এশিয়াজুড়ে মূল্যস্ফীতির চাপ ও বাংলাদেশ by আসজাদুল কিবরিয়া
বিশ্বমন্দার একটা ভালো দিক অন্তত ছিল। বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম কমে গিয়েছিল। ফলে বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের আমদানি ব্যয়ও কিছুটা কমে যায়। এর প্রভাবে দেশের ভেতর মূল্যস্ফীতির চাপ অনেকটা সহনীয় হয়ে আসে। এটা একটা সুযোগও তৈরি করেছিল। আর তা হলো, তুলনামূলক কম দামে কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি করে শিল্পের উত্পাদন জোরদার করা। বাংলাদেশ প্রথম সুবিধাটা নিতে পেরেছিল। তবে তা নিজস্ব ক্ষমতায় নয়, পরিস্থিতির চক্রে। দ্বিতীয় সুবিধাটা কাজে লাগানো যায়নি। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নীতি-নির্ধারকদের অদূরদর্শিতাই এর কারণ।
তার মানে এই নয় যে মন্দাকে সমর্থন করতে হবে অথবা বারবার মন্দা ফিরে আসার প্রত্যাশা করতে হবে। কেননা, মন্দার সময় মূল্যস্ফীতির চাপ কম থাকে—এটা পুরো চিত্রের খণ্ডিত অংশমাত্র। পুরো চিত্রটি দেখলে বোঝা যায়, মন্দা শেষ পর্যন্ত সুখকর কিছু বয়ে আনতে পারে না। বিশেষ করে কোনো সুযোগ থাকার পরও তা যদি কাজে লাগানো না যায়।
পরিস্থিতি এখন অবশ্য অন্যদিকে ঘুরে গেছে। ২০০৮ সালের শেষ ভাগে যে মন্দার যাত্রা শুরু, তা ২০০৯ সালের প্রথম ভাগে গভীর হয়। উন্নত দেশগুলোতে শিল্পের উত্পাদন হ্রাস পায়। বহু মানুষ কাজ হারায়। আর্থিক খাতের কর্মকাণ্ড শ্লথ হয়ে পড়ে। আমেরিকা ও ইউরোপ ছাড়িয়ে এ মন্দার ধাক্কা এশিয়াতেও এসে লাগে। অবশ্য মন্দা মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশ বিপুল পরিমাণ অর্থ ঢেলেছে। আর তা এসেছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। উদ্দেশ্য ছিল, অর্থ ব্যয় করে চাহিদা জাগিয়ে রাখা, যেন তা মেটাতে পণ্য ও সেবা জোগানের জন্য উত্পাদকেরা এগিয়ে আসেন। এ ছাড়া আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। অন্যভাবে বললে, মন্দা মোকাবিলায় সরকারগুলো যে ধরনের সম্প্রসারণমূলক রাজস্ব ও সংকুলানমুখী মুদ্রানীতি গ্রহণ করে। এসব নীতির আওতায় মন্দার সময় জনগণকে খরচ করতে উত্সাহিত করা এবং উদ্যোক্তাদের উত্পাদন ধরে রাখার জন্য সরকার বিভিন্ন ধরনের কর ছাড় ও নগদ ভর্তুকি দিয়েছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার কমিয়েছে। বলা যায়, এসব পদক্ষেপ এখনো বহাল আছে।
এর সমন্বিত ফল হিসেবে দেখা যায়, ২০০৯ সালের শেষ ভাগ থেকে বিভিন্ন দেশ মন্দা কাটিয়ে উঠছে—বিশেষ করে এশিয়ার প্রধান অর্থনীতিগুলোর অর্থনীতি আবার জোরালো হতে শুরু করে। দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়তে থাকে। আর চাহিদা বাড়ার জের ধরে আবার মূল্যস্ফীতি ভালোভাবেই মাথাচাড়া দিয়েছে।
এশিয়ার প্রধান অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর প্রমাণ মেলে শিল্পের উত্পাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে। জাপানকে বাদ দিয়ে এশিয়ার প্রধান দেশগুলোর সমন্বিত শিল্পের উত্পাদন অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে যথাক্রমে ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ ও ১৫ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে বেড়েছে, যেখানে সাধারণভাবে ৯ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধিকেই জোরালো বিবেচনা করা হয় (দ্য ইকোনমিক টাইমস, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১০)। নীতি পদক্ষেপের কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় অনেক নীতিনির্ধারক আবার এ রকমও ভাবছেন যে যদি এসব নীতি-সহায়তা প্রত্যাহার করা হয়, তাহলে হয়তো চাহিদা আবার কমে যাবে। ফলে এসব উদ্দীপনামূলক কর্মসূচি কত দিন বহাল রাখা হবে বা কত দ্রুত সীমিত করা হবে, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। যদিও গত দুই মাস ধরে চীন ব্যাংকপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে সুদের হার বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়ে আভাস দিয়েছে যে তারা নিয়ন্ত্রণমূলক মুদ্রানীতির দিকে অগ্রসর হবে। অন্যদিকে ভারত সরকার ২০১০-১১ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট ঘোষণা করেছে, তাতেও খুব দ্রুত প্রণোদনা গুচ্ছ থেকে সরে আসার আভাস মেলেনি।
সমস্যা হলো, অভ্যন্তরীণ চাহিদা যে হারে বেড়েছে, সে হারে বাড়ার প্রত্যাশা নীতিনির্ধারকদের ছিল বলে মনে হয় না। ফলে মূল্যস্ফীতিও যে এতটা দ্রুতহারে বেড়ে যাবে, তাও ঠিক পূর্বাভাসে মেলেনি। বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ তৈরির পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বৃদ্ধির চাপ। এটা আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া বাদে এশিয়ার প্রধান অর্থনীতির সবই জ্বালানি তেল ও তেলসামগ্রীর নিট আমদানিকারক।
আরেকটি বিষয় হলো, বাড়তি তারল্য—যাকে মোটাদাগে বলা যায়, ব্যাংকে প্রচুর পরিমাণ নগদ অর্থ জমে যাওয়া। এটা বেড়ে গিয়ে স্থাবর সম্পত্তির, বিশেষত জমি ও বাড়ির দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। একদিকে সুদের হার কম, অন্যদিকে ব্যাংকে প্রচুর অর্থ জমে আছে। তার মানে কম খরচে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে। এর ফলে ভোক্তারা ঋণ নিয়ে জমি ও বাড়ি কেনার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এটা জমি ও বাড়ির দাম অস্বাভাবিকহারে বাড়িয়ে দিচ্ছে। চীনের ৩৬টি শহরের সম্পত্তির একটি সূচক আছে, যা এক বছরের ব্যবধানে ২৫ শতাংশ বেড়েছে।
খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে চাল, চিনি, দুধ, ভোজ্যতেল ইত্যাদির দাম প্রায় সব দেশেই বিভিন্ন হারে বাড়ছে। চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড—সর্বত্রই মোটামুটি একই চিত্র (ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১০)। ২০০৯ সালে বড় ধরনের খরার মধ্যে পড়ায় ভারতে খাদ্যের মূল্যস্ফীতির হার বছর শেষে দুই অঙ্কের ঘর ছাড়িয়ে গেছে। আর এ বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভারতে খাদ্যের মূল্যস্ফীতির হার ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ফিলিপাইনে অতিবৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হওয়ায় দেশটিকে ২০ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়েছে। ভারত ও ভিয়েতনামের মতো দেশে শুধু চালের দামই মূল্যস্ফীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। এইচএসবিসির হিসাব অনুসারে, এশিয়ার উদীয়মান দেশগুলোয় সমন্বিতভাবে চালের দাম ২০ শতাংশ বাড়লে তা মূল্যস্ফীতির হার দেড় শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে দেয়। অর্থাত্ মূল্যস্ফীতির হার পাঁচ শতাংশ থাকলে তা হয়ে যাবে সাড়ে ছয় শতাংশ। আবার চালের দাম ৫০ শতাংশ বেড়ে গেলে তা মূল্যস্ফীতির হার তিন দশমিক ৭০ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ায়।
এশিয়াজুড়ে মূল্যস্ফীতির যে চাপ, তা থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। আর যেসব কারণে এশিয়ার প্রধান অর্থনীতিগুলোয় মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, এর কয়েকটি বাংলাদেশের জন্যও সত্য। তার মানে এই নয় যে এগুলোই বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির প্রধান নিয়ামক। এটা ঠিক বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাড়তি তারল্যজনিত চাপ। ব্যাংকগুলোয় প্রচুর অর্থ জমে আছে। প্রবাসী আয়ের উচ্চপ্রবাহ আসছে। শেয়ারবাজারও ক্রমেই স্ফীত হচ্ছে, যেখানে বাড়ছে ফটকা কারবার। এতে নির্দিষ্ট কিছু মানুষের হাতে প্রচুর অর্থ আসছে। এভাবে বাজারে বাড়ছে অর্থপ্রবাহ। অন্যদিকে বিনিয়োগে রয়েছে শ্লথগতি। ফলে অনেকেই জমি ও বাড়ি কেনার দিকে ঝুঁকছে, যা এসবের দাম বাড়াচ্ছে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি সামনের দিনগুলোয় আরও বাড়বে বলেই মনে হয়, যা যথেষ্ট শঙ্কার বিষয়।
সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, অর্থপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যাবে কি না। সুদের হার বাড়াবে কি না। সুদের হার বাড়াতে গেলে আবার তা বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকেই দেখা যায় যে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণপ্রবাহ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ৪১ শতাংশ। এ সময়ে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি শিল্পঋণ বিতরণ করা হয়েছে। তার মানে, অর্থপ্রবাহে কিছুটা রাশ টেনে ধরার সুযোগ আছে। কিন্তু এটা সমস্যা মোকাবিলার সীমিত একটি পদক্ষেপ।
সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে। পর্যাপ্ত জোগান থাকার পরও বাজারে চালের দাম বেড়ে গেছে। অর্থাত্ বাজারপ্রক্রিয়া ঠিকমতো কাজ করছে না। রয়েছে পরিবহনব্যয়জনিত সমস্যা। রেলপথে পণ্য পরিবহন বাড়ানো গেলে এ ব্যয় অনেকটাই কমতে পারে। পথে পথে চাঁদাবাজির উপদ্রবও কঠোর হাতে নির্মূল করা দরকার।
আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, চালের দাম সহনীয় রাখতে সরকার খোলাবাজারে ২২ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে তেমন সাড়া মিলছে না। অন্যদিকে বাজারে চালের দাম বাড়তি। তাহলে কি মানুষ বাজার থেকে চড়াদামে চাল কিনে খেতেই বেশি আগ্রহী? নাকি যে নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করে এ উদ্যোগ—তারা কি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাদের আয় সমন্বয় করে ফেলছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করাটা প্রয়োজন। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার রিকশাভাড়া ও সিএনজিভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি এখানে পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক।
asjadulk@gmail.com
তার মানে এই নয় যে মন্দাকে সমর্থন করতে হবে অথবা বারবার মন্দা ফিরে আসার প্রত্যাশা করতে হবে। কেননা, মন্দার সময় মূল্যস্ফীতির চাপ কম থাকে—এটা পুরো চিত্রের খণ্ডিত অংশমাত্র। পুরো চিত্রটি দেখলে বোঝা যায়, মন্দা শেষ পর্যন্ত সুখকর কিছু বয়ে আনতে পারে না। বিশেষ করে কোনো সুযোগ থাকার পরও তা যদি কাজে লাগানো না যায়।
পরিস্থিতি এখন অবশ্য অন্যদিকে ঘুরে গেছে। ২০০৮ সালের শেষ ভাগে যে মন্দার যাত্রা শুরু, তা ২০০৯ সালের প্রথম ভাগে গভীর হয়। উন্নত দেশগুলোতে শিল্পের উত্পাদন হ্রাস পায়। বহু মানুষ কাজ হারায়। আর্থিক খাতের কর্মকাণ্ড শ্লথ হয়ে পড়ে। আমেরিকা ও ইউরোপ ছাড়িয়ে এ মন্দার ধাক্কা এশিয়াতেও এসে লাগে। অবশ্য মন্দা মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশ বিপুল পরিমাণ অর্থ ঢেলেছে। আর তা এসেছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। উদ্দেশ্য ছিল, অর্থ ব্যয় করে চাহিদা জাগিয়ে রাখা, যেন তা মেটাতে পণ্য ও সেবা জোগানের জন্য উত্পাদকেরা এগিয়ে আসেন। এ ছাড়া আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। অন্যভাবে বললে, মন্দা মোকাবিলায় সরকারগুলো যে ধরনের সম্প্রসারণমূলক রাজস্ব ও সংকুলানমুখী মুদ্রানীতি গ্রহণ করে। এসব নীতির আওতায় মন্দার সময় জনগণকে খরচ করতে উত্সাহিত করা এবং উদ্যোক্তাদের উত্পাদন ধরে রাখার জন্য সরকার বিভিন্ন ধরনের কর ছাড় ও নগদ ভর্তুকি দিয়েছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার কমিয়েছে। বলা যায়, এসব পদক্ষেপ এখনো বহাল আছে।
এর সমন্বিত ফল হিসেবে দেখা যায়, ২০০৯ সালের শেষ ভাগ থেকে বিভিন্ন দেশ মন্দা কাটিয়ে উঠছে—বিশেষ করে এশিয়ার প্রধান অর্থনীতিগুলোর অর্থনীতি আবার জোরালো হতে শুরু করে। দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়তে থাকে। আর চাহিদা বাড়ার জের ধরে আবার মূল্যস্ফীতি ভালোভাবেই মাথাচাড়া দিয়েছে।
এশিয়ার প্রধান অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর প্রমাণ মেলে শিল্পের উত্পাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে। জাপানকে বাদ দিয়ে এশিয়ার প্রধান দেশগুলোর সমন্বিত শিল্পের উত্পাদন অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে যথাক্রমে ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ ও ১৫ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে বেড়েছে, যেখানে সাধারণভাবে ৯ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধিকেই জোরালো বিবেচনা করা হয় (দ্য ইকোনমিক টাইমস, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১০)। নীতি পদক্ষেপের কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় অনেক নীতিনির্ধারক আবার এ রকমও ভাবছেন যে যদি এসব নীতি-সহায়তা প্রত্যাহার করা হয়, তাহলে হয়তো চাহিদা আবার কমে যাবে। ফলে এসব উদ্দীপনামূলক কর্মসূচি কত দিন বহাল রাখা হবে বা কত দ্রুত সীমিত করা হবে, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। যদিও গত দুই মাস ধরে চীন ব্যাংকপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে সুদের হার বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়ে আভাস দিয়েছে যে তারা নিয়ন্ত্রণমূলক মুদ্রানীতির দিকে অগ্রসর হবে। অন্যদিকে ভারত সরকার ২০১০-১১ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট ঘোষণা করেছে, তাতেও খুব দ্রুত প্রণোদনা গুচ্ছ থেকে সরে আসার আভাস মেলেনি।
সমস্যা হলো, অভ্যন্তরীণ চাহিদা যে হারে বেড়েছে, সে হারে বাড়ার প্রত্যাশা নীতিনির্ধারকদের ছিল বলে মনে হয় না। ফলে মূল্যস্ফীতিও যে এতটা দ্রুতহারে বেড়ে যাবে, তাও ঠিক পূর্বাভাসে মেলেনি। বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ তৈরির পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বৃদ্ধির চাপ। এটা আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া বাদে এশিয়ার প্রধান অর্থনীতির সবই জ্বালানি তেল ও তেলসামগ্রীর নিট আমদানিকারক।
আরেকটি বিষয় হলো, বাড়তি তারল্য—যাকে মোটাদাগে বলা যায়, ব্যাংকে প্রচুর পরিমাণ নগদ অর্থ জমে যাওয়া। এটা বেড়ে গিয়ে স্থাবর সম্পত্তির, বিশেষত জমি ও বাড়ির দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। একদিকে সুদের হার কম, অন্যদিকে ব্যাংকে প্রচুর অর্থ জমে আছে। তার মানে কম খরচে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে। এর ফলে ভোক্তারা ঋণ নিয়ে জমি ও বাড়ি কেনার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এটা জমি ও বাড়ির দাম অস্বাভাবিকহারে বাড়িয়ে দিচ্ছে। চীনের ৩৬টি শহরের সম্পত্তির একটি সূচক আছে, যা এক বছরের ব্যবধানে ২৫ শতাংশ বেড়েছে।
খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে চাল, চিনি, দুধ, ভোজ্যতেল ইত্যাদির দাম প্রায় সব দেশেই বিভিন্ন হারে বাড়ছে। চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড—সর্বত্রই মোটামুটি একই চিত্র (ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১০)। ২০০৯ সালে বড় ধরনের খরার মধ্যে পড়ায় ভারতে খাদ্যের মূল্যস্ফীতির হার বছর শেষে দুই অঙ্কের ঘর ছাড়িয়ে গেছে। আর এ বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভারতে খাদ্যের মূল্যস্ফীতির হার ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ফিলিপাইনে অতিবৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হওয়ায় দেশটিকে ২০ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়েছে। ভারত ও ভিয়েতনামের মতো দেশে শুধু চালের দামই মূল্যস্ফীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। এইচএসবিসির হিসাব অনুসারে, এশিয়ার উদীয়মান দেশগুলোয় সমন্বিতভাবে চালের দাম ২০ শতাংশ বাড়লে তা মূল্যস্ফীতির হার দেড় শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে দেয়। অর্থাত্ মূল্যস্ফীতির হার পাঁচ শতাংশ থাকলে তা হয়ে যাবে সাড়ে ছয় শতাংশ। আবার চালের দাম ৫০ শতাংশ বেড়ে গেলে তা মূল্যস্ফীতির হার তিন দশমিক ৭০ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ায়।
এশিয়াজুড়ে মূল্যস্ফীতির যে চাপ, তা থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। আর যেসব কারণে এশিয়ার প্রধান অর্থনীতিগুলোয় মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, এর কয়েকটি বাংলাদেশের জন্যও সত্য। তার মানে এই নয় যে এগুলোই বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির প্রধান নিয়ামক। এটা ঠিক বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাড়তি তারল্যজনিত চাপ। ব্যাংকগুলোয় প্রচুর অর্থ জমে আছে। প্রবাসী আয়ের উচ্চপ্রবাহ আসছে। শেয়ারবাজারও ক্রমেই স্ফীত হচ্ছে, যেখানে বাড়ছে ফটকা কারবার। এতে নির্দিষ্ট কিছু মানুষের হাতে প্রচুর অর্থ আসছে। এভাবে বাজারে বাড়ছে অর্থপ্রবাহ। অন্যদিকে বিনিয়োগে রয়েছে শ্লথগতি। ফলে অনেকেই জমি ও বাড়ি কেনার দিকে ঝুঁকছে, যা এসবের দাম বাড়াচ্ছে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি সামনের দিনগুলোয় আরও বাড়বে বলেই মনে হয়, যা যথেষ্ট শঙ্কার বিষয়।
সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, অর্থপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যাবে কি না। সুদের হার বাড়াবে কি না। সুদের হার বাড়াতে গেলে আবার তা বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকেই দেখা যায় যে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণপ্রবাহ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ৪১ শতাংশ। এ সময়ে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি শিল্পঋণ বিতরণ করা হয়েছে। তার মানে, অর্থপ্রবাহে কিছুটা রাশ টেনে ধরার সুযোগ আছে। কিন্তু এটা সমস্যা মোকাবিলার সীমিত একটি পদক্ষেপ।
সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে। পর্যাপ্ত জোগান থাকার পরও বাজারে চালের দাম বেড়ে গেছে। অর্থাত্ বাজারপ্রক্রিয়া ঠিকমতো কাজ করছে না। রয়েছে পরিবহনব্যয়জনিত সমস্যা। রেলপথে পণ্য পরিবহন বাড়ানো গেলে এ ব্যয় অনেকটাই কমতে পারে। পথে পথে চাঁদাবাজির উপদ্রবও কঠোর হাতে নির্মূল করা দরকার।
আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, চালের দাম সহনীয় রাখতে সরকার খোলাবাজারে ২২ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে তেমন সাড়া মিলছে না। অন্যদিকে বাজারে চালের দাম বাড়তি। তাহলে কি মানুষ বাজার থেকে চড়াদামে চাল কিনে খেতেই বেশি আগ্রহী? নাকি যে নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করে এ উদ্যোগ—তারা কি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাদের আয় সমন্বয় করে ফেলছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করাটা প্রয়োজন। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার রিকশাভাড়া ও সিএনজিভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি এখানে পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক।
asjadulk@gmail.com
No comments