খুলে যাক সম্ভাবনার দুয়ার by অজয় দাশগুপ্ত

বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র। এ দেশটির পরিশ্রমী ও মেধাবী জনগোষ্ঠীর দক্ষতা, সততা আর কর্মনিষ্ঠা পৃথিবীব্যাপী প্রশংসিত ও প্রমাণিত। তারপরও তার ভাবমূর্তির সমস্যা যায়নি। কেন যায়নি? দেশ ভেদে, জাতি ভেদে আমাদের প্রবাসী পরিচয় বা জাতিগত অস্তিত্ব একেক ধরনের। মালয়েশিয়া গিয়ে দেখি শ্রমবাজার, শ্রম রপ্তানী, জনশক্তির দ্বন্দ্বে সমস্যার আকার ভয়াবহ।
দালাল, ফড়িয়া, এজেন্ট তো বটেই উচ্চপদের কর্তা ব্যক্তিরাও জড়িত। এমন সব ঘটনা, এমন সব ব্যক্তি শুনলে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। গেলাম সিঙ্গাপুর। আরেক অবস্থা। মিথ্যে প্রলোভন, বসতি বা উপার্জনের খোয়াব, স্বপ্ন নামের দুঃস্বপ্ন তাড়িত বাঙালি ঘুরছে। পথেঘাটে, রাস্তার মোড়ে, সর্বস্ব বিক্রি করে এসে খেলনা পুতুল, হ্রদের পাশে বাদাম আর স্ন্যাকস নিয়ে জীবন-যাপনের ব্যর্থ সংগ্রামে লড়াই করছেন এরা। যোগ্যতায় কেউ ডিগ্রী, কেউ কলেজ অবদি কেউ বা ধারে কাছে, এমন যোগ্যতার পরও আজ এরা পথে প্রান্তরে। কম্বোডিয়ার দ্বিতীয় নগরী সিয়াম রিপের হকার্স মার্কেট। যত ক্রেতা তারচে অধিক বিক্রেতা, এক দোকানে দাঁড়ালে অন্য দোকানের সুভাষিনী তরুণী এসে হাত চেপে ধরে। মনভোলানো হাসিতে নিয়ে যেতে চায় তার দোকানে। প্রথম সে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঠেও বাংলাদেশী দেখে চমকে উঠেছি। নীরবে দোকান সাজিয়ে বিক্রি করছে ঘর সাজানোর এন্টিকম। আলাপক্রমে জানলাম একই কাহিনী। নমপেন শহরে চাকরী, বাড়ী ও স্বচ্ছল জীবনের প্রলোভনে দেশ পাড়ি। এসে যখন জেনেছে সব মিথ্যে, ফকফকা, দিবাস্বপ্ন, তখন ফিরে যাবার রাস্তা বন্ধ। বহু ঘাটের পানি পানের পর এখন এই হাল।
শুধু এশিয়ার দেশগুলো কেন? ইউরোপে দেখুন। ইতালী, ফ্রান্স, স্পেনের ছোট ছোট বাজারে পসরা সাজিয়ে বসা তরুণদের অনেকেই বাঙালি, এদের কষ্ট অবর্ণনীয়, দুঃখের পর্বত পাড়ি দিয়ে দেশে ফেরাও দুঃসাধ্য প্রায়। দূর এশিয়ার বা সংলগ্ন দেশগুলো থেকে দেশে ফেরা সহজ হলেও ইউরোপ আমেরিকা থেকে তা অসম্ভব। ফলে শুধু বাঁচার জন্য লড়াই করতে করতেই বাঁচাটা মৃতু্যর অধিক হয়ে ওঠে। জানা বা শ্রুত দেশগুলোর বাইরেও এমন দেশ আছে যেখানে বাংলাদেশীদের অস্তিত্ব জেনে বিস্মিত হবার বিকল্প থাকে না। যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো'র কাছের একটি দেশ বেলিজ। আমার ছেলেটি গিয়েছিল ভ্রমণে। তার কাছ থেকেই গল্প শুনেছি। বেলিজে চোখে পড়ার মত কয়েকশ বাঙালি ছাত্র-ছাত্রীর বসবাস। যখন এরা জেনেছে অস্ট্রেলিয়ান হলেও মূলতঃ একগুচ্ছ বাংলাদেশী তরুণ-তরুণী ভ্রমণে এসেছে, নিজেরা গিয়েই দেখা করেছিল। চা পান থেকে রাতের খাবারের জন্য পীড়াপীড়ি কিছুই বাদ যায়নি।
ঐসব তরুণ বা যুব গোষ্ঠীর বেলিজ বাস সুখের কিছু নয়। বেলিজ কোন শীর্ষ স্থানীয় দেশ নয়। তার অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক অবস্থানও বিস্ময় বা চমকের নয়। উল্টো এর অপরাধ প্রবণ সমাজ বিষয়ে চালু গল্পগুলো রীতিমত ভয়ের। যদিও পর্যটকরা তা মানেন না। ভ্রমণবিলাসীরা মনে করেন এগুলো আমেরিকা বা ঐ জাতীয় দেশগুলোর কল্পিত বয়ান। হতেও পারে। বঙ্গদেশ যেমন এদের চোখে শুধু জলোচ্ছ্বাস আর ঘূর্ণিঝড়ের দেশ, ভারত মানে সাধু সন্যাসী, সাপ খোপ, পাকিস্তান মানে রক্তের স্রোত, তেমনটি কাল্পনিক হওয়াও অসম্ভব কিছু নয়। তারপরও দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বেলিজের মত নিঝুম পুরীতে অনিশ্চিত জীবন কারো কাম্য হতে পারে না। এই যে অজ্ঞাতবাস, এর মূল কারণ ও প্ররোচনা, প্রলোভন, বেলিজে কাজ-কর্ম করে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকতে পারলে আমেরিকায় প্রবেশ করা সহজ আর আমেরিকা মানেই তো কল্পিত স্বর্গপুরি।
আবার ধরুন এই অস্ট্রেলিয়ায় যারা এসেছে তাদের কাগজপত্র, শিক্ষা ভিসা, চাকরীর ব্যবস্থা, চাকরী করার সময়ের অনুমোদন থাকার পরও দূরাবস্থার অন্ত নেই, গত কয়েক বছরের দরখাস্তগুলো হয় ঠেকে আছে অথবা পরিত্যক্ত। অথচ যারা উদ্বিগ্ন, যাদের উৎকণ্ঠা যারা না জানা পর্যন্ত কোন কিছু স্থির করতে পারছে না, তারা কিছুই জানে না। এর ভেতর জীবন চলছে, এমনকি বাচ্চা-কাচ্চাও হচ্ছে অনেকের। হঠাৎই একদিন শেষ পত্র এসে জানিয়ে দেবে এবার বাড়ী ফেরার সময় এবং পত্র পাঠ বিদায়।
বলতে চাচ্ছি, দেশ ভেদে রাষ্ট্র ভেদে সমস্যার আকার বা চেহারা ভিন্ন হলেও ভোগান্তির কারণ ও উৎস একটাই। যে দেশ বা জাতির আর্থিক ভিত্তি দুর্বল তাকে নিয়ে নয়-ছয় করার মধ্যে আনন্দ না থাকলেও ঝামেলা নেই। যে রাষ্ট্র ও শক্তি নিজেদের অনৈক্য দুর্বল তাকে অন্যরা কুর্নিশ বা সালাম জানাবে কোন দুঃখে? অথচ এ অবদি বাংলাদেশীরা পৃথিবীর সবপ্রান্তে সম্মান ও আস্থার সাথে বাস করছেন। কোন দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা আইন বা নৈতিকতা ভেঙ্গে দেয়ার মত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অপরাধ করেনি তারা। কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা আর বিলেতের দাঙ্গা বাদ দিলে বাংলাদেশের প্রবাসী জনগোষ্ঠী সুশীল সমাজেরই প্রতিচ্ছবি।
সম্ভাবনাময় এই জাতির প্রয়োজন অভিভাবক সুলভ নেতৃত্ব। প্রয়োজন দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বাংলাদেশীদের মধ্যে সমন্বয় সাধন। নতুন বছরে এ কাজটি করা সত্যি প্রয়োজন। এতে দেশের সন্তানরা যেমন বিদেশে সুখে থাকবে তেমনি পাবে নিরাপত্তা ও কল্যাণের স্বাদ। স্বাধীনতার এত বছর পর বিশ্বায়নের এই নতুন বছরে এটুকু চাওয়া একেবারেই নূন্যতম। রাজনীতি যদি কলহ বাদ দিয়ে এদিকে মনযোগী হয় বাংলাদেশের দিগন্ত বিস্তৃত সম্ভাবনাই লাভবান হবে, হোক না তা নতুন বছরের প্রতিজ্ঞা।
===========================
কক্সবাজার সাফারি পার্কঃ প্রাণীর প্রাচুর্য আছে, নেই অর্থ, দক্ষতা  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের গুপ্ত জীবন  ছাব্বিশটি মৃতদেহ ও একটি গ্রেপ্তার  ৩৯ বছর পরও আমরা স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি  সাইবারযুদ্ধের দামামা  সরলতার খোঁজে  সেই আমি এই আমি  আমেরিকান অর্থনীতি ডলারের চ্যালেঞ্জ  বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহার- আশানুরূপ সুফল নেই এক বছরেও  ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাজনীতি  মাস্টারদা সূর্যসেন ও যুব বিদ্রোহ সাতাত্তর  রসভা নির্বাচন ২০১১: একটি পর্যালোচনা  ড. ইউনূস অর্থ আত্মসাৎ করেননি  প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ৩৯ বছর  স্বাধীনতাযুদ্ধের 'বিস্মৃত' কূটনৈতিক মুক্তিযোদ্ধারা  আতঙ্কে শেয়ারবাজার বন্ধঃ বিক্ষোভ  আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম হয়েছে  মানবকল্যাণ আমাদের মন্ত্র  ট্রানজিট নিয়ে সবে গবেষণা শুরু  ভারতের একতরফা সেচ প্রকল্পঃ বাংলাদেশের আপত্তিতে বিশ্বব্যাংকের সাড়া  আমলাদের যাচ্ছেতাই বিদেশ সফর  সরকারের ব্যর্থতায় হতাশাঃ বিরোধী দলের ব্যর্থতায় বিকল্পের অনুপস্থিতি  ক্ষমতা ও গণতন্ত্র  পানি সংকট পানি বাণিজ্য  ২০১০ সালের অর্থনীতি কেমন গেল  গণতান্ত্রিক বিকাশের পথে বাধা অনেক  কপাটে তালা দিয়ে কেন এই মৃতু্যর আয়োজন  বিজয়ের অর্থনীতি ও সম্ভাবনা  মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লক্ষ্মীর মুখোমুখি  একেই কি বলে আমলাতন্ত্র?  আত্মসমর্পণের সেই বিকেল  আমরা তাঁদের ভুলতে পারি না  সংবিধানের অনেক বক্তব্য পারস্পরিক সংঘাতমূলক  পরাশক্তির বিরুদ্ধে এক ‘ভবঘুরের’ স্পর্ধা  আবু সাঈদ চৌধুরীর ভাষণ দেওয়া হলো না  শুভ নববর্ষ ২০১১- দিনে দিনে বর্ষ হলো গত  এরশাদের বিচারে দুই দলেরই আগ্রহ কম  কিশোরদের সাদামাটা ফল  জিপিএ-৫ পেয়েছে আট হাজার ৫২ জন  এরশাদের বিচার হওয়া উচিত


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ অজয় দাশগুপ্ত


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.