রাজনৈতিক বিবেচনায়, না রাজনৈতিক প্রভাবে? by এ এম এম শওকত আলী
গত দুই বছর ধরে একটি উচ্চপর্যায়ের কেন্দ্রীয় কমিটি ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে দায়ের করা বিভিন্ন ধরনের ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিচ্ছে। এর মধ্যে দুর্নীতির মামলাও রয়েছে। এ কথা সত্য যে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা রুজু করা হয় তখনই, যখন রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়। এ অশুভ ধারার উৎপত্তি ১৯৫৮ সালের শাসনামলে প্রথম শুরু হয়। পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক শাসকেরাও একই অশুভ রীতি অনুসরণ করেছেন। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার অঙ্গীকার যে দুটি প্রধান দল করেছিল, তারাও একই রীতি কমবেশি অনুসরণ করে।
প্রচলিত আইনে প্রতিষ্ঠিত সরকার মামলা প্রত্যাহার করতে ক্ষমতাবান। তবে সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে সংশ্লিষ্ট আদালতের সম্মতি সাপেক্ষে। মামলা প্রত্যাহার-সংক্রান্ত বিধিবদ্ধ কাঠামো অনুযায়ী ইতিপূর্বে জেলা কমিটিই দায়িত্ব পালন করত। সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় তিন ব্যক্তির মধ্যে ছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা ডিসি, এসপি ও পিপি। এর মধ্যে এসপি ও পিপির মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হতো। এ দুই ব্যক্তির মধ্যে কোনো দ্বিমত না থাকলেই প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। তবে কোনো কোনো সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত গ্রহণ করে উপযুক্ত ক্ষেত্রে মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সাধারণত গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাব যেসব মামলায় রয়েছে, সেগুলোই প্রতিটি নিখুঁতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট আদালতে পেশ করা হতো। ২০০৯ সালে দেখা দিল রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের রেওয়াজ, যা আগে এ মাত্রায় ছিল না; যেমন ছিল না কোনো মন্ত্রীর নেতৃত্বে কোনো কেন্দ্রীয় কমিটি।
কেন্দ্রীয় কমিটি একাধিক দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহারের জন্য প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়ে দুদককে অবহিত করে। কারণ, আইন অনুযায়ী এ ধরনের মামলা প্রত্যাহারের এখতিয়ার দুদকের। দুদক আজ পর্যন্ত সরকারের গঠিত কমিটির সিদ্ধান্তের বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। জানা যায়, গত দুই বছরে ৩১৪টি দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহারের জন্য কমিটি দুদককে অনুরোধ জানিয়েছে। দুদকের প্রধান প্রকাশ্য উক্তি করেছেন, সব কটি মামলা পাওয়ার পরই তাঁরা এ বিষয়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত দেবেন। কয়েক দিন আগে কমিটি অতিরিক্ত ২৬টি দুর্নীতির মামলা দুদকে পাঠিয়েছে। এর ফলে মামলার মোট সংখ্যা হলো ৩৪০। সাংবাদিকেরা এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে প্রশ্ন করলে তিনি একটি গ্রহণযোগ্য উত্তর দেন। তাঁর মতে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে দুদকেরই আইনি ক্ষমতা রয়েছে। এখন বিষয়টি দুদকের।
দ্বিস্তরবিশিষ্ট কমিটি এখন পর্যন্ত প্রত্যাহার-সংক্রান্ত যেসব সিদ্ধান্ত দিয়েছে, তা নিয়ে মিডিয়ায় প্রশ্ন উঠেছে। মিডিয়ার ভাষায়, অনেক ক্ষেত্রেই কমিটির সিদ্ধান্ত প্রশ্নাতীত নয়, বরং প্রশ্নবিদ্ধ। প্রাসঙ্গিক প্রশ্নগুলো হলো—এক, কিছু ক্ষেত্রে জেলা কমিটির কোনো সুপারিশই ছিল না। তাদের অজান্তেই কেন্দ্রীয় কমিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। দুই, অনেক সাংঘাতিক ধরনের অপরাধের মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো সংবাদপত্র বলেছে, পরবর্তী পর্যায়ে এসব সিদ্ধান্ত রহিত করা হয়েছে। তবে বিষয়টি স্পষ্ট নয়। কারণ, নববর্ষের প্রথম দিনে এ-সম্পর্কিত আরও সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। যেমন—মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার আয়ুব আলী হত্যা মামলা। তিন, জানুয়ারির দুই তারিখে আরও সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। সংবাদে বলা হয়েছে, খুনসহ ৫২টি মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত দিয়েছে কমিটি। এসব মামলা দীর্ঘ সময় ধরে তদন্তের পর অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। সরকারের উচিত হবে, উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দেওয়া। অন্যথায় ক্ষমতাসীন দলসহ সরকারের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
এর সঙ্গে যোগ করা যায় আরেকটি বিষয়। কেন্দ্রীয় কমিটির ভাষ্য অনুযায়ী, মোট এক হাজার ৪৪০টি মামলা পরীক্ষা করে ৬৫২টি মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়, যা মোট মামলার ৪৫ শতাংশ। তার মানে, কমিটি দাবি করতে পারে, শতভাগ মামলা বিবেচনায় আনা হয়নি অথবা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এ কথা অনেকে বলে থাকেন যে পরিসংখ্যান অনেকটা প্রসাধনী দ্রব্যের মতো, যা ব্যবহার করে মুখের আসল রূপ চাপা দেওয়া সম্ভব। খুনসহ ডাকাতির যে ৫২টি মামলা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, সে বিষয়ে পুলিশ অধিদপ্তর লিখিত আপত্তি জানিয়েছে। এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে। এ ধরনের ঘটনাপ্রবাহ সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা ছাড়াও গুরুতর অপরাধীদের জন্য যে শঙ্কাহীন পরিবেশ ইতিপূর্বে সৃষ্টি করা হয়েছে, তা আরও অধিকতর মাত্রায় সুসংহত করছে বলে সুশাসনে বিশ্বাসী নাগরিকদের ধারণা। মিডিয়া মত প্রকাশ করেছে, রাজনৈতিক শাসনের মাধ্যমে দিনবদলের কোনো লক্ষণ এ ধরনের ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে না।
এর মধ্যে বর্তমান সরকারের দুই বছরের শাসনকালের সমাপ্তি ঘটেছে। সরকার এখন এই দুই বছরের অর্জন ও ব্যর্থতার হিসাব প্রণয়নে কাজ করবে—এমনটাই শোনা গেছে। রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট মামলা প্রত্যাহার যে অর্জনের পাল্লা হালকা করবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে বলা যাবে যখন সরকারের মতামত পাওয়া যাবে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনডিপি) ২০১০ সালের মানবিক উন্নয়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনের এক অংশে মন্তব্য করা হয়েছে, সব ভালো অর্জনই একসঙ্গে সম্ভব নয়। কথাটা সত্যি। তবে এ কথাও সত্যি যে আলোচ্য ঘটনাপ্রবাহ সুশাসনের জন্য একটা বিরাট বাধা। এ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কোনো রাষ্ট্র মানবিক উন্নয়নে অধিকতর সাফল্য অর্জন করলেও এ ধরনের উন্নয়নের সাফল্য শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হয় না এবং রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে অগণতান্ত্রিক হয়, যদিও সে রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের কাঠামো রয়েছে।
প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য এ ধরনের বিশ্লেষণ থেকে শিক্ষা নেওয়া সম্ভব—বিশেষ করে, রাজনৈতিক দল অবশ্যই শিক্ষা নিতে পারে। রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে সরকার-বহির্ভূত সংস্থা ও ব্যক্তিদের সুচিন্তিত পরামর্শ গ্রহণ করলে তাতে অসুবিধার চেয়ে সুবিধাই বেশি হয়। ১৯৯১ সাল পরবর্তী সময় থেকে নির্বাচিত রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে মনোযোগী হলে তা হতো জনকল্যাণমুখী। মনোযোগী না হয়ে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে ঠিক বিপরীত সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন। ২০০১-২০০৬ শাসনামলে এটা যেমন দৃশ্যমান ছিল, বর্তমান সময়েও তা সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হয়নি। টিআইবির দুর্নীতি-সংক্রান্ত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের ঘটনাপ্রবাহ এ বিষয়টিই প্রমাণ করে। এ ছাড়া গত এক দশক ধরে বিভিন্ন সংবাদপত্র ছাড়াও টিভি মিডিয়া রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড-সংক্রান্ত বিষয়ে যথাক্রমে গোলটেবিল বৈঠক ও আলোচনা অনুষ্ঠান সময় সময় করে থাকে। গোলটেবিল বৈঠকের ধারাবিবরণী পরবর্তী সময় প্রকাশ করা হয়। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো গুণগত পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়নি।
রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে সরকার ভালোমতো চিন্তা করেনি বলে অনেকের ধারণা। কারণ, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য কোনো দিকনির্দেশনা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। এ ধরনের দিকনির্দেশনা প্রণয়নে আইন কমিশনের পরামর্শ গ্রহণ করার বিপক্ষে কী যুক্তি তা সরকারই বলতে পারবে। তা ছাড়া আইন মন্ত্রণালয়কে প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার করা হয়নি; করা হয়েছে ওই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীকে কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি। এখনো সময় আছে। যেসব মামলা মিডিয়ায় প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে, সেগুলো সরকার পুনর্বিবেচনা করে আইনসম্মত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে জনগণকে অবহিত করতে পারে।
এ এম এম শওকত আলী: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা; সাবেক সচিব।
প্রচলিত আইনে প্রতিষ্ঠিত সরকার মামলা প্রত্যাহার করতে ক্ষমতাবান। তবে সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে সংশ্লিষ্ট আদালতের সম্মতি সাপেক্ষে। মামলা প্রত্যাহার-সংক্রান্ত বিধিবদ্ধ কাঠামো অনুযায়ী ইতিপূর্বে জেলা কমিটিই দায়িত্ব পালন করত। সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় তিন ব্যক্তির মধ্যে ছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা ডিসি, এসপি ও পিপি। এর মধ্যে এসপি ও পিপির মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হতো। এ দুই ব্যক্তির মধ্যে কোনো দ্বিমত না থাকলেই প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। তবে কোনো কোনো সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত গ্রহণ করে উপযুক্ত ক্ষেত্রে মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সাধারণত গ্রহণযোগ্য সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাব যেসব মামলায় রয়েছে, সেগুলোই প্রতিটি নিখুঁতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট আদালতে পেশ করা হতো। ২০০৯ সালে দেখা দিল রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের রেওয়াজ, যা আগে এ মাত্রায় ছিল না; যেমন ছিল না কোনো মন্ত্রীর নেতৃত্বে কোনো কেন্দ্রীয় কমিটি।
কেন্দ্রীয় কমিটি একাধিক দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহারের জন্য প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়ে দুদককে অবহিত করে। কারণ, আইন অনুযায়ী এ ধরনের মামলা প্রত্যাহারের এখতিয়ার দুদকের। দুদক আজ পর্যন্ত সরকারের গঠিত কমিটির সিদ্ধান্তের বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। জানা যায়, গত দুই বছরে ৩১৪টি দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহারের জন্য কমিটি দুদককে অনুরোধ জানিয়েছে। দুদকের প্রধান প্রকাশ্য উক্তি করেছেন, সব কটি মামলা পাওয়ার পরই তাঁরা এ বিষয়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত দেবেন। কয়েক দিন আগে কমিটি অতিরিক্ত ২৬টি দুর্নীতির মামলা দুদকে পাঠিয়েছে। এর ফলে মামলার মোট সংখ্যা হলো ৩৪০। সাংবাদিকেরা এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে প্রশ্ন করলে তিনি একটি গ্রহণযোগ্য উত্তর দেন। তাঁর মতে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে দুদকেরই আইনি ক্ষমতা রয়েছে। এখন বিষয়টি দুদকের।
দ্বিস্তরবিশিষ্ট কমিটি এখন পর্যন্ত প্রত্যাহার-সংক্রান্ত যেসব সিদ্ধান্ত দিয়েছে, তা নিয়ে মিডিয়ায় প্রশ্ন উঠেছে। মিডিয়ার ভাষায়, অনেক ক্ষেত্রেই কমিটির সিদ্ধান্ত প্রশ্নাতীত নয়, বরং প্রশ্নবিদ্ধ। প্রাসঙ্গিক প্রশ্নগুলো হলো—এক, কিছু ক্ষেত্রে জেলা কমিটির কোনো সুপারিশই ছিল না। তাদের অজান্তেই কেন্দ্রীয় কমিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। দুই, অনেক সাংঘাতিক ধরনের অপরাধের মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো সংবাদপত্র বলেছে, পরবর্তী পর্যায়ে এসব সিদ্ধান্ত রহিত করা হয়েছে। তবে বিষয়টি স্পষ্ট নয়। কারণ, নববর্ষের প্রথম দিনে এ-সম্পর্কিত আরও সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। যেমন—মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার আয়ুব আলী হত্যা মামলা। তিন, জানুয়ারির দুই তারিখে আরও সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। সংবাদে বলা হয়েছে, খুনসহ ৫২টি মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত দিয়েছে কমিটি। এসব মামলা দীর্ঘ সময় ধরে তদন্তের পর অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। সরকারের উচিত হবে, উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দেওয়া। অন্যথায় ক্ষমতাসীন দলসহ সরকারের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
এর সঙ্গে যোগ করা যায় আরেকটি বিষয়। কেন্দ্রীয় কমিটির ভাষ্য অনুযায়ী, মোট এক হাজার ৪৪০টি মামলা পরীক্ষা করে ৬৫২টি মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়, যা মোট মামলার ৪৫ শতাংশ। তার মানে, কমিটি দাবি করতে পারে, শতভাগ মামলা বিবেচনায় আনা হয়নি অথবা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এ কথা অনেকে বলে থাকেন যে পরিসংখ্যান অনেকটা প্রসাধনী দ্রব্যের মতো, যা ব্যবহার করে মুখের আসল রূপ চাপা দেওয়া সম্ভব। খুনসহ ডাকাতির যে ৫২টি মামলা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, সে বিষয়ে পুলিশ অধিদপ্তর লিখিত আপত্তি জানিয়েছে। এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে। এ ধরনের ঘটনাপ্রবাহ সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা ছাড়াও গুরুতর অপরাধীদের জন্য যে শঙ্কাহীন পরিবেশ ইতিপূর্বে সৃষ্টি করা হয়েছে, তা আরও অধিকতর মাত্রায় সুসংহত করছে বলে সুশাসনে বিশ্বাসী নাগরিকদের ধারণা। মিডিয়া মত প্রকাশ করেছে, রাজনৈতিক শাসনের মাধ্যমে দিনবদলের কোনো লক্ষণ এ ধরনের ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে না।
এর মধ্যে বর্তমান সরকারের দুই বছরের শাসনকালের সমাপ্তি ঘটেছে। সরকার এখন এই দুই বছরের অর্জন ও ব্যর্থতার হিসাব প্রণয়নে কাজ করবে—এমনটাই শোনা গেছে। রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট মামলা প্রত্যাহার যে অর্জনের পাল্লা হালকা করবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে বলা যাবে যখন সরকারের মতামত পাওয়া যাবে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনডিপি) ২০১০ সালের মানবিক উন্নয়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনের এক অংশে মন্তব্য করা হয়েছে, সব ভালো অর্জনই একসঙ্গে সম্ভব নয়। কথাটা সত্যি। তবে এ কথাও সত্যি যে আলোচ্য ঘটনাপ্রবাহ সুশাসনের জন্য একটা বিরাট বাধা। এ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কোনো রাষ্ট্র মানবিক উন্নয়নে অধিকতর সাফল্য অর্জন করলেও এ ধরনের উন্নয়নের সাফল্য শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হয় না এবং রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে অগণতান্ত্রিক হয়, যদিও সে রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের কাঠামো রয়েছে।
প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য এ ধরনের বিশ্লেষণ থেকে শিক্ষা নেওয়া সম্ভব—বিশেষ করে, রাজনৈতিক দল অবশ্যই শিক্ষা নিতে পারে। রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে সরকার-বহির্ভূত সংস্থা ও ব্যক্তিদের সুচিন্তিত পরামর্শ গ্রহণ করলে তাতে অসুবিধার চেয়ে সুবিধাই বেশি হয়। ১৯৯১ সাল পরবর্তী সময় থেকে নির্বাচিত রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে মনোযোগী হলে তা হতো জনকল্যাণমুখী। মনোযোগী না হয়ে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে ঠিক বিপরীত সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন। ২০০১-২০০৬ শাসনামলে এটা যেমন দৃশ্যমান ছিল, বর্তমান সময়েও তা সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হয়নি। টিআইবির দুর্নীতি-সংক্রান্ত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের ঘটনাপ্রবাহ এ বিষয়টিই প্রমাণ করে। এ ছাড়া গত এক দশক ধরে বিভিন্ন সংবাদপত্র ছাড়াও টিভি মিডিয়া রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড-সংক্রান্ত বিষয়ে যথাক্রমে গোলটেবিল বৈঠক ও আলোচনা অনুষ্ঠান সময় সময় করে থাকে। গোলটেবিল বৈঠকের ধারাবিবরণী পরবর্তী সময় প্রকাশ করা হয়। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো গুণগত পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়নি।
রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে সরকার ভালোমতো চিন্তা করেনি বলে অনেকের ধারণা। কারণ, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য কোনো দিকনির্দেশনা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। এ ধরনের দিকনির্দেশনা প্রণয়নে আইন কমিশনের পরামর্শ গ্রহণ করার বিপক্ষে কী যুক্তি তা সরকারই বলতে পারবে। তা ছাড়া আইন মন্ত্রণালয়কে প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার করা হয়নি; করা হয়েছে ওই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীকে কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি। এখনো সময় আছে। যেসব মামলা মিডিয়ায় প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে, সেগুলো সরকার পুনর্বিবেচনা করে আইনসম্মত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে জনগণকে অবহিত করতে পারে।
এ এম এম শওকত আলী: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা; সাবেক সচিব।
No comments