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
আরেকটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে। সব গণতান্ত্রিক সমাজেই সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজের একটি বড় ভূমিকা থাকে। তারা জাতিকে দিকনির্দেশনা দেবে। কারও প্রতি তাদের পক্ষপাত থাকবে না। সবকিছু নির্লিপ্ত ও নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখবে এবং সাহস করে সত্যের পক্ষে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশকে নিয়ে আমি এখনো স্বপ্ন দেখি। বাংলাদেশ যে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসবে—এটিই আমার প্রত্যাশা। আমরা যে যেখানে আছি, সেখান থেকেই দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। কিছু কিছু মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করা দরকার, যাতে অন্যরাও অনুপ্রাণিত হবে। সেই দৃষ্টান্ত সবার সামনে তুলে ধরতে হবে।
যাঁরা ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, সেসব কর্মবীরের চেতনা এবং প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারলে অন্যরাও গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে। কাদায় পড়া দেশটাও আবার দাঁড়িয়ে যাবে।
>>>জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: শিক্ষাবিদ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
কিন্তু ১৯৭১ থেকে ২০১১—এই ৪০ বছরে আরেকটি নেতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করলাম, সেটি হলো নৈতিকতার অধঃপতন। স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের রাজনীতি, সমাজ, শিক্ষাঙ্গন—সর্বত্র নৈতিকতার সর্বগ্রাসী অবক্ষয় লক্ষ করা গেছে। স্বাধীনতার সময়ে আমাদের মনে উত্তুঙ্গ আশা ছিল দেশটি নতুন করে গড়ার। যেভাবে আমরা গড়তে চেয়েছি, সেভাবে গড়তে পারিনি। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাফল্য-ব্যর্থতা কিংবা কতটা দারিদ্র্য বিমোচন হয়েছে, তার চুলচেরা বিশ্লেষণে আমি যাব না। এ ক্ষেত্রে ইতি-নেতি দুটোই আছে। কিন্তু একটি বিষয়ের ব্যাখ্যা আমি খুঁজে পাই না—সেটি হলো নীতি-নৈতিকতার সমূহ পতন কেন ঘটল?
আমরা দেখেছি, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের যে অভিঘাত আমাদের সমাজে পড়েছিল, তা নৈতিকতাকে অনেকখানি নাড়িয়ে দিয়েছে। এরপর সাতচল্লিশের দেশভাগ এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও আরেকবার অভিঘাত সৃষ্টি করে। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তো ছিল নৈতিক মানদণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের এবং অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর কেন আমরা নৈতিকতার যুদ্ধে হেরে যাব?
গত ৪০ বছরে বেসরকারি ক্ষেত্রে অনেক অর্জন আছে। ওষুধশিল্পের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। তৈরি পোশাক খাতে আমাদের অগ্রগতিও বিশাল। বিদেশে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক সমাদৃত। এর পাশাপাশি আমরা সাহিত্য, নাটক, চিত্রকলাও দেশের বাইরে ছড়িয়ে দিতে পেরেছি। ক্রিকেট নিয়ে আমাদের গর্বের সীমা নেই। আমাদের ক্রিকেট দল যখন জয়ী হয় তখন সারা দেশ আনন্দে ভাসে, যখন পরাজিত হয়, দুঃখ-কষ্টের শেষ থাকে না। এই আবেগ আমরা জাতির চিন্তা-চেতনা তথা মানস গঠনেও কাজে লাগাতে পারি।
আমার একটা বিষয় মনে হয়, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি উন্নত মানের হতেন, তাহলে আমরা আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতাম। গত ৪০ বছরে সে ধরনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব আমরা পাইনি।
শিক্ষার মানেরও মারাত্মক অবনতি হয়েছে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য শিক্ষাই হলো প্রধান শক্তি। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে মধ্যবিত্ত বাঙালি যে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করতে পেরেছিল, তা তো শিক্ষার কারণেই।
আরেকটি কথা, স্বাধীনতার পর আমাদের মধ্যবিত্তের চিত্তের প্রসার না ঘটলেও বিত্তের প্রসার ঘটেছে। এই যে রাতারাতি কিছু মানুষ অনেক বিত্তের মালিক হয়েছেন। তাঁরা কীভাবে ধনসম্পদ বাড়ালেন, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। আর এভাবে যাঁরা ধনী হন, তাঁরা প্রচণ্ডভাবে ভোগবাদী হন, দেশ ও সমাজের কথা ভাবেন না।
নতুন প্রজন্মকে আমি খুব কাছ থেকে জানি না। তবু তাদের ব্যাপারে আশাবাদী। নতুন প্রজন্মের মধ্যে যদি এই ধারণা দেওয়া যায়—ভবিষ্যতে তারাই দেশকে নেতৃত্ব দেবে, তারা সুনাগরিক হিসেবে তৈরি হলে দেশ বদলাবে—তাহলে তারা নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবে। সুশিক্ষা ও নৈতিক শক্তিই পারে একটি জাতিকে এগিয়ে নিতে। মানুষ কতটা মানুষ, তাও নির্ভর করে এই নৈতিকতার ওপর।
প্রশ্ন হলো কোথায় তারা এই শিক্ষাটি পাবে। একটি হতে পারে বিদ্যায়ন, আরেকটি বিদ্যায়নের বাইরে। একসময় শিক্ষার্থীদের বইয়ের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। পাড়ায় পাড়ায় পাঠাগার ছিল। আমরা যেন এমন একটি পরিবেশ তৈরি করি, যাতে তরুণ প্রজন্ম বই ও জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী হয়। তাদের হাতে প্রচুর বই পৌঁছে দিতে হবে। বই মানুষকে আত্মশক্তি জোগায়। পাড়ায় পাড়ায় ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি গড়ে তোলা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কাজ হয়নি। আমরা আশা করব, ভবিষ্যতে হবে।
বর্তমানে শিক্ষাঙ্গনে লজ্জাজনকভাবে দলীয়করণ হচ্ছে। এ থেকে পিছিয়ে আসতে হলে শিক্ষক নিয়োগ থেকে প্রশাসন পরিচালনা—সর্বক্ষেত্রে মানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন শিক্ষককেই নিয়োগ করতে হবে, যিনি মানসম্পন্ন শিক্ষা দিতে সক্ষম। শিক্ষাঙ্গন হয়তো রাজনীতিমুক্ত করা যাবে না। তবে সেই রাজনীতি হবে নীতি ও আদর্শের। ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে যাতে শিক্ষাঙ্গন ব্যবহূত না হয়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
আরেকটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে। সব গণতান্ত্রিক সমাজেই সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজের একটি বড় ভূমিকা থাকে। তারা জাতিকে দিকনির্দেশনা দেবে। কারও প্রতি তাদের পক্ষপাত থাকবে না। সবকিছু নির্লিপ্ত ও নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখবে এবং সাহস করে সত্যের পক্ষে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশকে নিয়ে আমি এখনো স্বপ্ন দেখি। বাংলাদেশ যে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসবে—এটিই আমার প্রত্যাশা। আমরা যে যেখানে আছি, সেখান থেকেই দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। কিছু কিছু মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করা দরকার, যাতে অন্যরাও অনুপ্রাণিত হবে। সেই দৃষ্টান্ত সবার সামনে তুলে ধরতে হবে।
যাঁরা ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, সেসব কর্মবীরের চেতনা এবং প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারলে অন্যরাও গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে। কাদায় পড়া দেশটাও আবার দাঁড়িয়ে যাবে।
>>>জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী: শিক্ষাবিদ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
No comments