‘গণপরিষদ’ ও ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ সামনে আসছে জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলোর মতভিন্নতা by সেলিম জাহিদ
জামায়াত মনে করে, ‘গণপরিষদ’ ও ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ কীভাবে হবে, সেটার কোনো ব্যাখ্যা আসেনি। এই পদক্ষেপ বিতর্ক তৈরি করতে পারে।
ইসলামী আন্দোলন মনে করে, সংবিধানের ব্যাপক সংস্কার অনুমোদনে ‘গণপরিষদ’ হতে পারে। ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠায়ও তাদের আপত্তি নেই। তবে এসব করতে গিয়ে যাতে কোনোভাবেই জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি না হয়।
৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর থেকে এ পর্যন্ত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতৃত্বের সঙ্গে জামায়াতসহ ইসলামপন্থীদের কোনো বিষয়ে তেমন মতবিরোধ দেখা যায়নি। এখন ‘গণপরিষদ’ ও ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ নিয়ে বিতর্কে কিছুটা মতভিন্নতা সামনে আসছে।
ছাত্র-তরুণদের নতুন দল এনসিপির নেতারা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নতুন করে আর কোনো ফ্যাসিস্ট যাতে তৈরি হতে না পারে, সে জন্য সংবিধানসহ রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল সংস্কার করতে হবে। সংবিধানের ব্যাপক সংশোধনের লক্ষ্যে গণপরিষদ নির্বাচন করতে হবে। এ লক্ষ্যে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করতে হবে। তাঁদের মতে, প্রথম রিপাবলিক হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন। মুক্তিযুদ্ধের পর যে সংবিধান প্রণীত হয়েছে, সেই সংবিধানে কাঠামোগত ত্রুটির কারণে সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী কর্তৃত্বপরায়ণ ও ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠে। এই কাঠামো বারবার সংশোধন করা হয়েছে বিদ্যমান সংবিধানের ভিত্তিতে। এখন মৌলিক পরিবর্তনগুলো করতে হলে সংবিধানে ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। এটিকেই তারা ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ বলছেন।
এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের আজ বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘তারা কিছু শব্দ (গণপরিষদ, সেকেন্ড রিপাবলিক) বলেছে, কিন্তু এগুলো কীভাবে হবে তার কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। আমরা মনে করি, এই মুহূর্তে এখনকার পরিস্থিতিতে এসব বিষয় নতুন করে বিতর্ক তৈরি করবে, নির্বাচনকে বিলম্বিত করবে এবং দেশকে কিছুটা অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যেতে পারে।’ জামায়াতের এই নেতা মনে করেন, এমন পরিস্থিতির উদ্ভব এড়াতে জরুরি কিছু সংস্কার শেষ করে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠান সমাধানের উত্তম পন্থা হতে পারে।
‘গণপরিষদ’ গঠন ও ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে নীতিগতভাবে একমত ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড রিপাবলিকের নজির আছে। সুতরাং এটা হতে পারে। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন সংবিধান সংশোধনের যে লিখিত প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে তারা সংবিধানের আমূল পরিবর্তন চেয়েছে। সেটা করতে হলেও ‘গণপরিষদ’ বা ‘গণভোট’ প্রয়োজন হবে। সে বিবেচনায় তারা এ বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত। তবে এসব করতে গিয়ে যাতে নতুন করে কোনো সংকট তৈরি না হয়, সে ব্যাপারেও তারা সতর্ক। দলটির অবস্থান, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে যথাসময়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে।
ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গণহত্যাকারীদের বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন; তিনটাই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি, বিএনপি যা চায়, তার বাইরে কিছুই হয় না। আমরা স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে চাইলাম, বিএনপির এর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমরা সংস্কার চাইলাম, বিএনপি চায় দ্রুত নির্বাচন। এখন সংস্কার আলোচনাতেই নেই। আমরা দেখছি, সবকিছুতে বিএনপির চিন্তাই প্রতিফলিত হচ্ছে।’
ইসলামী আন্দোলনের এই নেতা বলেন, ‘এ জন্যই আমরা বারবার বলছি, সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো পরিবেশ হয়নি। প্রশাসন নিরপেক্ষ হয়নি। তার জন্যই সংস্কার দরকার।’
জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের বাইরে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রয়েছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। দলটি ছাত্রদের ‘গণপরিষদ’ ও ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’-এর মতো তাত্ত্বিক বিষয়ে সম্পৃক্ত হতে চায় না। জমিয়তের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানিয়েছেন, তাঁদের অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার। তাঁরা প্রয়োজনীয় সংস্কার করে ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান চান। বরং দলটি ছাত্রদের সাম্প্রতিক তৎপরতার বিষয়ে সতর্ক।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটা নতুন দল আত্মপ্রকাশ করেছে। আমরা তাদের স্বাগত জানাই। তবে আমরা তাদের দলীয় অবস্থানে রাষ্ট্রের কোনো সম্পৃক্ততা চাই না। অন্যান্য দল যেভাবে দল পরিচালনা করে, তারাও সেভাবে করবে। তাদের জাতি গ্রহণ করলে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনা আর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা এক নয়। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের আলাদা স্বকীয়তা আছে। এখানে (ছাত্রদের) রাষ্ট্র যাতে পৃষ্ঠপোষকতা না করে।’
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২২ অক্টোবর ‘সেকেন্ড রিপাবলিকের’ বিষয়টি প্রথম আলোচনায় এনেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। সেদিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা ও রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে ‘বিপ্লবী ছাত্র-জনতার গণজমায়েত’ থেকে পাঁচ দফা দাবি জানানো হয়েছিল। তার মধ্যে একটি ছিল জুলাই বিপ্লবের চেতনার আলোকে ২০২৪-পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণে নতুন করে প্রক্লেমেশন অব রিপাবলিক ঘোষণা।
জুলাই-অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা নতুন দল গঠন করে গণপরিষদ গঠন ও সেকেন্ড রিপাবলিকের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে রাজনৈতিক মহলে বিতর্ক শুরু হয়েছে। গণপরিষদ ও সেকেন্ড রিপাবলিকের চিন্তাকে নিজেদের পাণ্ডিত্য জাহির করার চেষ্টা বলেও মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন নেতা। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনপ্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করা এবং রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র আছে বলেও সন্দেহ করছেন দলটির নেতারা।
অবশ্য এ ক্ষেত্র ভিন্নমত জানান বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক। তিনি বলেন, ‘এসব কাজ (গণপরিষদ ও সেকেন্ড রিপাবলিক) করতে গিয়ে নির্বাচন প্রলম্বিত হওয়ার আশঙ্কার যে বিষয়টা, সেটাকে আমি বড় ধরনের কোনো সমস্যা মনে করি না। সমস্যা যেটা, সেটা হলো বর্তমান সরকারের নানা দুর্বলতা দৃশ্যমান। এটা দূরে করে আমূল সংস্কারের মাধ্যমে চলমান রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনার হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে গিয়ে নির্বাচন যদি একটু বিলম্বিতও হয়, সেটাকে দেশের স্বার্থে মেনে নিতে আমরা প্রস্তুত।’
![]() |
রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দলটির নেতারা গণপরিষদ নির্বাচন ও ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করবেন বলে ঘোষণা দেন। ফাইল ছবি: প্রথম আলো |
No comments