বাঁধা আছে সূর্যের কাছে -মানুষের মুখ by আকমল হোসেন
সূর্যের কাছে বাঁধা পড়ে আছেন একজন হরদেব পাঁশি। সেই ভোরবেলা যখন পুবের আকাশ লাল করে সূর্য ওঠে, কাজের জায়গায় তাঁর চলে আসা। আবার যখন গোধূলির আলো ছড়িয়ে সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ে, তবেই তাঁর ছুটি, তাঁর ঘরে ফেরা। না, এ জন্য কোনো আফসোস নেই। বরং পোড়খাওয়া মুখের বলিরেখায় আলোর উচ্ছ্বাস ফুটিয়েই বলেন, ‘খারাপ লাগবে কেন বাবু। ভালো লাগে। এ জন্যই তো কাজ করছি।’
ফাল্গুনের মাঝামাঝি সময়, বাতাসে গরমের আঁচ। পথে পথে শুকনো ঝরাপাতা। চা-গাছের রং কেমন হালকা খয়েরি। ছায়াবৃক্ষও পুরোনো পাতা ঝরানোর খেলায় মেতেছে। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুগাছ চৌমোহনা থেকে ভানুগাছ-ধলই সীমান্ত সড়কের চা-বাগানের ভেতর দিয়ে পিচঢালা পথে এগিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়ে দুই পাশে চা-বাগানের এ রকমই ছবি। এই পথ পার হয়ে যেখানে গাড়ি থামল, সেই স্থানটি বাংলাদেশ আর ভারতের সীমানারেখার প্রান্ত, ধলই সীমান্ত। স্থানটি পড়েছে কমলগঞ্জ উপজেলায়। সেখানে একপাশে বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) ফাঁড়ি, অন্য পাশে চা-বাগানের টিলার ঢালুতে একটি স্মৃতিসৌধ। স্মৃতিসৌধটি বাংলার অকুতোভয় এক মুক্তিযোদ্ধা—পাকিস্তানি হানাদারদের শিবির তছনছ করে দিতে জীবন যাঁর কাছে ছিল তুচ্ছ—বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমানের।
বিডিআরের অনুমতি নিয়ে স্মৃতিসৌধের দিকে অগ্রসর হতেই এগিয়ে এলেন ৫০ পার হওয়া এই তামাটে মানুষ। একটা শ্রমজীবী জীবন ঘাঁটানোর ছাপ যাঁর পুরো মুখে। বললেন, ‘স্মৃতিসৌধে জুতা খুলে উঠবেন বাবু।’ কেন জানি চমকে উঠলাম, ফিরে তাকালাম তাঁর মুখের দিকে। প্রান্তিক এক মানুষ, সভ্যতার আলো-আঁধারি রং থেকে যে অনেক অনেক দূরে থাকে। সেই এক মানুষের কাছে স্মৃতিসৌধটি এখন এক পবিত্রতম স্থান। মনে পড়ল, এই তো কিছুদিন আগে পার করে আসা একুশে ফেব্রুয়ারিতে জুতা নিয়ে স্মৃতিসৌধে ওঠা কতিপয় ওজনদার মানুষের চেহারা!
আগে এই স্মৃতিসৌধটি ছিল না। ২০০৬ সালে স্মৃতিসৌধটি হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ রাইফেলসের উদ্যোগে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছিল বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের রণাঙ্গনের স্মৃতিবিজড়িত এ স্থানটিতে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাঙালির শ্রেষ্ঠসন্তানদের একজন হামিদুর রহমান ধলই সীমান্ত ফাঁড়িতে অবস্থান করা পাকিস্তানি হানাদারদের ঘাঁটি দখলে নিতে মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। জীবনের মায়া তাঁকে একবারের জন্যও পিছু টানেনি। ১৯৭১ সালের ২৮ অক্টোবর গুলি করতে করতে কখন ঢুকে পড়েন শত্রুর ঘেরাটোপের ভেতর। যুদ্ধ করতে করতে এখানেই শত্রুর গুলিতে প্রাণ হারান। পরে সতীর্থরা তাঁকে কাঁধে করে বয়ে এনে সীমান্তের ওপারে ভারতের আমবাসা গ্রামে কবর দেন। ২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁর কবর ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়।
হরদেব পাঁশি বললেন, ‘আমি এখন বাবু এই স্মৃতিসৌধ দেখাশোনা করি। এখানে ফুল লাগিয়েছি। ঘাস কাটি। ফুলগাছে পানি দিই। ঝাড়ু দিই।’ হরদেব পাঁশি জানান, প্রতিদিনই এখানে ছোট-বড় গাড়ি নিয়ে অনেকেই ছুটে আসেন। কোনো কোনো দিন পঞ্চাশ-ষাটজনও হয়ে যায়। এখন এই সবকিছুরই দেখাশোনা করতে হয় তাঁকে। জানালেন, সেই যে সকালবেলা যখন দিনের আলো ফোটা শুরু হয়, হরদেব পাঁশি বাগানের বস্তির ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। এসেই স্মৃতিসৌধে পতাকা উঠান। সেই পতাকা ওড়ে সারাটা দিন। সূর্য নিভে গেলেই পতাকা নামিয়ে তাঁর ঘরে ফেরার কথা মাথায় আসে। এর জন্য কি টাকা-পয়সা পান? হরদেব পাঁশি জানান, ২০০৭ পর্যন্ত তিনি এই কাজের জন্য মাসে এক হাজার ৮০০ টাকা পেতেন। ২০০৮ থেকে সেটা বন্ধ আছে। তবে ২০০৯ সালে বিডিআরের মহাপরিচালক তাঁকে থোক ৪৩ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। তা দিয়ে ঋণটিন শোধ করেছেন। ২০০৭ সালে ছেলে প্রদীপ পাঁশি এসএসসি পাস করেছিল। কলেজে ভর্তি করিয়েছিলেন। কিন্তু টাকার অভাবে কলেজে নিয়মিত পড়াতে পারেননি। স্ত্রী, তিন ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। এই সংসার চলে কীভাবে? হরদেব পাঁশি বলেন, ‘পরিবার (স্ত্রী) বাগানে কাজ করে। এটা দিয়ে কোনো মতে চলি।’
এর পরও কাজ করছেন কেন? বললেন—‘এখানে কাজ করতে ভালো লাগে। এই ভালো লাগারও কারণ আছে বাবু। বাবার অনেক সম্পদ ছিল। মুক্তিযুদ্ধে সব গেছে। সাতটা গরু ছিল। দেড় টাকা হালিতে বিক্রি করছি। মায়ের সোনাদানা বেচে তামাদি করে বিলাইয়া গেল। আমরার ঘর-দুয়ার সব খালি হইয়া গেল।’ স্মৃতিসৌধের প্রতি টানের শেষ এখানেই না। তাঁর এক বড় ভাই রামজনম পাঁশি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। হরদেব পাঁশি হয়তো এসব কারণে নিজের বেঁচে থাকার যুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধকে একাকার করে ফেলেছেন। যা চলছে তো চলছেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল ১৫ বছর। উদ্বাস্তু হওয়া যুদ্ধের সেই সময়টিকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। মানুষের দুর্ভোগ, কষ্ট, সব হারানোর বেদনা তাঁকে হয়তো এখনো প্লাবিত করে। বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান যেন তাঁরই এক ভাই, যাঁর স্মৃতিসৌধ আগলে রাখা এখন তাঁর পরম কাজ। এখানে চাওয়া-পাওয়ার কথা বড় নয়।
হরদেব পাঁশি বলেন, ‘উনারা (দর্শনার্থী) আসেন। ফটো তোলেন। দেখি। এভাবে চলে আরকি। সারা দিনই এখানে কাটাই। আগে এখানে টয়লেট ছিল না। তখন ফাঁকে-ফুকে কাজ করতাম। এখন চাবি আমার কাছে। তাই কোথাও যাই না। লোকে যদি চাবি না পায়। আমার তো বদনাম হইব!’
আরও একবার চমকানোর পালা। যার কাজ সে যদি ঠিকমতো পালন না করে, তাহলে বদনাম হবে। এই প্রান্তিক মানুষটিকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি, বলে দেয়নি। নিজের অন্তরের তাগাদা থেকে, দায়বোধ থেকে তিনি এ উপলব্ধিটুকু অর্জন করে নিয়েছেন।
ফাল্গুনের মাঝামাঝি সময়, বাতাসে গরমের আঁচ। পথে পথে শুকনো ঝরাপাতা। চা-গাছের রং কেমন হালকা খয়েরি। ছায়াবৃক্ষও পুরোনো পাতা ঝরানোর খেলায় মেতেছে। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুগাছ চৌমোহনা থেকে ভানুগাছ-ধলই সীমান্ত সড়কের চা-বাগানের ভেতর দিয়ে পিচঢালা পথে এগিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়ে দুই পাশে চা-বাগানের এ রকমই ছবি। এই পথ পার হয়ে যেখানে গাড়ি থামল, সেই স্থানটি বাংলাদেশ আর ভারতের সীমানারেখার প্রান্ত, ধলই সীমান্ত। স্থানটি পড়েছে কমলগঞ্জ উপজেলায়। সেখানে একপাশে বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) ফাঁড়ি, অন্য পাশে চা-বাগানের টিলার ঢালুতে একটি স্মৃতিসৌধ। স্মৃতিসৌধটি বাংলার অকুতোভয় এক মুক্তিযোদ্ধা—পাকিস্তানি হানাদারদের শিবির তছনছ করে দিতে জীবন যাঁর কাছে ছিল তুচ্ছ—বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমানের।
বিডিআরের অনুমতি নিয়ে স্মৃতিসৌধের দিকে অগ্রসর হতেই এগিয়ে এলেন ৫০ পার হওয়া এই তামাটে মানুষ। একটা শ্রমজীবী জীবন ঘাঁটানোর ছাপ যাঁর পুরো মুখে। বললেন, ‘স্মৃতিসৌধে জুতা খুলে উঠবেন বাবু।’ কেন জানি চমকে উঠলাম, ফিরে তাকালাম তাঁর মুখের দিকে। প্রান্তিক এক মানুষ, সভ্যতার আলো-আঁধারি রং থেকে যে অনেক অনেক দূরে থাকে। সেই এক মানুষের কাছে স্মৃতিসৌধটি এখন এক পবিত্রতম স্থান। মনে পড়ল, এই তো কিছুদিন আগে পার করে আসা একুশে ফেব্রুয়ারিতে জুতা নিয়ে স্মৃতিসৌধে ওঠা কতিপয় ওজনদার মানুষের চেহারা!
আগে এই স্মৃতিসৌধটি ছিল না। ২০০৬ সালে স্মৃতিসৌধটি হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ রাইফেলসের উদ্যোগে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছিল বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের রণাঙ্গনের স্মৃতিবিজড়িত এ স্থানটিতে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাঙালির শ্রেষ্ঠসন্তানদের একজন হামিদুর রহমান ধলই সীমান্ত ফাঁড়িতে অবস্থান করা পাকিস্তানি হানাদারদের ঘাঁটি দখলে নিতে মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। জীবনের মায়া তাঁকে একবারের জন্যও পিছু টানেনি। ১৯৭১ সালের ২৮ অক্টোবর গুলি করতে করতে কখন ঢুকে পড়েন শত্রুর ঘেরাটোপের ভেতর। যুদ্ধ করতে করতে এখানেই শত্রুর গুলিতে প্রাণ হারান। পরে সতীর্থরা তাঁকে কাঁধে করে বয়ে এনে সীমান্তের ওপারে ভারতের আমবাসা গ্রামে কবর দেন। ২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁর কবর ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়।
হরদেব পাঁশি বললেন, ‘আমি এখন বাবু এই স্মৃতিসৌধ দেখাশোনা করি। এখানে ফুল লাগিয়েছি। ঘাস কাটি। ফুলগাছে পানি দিই। ঝাড়ু দিই।’ হরদেব পাঁশি জানান, প্রতিদিনই এখানে ছোট-বড় গাড়ি নিয়ে অনেকেই ছুটে আসেন। কোনো কোনো দিন পঞ্চাশ-ষাটজনও হয়ে যায়। এখন এই সবকিছুরই দেখাশোনা করতে হয় তাঁকে। জানালেন, সেই যে সকালবেলা যখন দিনের আলো ফোটা শুরু হয়, হরদেব পাঁশি বাগানের বস্তির ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। এসেই স্মৃতিসৌধে পতাকা উঠান। সেই পতাকা ওড়ে সারাটা দিন। সূর্য নিভে গেলেই পতাকা নামিয়ে তাঁর ঘরে ফেরার কথা মাথায় আসে। এর জন্য কি টাকা-পয়সা পান? হরদেব পাঁশি জানান, ২০০৭ পর্যন্ত তিনি এই কাজের জন্য মাসে এক হাজার ৮০০ টাকা পেতেন। ২০০৮ থেকে সেটা বন্ধ আছে। তবে ২০০৯ সালে বিডিআরের মহাপরিচালক তাঁকে থোক ৪৩ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। তা দিয়ে ঋণটিন শোধ করেছেন। ২০০৭ সালে ছেলে প্রদীপ পাঁশি এসএসসি পাস করেছিল। কলেজে ভর্তি করিয়েছিলেন। কিন্তু টাকার অভাবে কলেজে নিয়মিত পড়াতে পারেননি। স্ত্রী, তিন ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। এই সংসার চলে কীভাবে? হরদেব পাঁশি বলেন, ‘পরিবার (স্ত্রী) বাগানে কাজ করে। এটা দিয়ে কোনো মতে চলি।’
এর পরও কাজ করছেন কেন? বললেন—‘এখানে কাজ করতে ভালো লাগে। এই ভালো লাগারও কারণ আছে বাবু। বাবার অনেক সম্পদ ছিল। মুক্তিযুদ্ধে সব গেছে। সাতটা গরু ছিল। দেড় টাকা হালিতে বিক্রি করছি। মায়ের সোনাদানা বেচে তামাদি করে বিলাইয়া গেল। আমরার ঘর-দুয়ার সব খালি হইয়া গেল।’ স্মৃতিসৌধের প্রতি টানের শেষ এখানেই না। তাঁর এক বড় ভাই রামজনম পাঁশি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। হরদেব পাঁশি হয়তো এসব কারণে নিজের বেঁচে থাকার যুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধকে একাকার করে ফেলেছেন। যা চলছে তো চলছেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল ১৫ বছর। উদ্বাস্তু হওয়া যুদ্ধের সেই সময়টিকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। মানুষের দুর্ভোগ, কষ্ট, সব হারানোর বেদনা তাঁকে হয়তো এখনো প্লাবিত করে। বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান যেন তাঁরই এক ভাই, যাঁর স্মৃতিসৌধ আগলে রাখা এখন তাঁর পরম কাজ। এখানে চাওয়া-পাওয়ার কথা বড় নয়।
হরদেব পাঁশি বলেন, ‘উনারা (দর্শনার্থী) আসেন। ফটো তোলেন। দেখি। এভাবে চলে আরকি। সারা দিনই এখানে কাটাই। আগে এখানে টয়লেট ছিল না। তখন ফাঁকে-ফুকে কাজ করতাম। এখন চাবি আমার কাছে। তাই কোথাও যাই না। লোকে যদি চাবি না পায়। আমার তো বদনাম হইব!’
আরও একবার চমকানোর পালা। যার কাজ সে যদি ঠিকমতো পালন না করে, তাহলে বদনাম হবে। এই প্রান্তিক মানুষটিকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি, বলে দেয়নি। নিজের অন্তরের তাগাদা থেকে, দায়বোধ থেকে তিনি এ উপলব্ধিটুকু অর্জন করে নিয়েছেন।
No comments