জেলেনস্কির প্রশংসা করলেন ট্রাম্প: মার্কিন কংগ্রেসে তীব্র হট্টগোল ওয়াকআউট

মার্কিন কংগ্রেসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভাষণের সময় তীব্র হট্টগোল হয়। ডেকোরাম লঙ্ঘন করে প্রতিবাদ-পাল্টা প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে কংগ্রেস। এক পর্যায়ে ডেমোক্রেট কোনো কোনো সদস্যকে হাউস থেকে বাইরে বের করে নেয়া হয়। বার্নি স্যান্ডার্সের মতো বর্ষীয়ান সিনেটর ওয়াকআউট করেন।

ট্রাম্পের প্রতিবাদ জানিয়ে ডেমোক্রেট অনেক সদস্য স্লোগান লেখা টি-শার্ট পরেন। ওদিকে ইউক্রেনে শান্তিচুক্তিতে প্রস্তুত বলে শক্তিশালী সিগন্যাল দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ওভাল অফিসে শোডাউন পর্বের পর আলোচনার টেবিলে ফিরতে প্রস্তুত জানিয়ে ট্রাম্পকে চিঠি লিখেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তার এমন অবস্থানের প্রশংসা করেছেন ট্রাম্প। মঙ্গলবার রাতে কংগ্রেসে ম্যারাথন ১০০ মিনিট ভাষণ দেন ট্রাম্প। তাতে তিনি জেলেনস্কির এমন সাড়া দেয়ার ব্যাপক প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, জেলেনস্কি তার সঙ্গে একটি চুক্তি করার কথা বলেছেন। এই চুক্তিবলে ইউক্রেন থেকে বিরল খনিজ পদার্থ অনুসন্ধান করার অনুমতি পাবে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো। একই সঙ্গে ইউরোপিয়ান দেশগুলোর সমালোচনা করেন ট্রাম্প। বলেন, তারা ইউক্রেনকে সহায়তা করার চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করছে রাশিয়ার তেলের পেছনে। বিস্তৃত ইস্যুতে দেয়া বক্তব্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভূয়সী প্রশংসা করেন ইলন মাস্কের নেতৃত্বে পরিচালিত ডজ-এর। মার্কিনিরা বর্তমানে যেসব সমস্যা মোকাবিলা করছে তার জন্য তিনি পূর্বসূরি সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে দায়ী করেন। ২০শে জানুয়ারি শপথ নিয়ে ক্ষমতায় আসার ৪৩ দিন অতিক্রম হয়েছে। এ সময়ে কী কী কাজ করেছেন তার বর্ণনা দেন ট্রাম্প। এ সময় প্রতিশ্রুতি দেন মহিলাদের স্পোর্টস থেকে ট্রান্সজেন্ডারদের নিষিদ্ধের পরিকল্পনা দ্বিগুণ করেছেন। এদিন পানামা ক্যানেল দখল করে নেয়ার পরিকল্পনা নতুন করে তুলে ধরেন। কিন্তু গ্রিনল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্র কিনে নেবে- এমন অবস্থান থেকে তাকে সরে আসতে দেখা যায়। তিনি বলেন, গ্রিনল্যান্ডের ভাগ্য নির্ধারণ করবেন সেখানে বসবাসকারী মানুষ। ট্রাম্প প্রথম ৬ সপ্তাহ হোয়াইট হাউসে ঘূর্ণিঝড় তুলে দিয়েছেন। তবে তাকে ছেড়ে দেননি বিরোধী দল ডেমোক্রেট সদস্যরা। তিনি মিথ্যা কথা বলেছেন বলে তাদের অভিযোগ। গত শুক্রবার জেলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্পের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের পর যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেন সম্পর্ক দৃশ্যত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এর পরপরই ইউক্রেনকে দেয়া সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন ট্রাম্প। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, ইউক্রেন থেকে বিরল খনিজ পদার্থ অনুসন্ধানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জেলেনস্কি-ট্রাম্প উত্তেজনার পর তাও মৃত্যুদশায় উপনীত হয়। কংগ্রেসে দেয়া ভাষণে ট্রাম্প বলেন, কিয়েভকে যুক্তরাষ্ট্রের শত শত কোটি ডলার পাঠানো নিয়ে তিনি সন্দিহান ছিলেন। এ সময় প্রশ্ন রাখেন, ডেমোক্রেটরা কি চায় যে, এই যুদ্ধ আরও ৫ বছর চলতে থাকুক। ব্যঙ্গ করে তিনি বলেন, সেটা হলে কী বিষয়টি ভালো হবে? এই উন্মাদনা বন্ধ করার সময় এসে গেছে। এখন সময় হলো হত্যা বন্ধ করা। এই কাণ্ডজ্ঞানহীন যুদ্ধ বন্ধের সময় এখন। যদি যুদ্ধ বন্ধ করতে চান, তাহলে উভয় পক্ষের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এটা নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে তিনি ‘সিরিয়াস আলোচনা’ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান। বলেন, ‘এরই মধ্যে শক্তিশালী সিগন্যাল পেয়েছেন যে, রাশিয়া শান্তির জন্য প্রস্তুত’। ট্রাম্প বলেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি চিঠি পেয়েছি। পরে তিনি জেলেনস্কির চিঠির বিষয় প্রকাশ করে বলেন, টেকসই একটি শান্তিতে পৌঁছাতে যত দ্রুত সম্ভব আলোচনার টেবিলে বসতে প্রস্তুত ইউক্রেন। ইউক্রেনের চেয়ে শান্তি অন্য কেউ বেশি চায় না। খনিজ ও নিরাপত্তা চুক্তির কথা বিবেচনা করে যেকোনো সময় চুক্তি স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত ইউক্রেন। ট্রাম্প বলেন, এই চিঠি পাঠানোর জন্য আমি তার (জেলেনস্কি) প্রশংসা করি। তবে ইউক্রেন ইস্যুতে ইউরোপের অবস্থান নিয়ে সমালোচনা করেন ট্রাম্প। বলেন, ইউক্রেনের নিরাপত্তার জন্য যে পরিমাণ অর্থ খরচ করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ ইউরোপ খরচ করছে রাশিয়ার তেল ও গ্যাস কিনতে।

উল্লেখ্য, ওভাল অফিসে উত্তেজনার পর শান্তি সমঝোতায় উদ্যোগ নিয়েছেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার এবং ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন। কিন্তু ট্রাম্প এখনো শান্তিচুক্তির প্রচেষ্টাকে সামনে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন। ডেমোক্রেট প্রতিনিধি আল গ্রিনের বিতণ্ডার কারণে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয় কংগ্রেসে। এরপর তাকে যখন সেখান থেকে বের করে নেয়া হয় তখন বক্তব্য দেয়া শুরু করেন ট্রাম্প। তার বক্তব্যের সময় বার বার প্রেসিডেন্টের বক্তব্যে ছেদ ঘটানো এবং তাকে ক্ষুব্ধ করার জন্য বেশ কয়েকবার প্রতিবাদের কৌশল অবলম্বন করেন ডেমোক্রেটরা। এতে পাত্তা না দিয়ে ট্রাম্প তার বক্তব্যে অটল ছিলেন। হাউস চেম্বারে স্পিকারের রোস্ট্রাম থেকে ট্রাম্প ঘোষণা করেন- আমেরিকা ইজ ব্যাক। এ সময় রিপাবলিকান সদস্যরা দাঁড়িয়ে তাকে অভিবাদন জানান। তারা ‘ইউএসএ’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। অন্যদিকে ডেমোক্রেটরা নীরবে বসে থাকেন। তাদের কারও কারও কাছে প্রতিবাদের বিভিন্ন প্রতীক দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্র যখন সংকটজনক অবস্থানে, তখনই প্রেসিডেন্ট এই ভাষণ দিয়েছেন। মুদ্রাস্ফীতি এবং জীবনযাপনের খরচ এখনো অনেক বেশি। বাণিজ্য যুদ্ধের ভয় আছে। দেশ যেদিকে এগিয়ে আছে তাতে এক জরিপে মার্কিনিদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা গিয়েছে। উপরন্তু সরকার আগামী ১৪ই মার্চ শাটডাউনের মুখোমুখি হবে, যদি এদিন আইনপ্রণেতারা একটি বাজেট পাস করতে ব্যর্থ হন। এসব প্রতিকূল পরিস্থিতির বিষয় হাউস চেম্বারে তোলা হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেই কংগ্রেসে প্রতিবাদ শুরু করেন ডেমোক্রেটরা। তারা ট্রাম্পকে এদিন বিব্রত করতে কাজ করেছেন। সরাসরি টেলিভিশনেও তাদেরকে এমনটা করতে দেখা গেছে। ট্রাম্প তার পথ দিয়ে অতিক্রমের সময় নিউ মেক্সিকোর ডেমোক্রেট প্রতিনিধি মেলানি স্ট্যান্সবারি একটি লেখা তুলে ধরেন। তাতে লেখা- এটা কোনো স্বাভাবিক অবস্থা নয়। ক্যামেরায়ও এই চিহ্ন দেখা গেছে। এক পর্যায়ে টেক্সাসের রিপাবলিকান প্রতিনিধি ল্যান্স গুডেন তা সরিয়ে নেন।

ট্রাম্প বক্তব্য শুরু করার ৫ মিনিটের মধ্যে ডেমোক্রেটরা প্রতিবাদে সোচ্চার হন। তাদের একজনকে ক্যাপিটল সিকিউরিটি হাউস চেম্বার থেকে নিরাপত্তা দিয়ে বের করে নেন। রিপাবলিকান আল গ্রিন প্রতিবাদে স্থির থাকেন। তার হাতের বেত প্রেসিডেন্টকে দেখিয়ে দোলাতে থাকেন। তিনি ট্রাম্পকে দুয়োধ্বনি দিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন- মেডিকএইড কর্তনের কোনো ম্যান্ডেট আপনার নেই। এ সময় ‘ইউএসএ, ইউএসএ’ স্লোগান দিয়ে তার কণ্ঠকে হারিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন রিপাবলিকানরা। স্পিকার মাইক জনসন চেম্বারের সভাপতিত্ব করেন। চেষ্টা করেন হাউসে শৃঙ্খলা ফেরাতে। তিনি বলেন, সদস্যদেরকে হাউসের নির্দেশনা সমুন্নত ও ডেকোরাম সুরক্ষিত রাখতে। আর কোনো বিঘ্ন ঘটাবেন না। এটা আপনাদের জন্য একটি সতর্কতা। তার এ কথা শেষ হতেই রিপাবলিকানরা উল্লাস করতে থাকেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ডায়াসে গিয়ে দাঁড়ান এবং হাততালি দেন।

কিন্তু আল গ্রিন তার ক্ষোভ প্রকাশ বন্ধ না করলে জনসন বলেন, মিস্টার গ্রিন, আপনার সিটে বসুন। শেষ পর্যন্ত তিনি নির্দেশ দেন। বলেন, এই ভদ্রলোককে চেম্বার থেকে সরিয়ে দিয়ে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য সার্জেন্টদের নির্দেশ দিচ্ছে চেয়ার। এরপরই নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা চেম্বার থেকে বের করে নেন আল গ্রিনকে। রিপাবলিকানরা উল্লাস করে চিৎকার করতে থাকেন- তাকে বের করে নাও। এক পর্যায়ে ডেকোরাম মেনে চলার অনুরোধ করেন জনসন। ঘটনা যা ঘটে গেছে তা নীরব হয়ে দেখছিলেন ট্রাম্প। তিনি শেষ পর্যন্ত বলেন, ধন্যবাদ। এটা বলেই তিনি বক্তব্য শুরু করেন। ওদিকে হাউস চেম্বারের বাইরে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আল গ্রিন। তিনি বলেন, এটাই এর মূল্য। এই শাস্তি আমি মেনে নেবো। জনগণের জানা উচিত যে, এই প্রেসিডেন্ট মেডিকেয়ার, মেডিকএইড এবং সোশ্যাল সিকিউরিটির বিরুদ্ধে তার ইচ্ছামতো অর্থ কর্তন করবেন। আমাদের মতো কিছু মানুষ আছেন, যারা প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। ডিমের উচ্চমূল্যের জন্য যখন সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে দায়ী করছিলেন তখনই ডেমোক্রেট প্রতিনিধি জেসমিন ক্রোকেটের  নেতৃত্বে অনুসারী প্রতিনিধি অ্যান্ড্রেয়া সালিনাস, ম্যাক্সিন ডেক্সটার চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসেন। এ সময় তারা কালো টি-শার্ট পরেন। এর পেছনে ইংরেজিতে লেখা ‘রেজিস্ট’। এদিন সন্ধ্যার আরও পরে ট্রাম্পের বক্তব্যের মধ্যেই ওয়াকআউট করেন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স। ট্রাম্পের বক্তব্যের মধ্যেই অন্য ডেমোক্রেটরা বিভিন্ন রকম ‘সাইন’ প্রদর্শন করতে থাকেন। তাতে লেখা ছিল ‘মাস্ক চুরি করে’ এবং ‘সেভ মেডিকএইড’। ইলিনয়ের ডেমোক্রেট প্রতিনিধি ডেলিয়া রমিরেজ একটি টি-শার্ট পরেন তার ব্লেজারের নিচে। ওই টি-শার্টে লেখা ছিল- ‘নো কিং। নো ক্যু’। চূড়ান্ত প্রতিবাদ এবং ডেকোরাম লঙ্ঘন করে হাউস ও সিনেট ডেমোক্রেট নেতারা এসকর্ট কমিটিতে যোগ দেয়া ত্যাগ করেননি। এসকর্ট কমিটি সাধারণত প্রেসিডেন্টকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে। এটি দ্বিপক্ষীয় একটি বিষয়। ট্রাম্পের নীতি, অতিরিক্ত নির্বাহী ক্ষমতার ব্যবহার এবং সরকারে কর্তন পদ্ধতি নিয়ে ডেমোক্রেটদের সঙ্গে অনৈক্য সৃষ্টি হয় ট্রাম্পের। তিনি চেম্বারে প্রবেশ করতেই বহু ডেমোক্রেট ট্রাম্পকে তাদের পশ্চাৎদেশ প্রদর্শন করেন।
তবে ট্রাম্প বলতে থাকেন, কংগ্রেসে এটা আমার পঞ্চম বক্তব্য। আরও একবার আমার সামনে ডেমোক্রেটদের দেখতে পাচ্ছি। বুঝতে পারছি তাদেরকে সন্তুষ্ট রাখতে অথবা তাদের মুখে হাসি ফোটাতে অথবা তাদের প্রশংসা করার মতো কোনো কথা বলার নেই আমার। তাদের জন্য কিছুই করতে পারবো না। আমি শুধু সবচেয়ে বিপর্যয়কর রোগগুলোর প্রতিকার খুঁজতে পারবো। যে রোগ পুরো জাতিকে শেষ করে দিতে পারে। অপরাধকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারবো। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.