আজ কোনো খেলা নেই, আজ জাপানের জন্য শোক
এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলের দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলাগুলো নিয়ে আমার প্রতিটি (উরুগুয়ের কাছে টাইব্রেকারে জাপানের হেরে যাওয়া ছাড়া) ভবিষ্যদ্বাণী ফলে যাওয়ায় আমি নিজেই কিছুটা অবাক, কিছুটা বিস্মিত, কিছুটা লজ্জিত এবং কিছুটা দুঃখিত হয়েছি। পরাজয়ের বেদনা নিয়ে খেলোয়াড় ও গ্যালারি মাতানো পরাজিত দলের সমর্থকদের মাথা নিচু করে মাঠ ত্যাগ করতে দেখে আমার মনে হয়েছে, কী জানি আমার ভবিষ্যদ্বাণীকে সত্য প্রমাণ করার জন্যই ফুটবলের ঈশ্বর ইংল্যান্ড, আমেরিকা, দ. কোরিয়া, স্লোভাকিয়া, পর্তুগাল, মেক্সিকো এবং আমার প্রিয় কবি পাবলো নেরুদার দেশ চিলিকে তাদের নিজ নিজ প্রতিপক্ষের কাছে হারিয়ে দিলেন না তো? ফুটবলের ঈশ্বর বলে আকাশে কোনো দেবতা আছেন, এমন প্রমাণ যেমন কারও কাছে নেই, ফুটবলের ঈশ্বর বলে কেউ নেই, এমন কথাও প্রমাণিত নয়। এ রকম বিশ্ব কাঁপানো একটা বিষয় দেখাশোনা করার জন্য একজন দেবতা তো থাকতেও পারেন। তিনি হয়তো কোনো অজানা কারণে, ফুটবল-পাগল কবিদের পছন্দ করেন। বাস্তবতা ব্যাখ্যার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদানের ক্ষেত্রে তাদের সঠিক পথে পরিচালনাও করেন।
জাপানকে নিয়ে আমার একটু আশা ছিল। সেটা সত্যি বলতে কী—যতটা যুক্তিনির্ভর ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল আবেগনির্ভর। জাপানে আমি দুবার গিয়েছি। জাপানকে নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ (আমার নিজের ধারণা) ভ্রমণ কাহিনি আমি লিখেছি। বহির্বিশ্বে একমাত্র জাপানেই আমার কবিতার বই বেরিয়েছে। ইয়োকো নোয়া নামে একজন সুন্দরী বিদ্যাবতী জাপানি ভাষায় আমার ও শামসুর রাহমানের অনেকগুলো কবিতা অনুবাদ করেছেন। আমার আরেকজন প্রিয় জাপানি বান্ধবী জাপান-বাংলা স্কুলের প্রিন্সিপাল ইয়াসুকু হাকামাদা আমাকে কবিতা লেখায় অনুপ্রাণিত করেছেন। সঙ্গ দিয়েছেন, নানাভাবে সাহায্য করেছেন। আমার কয়েকটি কবিতার চমৎকার অনুবাদও করেছেন। ফলে চলতি বিশ্বকাপে লাতিন আমেরিকান ফুটবলের জয়জয়কার হবে বুঝে খুশি হলেও, প্যারাগুয়ের বিরুদ্ধে জাপানের জয়টা দেখতে চেয়েছিলাম। ফুটবলের ঈশ্বরকে বলেও ছিলাম, আফ্রিকার ঘানাকে যেমন দিয়েছ, তেমনি করে এশিয়ার কোটায় তুমি জাপানকে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার গৌরব দান করো, প্রভু। দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে দুবারের বিশ্বকাপজয়ী বলে উরুগুয়ের মান রেখেছ, ভালো কথা। তাই বলে প্যারাগুয়ের সম্মান রক্ষার দায় তুমি নেবে কেন? ফুটবল-শক্তি বিচারে, জাপানও যা, প্যারাগুয়েও প্রায় তাই। কিন্তু হলো না। ফুটবলের ঈশ্বর লাতিন আমেরিকার ফুটবল-বিপ্লবের বিজয়ধ্বজাটাকে আরও দৃষ্টিগ্রাহ্য করার জন্যই জাপানকে দুঃখসমুদ্রে নিক্ষেপ করে প্যারাগুয়েকে শেষ আটের ভেলায় তুলে দিলেন। খেলাটি যখন এবারের বিশ্বকাপের প্রথম টাইব্রেকারে গড়িয়েছিল, তখনই আমি আমার বুকের ভেতরে জাপানের পরাজয়ের আগাম বার্তা পেয়ে গিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত জাপান যে পারেনি, আমি মনে করি তার দায় জাপানের নয়, এশিয়ার। প্যারাগুয়ে যে পেরেছে, তার পেছনে রয়েছে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা আর উরুগুয়ের বিজয়ছায়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি সইতে না পেরে অভিমানী জাপানিরা যেভাবে দলবেঁধে আত্মহত্যা করেছিল—আমি শঙ্কিত বোধ করছি, জাপানে এবারও না তার পুনরাবৃত্তি ঘটে! জাপান, আমরা তোমার পাশে আছি।
এবারের আগে চার-চারটি লাতিন দেশ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইন্যালে খেলার গৌরব অর্জন করেনি। করেছে কি? আর প্যারাগুয়ে সম্ভবত এবারই প্রথম বিশ্বশ্রেষ্ঠ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সঙ্গে কোয়ার্টার ফাইনালের শেষ-অষ্টকে নাম লেখালো। এখন বাকি থাকলো চার লাতিন দলের পরবর্তী কুরুক্ষেত্রজয়ের নাটক-দর্শন। ফুটবলের ঈশ্বর যে কোনো ইউরোপিয়ান নন, তিনি যে একজন লাতিন আমেরিকার আদিবাসী—, ঊনিশতম বিশ্বকাপ ফুটবল যেন সেই সত্য-প্রতিষ্ঠার পথেই ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। পাঠক, আপনারা কি তা বুঝতে পারছেন? যদি পারেন তো কোনো কথা নাই, যদি না পারেন তবে একখান কথা আছে।
মেক্সিকো বিশ্বকাপ ফুটবল চলাকালে, ১৯৮৬ সালে একটি কবিতা লিখেছিলাম। কবিতার নাম ‘আজ কোনো খেলা নেই’। কোয়ার্টার ফাইনাল শুরু হওয়ার আগের দু’দিনের বিরতির ভিতর ঐ কবিতাটি রচিত হয়েছিলো। প্রাসঙ্গিক বিচেনায়, কবিতাটির শেষাংশ উদ্ধৃত করে আজকের লেখা শেষ করছি।
‘আজ গোল নেই, পেনাল্টি নেই, কর্নার নেই, অফসাইড নেই—
কোনো টাফ-ট্যাকলিং নেই-; আজ সারা পৃথিবীর ছুটি।
হাভাল্যাঞ্জ এখন ঘুমাচ্ছেন—। ম্যারাডোনা, রুমানিগে,
প্লাটিনি, সক্রেটিস আজ আকাশে উধাও।
টিভির পর্দাকে আজ মনে হল মৃত ইলিশের চোখের মতন স্থির,
চঞ্চলতাহীন, স্বচ্ছ-শূন্য কাচ। আজ এই মধ্যরাতে
টিভির পর্দায় হঠাৎ আবিষ্কৃত হলো আমার হূদয়।’
(দ্রঃ আজ কোনো খেলা নেই / দুঃখ করো না, বাঁচো / ১৯৮৭)
কামরাঙ্গীর চর
৩০ জুন, ২০১০
জাপানকে নিয়ে আমার একটু আশা ছিল। সেটা সত্যি বলতে কী—যতটা যুক্তিনির্ভর ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল আবেগনির্ভর। জাপানে আমি দুবার গিয়েছি। জাপানকে নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ (আমার নিজের ধারণা) ভ্রমণ কাহিনি আমি লিখেছি। বহির্বিশ্বে একমাত্র জাপানেই আমার কবিতার বই বেরিয়েছে। ইয়োকো নোয়া নামে একজন সুন্দরী বিদ্যাবতী জাপানি ভাষায় আমার ও শামসুর রাহমানের অনেকগুলো কবিতা অনুবাদ করেছেন। আমার আরেকজন প্রিয় জাপানি বান্ধবী জাপান-বাংলা স্কুলের প্রিন্সিপাল ইয়াসুকু হাকামাদা আমাকে কবিতা লেখায় অনুপ্রাণিত করেছেন। সঙ্গ দিয়েছেন, নানাভাবে সাহায্য করেছেন। আমার কয়েকটি কবিতার চমৎকার অনুবাদও করেছেন। ফলে চলতি বিশ্বকাপে লাতিন আমেরিকান ফুটবলের জয়জয়কার হবে বুঝে খুশি হলেও, প্যারাগুয়ের বিরুদ্ধে জাপানের জয়টা দেখতে চেয়েছিলাম। ফুটবলের ঈশ্বরকে বলেও ছিলাম, আফ্রিকার ঘানাকে যেমন দিয়েছ, তেমনি করে এশিয়ার কোটায় তুমি জাপানকে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার গৌরব দান করো, প্রভু। দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে দুবারের বিশ্বকাপজয়ী বলে উরুগুয়ের মান রেখেছ, ভালো কথা। তাই বলে প্যারাগুয়ের সম্মান রক্ষার দায় তুমি নেবে কেন? ফুটবল-শক্তি বিচারে, জাপানও যা, প্যারাগুয়েও প্রায় তাই। কিন্তু হলো না। ফুটবলের ঈশ্বর লাতিন আমেরিকার ফুটবল-বিপ্লবের বিজয়ধ্বজাটাকে আরও দৃষ্টিগ্রাহ্য করার জন্যই জাপানকে দুঃখসমুদ্রে নিক্ষেপ করে প্যারাগুয়েকে শেষ আটের ভেলায় তুলে দিলেন। খেলাটি যখন এবারের বিশ্বকাপের প্রথম টাইব্রেকারে গড়িয়েছিল, তখনই আমি আমার বুকের ভেতরে জাপানের পরাজয়ের আগাম বার্তা পেয়ে গিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত জাপান যে পারেনি, আমি মনে করি তার দায় জাপানের নয়, এশিয়ার। প্যারাগুয়ে যে পেরেছে, তার পেছনে রয়েছে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা আর উরুগুয়ের বিজয়ছায়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি সইতে না পেরে অভিমানী জাপানিরা যেভাবে দলবেঁধে আত্মহত্যা করেছিল—আমি শঙ্কিত বোধ করছি, জাপানে এবারও না তার পুনরাবৃত্তি ঘটে! জাপান, আমরা তোমার পাশে আছি।
এবারের আগে চার-চারটি লাতিন দেশ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইন্যালে খেলার গৌরব অর্জন করেনি। করেছে কি? আর প্যারাগুয়ে সম্ভবত এবারই প্রথম বিশ্বশ্রেষ্ঠ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সঙ্গে কোয়ার্টার ফাইনালের শেষ-অষ্টকে নাম লেখালো। এখন বাকি থাকলো চার লাতিন দলের পরবর্তী কুরুক্ষেত্রজয়ের নাটক-দর্শন। ফুটবলের ঈশ্বর যে কোনো ইউরোপিয়ান নন, তিনি যে একজন লাতিন আমেরিকার আদিবাসী—, ঊনিশতম বিশ্বকাপ ফুটবল যেন সেই সত্য-প্রতিষ্ঠার পথেই ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। পাঠক, আপনারা কি তা বুঝতে পারছেন? যদি পারেন তো কোনো কথা নাই, যদি না পারেন তবে একখান কথা আছে।
মেক্সিকো বিশ্বকাপ ফুটবল চলাকালে, ১৯৮৬ সালে একটি কবিতা লিখেছিলাম। কবিতার নাম ‘আজ কোনো খেলা নেই’। কোয়ার্টার ফাইনাল শুরু হওয়ার আগের দু’দিনের বিরতির ভিতর ঐ কবিতাটি রচিত হয়েছিলো। প্রাসঙ্গিক বিচেনায়, কবিতাটির শেষাংশ উদ্ধৃত করে আজকের লেখা শেষ করছি।
‘আজ গোল নেই, পেনাল্টি নেই, কর্নার নেই, অফসাইড নেই—
কোনো টাফ-ট্যাকলিং নেই-; আজ সারা পৃথিবীর ছুটি।
হাভাল্যাঞ্জ এখন ঘুমাচ্ছেন—। ম্যারাডোনা, রুমানিগে,
প্লাটিনি, সক্রেটিস আজ আকাশে উধাও।
টিভির পর্দাকে আজ মনে হল মৃত ইলিশের চোখের মতন স্থির,
চঞ্চলতাহীন, স্বচ্ছ-শূন্য কাচ। আজ এই মধ্যরাতে
টিভির পর্দায় হঠাৎ আবিষ্কৃত হলো আমার হূদয়।’
(দ্রঃ আজ কোনো খেলা নেই / দুঃখ করো না, বাঁচো / ১৯৮৭)
কামরাঙ্গীর চর
৩০ জুন, ২০১০
No comments