শওকত আলীর গল্পে স্বপ্ন ও আকাঙক্ষার জীবনবেদ by সুশান্ত মজুমদার
সৃষ্টির
বিচারে কথাসাহিত্যে শওকত আলীর নান্দনিক অর্জন ও প্রভাব উপেক্ষা করা
অসম্ভব। বিষয়নিষ্ঠা ও জীবনমুখী প্রবাহ বিবেচনা করলে অবশ্যই স্বীকার করতে
হবে তাঁর শিল্পসিদ্ধির সফল সত্মর। অসাড়, পানসে, প্রচল, বহুল পঠনে নিষ্ফলা
গল্পের বিপরীতে সমাজবাসত্মবতার গল্প যাঁরা প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাঁদের
অন্যতম শওকত আলী। দেশভাগের পর খ–ত, ভেদবুদ্ধির গুণাতীত গল্পের অক্ষরকলা
মোকাবেলা করার প্রয়াসে তাঁর শ্রম নিবিড় ও উজ্জ্বল। এই ভূখ– স্বতন্ত্র
বৈশিষ্ট্যের যে-কথাসাহিত্য, বিশেষত গল্পের ধারা যাঁদের নিরলস অনুশীলনের
মাধ্যমে গড়ে উঠেছে, তাঁদের অন্যতম তিনি। বানোয়াট কেচ্ছা, মধ্যবিত্তের
বিবর্ণ উপাখ্যান পত্তন অস্বীকার করে গল্পে তিনি ধারণ করেছেন মানুষ, সংগ্রাম
এবং লড়াকু মানুষেরই প্রবল স্বপ্ন ও আকাঙক্ষা।
কর্মজীবনের কারণে রাজধানীতে বসবাস, তবু শওকত আলীর গল্প ঢাকাকেন্দ্রিক নয়। পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে সক্রিয় লেখালেখি শুরু করলেও ষাটের দশকে এসে তাঁর সাহিত্যের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা। আমাদের গল্প-সাহিত্যের পালে লেগেছে তখন উপযুক্ত বাতাস। বহুসত্মরা পর্যাপ্ত অর্থ সন্ধানের অভিপ্রায়ে লেখকরা প্রবেশ করেন জীবনের অমত্মর্লীন জগতে। নতুন সাহিত্যাদর্শের নামে লেখকদের অনেকে গল্পের আঙ্গিক বা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সচেষ্ট হন। নিজস্ব চর্চায় আস্থা রেখে জীবনবাদী গল্প-সাহিত্যে ভাষা-ভাবনা-মাত্রাযোগে শওকত আলী মনোনিবেশ করেন।
মেহনতি কিষান – যাঁদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই – এই তাঁরা শ্রমে, প্রাপ্তিতে প্রচ- মার-খাওয়া, বঞ্চিত; এই মানুষ মাটি আবাদ করে ফসল ফলায়, ফসল লালন করে; কিন্তু ফসল তুলে দিয়ে আসে মহাজনের গোলায়। চামড়া ফাটানো, হাড়-ছেঁদা তুমুল শীতের রাতে কিষানের মহাজনের ফসলও পাহারা দিতে হয়, বিনিময়ে সে হারায় স্বাস্থ্য, আয়ু ও সুখ। উত্তর বাংলার কিষানদের বিসত্মারিত জীবন নিয়ে এত গল্প শওকত আলীর মতো কোনো কথাশিল্পীই লেখেননি। উত্তরের জনগোষ্ঠী তাদের প্রাত্যহিক জীবন-সংসারের চালচিত্র জল-হাওয়া কথাসাহিত্যে রূপ দেওয়া এবং তা ব্যাপক পাঠক সমীপে উপস্থিত করার সিংহভাগ কৃতিত্ব শওকত আলীর প্রাপ্য। হাড্ডিসার, হাঁটুভাঙা মানুষ নিয়ে তাঁর কারবার অথচ তাঁর গল্পের মানুষ জীবন-জীবিকায় উপর্যুপরি মার খেতে খেতে বুক দিয়ে হেঁটে হলেও দাঁড়াতে প্রয়াস নেয় – পুরোপুরি ভেঙে পড়ে না। রুখে-দাঁড়ানো মানুষের স্বভাবের অমত্মর্গত – জেগে ওঠা সেই দ্রোহী মানুষ সংঘবদ্ধ হয় এবং মহাজনের ঘরে আগুন দিয়ে নিপীড়কের বিনাশ ঘটায়। কেবল ব্যর্থতার কাহিনি রচনা করে শওকত আলী জীবনকে নঞর্থক করে তোলেননি, জীবনে জীবন যোগ করে মানুষের সংগ্রামী রূপও গল্পে পেশ করেন। জীবন যে হারিয়ে ফুরিয়ে সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যায়নি, এখনো তার অবশিষ্ট আছে এবং সমুদয় প্রাপ্য আদায় সম্ভব সমষ্টির ঐক্যবদ্ধে তাই তাঁর গল্পের মর্মার্থ। শেষাবধি ইতিবাচক জীবনের গাথাই শওকত আলীর গল্পের উদ্দিষ্ট।
দেশভাগ-পরবর্তীকালের ছোটগল্পে সমাজের অসাম্য, অনাচার ও দুষ্টমতী মানুষের পাপাচার নিয়ে দুর্নীতির চিত্র থাকলেও তা কেবল অচঞ্চল স্থিরচিত্রই হয়ে থাকে। মানুষকে চলিষ্ণু মনে হয় না। শওকত আলীর গ্রাম ও চরিত্র পাঠকের পাশে যাতায়াত করে এবং মানুষের মর্যাদা দাবি করে। এমনকি শওকত আলীর গল্পের প্রকৃতিও জীবমত্ম। আবার প্রকৃতি শত্রম্নতাও করে। যে-জনপদের মানুষের জীবন তাঁর গল্পের বিষয় অনুরূপ নির্দয় প্রকৃতির সাক্ষাৎই আমরা পাই। প্রকৃতি মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি করে। অর্থাৎ গল্পের পরিপ্রেক্ষিতের অনুগামী হয়েছে প্রকৃতি। গল্পের সঙ্গে প্রকৃতি একাকার হয়ে থাকে। গল্পে শওকত আলী প্রকৃতিকে চাপিয়ে দেননি বা কোথাও থেকে তুলে এনে পরিপূরণ করেননি। প্রকৃতি থেকে মানুষ যেন বেরিয়ে আসে – উত্তরবাংলার আদিজগতের মতো গল্পের মানুষ রুক্ষ, রোদে পোড়া, শীতজর্জর, বৃষ্টিতে ভিজে অবসন্ন। তাঁর গল্পের মানুষ ও প্রকৃতিকে ছিঁড়ে তাই আলাদা করা যায় না। মানবজীবন ও প্রকৃতি অবিচ্ছিন্ন। কখনো কখনো সরাসরি না হলেও গল্পের পশ্চাৎপটে নৈসর্গিক উপাদানের প্রতীকী উপস্থাপনা উপস্থিত। এখানে বলার আছে যে, শওকত আলী মধ্যবিত্তের রুচি ও লাবণ্য, প্রীতিদায়ক আগ্রহ ও আসক্তি, শিহরণ-জাগানো অনুভূতির আধিক্য পরিবেশন করে পাঠককে পুলকিত করতে চাননি। তাঁর লেখক-মানসে মধ্যবিত্তের জীবনযাপনের চর্বিতচর্বণ ক্রিয়া করেনি। ভগ্ন, আপসকামী, দ্বিধাগ্রসত্ম, সংশয়াচ্ছন্ন মধ্যবিত্ত নিয়ে বাংলা গল্প-সাহিত্য থেকে শওকত আলীর গল্প স্বতন্ত্র। তাঁর গল্পের পোড়-খাওয়া চরিত্র ভেঙে পড়ে না, সাময়িক পরাজয়ের বার্তাও প্রকাশে অনাবশ্যক কাঁদে না। বরং প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত রাখা মুষ্টিমেয় শ্রেণিপ্রভু প্রতিপক্ষ দিনমজুরের উত্থানে কেঁপে ওঠে। এই কাঁপুনি গিয়ে স্পর্শ করে স্যাঁতসেঁতে গল্প-সাহিত্যের বিষয় ও শরীরে।
এগারোটি গল্প নিয়ে শওকত আলীর প্রথম গ্রন্থ উন্মূল বাসনার নামসূত্র বিশেস্নষণ করলে পাওয়া যায় মানবজীবনের কামনা ও অধীর অভিলাষের উপাখ্যান। কোনো কোনো আলোচকের মতে, উন্মূল বাসনা থেকে বেরিয়ে আসে লেখকের সাহিত্যিকসত্তার প্যাশননির্ভর রোমান্টিকতা। আমরা জানি, প্যাশন হচ্ছে প্রেম, ঘৃণা, ক্রোধের অনুভূতি, যার মধ্যে তীব্র উত্তেজনা। গ্রন্থভুক্ত গল্পগুলোর চরিত্রের ভ্রষ্টাচারে পরিষ্কার হয়ে যায় তারা উন্মার্গগামী। উত্তরাঞ্চলের বিত্তবানরা তাদের সমাজ-অনুপযুক্ত হীনপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করে নারীসঙ্গ প্রমোদে। হতদরিদ্র অসহায় নিতামত্ম খোসাসর্বস্ব নারীকে ইন্দ্রিয়-সেবায় ব্যবহার করে তারা। এমনকি ট্রাক ড্রাইভার, সাঁওতাল, চোর-বাটপার, রিফিউজি, চোরাচালানি সবাই অবৈধ কাজে লিপ্ত। নিঃস্ব কিষান তাঁর অসামর্থ্যের কারণে জোত-জমি-হালের মালিকের কাছে স্বীয় নারীকে বিলি করে দিচ্ছে। রিপুর প্রাবল্যে পুরুষ ভারসাম্যলুপ্ত মানসিকতা ও শরীরের উত্তেজনা চুকায়। ‘রঙ্গিনী’ গল্পে সংঘাত-ঈর্ষা-চিত্তচাঞ্চল্যের প্রকাশে শুনি : ‘সব নেশার চাইতে বড় নেশা হলো এই মেয়েমানুষ।’ ‘ফাগুয়ার পর’ গল্পে বৃদ্ধ সুখলাল নেশাখোর ছেলের জোয়ানি বউয়ের প্রতি লক্ষ নেই দেখে পুতের বউ গঙ্গাময়ীকে অন্য পুরুষের প্রতি তাকানো পাপ বলে উপদেশ দেয়। ‘ডাইন’ গল্পে সুবলা ও বিনোদচরণের স্মৃতিচারণেই জ্বলে ওঠে কামনার পুরনো আগুন ‘পুরুষের গলা জড়িয়ে ধরে না ঘুমোলে তোর ছাতি ঠান্ডা হতো না। প্রথম রাতে লোকটি ক্লামত্ম হয়ে ঘুমিয়ে পড়লে মাঝরাতে তুই তাকে আবার জাগাতিস। মনে পড়ে সুবলা।’ উন্মূল বাসনার গল্পগুলোর চারপাশের প্রকৃতি যেন সম্ভোগেচ্ছুকের পক্ষে সমর্থন দেয় শীত-বৃষ্টি-অন্ধকারের জোগান দিয়ে। ‘তৃতীয় রাত্রি’ গল্পে সার্কাসের বৃদ্ধ মৃত্যুপথযাত্রী সাজাহান ওসত্মাদকে আগলে বসে আছে অসমবয়সী বালিকা কাননবালা। এখানে সময়-প্রকৃতি, স্বজন-সংসারহীন মানুষ একাকার হয়ে যায় – ‘কে জানে ভোর হতে কতক্ষণ বাকী। বারান্দার বাইরে শ্মশানের ওপর শীতের দীর্ঘরাত আর কুয়াশাঢাকা বিশাল আকাশ একাকার হয়ে আছে। উত্তরের হাওয়া বয়ে যাচ্ছে নদীর ওপর দিয়ে। মেয়েটা অন্ধকারের দিকে চোখ মেলে রাখলো। পঞ্চচূড়া কাঞ্চনজংঘা আবার উত্তরের দিগমেত্ম ঝলমল করে উঠবে – যদি কাল আকাশ পরিষ্কার থাকে।’ জটিল রহস্যময় পরিবেষ্টন আর শরীরী ক্ষুধার উদ্রেকে পাঠকের অমত্মরাত্মা অনুশোচনা ও গস্নানিতে টাটিয়ে ওঠে। এমনকি অন্যথাচারীর অবৈধ সম্বন্ধ ও ক্রিয়াকলাপে আলেখ্যের পারিপার্শ্বিকতা পর্যমত্ম ভারি হয়ে যায়। গল্প সৃষ্টির এমন সার্থকতার জন্য সজ্ঞান পাঠক মনে করেন, উন্মূল বাসনার চরিত্রগুলো মনে হয় লেখকের নয়, তারা যেমন, তাদের চারপাশের পৃথিবীটা যেমন, লেখক যেন তেমনি যথাযথ তুলে দিয়েছেন ঘটনার ভাঁজে ভাঁজে। অধ্যবসায়ী পাঠক বিষয়ের আরো গভীর খনন করেন : প্রতিটি গল্পের অবলম্বন সমাজের পরাশ্রিতজন, প্রতিটি কাহিনিই শক্তিশূন্য পরাভূত মানুষের উপাখ্যান। জীবন সফলতার স্বাদবঞ্চিত যেসব মানুষ, পীড়নে, ছিবড়ে-যাওয়া ছিন্নভিন্ন তাদের অতলস্পর্শী বেদনা যেন ছুঁতে চেয়েছেন লেখক। শওকত আলীর উন্মূল বাসনায় রিরংসার ইচ্ছাপূরণে পুরুষের শিকার কেবল নারী। তাঁর গল্পে যে পুরুষতান্ত্রিক পলিস্ন সমাজের আদ্যোপামত্ম চিত্র, চরিত্রের পুনরাবৃত্তিময় আদিম মানসিকতা, প্রামিত্মক নিম্নবর্গের জীবনধারণ, তার উপস্থিতি, এমনকি অন্দর অবধি পৌঁছে যাওয়ায় আমরা বুঝতে পারি, যেখানে মানুষ শুধু পণ্য। যেখানে ধ্বংস হয়েছে মানবিকতা ও শুভবোধ। তবু জীবনপাত্রের তলানিতে পড়ে থাকা শেষ শাঁস নিয়ে মানুষ ধীরে ধীরে তার মেরুদ- ঋজু করতে তৎপর হয়। উন্মূল বাসনার ‘ডাইন’ গল্পে এর ইশারা লক্ষ করা যায় : ‘আকাশ ভরানো জ্যোৎস্না। আমগাছগুলো মাথা দোলাচ্ছে থেকে থেকে। হাটের আড়তে মিটমিট করে বাতি জ্বলছে। বাতি জ্বালিয়ে লোকটা এখন বুকের ধ্বক ধ্বক শব্দ নিয়ে অপেক্ষা করছে।’ শেষাবধি প্রতিবাদ ও শ্রেণিক্রোধের সাক্ষাৎ পাই শওকত আলীর লেলিহান সাধের গল্পসমূহে। চেতনাপ্রাপ্তির সুবাদে ন্যাড়া শুকনো বর্ণবঞ্চিত জনপদ কেঁপে ওঠে দলিত নিষ্পিষ্টদের প্রতিরোধে।
ধূসর কুয়াশার ভেতর দিয়ে চুইয়ে পড়ে জ্যোৎস্না, কখনো কুয়াশার মধ্যে অনাথ শিশুর মতো শুয়ে থাকে অন্ধকার, সত্মূপীকৃত খড় জ্বালিয়ে শীত থেকে রেহাই খোঁজে কিষান। এই কিষানের একটা জীবনের কত কথার গ্রন্থ শওকত আলীর লেলিহান সাধ। গল্পে আছে অগ্নিশিখার লকলকে জিভের মতো আগ্রাসী চরিত্রের তেজ ও প্রতাপের প্রকাশ। ‘একটি-দুটি করে লোক দেখা গেল একসময় বড় সড়কের ওপর। কৌতূহল না সমবেদনার কারণে তারা একে একে এসে পৌঁছাচ্ছিল বোঝা মুশকিল। তবে লোকগুলো ঈষৎ আন্দোলিত হচ্ছিল। আন্দোলিত হচ্ছিল যে তার প্রমাণ তারা ক্রমেই কাছাকাছি জড়ো হচ্ছিল এবং জড়ো হয়ে কাছে এগিয়ে আসছিল -’ এই উদ্ধৃতাংশ ‘নয়নতারা কোথায় রে’ গল্পের। কিষানদের আগমন, তাদের ঈষৎ আন্দোলন এবং জড়ো হয়ে তারা এগিয়ে এলে উত্তরবাংলার সমসত্ম জনপদ কেঁপে যায়। এই গল্পে মনোহরের সুন্দরী মেয়ে নয়নতারাকে মহাজনের পোষা মসত্মানরা ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। ঘটনা শুনে সহানুভূতিশীল পাড়া-প্রতিবেশীরা বড় সড়কের ওপর পরস্পর ঘনিষ্ঠ হয়। এমন জটলার মুখে পড়ে বাজার-ফেরা মহাজন। মনভোলানো কথা বলে সে মানুষের ক্রোধ কিছুতেই প্রশমিত করতে পারে না। শেষে মহাজন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে প্রাণপণে ছুটতে থাকে। তাকে ধাওয়া করে পেছন পেছন ছুটতে থাকে সব মানুষ। ‘মা আর কান্দে না’ গল্পের রমজান আলী অহর্নিশ ক্রন্দনরত বৃদ্ধ মা-কে কোনোভাবে নিবৃত্ত করতে না; পেরে মেরে ফেলতে চায়। কিন্তু মায়ের মরা মুখ কল্পনা করতে তার খারাপ লাগে। বাপ-ভাই সবাই মরেছে। কেবল সে মুমূর্ষু ক্ষুধার্ত মাকে আগলে আছে অথচ ঘরে খুদ-কুঁড়ো নেই। শেষে রমজান আলী চোরের সর্দার কলিমদ্দিনের শাগরেদি নেওয়া মনস্থ করে। রোজগার হলে মা অমন করে কাঁদবে না। কিন্তু ঘরে ফিরে সে টের পায় মা তার কাঁদছে না। রমজান আলী তখন চিৎকার করে – ‘মা তুই চুপ করে আছিস ক্যানে, মা আর কান্দিস না ক্যানে।’ ‘নবজাতক’ গল্পের মমত্মাজ ধান মাপার পর ভাগাভাগি নিয়ে মহাজনের পোষ্য গু-াদের হাতে প্রহৃত হয়। তার পিতা হাসন আলীর মনে পড়ে ধান নিয়ে আধিয়ার কিষানের লড়াইয়ের স্মৃতি। এদিকে অনেক টানাহেঁচড়া, কষ্ট-যন্ত্রণার পর গরু একটা বাচ্চা প্রসব করেছে। গল্প এখানে এসে প্রতীকধর্মী হয়ে ওঠে। আগুনের আলোয় দেখা যায় বাচ্চাটা সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। চারদিকের অন্ধকারের মধ্যে রক্তের আর কান্নার স্রোত এবং নবজাত গোবৎস মমত্মাজ আলীর চোখের সামনে জেগে থাকে। গল্পের মূল বিষয় গাভির বাছুর প্রসব নয়। যদিও মনে মনে প্রত্যাশা, গাভি থেকে একটা পুরুষ বাছুরের জন্ম হোক। পুরুষ মমত্মাজ জমির গর্ভে জন্মানো ধান ভাগাভাগি আর মহাজনের ঠকানো আচরণ নিয়ে ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ। সে পূর্বপুরুষের কিষান আন্দোলনের স্মৃতি ধরে উদ্বেলিত। নিজের মধ্যে সেদিনের বিদ্রোহের অনুরণন শোনে। মহাজনকে সে সরাসরি জিজ্ঞেস করে – ‘আচ্ছা মহাজন, তেভাগার কথা জানেন তুমরা? ঐ যে ধানকাটা নিয়ে গোলমাল, জানেন তুমরা? ঐ বছরও কি ধান কর্জের এই নিয়ম ছিল?’ ‘লেলিহান সাধ’ গল্পে মনোহর ও সবদর দুই কিষান রাতে মহাজনের ধান পাহারা দেয়। কিন্তু ঝড়-বৃষ্টি-শীতের মধ্যে ‘ইঃ শালার কুন জাড় নামিল বাহে’ মনোহরের উক্তি ধরে আমরা গল্পে দেখতে পাই – ‘কুহার বড়ই কুহক বাহে। চোখ আছে তুমার – কিন্তু লজরটা চলে না, রাসত্মা আছে কিন্তুক দেখা যায় না। কুহার ভিতর গাঁও নাই, বাগিচা নাই, মানুষ নাই – কিছু নাই। খালি একটা জিনিষ আছে – সে তুমার জাড়টা, শরীরের কষ্টটা। জাড়টা তুমার দেহের চামড়া কামড়ায়, মাংস কামড়ায়, হাড্ডি কামড়ায় – ছাড়ে না কিছুতে। মহাজনের ধারের মতোন বাহে শরীলের এ জাড়ের কষ্টটা।’ তীব্র শীতের কষ্ট থেকে বাঁচতে মনোহর ও সবদর মধ্যরাতে আগুনের ব্যবস্থার জন্য মহাজনকে ডাকে। মহাজন তখন দুর্যোগের রাতে লেপ-কাঁথার উমের মধ্যে কাসেমালির বউটাকে বুকে জড়িয়ে সুখনিদ্রায়। দুই উজবুক দিনিয়ারের ডাক শুনে মহাজন চৌধুরী যখন বাইরে বেরোলো, তখন তার হাতে গরু-তাড়ানো লাঠি। সটাসট সে মারতে থাকে দুজনকে। – ‘জীবন এমনই। কিষান এমনই হয়, মহাজনও এই রকম। ঝড় বৃষ্টি বাতাস সব এমনই হয়ে থাকে। রক্তমাখা সবদর আলীর মুখ ঠান্ডা জ্যোৎস্নায় জ্বলজ্বল করে উঠলো।’ মহাজন ঘরে ফিরে গেলে দুই কিষান খড়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। শেকল তুলে দেয় মহাজনের দরজায়। মনোহর আর সবদর – ‘নয়নভরে দেখছে দাউ দাউ আগুনের লেলিহান শিখাগুলোকে। জন্ম-জন্মামত্মরের সাধ, সারাজীবনের সবকিছু তখন চোখের সামনে জ্বলে জ্বলে উঠতে লাগল। আর মানুষ দুজন প্রাণভরে তাই দেখতে লাগলো।’ শওকত আলীর তিনটি গল্প ‘আর মা কান্দে না’র রমজান আলী বেকার, গ্রামে কাজ নেই, তার করার কিছু নেই। এখানে সে একা। ‘নবজাতক’ গল্পের চরিত্রের সামনে তেভাগা আন্দোলনের স্মৃতি আছে, কিন্তু ‘বড় ডর করে এখন। বুনো আধিয়ার কিষান উ কথা কহে না’ বলে, মহাজনের মার হজম করে। এখানে চরিত্র একজন জোয়ান এবং একজন বৃদ্ধ। ‘লেলিহান সাধ’ গল্পে দুই কিষান মার খায় এবং মার দেয়। এখানে লক্ষ করা যায় শওকত আলীর গল্পের চরিত্রের ক্রমবিকাশ। ভয়কে জয় করছে চরিত্র। এরই প্রভাব পড়েছে তাঁর পরবর্তী সময়ে লেখা গল্পে। স্রোতে ভেসে যাচ্ছে মহাজনসহ তার নৌকা। কিন্তু পাড়ে দাঁড়িয়ে থেকেও ‘ভবনদী’ গল্পের নসরউদ্দিনের নৌকার কাছিটা গাছের গুঁড়িতে পেঁচিয়ে দিতে ইচ্ছা হয় না। তার মনে পড়ে, ‘সংসারে কত দুঃখ – হায়, আমার বউয়ের বুকে দুধ নাইগো। মেয়েটা ভয়ানক কান্দে।’ ‘কপিল দাস মুর্মুর শেষ কাজ’ গল্পে বৃদ্ধ সাঁওতাল কপিল দাস বসত উচ্ছেদের বিরুদ্ধে একাই প্রতিবাদ করে – ‘মহাজন বসত উঠায় দিবা চাহিলেই কি হোবে, ক্যান হামার কমরত জোর নাই।’ বুড়ো বয়সে সে তীর তুলে নিলে কিশোরকাল ফিরে পায়। জীবনে প্রথম নিশানা ভেদ করার খুশি আর একবার শেষ জীবনে এসে উপলব্ধি করে।
শওকত আলী সাধারণ মানুষের জীবনযন্ত্রণা, উঁচু ও নিচু সত্মরের অনিবার্য দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছাড়াও লোকসমাজে প্রচলিত মুখের ভাষা ব্যবহার করে নগণ্য মানুষকে নিয়ে হিউমার সৃষ্টি করেছেন। হাস্যকৌতুক, বিকল-মেজাজের মধ্য দিয়েও চরিত্রের ঘুমমত্ম নাখোশ বেরিয়ে আসে। এর উদাহরণ ‘দুই গজুয়া’র গল্পটি। অবোধ্য বিষয় নিয়ে ভাগ্নে রহিমুদ্দিন বারবার প্রশ্ন করে মামা পোহাতুকে জ্বালাতন করে। ‘বৃষ্টির শব্দ, ভাগ্নের গুনগুনানি আর কাঁথার উম, এই তিন মিলে ভারি আরামের একটা ভাব তৈরি করে ঘরের ভেতর।’ মামা নাক ডাকতে শুরু করলে ভাগ্নে জানায় : ‘তোর নাকের ডাক শুনে সাপ বাহার হইছে। চুপশালা, বলে পোহাতু ফের শুয়ে পড়ে।’ পোহাতু মনে করে বোধহয় ছোট মহাজন এসেছে। ভাঙা ঘুমের মধ্যে এখানেও মহাজনভীতি। মহাজনের বাড়িতে হা-ভাতের দল হাজির হলে রহিমুদ্দিনের মগজে ঘুরপাক নির্ধারিত ধারণা – মহাজনের দয়ামায়া নেই, গোলায় ধান, অথচ আকালের সময় ধান চাইলে সে তেড়ে আসবে। গত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি শওকত আলীর লেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প ‘শুন হে লখিন্দর’-এ মহাজন এখানে দ্রোহী মজুরকে ভয় করছে। উভয়ে রাতে অবস্থানের সময় গুপীনাথ মহাজনকে বলে – ‘হামরা কিন্তুক আন্ধারে থাকি। আন্ধারে জনম, আন্ধারে বাঁচন, আন্ধারে মরণ।’ অনেকদিন পর সুযোগ পেয়েছে গুপীনাথ। পুরনো হিসাব চুকিয়ে দেওয়ার জন্য সে মহাজনকে লখিন্দর বলে সম্বোধন করে জানায় : ‘হিসাবটা যে বহুতদিনের লখিন্দর। কতদিন আর ঘুরে ঘুরে যামো হামরা। সামত্মালী পাহাড়ত হামার দাদা, পরদাদার বাস ছিল। কালীনাগের রক্ত হামার শরীলে বহে যাচ্ছে। কতকালের পুরানো হিসাব, ফম করে দেখ তুই। কত আকাল গেল, ব্যারাম গেল, বানবরিষা গেল – কিন্তুক হামরা খোরাকি পাই নাই। সওদাগরের বেটা, সেই হিসাবটা ইবার দিবা হবে।’ পৌরাণিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সমকালীন জীবন একীভূত করে শওকত আলী মহাজন ও মজুরকে মুখোমুখি গল্পে দাঁড় করিয়ে দেন। এই মজুর গোসাপ-ধরা সাঁওতাল সাপুড়ে গুপীনাথ। তাঁর কবলে পড়েছে সীমামেত্মর ওপার থেকে চোরাচালানি লক্ষ্মীকামত্ম। বর্ডারের গোলমালে যেতে না পেরে রাতে সে হাঙ্গামার ভয়ে পলাতক এপারের কসিমুদ্দিনের আড়তে আশ্রয় নেয়। সেখানে এসে উপস্থিত হয় এই গুপীনাথ। এদিকে লণ্ঠনের তেল ফুরিয়ে গেলে গাঢ় অন্ধকার হয়ে যায় আড়তের ঘর। লক্ষ্মীকামত্ম একবার সরে বসতে চাইলেন, আর তাতেই ভয়ানক শব্দে ফুঁসে উঠল একটা সাপ। পুরনো হিসাব বুঝে নিতে গুপীনাথ প্রথম থেকে বেপরোয়া। কেবল জীবন-জীবিকার কারণে তাঁর চরিত্র রুক্ষ নয়, মহাজনকে মুঠোয় পেয়ে প্রতিশোধ নিতেও সে তৎপর। শওকত আলীর গল্পের এই গুপীনাথ ভয়কাতুরে ও আপসকামী নয়। অন্যান্য গল্পের চরিত্রে যে দ্বিধা, পিছুটান, আফসোস আছে গুপীনাথ চরিত্রে তা নেই। প্রথম থেকেই সে মেজাজি। সওদাগর লক্ষ্মীকামত্ম বাবুরা ন্যায্য পাওনা আদায়ে নির্ভীক চরিত্র গুপীনাথদের ভয় পায়, সমীহ করে। এই গুপীনাথদের গল্পে জায়গা দেওয়া ও ফুটিয়ে তোলার জন্য আমরা পাই শওকত আলীর জীবনবাদী সৃষ্টিশীলতার পরিচয়।
গল্পের আবহ পরিবেশ রচনায় শওকত আলীর গল্পের সঙ্গে আরেক গল্পের বহুলাংশে সাযুজ্য বা একাত্মতা আছে। গল্পে ঘুরেফিরে আসে রাত-শীত-বৃষ্টি-কান্দরের একই সবিসত্মার বিবরণ। মনে হয় কেবল চরিত্র ও ঘটনা ছাড়া অকুস্থল প্রায় এক। লোভ-ক্ষুধা-ক্ষক্ষাভ-প্রতিবাদ-যৌন অবদমন সঙ্গে নিয়ে উত্তরবঙ্গের বুনোগন্ধময় পাড়াগাঁয় যাবতীয় কাজকর্ম করলেও বারবার এক বর্ণনানির্ভর প্রকৃতির মধ্যেই তাদের স্থিতি। ‘আর মা কান্দে না’ গল্পের অংশবিশেষ ‘অন্ধকার চারদিকে থৈ থৈ করে। মনে হয় বাতাসে অন্ধকারটা পাক খাচ্ছে, ফুলছে আর চারদিকে কেমন ছড়িয়ে যাচ্ছে। উত্তর দেখো, দক্ষিণ দেখো, আসমানে তাকাও – শুধু কালো। থেকে থেকে কালো মেঘের পি-গুলো একদিক থেকে গড়িয়ে যাচ্ছে আরেক দিকে। ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা এসে শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছে।’ বিরুদ্ধ চরাচরের বর্ণনার সঙ্গে ‘লেলিহান সাধ’ গল্পের দৃশ্যমান অবস্থার মিল আছে। – ‘খোলা কান্দরে হাওয়ার ঝাপটা ভীষণ আছাড় যাচ্ছে। উত্তর থেকে বাতাস শব্দ করে ছুটে আসছে। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে উথাল-পাতাল অন্ধকারটা দেখে নিলো দু’জনে। তারপর পা বাড়াল। কিন্তু কোথায়? তখুনি শুরু হলো বেদম বৃষ্টি।’ ‘নয়নতারা কোথায় রে’ গল্পেরও আকাশ-বাতাস-বৃষ্টির বর্ণনা অনুরূপ – ‘আসমানের লীলা বোঝা ভার। এই বাতাস বন্ধ, গুমোট ভাব, যেন চেপে আসছে বুকের উপর ভারী বোঝার মতো – তারপর এই আবার দেখো, দেখতে দেখতে কোনদিক থেকে বাতাস বইতে শুরু করে দিলো, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ফুটে উঠল বাতাসের গায়ে। শেষে মেঘ ডাক ছেড়ে বৃষ্টি ঢালতে শুরু করে দিলো।’ শীতের প্রকোপ এবং চরম শীতে শায়েসত্মা হওয়া কামলা-কিষানের দুরবস্থাও একইভাবে গল্পে ঘুরেফিরে এসেছে। পরিপ্রেক্ষিত এক হতে পারে, কিন্তু তা ভাষায় মূর্ত করতে গিয়ে বারবার একরকম হয়ে এলে পাঠকের সামনে চলে আসে লেখকের পুনরাবৃত্তির প্রবণতা। কিন্তু মানুষ, তার কার্যক্ষমতা, রোদজ্বলা প্রামত্মর, অন্ধকারশাসিত রাত্রির প্রকৃতি এক জায়গায় এসে মিলেমিশে গেলে বাসত্মবের পুনর্জীবন ঘটতে দেখা যায়। অঞ্চল বিশেষের ঘাত-প্রতিঘাত, মানুষের ক্ষয়, ঘটনাস্রোত এবং শেষাবধি পুনরুত্থান মানুষেরই শক্তিকে অভিনন্দন জানায়। তখন গল্প বর্ণনায় দুর্বলতা জোরালো বলে মনে হয় না।
শওকত আলীর গল্পের গদ্য প্রাঞ্জল, সহজবোধ্য। সর্বত্র আবার অলংকারবর্জিত নয়। অনায়াস স্বচ্ছন্দে তিনি বৃত্তামত্ম লিখে গেছেন। জয়-পরাজয়, আলো-অন্ধকারের পালটাপালটি যে-জীবন তিনি চিত্রিত করেছেন সে-জীবন প্রতিদিনের বাঁচার জন্য লড়াই করে, প্রতিদিন সে-জীবন আবার নিঃশেষিত হয়। অশামিত্মময়, সুখবঞ্চিত। সারাংশশূন্য এই জীবন রূপায়ণে বিষয়ানুগ গল্পভাষা ব্যবহারে অনমনীয় হওয়ার প্রয়োজন ছিল। জীবন ও সমাজের যে ভাগ ধূসর, ধূলিমলিন, নিষ্প্রভ, ফাটলপূর্ণ তার যথাযথ প্রকাশে গদ্য অনুরূপ হওয়া বাঞ্ছনীয়। শওকত আলীর গল্পভাষা লিরিক্যাল থেকে যায়। কি প্রকৃতি বা দৃশ্য বর্ণনায়, কি মানুষের স্মৃতি রোমান্থনে, কি ঘটনা উপস্থাপনে গল্পে শওকত আলীর রোমান্টিক মনের খোঁজ পাওয়া যায়।
উন্মূল বাসনার গল্পের প্রধান প্রবণতা যে জৈবিক প্রবৃত্তি তা থেকে সরে এসে শওকত আলী সমাজ ও মানুষের শ্রেণিদ্বন্দ্ব গল্পে মূর্ত করে নিশ্চিত করেছেন তাঁর নিজের ক্রম-উত্তরণ। বানোয়াট কাহিনি পরিবেশন অস্বীকার করে তিনি গল্পে ধারণ করেছেন মানুষের বেঁচে থাকা, জেগে ওঠার প্রবল স্বপ্ন ও আকাঙক্ষা। কথাসাহিত্য নিয়ে শওকত আলীর মনোভাব তাঁর সাহিত্যের জন্যও প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে এখানে পেশ করা যায় : আসলে মানুষের জীবনই কথাসাহিত্যের বিবেচ্য বিষয়। তাতে পূর্ণাঙ্গ কাহিনি থাকতেও পারে, না-ও পারে। বিচার্য বিষয় হচ্ছে, লেখক জীবনের কতটুকু দেখলেন ও দেখালেন এবং কীভাবে দেখালেন। লেখক জীবনের গভীর থেকে গভীরতর ভেতরের দিকে যদি যেতে পারেন, তাহলে তাঁর লেখায় যা উঠে আসবে তাতেই পাওয়া যাবে সাহিত্যের সেই অন্বিষ্টকে, যা মানুষকে ভাবায় এবং আলোড়িত ও উদ্দীপ্ত করে।
কর্মজীবনের কারণে রাজধানীতে বসবাস, তবু শওকত আলীর গল্প ঢাকাকেন্দ্রিক নয়। পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে সক্রিয় লেখালেখি শুরু করলেও ষাটের দশকে এসে তাঁর সাহিত্যের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা। আমাদের গল্প-সাহিত্যের পালে লেগেছে তখন উপযুক্ত বাতাস। বহুসত্মরা পর্যাপ্ত অর্থ সন্ধানের অভিপ্রায়ে লেখকরা প্রবেশ করেন জীবনের অমত্মর্লীন জগতে। নতুন সাহিত্যাদর্শের নামে লেখকদের অনেকে গল্পের আঙ্গিক বা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সচেষ্ট হন। নিজস্ব চর্চায় আস্থা রেখে জীবনবাদী গল্প-সাহিত্যে ভাষা-ভাবনা-মাত্রাযোগে শওকত আলী মনোনিবেশ করেন।
মেহনতি কিষান – যাঁদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই – এই তাঁরা শ্রমে, প্রাপ্তিতে প্রচ- মার-খাওয়া, বঞ্চিত; এই মানুষ মাটি আবাদ করে ফসল ফলায়, ফসল লালন করে; কিন্তু ফসল তুলে দিয়ে আসে মহাজনের গোলায়। চামড়া ফাটানো, হাড়-ছেঁদা তুমুল শীতের রাতে কিষানের মহাজনের ফসলও পাহারা দিতে হয়, বিনিময়ে সে হারায় স্বাস্থ্য, আয়ু ও সুখ। উত্তর বাংলার কিষানদের বিসত্মারিত জীবন নিয়ে এত গল্প শওকত আলীর মতো কোনো কথাশিল্পীই লেখেননি। উত্তরের জনগোষ্ঠী তাদের প্রাত্যহিক জীবন-সংসারের চালচিত্র জল-হাওয়া কথাসাহিত্যে রূপ দেওয়া এবং তা ব্যাপক পাঠক সমীপে উপস্থিত করার সিংহভাগ কৃতিত্ব শওকত আলীর প্রাপ্য। হাড্ডিসার, হাঁটুভাঙা মানুষ নিয়ে তাঁর কারবার অথচ তাঁর গল্পের মানুষ জীবন-জীবিকায় উপর্যুপরি মার খেতে খেতে বুক দিয়ে হেঁটে হলেও দাঁড়াতে প্রয়াস নেয় – পুরোপুরি ভেঙে পড়ে না। রুখে-দাঁড়ানো মানুষের স্বভাবের অমত্মর্গত – জেগে ওঠা সেই দ্রোহী মানুষ সংঘবদ্ধ হয় এবং মহাজনের ঘরে আগুন দিয়ে নিপীড়কের বিনাশ ঘটায়। কেবল ব্যর্থতার কাহিনি রচনা করে শওকত আলী জীবনকে নঞর্থক করে তোলেননি, জীবনে জীবন যোগ করে মানুষের সংগ্রামী রূপও গল্পে পেশ করেন। জীবন যে হারিয়ে ফুরিয়ে সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যায়নি, এখনো তার অবশিষ্ট আছে এবং সমুদয় প্রাপ্য আদায় সম্ভব সমষ্টির ঐক্যবদ্ধে তাই তাঁর গল্পের মর্মার্থ। শেষাবধি ইতিবাচক জীবনের গাথাই শওকত আলীর গল্পের উদ্দিষ্ট।
দেশভাগ-পরবর্তীকালের ছোটগল্পে সমাজের অসাম্য, অনাচার ও দুষ্টমতী মানুষের পাপাচার নিয়ে দুর্নীতির চিত্র থাকলেও তা কেবল অচঞ্চল স্থিরচিত্রই হয়ে থাকে। মানুষকে চলিষ্ণু মনে হয় না। শওকত আলীর গ্রাম ও চরিত্র পাঠকের পাশে যাতায়াত করে এবং মানুষের মর্যাদা দাবি করে। এমনকি শওকত আলীর গল্পের প্রকৃতিও জীবমত্ম। আবার প্রকৃতি শত্রম্নতাও করে। যে-জনপদের মানুষের জীবন তাঁর গল্পের বিষয় অনুরূপ নির্দয় প্রকৃতির সাক্ষাৎই আমরা পাই। প্রকৃতি মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি করে। অর্থাৎ গল্পের পরিপ্রেক্ষিতের অনুগামী হয়েছে প্রকৃতি। গল্পের সঙ্গে প্রকৃতি একাকার হয়ে থাকে। গল্পে শওকত আলী প্রকৃতিকে চাপিয়ে দেননি বা কোথাও থেকে তুলে এনে পরিপূরণ করেননি। প্রকৃতি থেকে মানুষ যেন বেরিয়ে আসে – উত্তরবাংলার আদিজগতের মতো গল্পের মানুষ রুক্ষ, রোদে পোড়া, শীতজর্জর, বৃষ্টিতে ভিজে অবসন্ন। তাঁর গল্পের মানুষ ও প্রকৃতিকে ছিঁড়ে তাই আলাদা করা যায় না। মানবজীবন ও প্রকৃতি অবিচ্ছিন্ন। কখনো কখনো সরাসরি না হলেও গল্পের পশ্চাৎপটে নৈসর্গিক উপাদানের প্রতীকী উপস্থাপনা উপস্থিত। এখানে বলার আছে যে, শওকত আলী মধ্যবিত্তের রুচি ও লাবণ্য, প্রীতিদায়ক আগ্রহ ও আসক্তি, শিহরণ-জাগানো অনুভূতির আধিক্য পরিবেশন করে পাঠককে পুলকিত করতে চাননি। তাঁর লেখক-মানসে মধ্যবিত্তের জীবনযাপনের চর্বিতচর্বণ ক্রিয়া করেনি। ভগ্ন, আপসকামী, দ্বিধাগ্রসত্ম, সংশয়াচ্ছন্ন মধ্যবিত্ত নিয়ে বাংলা গল্প-সাহিত্য থেকে শওকত আলীর গল্প স্বতন্ত্র। তাঁর গল্পের পোড়-খাওয়া চরিত্র ভেঙে পড়ে না, সাময়িক পরাজয়ের বার্তাও প্রকাশে অনাবশ্যক কাঁদে না। বরং প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত রাখা মুষ্টিমেয় শ্রেণিপ্রভু প্রতিপক্ষ দিনমজুরের উত্থানে কেঁপে ওঠে। এই কাঁপুনি গিয়ে স্পর্শ করে স্যাঁতসেঁতে গল্প-সাহিত্যের বিষয় ও শরীরে।
এগারোটি গল্প নিয়ে শওকত আলীর প্রথম গ্রন্থ উন্মূল বাসনার নামসূত্র বিশেস্নষণ করলে পাওয়া যায় মানবজীবনের কামনা ও অধীর অভিলাষের উপাখ্যান। কোনো কোনো আলোচকের মতে, উন্মূল বাসনা থেকে বেরিয়ে আসে লেখকের সাহিত্যিকসত্তার প্যাশননির্ভর রোমান্টিকতা। আমরা জানি, প্যাশন হচ্ছে প্রেম, ঘৃণা, ক্রোধের অনুভূতি, যার মধ্যে তীব্র উত্তেজনা। গ্রন্থভুক্ত গল্পগুলোর চরিত্রের ভ্রষ্টাচারে পরিষ্কার হয়ে যায় তারা উন্মার্গগামী। উত্তরাঞ্চলের বিত্তবানরা তাদের সমাজ-অনুপযুক্ত হীনপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করে নারীসঙ্গ প্রমোদে। হতদরিদ্র অসহায় নিতামত্ম খোসাসর্বস্ব নারীকে ইন্দ্রিয়-সেবায় ব্যবহার করে তারা। এমনকি ট্রাক ড্রাইভার, সাঁওতাল, চোর-বাটপার, রিফিউজি, চোরাচালানি সবাই অবৈধ কাজে লিপ্ত। নিঃস্ব কিষান তাঁর অসামর্থ্যের কারণে জোত-জমি-হালের মালিকের কাছে স্বীয় নারীকে বিলি করে দিচ্ছে। রিপুর প্রাবল্যে পুরুষ ভারসাম্যলুপ্ত মানসিকতা ও শরীরের উত্তেজনা চুকায়। ‘রঙ্গিনী’ গল্পে সংঘাত-ঈর্ষা-চিত্তচাঞ্চল্যের প্রকাশে শুনি : ‘সব নেশার চাইতে বড় নেশা হলো এই মেয়েমানুষ।’ ‘ফাগুয়ার পর’ গল্পে বৃদ্ধ সুখলাল নেশাখোর ছেলের জোয়ানি বউয়ের প্রতি লক্ষ নেই দেখে পুতের বউ গঙ্গাময়ীকে অন্য পুরুষের প্রতি তাকানো পাপ বলে উপদেশ দেয়। ‘ডাইন’ গল্পে সুবলা ও বিনোদচরণের স্মৃতিচারণেই জ্বলে ওঠে কামনার পুরনো আগুন ‘পুরুষের গলা জড়িয়ে ধরে না ঘুমোলে তোর ছাতি ঠান্ডা হতো না। প্রথম রাতে লোকটি ক্লামত্ম হয়ে ঘুমিয়ে পড়লে মাঝরাতে তুই তাকে আবার জাগাতিস। মনে পড়ে সুবলা।’ উন্মূল বাসনার গল্পগুলোর চারপাশের প্রকৃতি যেন সম্ভোগেচ্ছুকের পক্ষে সমর্থন দেয় শীত-বৃষ্টি-অন্ধকারের জোগান দিয়ে। ‘তৃতীয় রাত্রি’ গল্পে সার্কাসের বৃদ্ধ মৃত্যুপথযাত্রী সাজাহান ওসত্মাদকে আগলে বসে আছে অসমবয়সী বালিকা কাননবালা। এখানে সময়-প্রকৃতি, স্বজন-সংসারহীন মানুষ একাকার হয়ে যায় – ‘কে জানে ভোর হতে কতক্ষণ বাকী। বারান্দার বাইরে শ্মশানের ওপর শীতের দীর্ঘরাত আর কুয়াশাঢাকা বিশাল আকাশ একাকার হয়ে আছে। উত্তরের হাওয়া বয়ে যাচ্ছে নদীর ওপর দিয়ে। মেয়েটা অন্ধকারের দিকে চোখ মেলে রাখলো। পঞ্চচূড়া কাঞ্চনজংঘা আবার উত্তরের দিগমেত্ম ঝলমল করে উঠবে – যদি কাল আকাশ পরিষ্কার থাকে।’ জটিল রহস্যময় পরিবেষ্টন আর শরীরী ক্ষুধার উদ্রেকে পাঠকের অমত্মরাত্মা অনুশোচনা ও গস্নানিতে টাটিয়ে ওঠে। এমনকি অন্যথাচারীর অবৈধ সম্বন্ধ ও ক্রিয়াকলাপে আলেখ্যের পারিপার্শ্বিকতা পর্যমত্ম ভারি হয়ে যায়। গল্প সৃষ্টির এমন সার্থকতার জন্য সজ্ঞান পাঠক মনে করেন, উন্মূল বাসনার চরিত্রগুলো মনে হয় লেখকের নয়, তারা যেমন, তাদের চারপাশের পৃথিবীটা যেমন, লেখক যেন তেমনি যথাযথ তুলে দিয়েছেন ঘটনার ভাঁজে ভাঁজে। অধ্যবসায়ী পাঠক বিষয়ের আরো গভীর খনন করেন : প্রতিটি গল্পের অবলম্বন সমাজের পরাশ্রিতজন, প্রতিটি কাহিনিই শক্তিশূন্য পরাভূত মানুষের উপাখ্যান। জীবন সফলতার স্বাদবঞ্চিত যেসব মানুষ, পীড়নে, ছিবড়ে-যাওয়া ছিন্নভিন্ন তাদের অতলস্পর্শী বেদনা যেন ছুঁতে চেয়েছেন লেখক। শওকত আলীর উন্মূল বাসনায় রিরংসার ইচ্ছাপূরণে পুরুষের শিকার কেবল নারী। তাঁর গল্পে যে পুরুষতান্ত্রিক পলিস্ন সমাজের আদ্যোপামত্ম চিত্র, চরিত্রের পুনরাবৃত্তিময় আদিম মানসিকতা, প্রামিত্মক নিম্নবর্গের জীবনধারণ, তার উপস্থিতি, এমনকি অন্দর অবধি পৌঁছে যাওয়ায় আমরা বুঝতে পারি, যেখানে মানুষ শুধু পণ্য। যেখানে ধ্বংস হয়েছে মানবিকতা ও শুভবোধ। তবু জীবনপাত্রের তলানিতে পড়ে থাকা শেষ শাঁস নিয়ে মানুষ ধীরে ধীরে তার মেরুদ- ঋজু করতে তৎপর হয়। উন্মূল বাসনার ‘ডাইন’ গল্পে এর ইশারা লক্ষ করা যায় : ‘আকাশ ভরানো জ্যোৎস্না। আমগাছগুলো মাথা দোলাচ্ছে থেকে থেকে। হাটের আড়তে মিটমিট করে বাতি জ্বলছে। বাতি জ্বালিয়ে লোকটা এখন বুকের ধ্বক ধ্বক শব্দ নিয়ে অপেক্ষা করছে।’ শেষাবধি প্রতিবাদ ও শ্রেণিক্রোধের সাক্ষাৎ পাই শওকত আলীর লেলিহান সাধের গল্পসমূহে। চেতনাপ্রাপ্তির সুবাদে ন্যাড়া শুকনো বর্ণবঞ্চিত জনপদ কেঁপে ওঠে দলিত নিষ্পিষ্টদের প্রতিরোধে।
ধূসর কুয়াশার ভেতর দিয়ে চুইয়ে পড়ে জ্যোৎস্না, কখনো কুয়াশার মধ্যে অনাথ শিশুর মতো শুয়ে থাকে অন্ধকার, সত্মূপীকৃত খড় জ্বালিয়ে শীত থেকে রেহাই খোঁজে কিষান। এই কিষানের একটা জীবনের কত কথার গ্রন্থ শওকত আলীর লেলিহান সাধ। গল্পে আছে অগ্নিশিখার লকলকে জিভের মতো আগ্রাসী চরিত্রের তেজ ও প্রতাপের প্রকাশ। ‘একটি-দুটি করে লোক দেখা গেল একসময় বড় সড়কের ওপর। কৌতূহল না সমবেদনার কারণে তারা একে একে এসে পৌঁছাচ্ছিল বোঝা মুশকিল। তবে লোকগুলো ঈষৎ আন্দোলিত হচ্ছিল। আন্দোলিত হচ্ছিল যে তার প্রমাণ তারা ক্রমেই কাছাকাছি জড়ো হচ্ছিল এবং জড়ো হয়ে কাছে এগিয়ে আসছিল -’ এই উদ্ধৃতাংশ ‘নয়নতারা কোথায় রে’ গল্পের। কিষানদের আগমন, তাদের ঈষৎ আন্দোলন এবং জড়ো হয়ে তারা এগিয়ে এলে উত্তরবাংলার সমসত্ম জনপদ কেঁপে যায়। এই গল্পে মনোহরের সুন্দরী মেয়ে নয়নতারাকে মহাজনের পোষা মসত্মানরা ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। ঘটনা শুনে সহানুভূতিশীল পাড়া-প্রতিবেশীরা বড় সড়কের ওপর পরস্পর ঘনিষ্ঠ হয়। এমন জটলার মুখে পড়ে বাজার-ফেরা মহাজন। মনভোলানো কথা বলে সে মানুষের ক্রোধ কিছুতেই প্রশমিত করতে পারে না। শেষে মহাজন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে প্রাণপণে ছুটতে থাকে। তাকে ধাওয়া করে পেছন পেছন ছুটতে থাকে সব মানুষ। ‘মা আর কান্দে না’ গল্পের রমজান আলী অহর্নিশ ক্রন্দনরত বৃদ্ধ মা-কে কোনোভাবে নিবৃত্ত করতে না; পেরে মেরে ফেলতে চায়। কিন্তু মায়ের মরা মুখ কল্পনা করতে তার খারাপ লাগে। বাপ-ভাই সবাই মরেছে। কেবল সে মুমূর্ষু ক্ষুধার্ত মাকে আগলে আছে অথচ ঘরে খুদ-কুঁড়ো নেই। শেষে রমজান আলী চোরের সর্দার কলিমদ্দিনের শাগরেদি নেওয়া মনস্থ করে। রোজগার হলে মা অমন করে কাঁদবে না। কিন্তু ঘরে ফিরে সে টের পায় মা তার কাঁদছে না। রমজান আলী তখন চিৎকার করে – ‘মা তুই চুপ করে আছিস ক্যানে, মা আর কান্দিস না ক্যানে।’ ‘নবজাতক’ গল্পের মমত্মাজ ধান মাপার পর ভাগাভাগি নিয়ে মহাজনের পোষ্য গু-াদের হাতে প্রহৃত হয়। তার পিতা হাসন আলীর মনে পড়ে ধান নিয়ে আধিয়ার কিষানের লড়াইয়ের স্মৃতি। এদিকে অনেক টানাহেঁচড়া, কষ্ট-যন্ত্রণার পর গরু একটা বাচ্চা প্রসব করেছে। গল্প এখানে এসে প্রতীকধর্মী হয়ে ওঠে। আগুনের আলোয় দেখা যায় বাচ্চাটা সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। চারদিকের অন্ধকারের মধ্যে রক্তের আর কান্নার স্রোত এবং নবজাত গোবৎস মমত্মাজ আলীর চোখের সামনে জেগে থাকে। গল্পের মূল বিষয় গাভির বাছুর প্রসব নয়। যদিও মনে মনে প্রত্যাশা, গাভি থেকে একটা পুরুষ বাছুরের জন্ম হোক। পুরুষ মমত্মাজ জমির গর্ভে জন্মানো ধান ভাগাভাগি আর মহাজনের ঠকানো আচরণ নিয়ে ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ। সে পূর্বপুরুষের কিষান আন্দোলনের স্মৃতি ধরে উদ্বেলিত। নিজের মধ্যে সেদিনের বিদ্রোহের অনুরণন শোনে। মহাজনকে সে সরাসরি জিজ্ঞেস করে – ‘আচ্ছা মহাজন, তেভাগার কথা জানেন তুমরা? ঐ যে ধানকাটা নিয়ে গোলমাল, জানেন তুমরা? ঐ বছরও কি ধান কর্জের এই নিয়ম ছিল?’ ‘লেলিহান সাধ’ গল্পে মনোহর ও সবদর দুই কিষান রাতে মহাজনের ধান পাহারা দেয়। কিন্তু ঝড়-বৃষ্টি-শীতের মধ্যে ‘ইঃ শালার কুন জাড় নামিল বাহে’ মনোহরের উক্তি ধরে আমরা গল্পে দেখতে পাই – ‘কুহার বড়ই কুহক বাহে। চোখ আছে তুমার – কিন্তু লজরটা চলে না, রাসত্মা আছে কিন্তুক দেখা যায় না। কুহার ভিতর গাঁও নাই, বাগিচা নাই, মানুষ নাই – কিছু নাই। খালি একটা জিনিষ আছে – সে তুমার জাড়টা, শরীরের কষ্টটা। জাড়টা তুমার দেহের চামড়া কামড়ায়, মাংস কামড়ায়, হাড্ডি কামড়ায় – ছাড়ে না কিছুতে। মহাজনের ধারের মতোন বাহে শরীলের এ জাড়ের কষ্টটা।’ তীব্র শীতের কষ্ট থেকে বাঁচতে মনোহর ও সবদর মধ্যরাতে আগুনের ব্যবস্থার জন্য মহাজনকে ডাকে। মহাজন তখন দুর্যোগের রাতে লেপ-কাঁথার উমের মধ্যে কাসেমালির বউটাকে বুকে জড়িয়ে সুখনিদ্রায়। দুই উজবুক দিনিয়ারের ডাক শুনে মহাজন চৌধুরী যখন বাইরে বেরোলো, তখন তার হাতে গরু-তাড়ানো লাঠি। সটাসট সে মারতে থাকে দুজনকে। – ‘জীবন এমনই। কিষান এমনই হয়, মহাজনও এই রকম। ঝড় বৃষ্টি বাতাস সব এমনই হয়ে থাকে। রক্তমাখা সবদর আলীর মুখ ঠান্ডা জ্যোৎস্নায় জ্বলজ্বল করে উঠলো।’ মহাজন ঘরে ফিরে গেলে দুই কিষান খড়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। শেকল তুলে দেয় মহাজনের দরজায়। মনোহর আর সবদর – ‘নয়নভরে দেখছে দাউ দাউ আগুনের লেলিহান শিখাগুলোকে। জন্ম-জন্মামত্মরের সাধ, সারাজীবনের সবকিছু তখন চোখের সামনে জ্বলে জ্বলে উঠতে লাগল। আর মানুষ দুজন প্রাণভরে তাই দেখতে লাগলো।’ শওকত আলীর তিনটি গল্প ‘আর মা কান্দে না’র রমজান আলী বেকার, গ্রামে কাজ নেই, তার করার কিছু নেই। এখানে সে একা। ‘নবজাতক’ গল্পের চরিত্রের সামনে তেভাগা আন্দোলনের স্মৃতি আছে, কিন্তু ‘বড় ডর করে এখন। বুনো আধিয়ার কিষান উ কথা কহে না’ বলে, মহাজনের মার হজম করে। এখানে চরিত্র একজন জোয়ান এবং একজন বৃদ্ধ। ‘লেলিহান সাধ’ গল্পে দুই কিষান মার খায় এবং মার দেয়। এখানে লক্ষ করা যায় শওকত আলীর গল্পের চরিত্রের ক্রমবিকাশ। ভয়কে জয় করছে চরিত্র। এরই প্রভাব পড়েছে তাঁর পরবর্তী সময়ে লেখা গল্পে। স্রোতে ভেসে যাচ্ছে মহাজনসহ তার নৌকা। কিন্তু পাড়ে দাঁড়িয়ে থেকেও ‘ভবনদী’ গল্পের নসরউদ্দিনের নৌকার কাছিটা গাছের গুঁড়িতে পেঁচিয়ে দিতে ইচ্ছা হয় না। তার মনে পড়ে, ‘সংসারে কত দুঃখ – হায়, আমার বউয়ের বুকে দুধ নাইগো। মেয়েটা ভয়ানক কান্দে।’ ‘কপিল দাস মুর্মুর শেষ কাজ’ গল্পে বৃদ্ধ সাঁওতাল কপিল দাস বসত উচ্ছেদের বিরুদ্ধে একাই প্রতিবাদ করে – ‘মহাজন বসত উঠায় দিবা চাহিলেই কি হোবে, ক্যান হামার কমরত জোর নাই।’ বুড়ো বয়সে সে তীর তুলে নিলে কিশোরকাল ফিরে পায়। জীবনে প্রথম নিশানা ভেদ করার খুশি আর একবার শেষ জীবনে এসে উপলব্ধি করে।
শওকত আলী সাধারণ মানুষের জীবনযন্ত্রণা, উঁচু ও নিচু সত্মরের অনিবার্য দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছাড়াও লোকসমাজে প্রচলিত মুখের ভাষা ব্যবহার করে নগণ্য মানুষকে নিয়ে হিউমার সৃষ্টি করেছেন। হাস্যকৌতুক, বিকল-মেজাজের মধ্য দিয়েও চরিত্রের ঘুমমত্ম নাখোশ বেরিয়ে আসে। এর উদাহরণ ‘দুই গজুয়া’র গল্পটি। অবোধ্য বিষয় নিয়ে ভাগ্নে রহিমুদ্দিন বারবার প্রশ্ন করে মামা পোহাতুকে জ্বালাতন করে। ‘বৃষ্টির শব্দ, ভাগ্নের গুনগুনানি আর কাঁথার উম, এই তিন মিলে ভারি আরামের একটা ভাব তৈরি করে ঘরের ভেতর।’ মামা নাক ডাকতে শুরু করলে ভাগ্নে জানায় : ‘তোর নাকের ডাক শুনে সাপ বাহার হইছে। চুপশালা, বলে পোহাতু ফের শুয়ে পড়ে।’ পোহাতু মনে করে বোধহয় ছোট মহাজন এসেছে। ভাঙা ঘুমের মধ্যে এখানেও মহাজনভীতি। মহাজনের বাড়িতে হা-ভাতের দল হাজির হলে রহিমুদ্দিনের মগজে ঘুরপাক নির্ধারিত ধারণা – মহাজনের দয়ামায়া নেই, গোলায় ধান, অথচ আকালের সময় ধান চাইলে সে তেড়ে আসবে। গত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি শওকত আলীর লেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প ‘শুন হে লখিন্দর’-এ মহাজন এখানে দ্রোহী মজুরকে ভয় করছে। উভয়ে রাতে অবস্থানের সময় গুপীনাথ মহাজনকে বলে – ‘হামরা কিন্তুক আন্ধারে থাকি। আন্ধারে জনম, আন্ধারে বাঁচন, আন্ধারে মরণ।’ অনেকদিন পর সুযোগ পেয়েছে গুপীনাথ। পুরনো হিসাব চুকিয়ে দেওয়ার জন্য সে মহাজনকে লখিন্দর বলে সম্বোধন করে জানায় : ‘হিসাবটা যে বহুতদিনের লখিন্দর। কতদিন আর ঘুরে ঘুরে যামো হামরা। সামত্মালী পাহাড়ত হামার দাদা, পরদাদার বাস ছিল। কালীনাগের রক্ত হামার শরীলে বহে যাচ্ছে। কতকালের পুরানো হিসাব, ফম করে দেখ তুই। কত আকাল গেল, ব্যারাম গেল, বানবরিষা গেল – কিন্তুক হামরা খোরাকি পাই নাই। সওদাগরের বেটা, সেই হিসাবটা ইবার দিবা হবে।’ পৌরাণিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সমকালীন জীবন একীভূত করে শওকত আলী মহাজন ও মজুরকে মুখোমুখি গল্পে দাঁড় করিয়ে দেন। এই মজুর গোসাপ-ধরা সাঁওতাল সাপুড়ে গুপীনাথ। তাঁর কবলে পড়েছে সীমামেত্মর ওপার থেকে চোরাচালানি লক্ষ্মীকামত্ম। বর্ডারের গোলমালে যেতে না পেরে রাতে সে হাঙ্গামার ভয়ে পলাতক এপারের কসিমুদ্দিনের আড়তে আশ্রয় নেয়। সেখানে এসে উপস্থিত হয় এই গুপীনাথ। এদিকে লণ্ঠনের তেল ফুরিয়ে গেলে গাঢ় অন্ধকার হয়ে যায় আড়তের ঘর। লক্ষ্মীকামত্ম একবার সরে বসতে চাইলেন, আর তাতেই ভয়ানক শব্দে ফুঁসে উঠল একটা সাপ। পুরনো হিসাব বুঝে নিতে গুপীনাথ প্রথম থেকে বেপরোয়া। কেবল জীবন-জীবিকার কারণে তাঁর চরিত্র রুক্ষ নয়, মহাজনকে মুঠোয় পেয়ে প্রতিশোধ নিতেও সে তৎপর। শওকত আলীর গল্পের এই গুপীনাথ ভয়কাতুরে ও আপসকামী নয়। অন্যান্য গল্পের চরিত্রে যে দ্বিধা, পিছুটান, আফসোস আছে গুপীনাথ চরিত্রে তা নেই। প্রথম থেকেই সে মেজাজি। সওদাগর লক্ষ্মীকামত্ম বাবুরা ন্যায্য পাওনা আদায়ে নির্ভীক চরিত্র গুপীনাথদের ভয় পায়, সমীহ করে। এই গুপীনাথদের গল্পে জায়গা দেওয়া ও ফুটিয়ে তোলার জন্য আমরা পাই শওকত আলীর জীবনবাদী সৃষ্টিশীলতার পরিচয়।
গল্পের আবহ পরিবেশ রচনায় শওকত আলীর গল্পের সঙ্গে আরেক গল্পের বহুলাংশে সাযুজ্য বা একাত্মতা আছে। গল্পে ঘুরেফিরে আসে রাত-শীত-বৃষ্টি-কান্দরের একই সবিসত্মার বিবরণ। মনে হয় কেবল চরিত্র ও ঘটনা ছাড়া অকুস্থল প্রায় এক। লোভ-ক্ষুধা-ক্ষক্ষাভ-প্রতিবাদ-যৌন অবদমন সঙ্গে নিয়ে উত্তরবঙ্গের বুনোগন্ধময় পাড়াগাঁয় যাবতীয় কাজকর্ম করলেও বারবার এক বর্ণনানির্ভর প্রকৃতির মধ্যেই তাদের স্থিতি। ‘আর মা কান্দে না’ গল্পের অংশবিশেষ ‘অন্ধকার চারদিকে থৈ থৈ করে। মনে হয় বাতাসে অন্ধকারটা পাক খাচ্ছে, ফুলছে আর চারদিকে কেমন ছড়িয়ে যাচ্ছে। উত্তর দেখো, দক্ষিণ দেখো, আসমানে তাকাও – শুধু কালো। থেকে থেকে কালো মেঘের পি-গুলো একদিক থেকে গড়িয়ে যাচ্ছে আরেক দিকে। ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা এসে শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছে।’ বিরুদ্ধ চরাচরের বর্ণনার সঙ্গে ‘লেলিহান সাধ’ গল্পের দৃশ্যমান অবস্থার মিল আছে। – ‘খোলা কান্দরে হাওয়ার ঝাপটা ভীষণ আছাড় যাচ্ছে। উত্তর থেকে বাতাস শব্দ করে ছুটে আসছে। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে উথাল-পাতাল অন্ধকারটা দেখে নিলো দু’জনে। তারপর পা বাড়াল। কিন্তু কোথায়? তখুনি শুরু হলো বেদম বৃষ্টি।’ ‘নয়নতারা কোথায় রে’ গল্পেরও আকাশ-বাতাস-বৃষ্টির বর্ণনা অনুরূপ – ‘আসমানের লীলা বোঝা ভার। এই বাতাস বন্ধ, গুমোট ভাব, যেন চেপে আসছে বুকের উপর ভারী বোঝার মতো – তারপর এই আবার দেখো, দেখতে দেখতে কোনদিক থেকে বাতাস বইতে শুরু করে দিলো, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ফুটে উঠল বাতাসের গায়ে। শেষে মেঘ ডাক ছেড়ে বৃষ্টি ঢালতে শুরু করে দিলো।’ শীতের প্রকোপ এবং চরম শীতে শায়েসত্মা হওয়া কামলা-কিষানের দুরবস্থাও একইভাবে গল্পে ঘুরেফিরে এসেছে। পরিপ্রেক্ষিত এক হতে পারে, কিন্তু তা ভাষায় মূর্ত করতে গিয়ে বারবার একরকম হয়ে এলে পাঠকের সামনে চলে আসে লেখকের পুনরাবৃত্তির প্রবণতা। কিন্তু মানুষ, তার কার্যক্ষমতা, রোদজ্বলা প্রামত্মর, অন্ধকারশাসিত রাত্রির প্রকৃতি এক জায়গায় এসে মিলেমিশে গেলে বাসত্মবের পুনর্জীবন ঘটতে দেখা যায়। অঞ্চল বিশেষের ঘাত-প্রতিঘাত, মানুষের ক্ষয়, ঘটনাস্রোত এবং শেষাবধি পুনরুত্থান মানুষেরই শক্তিকে অভিনন্দন জানায়। তখন গল্প বর্ণনায় দুর্বলতা জোরালো বলে মনে হয় না।
শওকত আলীর গল্পের গদ্য প্রাঞ্জল, সহজবোধ্য। সর্বত্র আবার অলংকারবর্জিত নয়। অনায়াস স্বচ্ছন্দে তিনি বৃত্তামত্ম লিখে গেছেন। জয়-পরাজয়, আলো-অন্ধকারের পালটাপালটি যে-জীবন তিনি চিত্রিত করেছেন সে-জীবন প্রতিদিনের বাঁচার জন্য লড়াই করে, প্রতিদিন সে-জীবন আবার নিঃশেষিত হয়। অশামিত্মময়, সুখবঞ্চিত। সারাংশশূন্য এই জীবন রূপায়ণে বিষয়ানুগ গল্পভাষা ব্যবহারে অনমনীয় হওয়ার প্রয়োজন ছিল। জীবন ও সমাজের যে ভাগ ধূসর, ধূলিমলিন, নিষ্প্রভ, ফাটলপূর্ণ তার যথাযথ প্রকাশে গদ্য অনুরূপ হওয়া বাঞ্ছনীয়। শওকত আলীর গল্পভাষা লিরিক্যাল থেকে যায়। কি প্রকৃতি বা দৃশ্য বর্ণনায়, কি মানুষের স্মৃতি রোমান্থনে, কি ঘটনা উপস্থাপনে গল্পে শওকত আলীর রোমান্টিক মনের খোঁজ পাওয়া যায়।
উন্মূল বাসনার গল্পের প্রধান প্রবণতা যে জৈবিক প্রবৃত্তি তা থেকে সরে এসে শওকত আলী সমাজ ও মানুষের শ্রেণিদ্বন্দ্ব গল্পে মূর্ত করে নিশ্চিত করেছেন তাঁর নিজের ক্রম-উত্তরণ। বানোয়াট কাহিনি পরিবেশন অস্বীকার করে তিনি গল্পে ধারণ করেছেন মানুষের বেঁচে থাকা, জেগে ওঠার প্রবল স্বপ্ন ও আকাঙক্ষা। কথাসাহিত্য নিয়ে শওকত আলীর মনোভাব তাঁর সাহিত্যের জন্যও প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে এখানে পেশ করা যায় : আসলে মানুষের জীবনই কথাসাহিত্যের বিবেচ্য বিষয়। তাতে পূর্ণাঙ্গ কাহিনি থাকতেও পারে, না-ও পারে। বিচার্য বিষয় হচ্ছে, লেখক জীবনের কতটুকু দেখলেন ও দেখালেন এবং কীভাবে দেখালেন। লেখক জীবনের গভীর থেকে গভীরতর ভেতরের দিকে যদি যেতে পারেন, তাহলে তাঁর লেখায় যা উঠে আসবে তাতেই পাওয়া যাবে সাহিত্যের সেই অন্বিষ্টকে, যা মানুষকে ভাবায় এবং আলোড়িত ও উদ্দীপ্ত করে।
No comments