অনৈচ্ছিক অন্তর্ধানের বিরুদ্ধে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম মারুফ জামানের বিবৃতি
শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন এবং আন্তর্জাতিক আধিপত্যের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য বলপূর্বক গুম-এর শিকার হওয়া মানুষগুলির পক্ষ থেকে দেশের বীর অগ্রদূতদের জানাই অভিনন্দন। বলপূর্বক গুমের পরিবারের সদস্যদের তরফ থেকে প্রায় দুই হাজার বীর শহীদদের আমি স্যালুট জানাই। এরাই আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতার প্রকৃত নায়ক। এই সাহসী যুবকরা দৃঢ় সংকল্পের সাথে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিল, সমস্ত নির্যাতন ও যন্ত্রণা সহ্য করেছিল। কিন্তু মাতৃভূমির প্রতি তাদের প্রগাঢ় ভালোবাসার জন্য কখনোই হাল ছেড়ে দেননি।
আমরা প্রায় ২০,০০০ প্রকৃত দেশপ্রেমিক বা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানাই। যারা বর্ডার গার্ড, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, সোয়াট টিম, প্যারা মিলিটারি ফোর্সের পাশাপাশি সশস্ত্র আওয়ামী লীগের ছাত্র গুন্ডাদের দ্বারা নির্বিচারে গুলি চালানোর ফলে মারাত্মক বুলেটে আহত হয়েছেন।
অলিগার্কিক শাসন রীতিমতো একটি হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। দেশব্যাপী কারফিউ জারি করা হয়েছিল। বিক্ষোভকারীদের দমন করার জন্য সমস্ত উপলব্ধ সংস্থান মোতায়েন করা হয়েছিল। হাসিনা আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার BTR 80s মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছিলেন যেখান থেকে ৭.৬২ মিমি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলি থেকে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়েছিল নিরস্ত্র জনতার ওপর।
গুলি চালানোর জন্য স্নাইপারদের ছাদে মোতায়েন করা হয়েছিল। হেলিকপ্টার থেকে অগ্নিসংযোগকারী বোমা, কাঁদানে গ্যাসের শেল এবং সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়েছিল। হেলিকপ্টারের ভেতরে থাকা র্যাব সদস্যরা তাদের অস্ত্রগুলি নীচের ভিড়ের মধ্যে ফেলে দিচ্ছিল এবং ছাদে যাদের দেখা গিয়েছিল তারা নিচে থাকা জনতাকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল, এমনকি শিশুদেরও বাদ দেয়নি তারা। এককথায় , নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। প্রায় ২০,০০০ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারী বন্দুকের গুলির আঘাতে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়েছে, শটগানের গুলির আঘাতে শত শত মানুষ স্থায়ীভাবে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। কাশ্মীরি স্বাধীনতাকামী নাগরিকদের উপর ভারতীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলি যে আচরণ দেখিয়েছিলো ঠিক অনুরূপ একটি কৌশল। জুলাইয়ে আমাদের রক্তক্ষয়ী বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী সত্যিকারের নায়করা এই ধরনের সমস্ত প্রতিকূলতাকে অস্বীকার করে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে। এইভাবে ৫ আগস্ট আমাদের বিজয় প্রাপ্তি ঘটে।
এই নিরস্ত্র যোদ্ধাদের আত্মত্যাগ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। অন্যায় ও বঞ্চনা থেকে মুক্ত করে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য তাদের স্বপ্ন ও আকাঙ্খা প্রতিফলিত হয়েছে, যা তুলে ধরে আমাদের পরবর্তী সংবিধান কেমন হওয়া দরকার। এই আত্মত্যাগ আমাদের ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে যা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য মেহনতি মানুষের সাথে জেনারেশন জেডের স্বপ্নকে প্রতিফলিত করে।
বলপূর্বক নিখোঁজদের পরিবারের পক্ষ থেকে আমি ‘অধিকার’ সহ বিশ্বব্যাপী এবং এশিয়ার সকল মানবাধিকার সংস্থার প্রতি আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, বিশেষ করে অনিচ্ছাকৃত নিখোঁজদের জন্য গঠিত এশিয়ান ফেডারেশন (AFAD) এবং তাদের সদস্য সংস্থার প্রতি। ‘অধিকার’ তাদের অটল সাহসী অবস্থান, অবিরাম এবং জোরালো প্রচারণার জন্য একাধিকবার শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের দ্বারা নিপীড়নের শিকার হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিশ্বব্যাপী দর্শকদের সামনে জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের দুর্দশার কথা তুলে ধরে AFAD একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।
আমরা সকলেই সচেতন যে, ‘জোরপূর্বক গুম’ একটি বৃহত্তর কৌশলের অংশ। দমনের হাতিয়ার হিসেবে এই কৌশল ব্যবহার করা হয়। যার লক্ষ্য ভিন্নমতাবলম্বীদের কণ্ঠস্বর নীরব করা এবং জনসাধারণের মধ্যে ভয় ও ভীতির পরিবেশ তৈরি করা। ফ্যাসিস্ট এবং নিপীড়নমূলক কর্তৃত্ববাদী শাসনগুলি তাদের বিরোধী এবং সমালোচকদের হুমকি দিতে বলপূর্বক গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার কৌশল ব্যবহার করেছে। আমরা জানি যে, জোরপূর্বক গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলো ক্ষমতাবান রাষ্ট্রনায়কদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সংগঠিত হয়। শেখ হাসিনার গত ১৬ বছরের বর্বর শাসনামলে ‘বলপূর্বক গুম’ তাদের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই) এর মহাপরিচালক সেই সময়কালে কিছু দুর্নীতিবাজ অফিসার এবং তাদের অধস্তনদের সাথে ক্ষমতার প্রতি ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠে। আইনের ত্রুটিগুলিকে কাজে লাগিয়ে তারা বিচারবহিৰ্ভূত হত্যাকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (RAW) নামে পরিচিত ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলো। এই প্রসঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ২০১২ এবং ২০১৭ সালে গোপনে ‘মউ’ স্বাক্ষরিত হয়। অন্যান্য সমস্ত চুক্তির সাথে বাংলাদেশের সকল নাগরিকদের সামনে এই তথ্য উন্মোচন করা প্রয়োজন।
এই ভাড়াটেদের বেসরকারি সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং সামরিক বাহিনীর মতো একই লাইনে পরিচালিত করা হয়েছিল যা সাধারণত ‘ব্ল্যাক ওয়াটারস’ বা রাশিয়ান ‘ওয়াগনার’স নামে পরিচিত। এই সশস্ত্র বাহিনীর অফিসারেরা তাদের অশুভ সাম্রাজ্য বাড়িয়ে চলেছে এবং ‘ব্ল্যাক ফান্ড’ এর অধীনে বিলিয়ন বিলিয়ন অডিট মুক্ত তহবিল আত্মসাৎ করেছে। তারা নিজেদের ‘দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড কিংস’ বা ‘নাইট কিং’ বলে ডাকত। অতিরিক্ত বিচারিক ক্ষমতা ব্যবহার করার পাশাপাশি প্রয়োজনে বন্দীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা, কোনো চিহ্ন ছাড়াই মৃতদেহকে স্থায়ীভাবে নিষ্পত্তি করার অধিকার ছিল তাদের হাতে। প্রায় ১৬ মাস ধরে গোপন কারাগারে বন্দী থাকার সময় বিষয়গুলি আমি জানতে পারি। এই কারাগারে চলতো অকথ্য নির্যাতন, একমাত্র রাশিয়ান গুলাগ বা কারাগারের সাথেই এর তুলনা করা যেতে পারে।
সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের জন্য গড়ে ওঠা একটি আধাসামরিক ইউনিট - র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন নিজেদের নৃশংস জার্মান এসএস-এর প্রতিরূপে রূপান্তরিত করেছিল। অ্যাডলফ হিটলারের কালো ইউনিফর্মধারী বাহিনীর মতো এই অভিজাত বাহিনী আওয়ামী লীগের ‘রাজনৈতিক সৈনিক’ হিসাবে কাজ করেছিল। অতিরিক্ত বিচারিক ক্ষমতা পেয়ে র্যাব সদস্যরা আরো ভয়ংকরে হয়ে ওঠে। ১০ ডিসেম্বর, ২০২১-এ, মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে বাংলাদেশের অভিজাত আধাসামরিক বাহিনী, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর সাতজন বর্তমান ও সাবেক অফিসারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। শেখ হাসিনার পতনের সাথে সাথে কালো ইউনিফর্মধারী ‘কুখ্যাত’ বিশেষ পুলিশ বাহিনী প্রশ্নের মুখে পড়ে। পরবর্তীকালে অসংখ্য টর্চার সেলের সন্ধান পাওয়া যায়।
‘ছাত্রলীগ’ নামে পরিচিত আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ছাত্র ফ্রন্ট ছিল সত্যিকারের কুখ্যাত ডেথ স্কোয়াডের প্রতিরূপ। এই ডেথ স্কোয়াড ফ্যাসিস্ট কসাই অ্যাডলফ হিটলারের সময় গড়ে ওঠে , নাম ছিল ‘ব্রাউন কোটস’। একইভাবে বেনিটো মুসোলিনির নেতৃত্বে মাথাচাড়া দেয় ‘কালো শার্ট’ যা ইতালিতে ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সহিংসতা এবং ভীতি প্রদর্শন করেছিল।
ডিজিএফআই-এর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তারা সারা বাংলাদেশে ২৩টি এরকম কারাগার স্থাপন করেছে। আমাকে ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বন্দুক দেখিয়ে জোরপূর্বক অপহরণ করা হয়। শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের কৌশলগুলো ছিল বর্ণনাতীত। প্রাথমিকভাবে থার্ড ডিগ্রি শারীরিক নির্যাতনের সাথে তুলনীয়। সহজ ভাষায় ফাঁসিতে ঝুলানোর সমান। কারাগারে মারাত্মকভাবে মারধর চলতো বন্দিদের ওপর যতক্ষণ না ভিকটিম অজ্ঞান হয়ে পড়ে। বন্দিদের শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে বৈদ্যুতিক প্রবাহ প্রয়োগ করা, ওয়াটার বোর্ডিং, ট্রুথ সিরাম ইনজেকশন ব্যবহার করা হতো। সৌভাগ্যবশত, বার্ধক্যের কারণে আমি এই ভয়ঙ্কর অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম।
যেহেতু এই সাইটগুলির স্মৃতিগুলি আমার মনে গভীরভাবে গেঁথে আছে আমি যা শুনেছি এবং অনুভব করেছি তা আজও মনে করতে পারি। ভুক্তভোগীদের উপর প্রয়োগ করা নির্যাতনের পদ্ধতিগুলি বিখ্যাত গুয়ানতানামো বে বন্দী শিবিরের কথা বা ইরাকের আবু ঘ্রাইবের বন্দীদের কথা মনে করিয়ে দেয়। যেখানে সৈন্যরা হাসিমুখে বন্দিদের ওপর নির্যাতন চালাতো। এই নৃশংসতা বিশ্বকে হতবাক করেছিল। তবুও অত্যাচারী আ.লীগ শাসন বারবার ও সুস্পষ্টভাবে বলপূর্বক গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রকাশ্যে এসব অপব্যবহার নিয়ে আবার বড়াই করেছেন। পরিবর্তে, কর্তৃপক্ষ প্রায়শই দাবি করে যে কিছু ব্যক্তি যাদেরকে জোরপূর্বক নিখোঁজ করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে বা গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে তা প্রমাণ করে যে তারা কখনই জোরপূর্বক নিখোঁজ হয়নি।
এই হত্যাকাণ্ডগুলিকে এমনভাবে দেখানো হয়েছে যেন ভিকটিম নিজেই তার পরিবারকে পরিত্যাগ করেছিল বা কর্মসংস্থানের সন্ধানে অন্য ধনী দেশে অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টা করার সময় সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিল। সুপরিকল্পিত মানহানিকর প্রচারণার বানোয়াট খেলা থেকে পরিবারের নারী সদস্যরাও রেহাই পায়নি। তাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা হুমকি ও হয়রানি করা হয়েছিল এবং মধ্যরাতে থানায় রিপোর্ট করতে বলা হয়েছিল। বলপূর্বক গুম শুধু একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনই নয়, এটি নিপীড়নের এমন এক হাতিয়ার যা সারা সমাজে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা ছড়ায়। দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশ এই ভয়াবহ বাস্তবতার সাথে পরিচিত।
২০২৪ এর ৫ আগস্ট আয়রন লেডি হিসাবে পরিচিত শেখ হাসিনা কয়েক সপ্তাহের রক্তক্ষয়ী বিক্ষোভের মধ্যে পদত্যাগ করেন এবং ভারতে পালিয়ে যান। হাসিনা শাসনের পতনের পরপরই শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের অধীনে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়; আমরা বিশ্বাস করি এই অন্তর্বর্তী সরকার এবং তার দল অখন্ড বাংলাদেশের জন্য 'আশার আলো' প্রজ্জলিত করবে।
পান্ডোরা বক্স খোলার সাথে সাথে সামনে আসতে থাকে বলপূর্বক গুমের শিকারদের অকল্পনীয় দুর্ভোগ ও যন্ত্রণার কথা, তাদের ওপর চালানো হয় ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কথা। ভুক্তভোগীরা নিজের এবং তাদের প্রিয়জনের জীবনের কথা ভেবে ক্রমাগত ভয়ের মধ্যে দিয়ে জীবন কাটাতো। তাদের সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল এবং আইনের সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। আমাদের মতো কয়েকজনকে যাদের হত্যা না করে জীবিত রাখা হয়েছিল মুক্তি পাওয়ার পরেও সেই মানসিক এবং শারীরিক ক্ষত ছিল নিখোঁজদের পরিবারের যন্ত্রণার সমান গভীর। সেই পরিবারগুলো জানতো-ও না তাদের প্রিয়জন বেঁচে আছে নাকি মৃত। এই অনিশ্চয়তা নিখোঁজদের পরিবারগুলিকে অর্থনৈতিক কষ্ট এবং হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত করেছিল। পরিবারের নারীদের কষ্ট ছিল সবথেকে বেশি। একদিকে বেঁচে থাকার সংগ্রাম, অন্যদিকে খুঁজে না পাওয়ার জ্বালা দুটোই তাদের সহ্য করতে হয়েছে। জোরপূর্বক নিখোঁজ হওয়ার প্রভাব সেই শিশুদেরও প্রভাবিত করেছে যারা হয়তো তাদের বাবা-মাকে হারিয়েছে এবং এই আঘাতের দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি ভোগ করছে। অনেক ক্ষেত্রে, শিশুদের কোনো আইনি বা আর্থিক সহায়তা ছাড়াই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ।
২০২৪ এর ৩০ আগস্ট বলপূর্বক নিখোঁজদের উদ্দেশে পালিত আন্তর্জাতিক দিবসে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক কনভেনশন ফর দ্য প্রোটেকশন অফ অল পার্সন ফ্রম এনফোর্সড ডিসপিয়ারেন্স (ICPPED) এ যোগদান করে একটি স্বাক্ষরকারী দেশ হয়ে ওঠে। এনফোর্সড ডিসপিয়ারেন্সের আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে ইউনূস সরকার সত্য, ন্যায়বিচার এবং ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যদের ক্ষতিপূরণের পথ প্রশস্ত করেছে।মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ হিসাবে বলপূর্বক গুমের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে, ২৭ আগস্ট, ২০২৪ -এ অন্তর্বর্তী সরকার ২০০৯ থেকে ২০২৪ এর ৫ আগস্ট পর্যন্ত সমস্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের তদন্তের আওতায় নিয়ে একটি পাঁচ সদস্যের কমিশন গঠন করে। কমিশন নিখোঁজ ব্যক্তিদের শনাক্ত করবে এবং কোন পরিস্থিতিতে তারা নিখোঁজ হয়েছে তা নির্ধারণ করবে। এতে সশস্ত্র বাহিনী সহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যেকোন সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত বলপূর্বক অন্তর্ধানের সমস্ত ঘটনা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
৯ নভেম্বর কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছিলেন যে, 'আমরা ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ১৬০০টি অভিযোগ পেয়েছি এবং আমরা অভিযোগের সংখ্যা দেখে বিস্মিত। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার ভয়ে এখনও অনেক লোক কমিশনে আসছেন না। এর থেকে, আমরা বুঝতে পারি যে ঘটনার সংখ্যা এখনও পর্যন্ত রিপোর্ট করা সংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি। 'কমিশনের একজন সদস্য জানিয়েছেন যে, ভুক্তভোগীদের অনেকেই কারাগারে রয়েছেন, কেউ কেউ এমনকি মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হয়েছেন। কারণ তাদের গ্রেপ্তার দেখানোর পরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। গুমের শিকার কিছু ব্যক্তি ভারতের কারাগারেও বন্দী রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শেষ করার আগে আমি বিবেচনার জন্য কয়েকটি ব্যবহারিক প্রস্তাব দিতে চাই। আমরা জীবিতরা এবং বলপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা যথাযথ বিচার চাই এবং প্রতিশোধ নয় বরং আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা চাই। তার জন্য নিম্নলিখিত সুপারিশগুলি পেশ করা হচ্ছে -
বলপূর্বক গুমের শিকার জীবিত ব্যক্তিদের উপযুক্ত কর্মসংস্থানসহ ক্ষতিপূরণ, পর্যাপ্ত সহায়তা জরুরি ভিত্তিতে প্রদান করা প্রয়োজন। বলপূর্বক গুমের শিকার সকলকে কারাদণ্ড ভোগ করা থেকে বা মিথ্যা অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেবার হাত থেকে মুক্তি দেওয়া উচিত।
বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন এবং জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে ডিসপিয়ারেন্স সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বারা দেশব্যাপী পর্যাপ্ত পদক্ষেপগুলি ত্বরান্বিত করা দরকার। এমনকি প্রান্তিক অঞ্চলে হলেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দ্বারা তাদের নাম এবং বিবৃতি ইত্যাদি রেকর্ড করা প্রয়োজন।
মনোসামাজিক প্রভাব বিবেচনা করে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জোরপূর্বক নিখোঁজের শিকার ব্যক্তিদের মানসিক স্বাস্থ্য পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার পাশাপাশি তাদের মনোসামাজিক সহায়তা প্রদানের প্রয়োজন। মানসিক সমর্থন প্রদান এই কারণে প্রয়োজন কারণ ভুক্তভোগীরা প্রায়শই গুরুতর মানসিক যন্ত্রণা অনুভব করে, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) এর মধ্যে থাকার। তাদের মাথায় আত্মহত্যার চিন্তাভাবনা, উদ্বেগ, নিদ্রাহীনতা কাজ করে।
উপযুক্ত পুনর্বাসন কর্মসূচী ব্যবস্থা প্রয়োজন। আর্থিক সহায়তা, চিকিৎসা সহায়তা এবং বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদান করা প্রয়োজন। যাতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা বিশেষ করে নারীরা এই বোঝা বহন করতে পারে। কারণ প্রিয়জনদের অনুপস্থিতিতে এখন তাদেরই উপার্জনকারীর ভূমিকা নিতে হবে।
জোরপূর্বক অন্তর্ধানের প্রভাব পড়ে শিশুদের ওপরও , যারা পিতামাতাকে হারিয়ে এই আঘাতের দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি ভোগ করছে। অনেক ক্ষেত্রে, শিশুদের কোনো আইনি বা আর্থিক সহায়তা ছাড়াই ছেড়ে দেওয়া হয়, যা তাদের দুর্বলতা এবং প্রান্তিকতাকে বাড়িয়ে তোলে। ক্ষতিপূরণ এবং নিখোঁজ ব্যক্তিদের জন্য একটি অফিস (ওএমপি) প্রতিষ্ঠা করলে তাদের দুর্ভোগ কিছুটা হলেও কমবে।
আমরা সকলেই সচেতন যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্যের প্রাথমিক উৎস ভিকটিম, তাদের পরিবারের সদস্য, সাক্ষী এবং সহযোগী ব্যক্তিরা। তাদের সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।
বলপূর্বক গুম যেমন শুধু অপহরণ নয়, বরং এগুলো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সুনিপুণ ও সমন্বিত অভিযান যা বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের সাথে জড়িত। নতুন আইনি কাঠামোতে বর্তমানে খসড়া তৈরি করা হচ্ছে। বিদ্যমান ত্রুটিপূর্ণ আইন সংশোধন করতে হবে, যাতে জোরপূর্বক অন্তর্ধানের এই অপরাধীদের মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের অধীনে এনে বিচার করা যায়। এইভাবে ন্যায়বিচার এবং ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে যাতে অপরাধীরা উপযুক্ত শাস্তি পায়।
ভবিষ্যত সরকারগুলিকে এই ধরনের জঘন্য অপরাধ থেকে নিরাপত্তা সংস্থাগুলিকে বিরত রাখার জন্য আইনি কাঠামোর বিধানগুলি শক্তিশালী করতে হবে। শুধু বলপূর্বক গুম নয়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনাগুলির আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য বিচার বিভাগীয় তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
বিগত ষোল বছরে ফ্যাসিবাদী শাসনামলে যে অপরাধগুলি সংঘটিত হয়েছে তার বিচার এনফোর্সড ডিসপিয়ারেন্স সম্পর্কিত আইনের অধীনে হয়েছে কিনা তা নিচিত করতে হবে। প্রস্তাবিত আইনি কাঠামোকে অবশ্যই সংস্কার করতে হবে যাতে নিরাপত্তা সংস্থাগুলিকে রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিগ্রস্ত প্রভাব থেকে বিরত রাখা যায়। তাদের অপরাধের জন্য দায়মুক্তির সংস্কৃতি চিরতরে শেষ করতে হবে।
No comments