ফিচার- ‘কাপ্তাই লেক:ক্রমেই পতিত হচ্ছে মৃত্যুমুখে' by আজিজুর রহমান

দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর পর শেষ পর্যন্ত কাপ্তাই হ্রদের ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দূষণ আর ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ রাঙ্গামাটির কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদটি নিশ্চিহ্ন হতে চলেছিল।

যুগ যুগ ধরে কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতা আর মানুষের নির্বিচার বিরামমীন অত্যাচারই কাপ্তাই হ্রদের অস্তিত্ব সংকটে পড়ার মূল কারণ। পরিবেশবিদদের আশঙ্কা ছিল, কাপ্তাই হ্রদটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে স্থানীয় প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ মারাত্দক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। বহু বছর ধরেই তারা অতীতের সরকারগুলোর কাছে দাবি করে আসছিলেন, হ্রদটিকে রক্ষা করার জন্য দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা ও যথাযথ উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে।
১৯৬২ সালে খরসে াতা কর্ণফুলী নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে নির্মাণ করা হয় কাপ্তাই হ্রদ। নদীর মূল মোহনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সৃষ্ট এ হ্রদের আয়তন প্রায় ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার। নির্মাণের সময় এখানকার বিশাল এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যায়। আর এতে লক্ষাধিক পাহাড়ি অধিবাসী উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। রাঙ্গামাটি জেলার ১০টি উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষের অধিকাংশই পানির চাহিদা পূরণের জন্য কাপ্তাই হ্রদের ওপর নির্ভরশীল। মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পর্যটন, জলপথ উন্নয়ন, নৌযোগাযোগ সুবিধা, মৎস্য উৎপাদন এবং বনজ সম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যেই নির্মাণ করা হয় এ হ্রদটি। হাজার হাজার পাহাড়ি অধিবাসীর জন্য অভিশাপ বয়ে আনলেও, হ্রদটি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য উন্মুক্ত করে দেয় নতুন এক সোনালি সম্ভাবনার দ্বার। শুধু অর্থনৈতিক কারণেই নয়, অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য কাপ্তাই হ্রদটি হয়ে ওঠে আমাদের গৌরবের জাতীয় সম্পদ। নয়নাভিরাম এ হ্রদটি দর্শনের জন্য প্রতিবছর হাজার হাজার সৌন্দর্য পিপাসু পর্যটক ছুটে যান কাপ্তাইয়ে। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, নির্মাণের পর গত ৪৮ বছরে কোনো ড্রেজিং বা সংস্কার তো দূরের কথা বরং বছরের পর বছর বর্জ্য, মলমূত্র, ময়লা-আবর্জনা ইত্যাদি ফেলে হ্রদটিকে মারাত্দক দূষিত করে তোলা হয়েছে। তা ছাড়া নদীর বয়ে আনা পাহাড়ি ঢলের পলি জমে হ্রদের তলদেশ ভরাট হয়ে গভীরতা হ্রাস পাচ্ছে। পলি ও আবর্জনা জমে নাব্যতা হারিয়ে কাপ্তাই হ্রদ এখন শ্যালো বা অগভীর হ্রদে পরিণত হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও হ্রদ ভরাট করে সরকারি-বেসরকারি অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চালানো হচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ আমাদের গর্বের এই জাতীয় সম্পদটি ভাগাড়ে পরিণত হয়ে নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্তদের ক্ষমাহীন নিষ্ক্রিয়তা আর উপকারভোগীদের বিবেকহীনতায়।
মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ নিয়েই হ্রদ নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হওয়ার পর দীর্ঘ ৪৮ বছরে হ্রদটিকে একবারের জন্যও ড্রেজিং করা হয়নি। কাপ্তাই হ্রদের ৮৩ বছর লাইফটাইমের বেশির ভাগ সময় অর্থাৎ ৪৮ বছর এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে। অসম্ভব হারে পলি পড়ে এবং নির্বিচার বর্জ্য নিক্ষেপের কারণে অবশিষ্ট লাইফটাইম ৩২ বছরের সময়সীমাও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যবস্থা না নিলে ৩৪ বছরের অনেক আগেই কাপ্তাই হ্রদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। পানির স্বাভাবিক উচ্চতা যেখানে থাকার কথা ৯৮.৫ ফুট এমএসএল, অর্থাৎ ভরা মৌসুমে স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ ফুট এমএসএল উচ্চতা কম থাকছে। ফলে কাপ্তাই হ্রদ এখন অগভীর হ্রদে পরিণত হয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর স্বাভাবিক উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিপুল মৎস্য সম্পদের ভাণ্ডার এ হ্রদ থেকে প্রতিবছর কয়েক কোটি টাকার মাছ আহরণ ও বাজারজাত করা হয়। প্রায় ১০ হাজার মৎস্যজীবীর জীবিকা নির্বাহের উৎস হচ্ছে এ হ্রদ। কর্তৃপক্ষের বহু বছরের অবহেলা আর অব্যবস্থাপনার কারণে কাপ্তাই হ্রদটি ভরাট হয়ে অপমৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে_এ বিষয়টি আমাদের জন্য সন্দেহাতীতভাবে একটি দুঃসংবাদ। তবে এর চেয়ে উদ্বেগ আর আশংকার বিষয় হচ্ছে, আমাদের জাতীয় সম্পদ এই হ্রদটি এখন ভয়াবহ দূষণ আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। আর পানিতে মারাত্দক সব ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। হ্রদের পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। উপকারভোগী মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডই প্রধানত এর জন্য দায়ী। যা পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্দক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা অসংখ্য জনবসতির মলমূত্রের ৮০ শতাংশই পড়ছে হ্রদের পানিতে। এ ছাড়া প্রতিদিন চলাচলরত লঞ্চ ও ইঞ্জিনচালিত নৌকার তেল-মবিল-গ্রিজসহ অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ নদীতে ফেলা হচ্ছে। এসব নৌযানের যাত্রী, জেলে ও নৌপরিবহনের শ্রমিকরা পানিতে মলমূত্র ত্যাগ করছে এবং ময়লা-আবর্জনা পানিতে ফেলছে। অন্যদিকে হ্রদ এলাকার শহরে স্থাপিত স'মিল, ফিলিং স্টেশন, জেটি ঘাট, বাস-ট্রাক টার্মিনাল এবং হোটেল-রেস্তোরাঁসহ আবাসিক এলাকার বর্জ্য ও আবর্জনা ফেলা হচ্ছে হ্রদে। পাশাপাশি শহরের বড় বড় ভবন ও হোটেলের পয়ঃনিষ্কাশন সরাসরি যুক্ত করা হয়েছে হ্রদের সঙ্গে।
বিদ্যুৎ, মৎস্য, যোগাযোগ, পর্যটন ইত্যাদি নানা কারণে কাপ্তাই হ্রদের গুরুত্ব অপরিসীম। দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়া হলে হ্রদের বিপর্যয় ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে। কঠিন হয়ে পড়বে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করাও। আর এর বিরূপ প্রভাবে বিপর্যয়ে পড়বে ১০ লক্ষাধিক অধিবাসী অধ্যুষিত জেলার ১৩ ভাষাভাষীর ১১টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জীবন ও জীবিকা। সৌভাগ্য, সরকার কাপ্তাই কৃত্রিম হ্রদের পরিবেশের উন্নয়নে পরিকল্পনা গ্রহণ করে একটি অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এ নীলাভূমিকে পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। বর্তমানে পর্যটন শিল্পকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। পর্যটন যে একটি দেশের প্রধান আয়ের উৎস হতে পারে_এ অঞ্চলের মালদ্বীপ, নেপাল, থাইল্যান্ড তার বড় উদাহরণ। হ্রদের পলি অপসারণের পাশাপাশি মৎস্য সম্পদ বাড়ানোর সরকারের পরিকল্পনাও আমাদের মাছের ঘাটতির অনেকটাই পূরণ করতে পারবে। জলবিদ্যুতের আরো দুটি ইউনিট স্থাপনের পরিকল্পনাও সরকারের দূরদর্শিতার পরিচায়ক। তবে মনে রাখা দরকার, প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতি প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। দেশবাসী আশা করে, ভালো কাজ দ্রুত শুরু এবং সফলভাবে শেষ করাই দক্ষতার পরিচয়।
=================================
রাজনৈতিক আলোচনা- 'ছাত্ররাজনীতি:লেজুড়বৃত্তির অবসান আজ জরুরি by বদিউল আলম মজুমদার  কৃষি আলোচনা- 'কৃষিজমি রক্ষার দায় সবার' by আফতাব চৌধুরী  শিল্পি- 'আমি যে গান গেয়েছিলেম...কলিম শরাফী' by জাহীদ রেজা নূর  আলোচনা- 'হাওয়ার হয়রানি নামে ঢেকে যায় যৌন সন্ত্রাস'  সাহিত্যালোচনা- 'মারিও ভার্গাস ইয়োসা'র সাহিত্যে নোবেলের রাজনৈতিক মোড়  রাজনৈতিক আলোচনা- 'জনগণ ও সেনাবাহিনীর বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতা by নূরুল কবীর  রাজনৈতিক আলোচনা- 'নির্মানবীয় রাজনীতি ও জনসমাজের বিপজ্জনক নীরবতা by নূরুল কবীর  আলোচনা- 'সত্য প্রকাশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের ত্রিমুখী অভিযান by নূরুল কবীর  খাদ্য আলোচনা- 'খাদ্য উৎপাদনের বাধা দূর করাই ক্ষুধার বিরোদ্ধে প্রধান সংগ্রাম' by ফরিদা আক্তার  রাজনৈতিক আলোচনা- ' কোন পথে ক্ষমতা! হস্তান্তর নয় রূপান্তর চাই   আলোচনা- 'শিল্পনীতি-২০১০:সামর্থ্যের অপব্যবহারে পঙ্গ  আলোচনা- যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিদের স্বার্থ রক্ষাকারী ইসরাইল লবি ইভটিজং আলোচনা- নারী উৎপীড়ক সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া  রাজনৈতিক আলোচনা- 'ছাত্ররাজনীতি তার হারানো গৌরব ফিরে পাক by ফরহাদ মাহমুদ  আলোচনা- 'দেশ কাঁপানো নূরজাহান' by আবদুল হামিদ মাহবুব  ইতিহাস- 'বাংলা ভাষার স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ' by রফিকুল ইসলাম



কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ আজিজুর রহমান


এই ফিচার'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.