অধিকৃত দেশে গণতন্ত্র by ওয়াহিদ নবী
অনেক দরকষাকষি, অনেক ভুল বোঝাবুঝি আর অনেক বাগিবতণ্ডার পরে ইরাকের পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানসংক্রান্ত আইন পাস করেছিল। কথা ছিল, ২০১০ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু ইরাকের ভাইস প্রেসিডেন্ট তারিখ আল হাশেমী ভেটো দিয়ে দিলেন। তিনি সুন্নি। এখানে উল্লেখযোগ্য, ইরাকের বর্তমান যুদ্ধের সময় অনেককে গৃহত্যাগ করতে হয়েছে। তাদের মধ্যে সুন্নিদের সংখ্যাই বেশি। হাশেমী গৃহত্যাগীদের জন্য পার্লামেন্টে শতকরা ১৫ ভাগ আসন দাবি করেছিলেন। এসব কারণে নির্বাচন ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে। মুরব্বি আমেরিকা নির্বাচন নিয়ে উদ্বিগ্ন। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তারা বলতে পারে, তারা ইরাকে গণতন্ত্র দিয়েছে। তারা গোটা পৃথিবীকে বলতে চায় যে ইরাককে স্বৈরতন্ত্রমুক্ত করে গণতন্ত্র উপহার দেওয়ার জন্যই তারা ইরাকে হাজার হাজার সৈন্য পাঠিয়েছে। আফগানিস্তানের নির্বাচনে ‘হ-য-ব-র-ল’ হওয়ার পর মাকির্িনরা ইরাকে একটা ‘সর্বাঙ্গীণ সুন্দর নির্বাচন’ করে পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিতে আগ্রহী। মুরব্বিরা যখন গণতন্ত্র দিতে চায়, তখন ইরাকিদের আর কী বলার থাকতে পারে! নির্বাচন তাদের করতেই হবে। কিন্তু ইরাকের তো অন্যান্য সমস্যা রয়েছে।
ইরাকের শতকরা ৬০ ভাগ মানুষ শিয়া আর ৩০ ভাগ সুন্নি। সুন্নিদের মধ্যে রয়েছে আরব ও কুর্দি। এ ছাড়া রয়েছে তুর্কি, আর্মেনিয়ান ও এসিরিয়ান বংশোদ্ভূত মানুষ। তাদের সবার মধ্যে সব সময় সুসম্পর্ক ছিল না। বিশেষ করে সাদ্দাম হোসেনের শাসনকালে সুন্নি আরবরা অতিরিক্ত প্রাধান্য উপভোগ করে। ফলে শিয়া ও কুর্দিরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। কুর্দিরা অবশ্য বহু বছর থেকেই স্বাধিকারের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিল। ১৯৯১ সালের কুয়েত যুদ্ধের পর শিয়া সম্প্রদায় মনে করে যে বিজয়ী পাশ্চাত্য শক্তি সাদ্দাম হোসেনের পতন চায়। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা সুন্নিদের হত্যা করে। সাদ্দাম হোসেন নির্মমভাবে এই বিদ্রোহ দমন করেন। কুর্দিদের দমন করতে সাদ্দাম হোসেন বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করেন।
ইরাকের সাম্প্রতিক ইতিহাস অত্যন্ত দুঃখজনক। অথচ ইরাক ছিল মানবজাতির আদি সভ্যতার পীঠস্থান। ইরাকের সুমেরিয় সভ্যতা মানবজাতিকে লিখতে শিখিয়েছে। তাদের আবিষ্কৃত ‘কিউনিফর্ম বর্ণমালা’ মানুষের ব্যবহূত প্রথম বর্ণমালা। আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে এই বর্ণমালা প্রচলিত হয়েছিল। আব্বাসীয় বংশের রাজত্বকালে তাদের রাজধানী ছিল বাগদাদ। বাগদাদ জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা, শিক্ষা-দীক্ষায় প্রভূত উন্নতি লাভ করে। যদিও হালাকু খানের ধ্বংসলীলার শিকার হয়েছিল বাদগাদ সে যুগে। কিন্তু ইরাকের বর্তমান দুঃখের ইতিহাস শুরু হয় প্রথম মহাযুদ্ধের সময়। তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্য অধিকৃত ইরাক দখল করে ইংরেজরা। ১৯২০ সালে ইরাকিরা বিদ্রোহ করলে নির্মম হাতে তা দমন করে ইংরেজরা। এরপর থেকে গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের শেষ পর্যন্ত ইরাকের ইতিহাস একটা ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ইতিহাস। শিখণ্ডীদের মাধ্যমে ইরাক শাসনের চেষ্টা করেছে ইংরেজরা। চুক্তির পর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে কিন্তু ঝড় থামেনি। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪০ সালের ভেতর সাতটি সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে।
ইরাক আক্রমণের অজুহাত হিসেবে বুশ সরকার দুটি লক্ষ্যের কথা উল্লেখ করেছিল। একটি হচ্ছে সাদ্দাম কর্তৃক সংগৃহীত বিশাল অস্ত্রভান্ডার ধ্বংস করা এবং অন্যটি হচ্ছে স্বৈরাচারী সাদ্দাম হোসেনের অপসারণ। খুব কম মানুষই এ দুটি অজুহাত গ্রহণ করেছে। বুশ সাহেবের নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারটিই একটা সন্দেহজনক ব্যাপার। কাজেই তাঁর নেতৃত্বে ঘটা যেকোনো ব্যাপারকেই মানুষ সন্দেহের চোখে দেখবে, এটাই স্বাভাবিক। ইরাক দখলের পর অনেক চেষ্টা করেও দখলদারেরা কোনো অস্ত্রভান্ডার খুঁজে পায়নি। আমেরিকার অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে, যার দ্বারা তারা সাদ্দামের অস্ত্রভান্ডার অনায়াসেই খুঁজে পেতে পারত। এ ছাড়া তাদের পক্ষে অনেক ইরাকি কাজ করেছে, যারা অস্ত্রভান্ডারের খোঁজ দিতে পারত। দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্রভান্ডারের কথা বলে তারা ইরাক আক্রমণ করেছে কিন্তু অস্ত্রভান্ডার খুঁজে পায়নি। অর্থাত্ তারা জেনেশুনে নির্জলা মিথ্যা কথা বলেছে।
স্বৈরাচার দূর করার জন্য আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করেছে; এটা একটা খাঁটি পরিহাস। পৃথিবীতে তো অনেক স্বৈরাচারী রয়েছেন। আমেরিকা শুধু সাদ্দাম হোসেনের ব্যাপারে উত্সাহী কেন? ইরাক ও ইরানের আট বছরব্যাপী যুদ্ধের সময় আমেরিকা সাদ্দামকে মদদ জুগিয়েছে। ১৯৬৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর প্রায় তিন দশক পর্যন্ত সাদ্দাম হোসেন স্বৈরাচারী ছিলেন না আমেরিকার চোখে। কিন্তু হাঠাত্ করে তাদের চোখে সাদ্দাম এত খারাপ হয়ে গেলেন কেন? সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে ইসলামি জঙ্গিদের যোগাযোগ ছিল কি? এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সাদ্দাম হোসেনের যত দোষ থাকুক না কেন, ধর্মকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন—এ অপবাদ তাঁকে কেউ দিতে পারবে না।
এসব মিথ্যা কথা বলে আমেরিকা তবে ইরাক আক্রমণ করল কেন?
তেলের জন্য? উড়িয়ে দেওয়া যায় না কথাটা।
একটি শক্তিশালী আরব দেশ ইসরায়েলের জন্য বিপজ্জনক? কথাটার পেছনে যুক্তি আছে।
আমার সহকর্মী ও বন্ধু ইরাকিদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি। তাঁদের অনেকেই বিশ্বাস করেন যে সাদ্দামকে উত্খাত করার জন্য আমেরিকার সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। তাঁদের অনেকের ধারণা, গণতন্ত্রের শুরুতে আমেরিকার সাহায্য ইরাকের দরকার ছিল। তাঁদের কেউ আমাকে এমন কথাও বলেছেন যে ব্রিটিশদের দেওয়া বিচারব্যবস্থা ও সিভিল সার্ভিস ইত্যাদি পাক-ভারত উপমহাদেশের দেশগুলোকে সাহায্য করেছে। কথাগুলো ভেবে দেখার মতো। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রে অধিকৃত দেশ কি আক্রমণকারী দেশের দ্বারা উপকৃত হয়েছে? যদিও অধিকৃত দেশের উপকারের জন্য নয়, বরং নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আক্রমণকারীরা অন্য দেশ আক্রমণের মতো ঘৃণ্য কাজ করে থাকে।
আরও একটি কথা মনে পড়ে এ প্রসঙ্গে। একটি দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা আক্রমণকারীদের সাহায্য করে। দেশের ভেতর অবিচার চরম আকার ধারণ করলে এবং জাতির একটি দুর্বল অংশ বিচারের কোনো সম্ভাবনা না দেখলে অনেক সময় পূর্বাপর চিন্তা না করে অবাঞ্ছিত বহিঃশত্রুর সাহায্য নেয়। কাজটা ভালো নয়। এতে করে কেউ লাভবান হয় না। তবে পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল নয়।
আমেরিকা যখন ইরাক আক্রমণ করে, তখন কুর্দিরা সৈন্য দিয়ে তাদের সাহায্য করেছে। তারা কিছু লাভবানও হয়েছে। এখন কুর্দিস্তান প্রায় স্বাধীন। কিন্তু তারা নির্বাচন বর্জনের হুমকি দিচ্ছে শিয়াপ্রধান সরকারের কাছ থেকে প্রচুর হিস্যা না পাওয়ার জন্য।
এতকালের শক্তিশালী সুন্নিরা কি শিয়াপ্রধান সরকারের কাছ থেকে আশানুরূপ হিস্যা পাবে?
আমেরিকা কি চিরদিন ইরাকে থেকে মুরব্বির ভূমিকা পালন করতে পারবে? রাস্তা থেকে আমেরিকান সেনা ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার পর ইরাকে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড বেড়ে গেছে। চুক্তি অনুযায়ী ২০১১ সালে আমেরিকার সব সেনা চলে গেলে ইরাকে কী ঘটবে?
মৃতদেহ গণনার পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় দেড় লাখ ইরাকি প্রাণ হারিয়েছে। নেতাদের দরকষাকষি দেখার জন্য আরও ইরাকি কি হাসিমুখে প্রাণ দেবে? ইরাকের নতুন এই ‘এক্সপেরিমেন্টের’ জন্য আরও কতজনকে প্রাণ দিতে হবে? মার্কিন সেনাদের প্রাণহানি আর কত দিন আমেরিকাবাসী চুপ করে দেখবে?
এত কাঠখড় পুড়িয়ে নির্বাচন হলেই কি ইরাকের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? বিশেষ করে তিনটি প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক যখন সুমধুর নয়।
ওয়াহিদ নবী: লন্ডন প্রবাসী। গবেষক ও মনোরোগবিশেষজ্ঞ।
ইরাকের শতকরা ৬০ ভাগ মানুষ শিয়া আর ৩০ ভাগ সুন্নি। সুন্নিদের মধ্যে রয়েছে আরব ও কুর্দি। এ ছাড়া রয়েছে তুর্কি, আর্মেনিয়ান ও এসিরিয়ান বংশোদ্ভূত মানুষ। তাদের সবার মধ্যে সব সময় সুসম্পর্ক ছিল না। বিশেষ করে সাদ্দাম হোসেনের শাসনকালে সুন্নি আরবরা অতিরিক্ত প্রাধান্য উপভোগ করে। ফলে শিয়া ও কুর্দিরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। কুর্দিরা অবশ্য বহু বছর থেকেই স্বাধিকারের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিল। ১৯৯১ সালের কুয়েত যুদ্ধের পর শিয়া সম্প্রদায় মনে করে যে বিজয়ী পাশ্চাত্য শক্তি সাদ্দাম হোসেনের পতন চায়। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা সুন্নিদের হত্যা করে। সাদ্দাম হোসেন নির্মমভাবে এই বিদ্রোহ দমন করেন। কুর্দিদের দমন করতে সাদ্দাম হোসেন বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করেন।
ইরাকের সাম্প্রতিক ইতিহাস অত্যন্ত দুঃখজনক। অথচ ইরাক ছিল মানবজাতির আদি সভ্যতার পীঠস্থান। ইরাকের সুমেরিয় সভ্যতা মানবজাতিকে লিখতে শিখিয়েছে। তাদের আবিষ্কৃত ‘কিউনিফর্ম বর্ণমালা’ মানুষের ব্যবহূত প্রথম বর্ণমালা। আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে এই বর্ণমালা প্রচলিত হয়েছিল। আব্বাসীয় বংশের রাজত্বকালে তাদের রাজধানী ছিল বাগদাদ। বাগদাদ জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা, শিক্ষা-দীক্ষায় প্রভূত উন্নতি লাভ করে। যদিও হালাকু খানের ধ্বংসলীলার শিকার হয়েছিল বাদগাদ সে যুগে। কিন্তু ইরাকের বর্তমান দুঃখের ইতিহাস শুরু হয় প্রথম মহাযুদ্ধের সময়। তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্য অধিকৃত ইরাক দখল করে ইংরেজরা। ১৯২০ সালে ইরাকিরা বিদ্রোহ করলে নির্মম হাতে তা দমন করে ইংরেজরা। এরপর থেকে গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের শেষ পর্যন্ত ইরাকের ইতিহাস একটা ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ইতিহাস। শিখণ্ডীদের মাধ্যমে ইরাক শাসনের চেষ্টা করেছে ইংরেজরা। চুক্তির পর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে কিন্তু ঝড় থামেনি। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪০ সালের ভেতর সাতটি সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে।
ইরাক আক্রমণের অজুহাত হিসেবে বুশ সরকার দুটি লক্ষ্যের কথা উল্লেখ করেছিল। একটি হচ্ছে সাদ্দাম কর্তৃক সংগৃহীত বিশাল অস্ত্রভান্ডার ধ্বংস করা এবং অন্যটি হচ্ছে স্বৈরাচারী সাদ্দাম হোসেনের অপসারণ। খুব কম মানুষই এ দুটি অজুহাত গ্রহণ করেছে। বুশ সাহেবের নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারটিই একটা সন্দেহজনক ব্যাপার। কাজেই তাঁর নেতৃত্বে ঘটা যেকোনো ব্যাপারকেই মানুষ সন্দেহের চোখে দেখবে, এটাই স্বাভাবিক। ইরাক দখলের পর অনেক চেষ্টা করেও দখলদারেরা কোনো অস্ত্রভান্ডার খুঁজে পায়নি। আমেরিকার অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে, যার দ্বারা তারা সাদ্দামের অস্ত্রভান্ডার অনায়াসেই খুঁজে পেতে পারত। এ ছাড়া তাদের পক্ষে অনেক ইরাকি কাজ করেছে, যারা অস্ত্রভান্ডারের খোঁজ দিতে পারত। দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্রভান্ডারের কথা বলে তারা ইরাক আক্রমণ করেছে কিন্তু অস্ত্রভান্ডার খুঁজে পায়নি। অর্থাত্ তারা জেনেশুনে নির্জলা মিথ্যা কথা বলেছে।
স্বৈরাচার দূর করার জন্য আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করেছে; এটা একটা খাঁটি পরিহাস। পৃথিবীতে তো অনেক স্বৈরাচারী রয়েছেন। আমেরিকা শুধু সাদ্দাম হোসেনের ব্যাপারে উত্সাহী কেন? ইরাক ও ইরানের আট বছরব্যাপী যুদ্ধের সময় আমেরিকা সাদ্দামকে মদদ জুগিয়েছে। ১৯৬৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর প্রায় তিন দশক পর্যন্ত সাদ্দাম হোসেন স্বৈরাচারী ছিলেন না আমেরিকার চোখে। কিন্তু হাঠাত্ করে তাদের চোখে সাদ্দাম এত খারাপ হয়ে গেলেন কেন? সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে ইসলামি জঙ্গিদের যোগাযোগ ছিল কি? এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সাদ্দাম হোসেনের যত দোষ থাকুক না কেন, ধর্মকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন—এ অপবাদ তাঁকে কেউ দিতে পারবে না।
এসব মিথ্যা কথা বলে আমেরিকা তবে ইরাক আক্রমণ করল কেন?
তেলের জন্য? উড়িয়ে দেওয়া যায় না কথাটা।
একটি শক্তিশালী আরব দেশ ইসরায়েলের জন্য বিপজ্জনক? কথাটার পেছনে যুক্তি আছে।
আমার সহকর্মী ও বন্ধু ইরাকিদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি। তাঁদের অনেকেই বিশ্বাস করেন যে সাদ্দামকে উত্খাত করার জন্য আমেরিকার সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। তাঁদের অনেকের ধারণা, গণতন্ত্রের শুরুতে আমেরিকার সাহায্য ইরাকের দরকার ছিল। তাঁদের কেউ আমাকে এমন কথাও বলেছেন যে ব্রিটিশদের দেওয়া বিচারব্যবস্থা ও সিভিল সার্ভিস ইত্যাদি পাক-ভারত উপমহাদেশের দেশগুলোকে সাহায্য করেছে। কথাগুলো ভেবে দেখার মতো। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রে অধিকৃত দেশ কি আক্রমণকারী দেশের দ্বারা উপকৃত হয়েছে? যদিও অধিকৃত দেশের উপকারের জন্য নয়, বরং নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আক্রমণকারীরা অন্য দেশ আক্রমণের মতো ঘৃণ্য কাজ করে থাকে।
আরও একটি কথা মনে পড়ে এ প্রসঙ্গে। একটি দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা আক্রমণকারীদের সাহায্য করে। দেশের ভেতর অবিচার চরম আকার ধারণ করলে এবং জাতির একটি দুর্বল অংশ বিচারের কোনো সম্ভাবনা না দেখলে অনেক সময় পূর্বাপর চিন্তা না করে অবাঞ্ছিত বহিঃশত্রুর সাহায্য নেয়। কাজটা ভালো নয়। এতে করে কেউ লাভবান হয় না। তবে পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল নয়।
আমেরিকা যখন ইরাক আক্রমণ করে, তখন কুর্দিরা সৈন্য দিয়ে তাদের সাহায্য করেছে। তারা কিছু লাভবানও হয়েছে। এখন কুর্দিস্তান প্রায় স্বাধীন। কিন্তু তারা নির্বাচন বর্জনের হুমকি দিচ্ছে শিয়াপ্রধান সরকারের কাছ থেকে প্রচুর হিস্যা না পাওয়ার জন্য।
এতকালের শক্তিশালী সুন্নিরা কি শিয়াপ্রধান সরকারের কাছ থেকে আশানুরূপ হিস্যা পাবে?
আমেরিকা কি চিরদিন ইরাকে থেকে মুরব্বির ভূমিকা পালন করতে পারবে? রাস্তা থেকে আমেরিকান সেনা ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার পর ইরাকে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড বেড়ে গেছে। চুক্তি অনুযায়ী ২০১১ সালে আমেরিকার সব সেনা চলে গেলে ইরাকে কী ঘটবে?
মৃতদেহ গণনার পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় দেড় লাখ ইরাকি প্রাণ হারিয়েছে। নেতাদের দরকষাকষি দেখার জন্য আরও ইরাকি কি হাসিমুখে প্রাণ দেবে? ইরাকের নতুন এই ‘এক্সপেরিমেন্টের’ জন্য আরও কতজনকে প্রাণ দিতে হবে? মার্কিন সেনাদের প্রাণহানি আর কত দিন আমেরিকাবাসী চুপ করে দেখবে?
এত কাঠখড় পুড়িয়ে নির্বাচন হলেই কি ইরাকের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? বিশেষ করে তিনটি প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক যখন সুমধুর নয়।
ওয়াহিদ নবী: লন্ডন প্রবাসী। গবেষক ও মনোরোগবিশেষজ্ঞ।
No comments