শওকত আলী : পথিকৃৎ লেখকের প্রতিকৃতি by জাকির তালুকদার
নিজের
সাহিত্যিক লক্ষ্য থেকে কখনো বিচ্যুত হননি শওকত আলী। প্রগতিশীল সাহিত্য ও
সমাজচিমত্মা তাঁর ভেতরে প্রজ্বালিত রেখেছে পথচলার আলোকশিখা। তাই কখনো
পথভ্রষ্ট হননি তিনি। বিভিন্ন সময় কলাকৈবল্যবাদ আক্রমণ শানিয়েছে বাংলাদেশের
সাহিত্য-অঙ্গনে। সেই কুহকে বেপথু হয়েছেন অনেকে; কিন্তু নিজের জায়গা থেকে
নড়েননি শওকত আলী। নিজের সাহিত্যদর্শনকে বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন।
পর্যালোচনা এবং নির্মম আত্মসমালোচনায় কখনো পরাঙ্মুখ হননি তিনি। শেষ
পর্যমত্ম স্থিত থেকেছেন সাহিত্য এবং সমাজ প্রগতির আন্দোলনে। তাই বাংলাদেশের
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসগুলোর একটি বড় অংশই লিখিত হয়েছে তাঁর হাতে।
অনেক সময়ই আলোচনার পাদপ্রদীপ থেকে দূরে থাকতে হয়েছে তাঁকে। বাংলাদেশের
সাহিত্যের কর্তৃত্ব বেশিরভাগ সময় থাকে প্রতিক্রিয়াশীল একটি দুষ্টচক্রের
হাতে; কিন্তু তারা পরাজিত করতে পারেনি শওকত আলীকে। বাংলাদেশের সাহিত্যের গত
৭০ বছরের ইতিহাস প্রমাণ করেছে, শওকত আলীর মতো লেখকরাই শেষ পর্যমত্ম
দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন মাথা উঁচু করে। উপন্যাস-সাহিত্যে মনোযোগ বেশি নিবদ্ধ
থাকলেও বাংলাদেশের গল্পের আলোচনাও শওকত আলীকে বাদ দিয়ে কিছুতেই পূর্ণাঙ্গতা
পেতে পারে না।
শওকত আলীর লেখালেখির শুরু গত শতকের পাঁচের দশকে। নিজেকে আলাদা করে এবং উজ্জ্বলভাবে চিনিয়েছেন ষাটের দশকে। তারপর নিজেকেই নিজে ছাড়িয়ে গেছেন নতুন নতুন লেখার মাধ্যমে আমৃত্যু।
কেমন পরিবেশে লিখতে শুরু করেছিলেন শওকত আলী?
আর কেন এবং কীভাবে এই ভূখণ্ডেরগল্প শওকত আলীদের হাত ধরে অন্য এক রূপ লাভ করল কলকাতাকেন্দ্রিক কথাসাহিত্যকে পাশ কাটিয়ে? তিরিশ, চলিস্নশ এবং পঞ্চাশের দশকে এ-ভূখণ্ডেরআর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার কথা বিবেচনায় নিলে বোঝা যাবে শওকত আলীদের লড়াই ছিল কত ধরনের ফ্রন্টে।
আজকের বাংলাদেশ, তখনকার পূর্ববঙ্গ, মূলত ছিল কৃষক-অধ্যুষিত অঞ্চল। সকল জমিদারি এবং বড় জোতের মালিক ছিলেন ব্রিটিশ-সখ্যসূত্রে উচ্চবর্ণের বাঙালি হিন্দু এবং অবাঙালি আশরাফ গোত্রের মুসলমানরা। তারা বাস করতেন কলকাতায় বা দিলিস্নতে। বাঙালি জাতির হয়ে সব ভাবনাচিমত্মা এবং সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেরচিরস্থায়ী বন্দোবসত্ম নিয়েছিলেন কলকাতার বাবু এবং সাহেবশ্রেণি। তারা যে সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, তার সঙ্গে পূর্ববঙ্গীয় কৃষকসমাজের কোনো মিল ছিল না, থাকার কথাও নয়। ফলে আধুনিক সাহিত্যের অনুপ্রবেশ এ-অঞ্চলে ঘটেছিল খুবই ছোট একটি শহুরে অংশের মধ্যে। ভারত-বিভক্তির পরে যদিও বাঙালি-আত্মাকে বিভক্ত করা যায়নি, তারপরও সমাজ এবং রাজনৈতিক বাসত্মবতা দুই দেশের বাঙালির মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে চিমত্মাকর্ম এবং সৃজনের ভিন্নতা এনে দিয়েছে। ভারতীয় বাঙালিরা সেদেশে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিয়ে একটি নিরুপদ্রব জীবনকে গ্রহণ করেছেন। তারা মনোযোগ দিয়েছেন ভারতীয় জাতীয় পুঁজি বিকাশের পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে একটি বড়সড় মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম দিতে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে না নিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে অচিমত্মনীয় ভাষা-আন্দোলনের জন্ম দিয়েছেন। পাকিসত্মান এবং বাংলাদেশ আমলেও সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েও সেই শাসনকে বারবার বিদূরিত করে গণতন্ত্রের সংগ্রামে জয়ী হওয়ার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে। বস্ত্তত ভঙ্গুর গণতন্ত্রকে সবসময় রক্ষা করতে না পারলেও সামরিক স্বৈরাচারকে বারবার গণতান্ত্রিক সংগ্রামে পরাজিত করার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষের সমান আর কারো নেই পৃথিবীতে। তারপর রয়েছে একের পর এক আন্দোলনের ঢেউ। বাষট্টির শিক্ষা-আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, টর্নেডো-ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ এবং সর্বোপরি একাত্তরের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের অর্জন ও উত্তরাধিকার পুরোপুরি বাংলাদেশের বাঙালির। এসব অভিজ্ঞতা থেকে ভারতীয় বাঙালি বঞ্চিত। ফলে তাদের রচিত ছোটগল্পে জীবন যেভাবে ধরা পড়বে, বাংলাদেশের গল্পে জীবনের জঙ্গমতা তার চেয়ে ভিন্ন হবেই।
এছাড়া রয়েছে পার্থক্যের অন্য একটি সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক মাত্রাও। এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পরেও, মাত্র এক দশক আগে পর্যমত্ম, বাংলাসাহিত্যের মূলধারা বলতে বিনা প্রশ্নে বোঝানো হতো ভারতের বাংলাভাষী অধ্যুষিত প্রদেশ পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাকেন্দ্রিক সাহিত্যকেই। আমাদের এই বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডেরমানুষ হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথম বাঙালির নিজস্ব স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হলেও বাংলা-সম্পর্কিত ‘সবকিছু’র দায়িত্ব গ্রহণের জন্য মানসিকভাবে তৈরি হতে সময় নেওয়া হয়েছে প্রচুর। একই কথা প্রযোজ্য এদেশের লেখকদের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশ নামক বাঙালির একমাত্র স্বাধীন ভূমির অধিবাসী হিসেবে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের ধারণ-বাহন-রক্ষণ-সৃজনের প্রধান দায়ভার যে আমাদেরই – এই সত্য বুঝে উঠতে এবং সেই দায়িত্ব পালনের যোগ্য হয়ে উঠতে বেদনাদায়কভাবে বেশি সময় নিয়েছেন এদেশের কবি-সাহিত্যিকরা। তাই কিছুদিন আগে পর্যমত্মও বাংলাসাহিত্যের প্রধান স্রোতধারা বলতে কলকাতাকেন্দ্রিক পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যকেই বোঝানো হতো। বর্তমানেও এ-মনোভঙ্গি পুরোপুরি অপসৃত হয়েছে, এমনটি নিঃসংশয়ে বলা যায় না।
পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য যে এতদিন ধরে মূল স্রোতধারা হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে, অথবা সত্যি সত্যিই পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতাই যে ছিল বাংলাসাহিত্যের প্রধান কেন্দ্র, তার পেছনে ঐতিহাসিক, প্রযুক্তিগত, সাংস্কৃতিক এবং লগ্নিবিষয়ক নানাবিধ কারণ বিদ্যমান। ব্রিটিশ আমলে ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্যের আধুনিক ধারার সঙ্গে পরিচিত হয়ে-ওঠার সুযোগ পেয়েছিলেন কেবলমাত্র কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী এবং সাহিত্যিকবৃন্দ। পরিচিত হওয়ার পাশাপাশি সে-ধারার রচনাকুশলতা অর্জনও সম্ভব হয়েছিল তাদের পক্ষেই। অবিভক্ত ভারত এবং অবিভক্ত বাংলার অর্থনীতি ও সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র হওয়ায় কলকাতাতেই প্রধানত বিকশিত হয়েছিল সংবাদপত্র, সাময়িকপত্র এবং প্রকাশনা শিল্প। পত্রপত্রিকা তো বটেই, পুসত্মক প্রকাশনা ও বিপণনের মূল বা একমাত্র কেন্দ্র হওয়ায় সারাদেশের লেখক-শিল্পীরা কলকাতাকেই বেছে নিতেন নিজেদের অবস্থান এবং কর্মক্ষেত্র হিসেবে। দেশের অন্যত্র, বিশেষ করে ঢাকা, রংপুর, রাজশাহী ও নদীয়া অঞ্চল থেকে কিছু সাময়িকপত্র ও গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও তা কখনো কলকাতার সমতুল্য গুরুত্ব অর্জন করতে পারেনি। বাংলার বাইরে, বিশেষ করে ত্রিপুরা, আসাম, বিহার ও উড়িষ্যা অঞ্চলে বাংলাসাহিত্যের চর্চা হলেও সেগুলিকে প্রবাসী সাহিত্যের তকমা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। ১৯৪৭ সালের ভারতভাগ এবং বাংলাভাগের পরেও অক্ষুণ্ণ থেকেছে কলকাতার একক প্রাধান্য। প্রকাশনা, ছাপা, বাঁধাই এবং বিপণনের প্রায় সব কাঠামোই পড়েছিল কলকাতার ভাগে। ঢাকাকে শুরু করতে হয়েছিল শূন্য হাতে। তৃতীয়ত, ঢাকা তথা বাংলাদেশ ব্রিটিশের কবল থেকে মুক্ত হলেও স্বাধীনতা অর্জনের পরিবর্তে পরিণত হয়েছিল পশ্চিম পাকিসত্মানের উপনিবেশে। পাকিসত্মানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাচর্চাকে সুনজরে দেখেনি, বরং তাকে দমাতে চেষ্টা করেছে সর্বাত্মকভাবে। চতুর্থত, ব্রাহ্মণ্যবাদী লেখকদের দ্বারা এত বছর সাংস্কৃতিক ও মানসিকভাবে নিগৃহীত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় অবহেলিত বাঙালি মুসলমান লেখকদের একটি বড় অংশ পাকিসত্মানি জোশে আত্মহারা হয়ে বাংলাসাহিত্যের উত্তরাধিকারকেই অস্বীকার করে মুসলমানি পাকিসত্মানি বাংলাসাহিত্য সৃষ্টির অলীক চেষ্টায় মেতে উঠে এই ভূখ– সাহিত্যের প্রকৃত বিকাশকে কঠিনতর করে তুলেছিলেন। পঞ্চমত, বাঙালি মুসলমান তথা বাংলাদেশে বসবাসরত লেখকদের সামগ্রিকভাবে সাহিত্যপ্রতিভায় উনতা ছিল লক্ষণীয়। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে, বিশেষ করে বাহান্নর ভাষা-আন্দোলনের পরে বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান কবি-সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটলেও প্রয়োজনীয় সংখ্যার তুলনায় তা ছিল বেদনাদায়কভাবে কম। আর ড. মুহম্মদ শহীদুলস্নাহ্র মতো ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি বিবেচনায় নিয়েও নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, সমালোচনা সাহিত্য তখন গড়েই ওঠেনি আদৌ। ফলে প্রতিভাবান লেখকবৃন্দ না পারতেন স্বদেশে চিহ্নিত হতে, না পারতেন প্রচারের আলোয় আলোকিত হতে। তদুপরি কোনো বহুল প্রচারিত এবং মানসম্মত নিয়মিত সাহিত্য পত্রিকার অনুপস্থিতির কারণে, এবং একই সঙ্গে প্রকাশনা ও বিপণনের ব্যবস্থা না থাকার কারণে তারা নিজ দেশের সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, সচেতন পাঠকসমাজের কাছে পৌঁছতেও ব্যর্থ হচ্ছিলেন প্রতিনিয়ত। পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে (১৯৫৭ সালে) সমকাল প্রকাশিত হলেও তা যথেষ্টর বিবেচনায় ছিল নেহায়েতই অপ্রতুল। তাই ঢাকার কবি-গল্পকারদের তখনো নিজেদের লেখা ছাপার জন্য প্রধানত নির্ভর করতে হতো কলকাতার স্বনামধন্য পত্রিকাগুলির ওপরেই। তারা সামত্মবনাসূচক কিছু লেখা ছাপাতেন বটে, তবে তা কেবল নিজেদের লেখকদের লেখা ছাপার পরে ফাঁকা জায়গা থাকলে।
এতসব প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের নিজস্ব ধারা সৃষ্টি করতে হয়েছে শওকত আলীদের।
পঞ্চাশের দশকে এই দেশে সংঘটিত হয়েছে ভাষা-আন্দোলনের মতো যুগামত্মকারী ঘটনা। পূর্ববাংলা বা বাংলাদেশ নামের এই ভূখ– ভাষা-আন্দোলনের পরে কোনো কিছুই আর আগের মতো থাকেনি। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত পাকিসত্মান নামক রাষ্ট্রটির প্রতি বাঙালির মোহ ফিকে হতে শুরু করেছিল সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই। সেই মোহ থেকে বাংলাদেশের মানুষ পুরোপুরি মুক্তিলাভ করে ভাষা-আন্দোলনের মাধ্যমে। ভাষা-আন্দোলনের মাধ্যমেই বাংলাদেশের মানুষ পৃথিবীবাসীকে এই সংকেত পাঠায় যে, বাঙালি নিজস্ব একটি রাষ্ট্র গঠনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আর সেই রাষ্ট্রগঠনে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ থাকবে প্রধান প্রভাবকের ভূমিকায়। বাংলাদেশের গল্পকাররা ভাষা-আন্দোলনে সাড়া দিয়েছিলেন আমত্মরিকভাবে। এমনকি লেখকদের অনেকেই ছিলেন এই আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক এবং কর্মী। ভাষা-আন্দোলনের সব সাহিত্যিক দলিলকে ধারণ করতে হাসান হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে এগিয়ে এলেন প্রগতিশীল লেখক ও কবিরা। বাহান্নর শহীদদের রক্তের দাগ শুকানোর আগেই একুশের প্রথম সংকলন প্রকাশিত হলো হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায়। সেই সংকলন আজো পৃথিবীতে মুক্তিকামী মানুষের অন্যতম প্রধান সৃজনশীল দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। ভাষা-আন্দোলনের মাধ্যমে এদেশের কবি-সাহিত্যিকরা এই উপলব্ধিতেও পৌঁছালেন যে, বাংলা সাহিত্যের চর্চা কেবলমাত্র আর সাহিত্যচর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, তা এখন বাঙালি জাতিসত্তা রক্ষার এক মহান বিপস্নবী দায়িত্বেও পরিণত হয়েছে। এই দায়িত্ব পালনে শৈথিল্য দেখালে ইতিহাস কাউকেই ক্ষমা করবে না। ফলে লেখকরা সর্বাত্মকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সাহিত্যকর্মে। ফল্গুধারা পরিণত হলো মুক্তধারায়। অসংখ্য সৃষ্টি ও ফসলে ভরে উঠল বাংলার সাহিত্যজমিন। গল্প-লেখকদের তো পিছিয়ে থাকার প্রশ্নই আসে না। কারণ, তাঁরা ততদিনে বুঝে গেছেন যে, বাংলার মানুষ একটি সম্মানজনক ও গণতান্ত্রিক জীবনের জন্য আবহমান কাল ধরে যে-লড়াই চালিয়ে আসছে, সে-লড়াইকে জীবমত্ম ধরে রাখার সবচেয়ে কার্যকর সাহিত্যমাধ্যম হচ্ছে ছোটগল্প। পঞ্চাশের দশকের সব গল্পকারই আমৃত্যু সৃষ্টিমুখর। অনেকে পরবর্তী সময়ে গল্প লেখা থেকে সরে অন্য রচনায় মনোনিবেশ করেছেন। কিন্তু সৃষ্টিশীলতার অঙ্গীকার থেকে পিছু হটেননি কেউ-ই। এই দশকে আবির্ভূত উজ্জ্বল গল্পকার শওকত আলী।
ষাটের দশকে হঠাৎ করেই যেন গল্প এবং গল্পকারের ব্যাপ্তি প্রসারিত হয় অনেকগুণ। কি সংখ্যায় কি বৈচিত্র্যে কি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় – সবক্ষেত্রেই ছোটগল্প যেন আমূল পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছিল। রাজনৈতিক-সামাজিক টালমাটাল ঢেউয়ের মধ্যে যেমন এই দশকেই বাঙালি মুসলমান সমাজের মধ্যে, বিকৃত পথে হলেও, একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সব শর্ত পূরণ হয়, তেমনি ছোটগল্পের ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে সূচনা হয় একটি ভিন্ন ভূগোল এবং ভিন্ন কণ্ঠের। এই প্রথম লেখকদের কেউ কেউ উপলব্ধি করতে শুরু করেন যে, তাঁদের বাংলাদেশের মানুষের গল্প লিখতে হবে, যে-গল্পগুলো ইউরোপীয় নয়, পশ্চিমবঙ্গীয় নয়। ষাটের দশকের গল্পগুলোর মধ্যে অনেকগুলো প্রবণতা ছিল, যা এই দশকের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রবণতাসমূহের সমানুপাতী।
প্রথমত, ষাটের দশকের উজ্জ্বল ছোটগল্পগুলো প্রধানত প্রকাশিত হয়েছিল লিটল ম্যাগাজিনে। ফলে এক ধরনের অপ্রাতিষ্ঠানিকতার পরিচয় এই গল্পগুলির অবয়বে খুঁজে পাওয়া যায়। যেহেতু লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত, তাই কিছুটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ ছিল। সবসময়ই সেগুলো শিল্পোত্তীর্ণ এমনটি বলা যাবে না। তবে এই অর্থে একে ইতিবাচক বলতেই হবে যে, একটি নিরীক্ষা-পরবর্তী সময়ে আরো নিরীক্ষার দরজা উন্মুক্ত করে দেয়। দ্বিতীয়ত, ষাটের দশক প্রধানত কেটেছে আইয়ুবী স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে। সে-সময় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল নিষিদ্ধ। তাই ষাটের লেখকদের কথনরীতিতে আনতে হয় পরিবর্তন। অপ্রত্যক্ষ কথনের মাধ্যমে গল্প-নির্মাণ। এর ফলে আবার জীবনবিমুখ শিল্প-সর্বস্বতার একটি প্রবণতাও দানা বেঁধেছিল এ-দশকে। তৃতীয়ত, ষাটের লেখকদের একটি বড় সাফল্য হচ্ছে, গল্পের ভাষাকে উপযুক্তরূপে গড়ে তুলতে পারা। ষাটের প্রধান গল্পকাররা শব্দের শক্তি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তাই তাঁরা প্রত্যেকেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভাষাশিল্পীও বটে। এই দশকে শওকত আলী একের পর এক সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেকে চেনাচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে।
-------দুই------
এতসব সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-মনসত্মাত্ত্বিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শওকত আলী এবং তাঁর সঙ্গীরা বাংলাদেশের সাহিত্যকে নিয়ে এসেছেন আধুনিক প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষতার ধারায়। এবং অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এ-ধারাটিই আজকের বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির মূলধারা হিসেবে প্রবহমান। পশ্চাৎপদ সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার কথা বিবেচনায় নিলে এ এক মহাবিপস্নবই বটে। এটি কীভাবে সম্ভব হলো?
সম্ভব হয়েছে শওকত আলী এবং তাঁর সঙ্গীদের প্রতিভা, পরিশ্রম এবং স্বচ্ছ দৃষ্টি আয়ত্ত করার মধ্য দিয়ে। তাঁরা ইংরেজি সাহিত্যের আধুনিকতা ও মানবিক ধারাটির সঙ্গে সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন বাঙালির চিরায়ত আখ্যানসমূহের।
হাজার বছর বয়সী একটি জাতির আখ্যান আসলে সেই জাতির সত্যিকারের প্রাণস্পন্দন। সেই প্রাণস্পন্দন কোনোদিনই লুপ্ত হয়নি বাঙালির। সমাজের ওপরতলার মানুষকে আপাতদৃষ্টিতে সবকিছুর নিয়ন্ত্রক মনে হলেও জাতিকে ধারণ করে রাখে অমত্ম্যবাসী কর্মীসমাজ। ইউরোপীয় শিক্ষা তথা সাহিত্য-সংস্কৃতির আগ্রাসন সেই তলা পর্যমত্ম পৌঁছতে পারেনি। আবার তারও আগে তুর্কি আগ্রাসনও এই পর্যমত্ম শেকড় বিছাতে পারেনি। ব্রিটিশ যুগে শরীয়তপন্থীদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি আমাদের অনেক ঋণ। কিন্তু এই শরিয়া-আন্দোলনও পরাজিত হয়েছে প্রকৃতিনিষ্ঠ বাঙালির আখ্যানকাব্যের শরীরে ফাটল ধরাতে। শেষ পর্যমত্ম বাঙালির আখ্যান তাই ধর্মনিরপেক্ষই থেকে গেছে, এবং গড়ে দিয়েছে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত। ধর্মনিরপেক্ষতার চেয়েও শক্তিশালী একটি ধারা রয়েছে বাঙালির আখ্যানের। সেটি হচ্ছে সর্বধর্মের সমন্বয়বাদী আখ্যান। পৃথিবীর ইতিহাসে এর কোনো তুলনা পাওয়া যাবে না। বাঙালি তার মাটিতে আশ্রয় দিয়েছে আর্যদের, শক-হূন-মোগলদের, পাঠানদের, বৌদ্ধ-জৈনদের, তুর্কি-ইরানি-আরবীয়দের। তাদের দিয়েছে নিজের থালার অন্ন-ব্যঞ্জনের ভাগ, নিজের সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছে তাদের, নিজের ধর্মপরায়ণতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে দেয়নি অতিথিদের ধর্মবিশ্বাসকে। তাই সকল ধর্মবিশ্বাসের বাইরের আবরণটিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে খুঁজে নিতে হয়েছে ভেতরের অমত্মর্নিহিত আদর্শটিকে। সেখান থেকে যেসব অভিন্ন উপাদান সংগৃহীত হয়েছে – যেমন সকল মানুষের প্রতি ভালোবাসা, প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান, অন্যের ধর্মাচরণে বাধা না দেওয়া, নির্বাণ বা প্রশামিত্মর জন্য ধর্ম-অবলম্বন – এসবকে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে অভিন্ন ধর্মবিশ্বাসের কথকতা-কাব্য-পাঁচালি-পুঁথি। বিভেদের বিভ্রামিত্ম এসেছে কখনো কখনো, কিন্তু সমন্বয়ের সাফল্যই শেষকথা। আর আছে ভালোবাসা। ব্যক্তির জন্য ভালোবাসা, কৌমের জন্য ভালোবাসা, যে কাছে আসছে তার জন্যই ভালোবাসা, বৃক্ষের জন্য, বৃষ্টির জন্য, পিঁপড়ের জন্য, পাখির জন্য, মাছের জন্য, গায়ে পরশ বুলিয়ে বয়ে যাওয়া ঝিরঝিরে বাতাসের জন্য, প্রাণদায়ী বৃষ্টির জন্য, বিপাকে পড়া শত্রম্নর জন্যও, সর্বোপরি গর্ভধারিণী এবং হৃদয়ধারিণী মায়েদের জন্য। লিখিত হয়নি এসব আখ্যান। রচিত হয়েছে কৌমের কোনো প্রাজ্ঞ বৃদ্ধ বা তরুণের মুখে, সঞ্চিত এবং পরিশীলিত হয়েছে বুকের মধ্যে, তারপর সঞ্চারিত হয়েছে মুখের বয়ান হিসেবে আরেকজনের কাছে, পরবর্তী জন ধারণ করেছে সে-আখ্যানকে, পুষে রেখেছে বুকের মধ্যে, তারপর ছড়িয়ে দিয়েছে পর্যটনে গিয়ে, পশুশিকারে গিয়ে, মৎস্যশিকারে গিয়ে, কৃষিক্ষেত্রে গিয়ে, ‘জলকে চল’তে গিয়ে, নাইয়রে গিয়ে। মুখে মুখে সৃষ্টি, বুকে বুকে সঞ্চয়ন, বুকে বুকে বহন, মুখে মুখে সঞ্চালন – এ-প্রক্রিয়ায় হাজার বছর ধরে সৃষ্টি হয়েছে এবং বাহিত হয়ে এসেছে বাঙালির আখ্যান। বিদেশি আগ্রাসন পারেনি এসব আখ্যান বন্ধ করতে, ঔপনিবেশিকতা পারেনি এসবের প্রবাহ রুদ্ধ করতে। মধ্যবিত্ত এবং ওপরতলার বাঙালির একটা অংশ শাসকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইংরেজ হতে চেয়েছে, পাঞ্জাবি হতে চেয়েছে, তুর্কি হতে চেয়েছে, পারসি হতে চেয়েছে, আরবীয় হতে চেয়েছে। কিন্তু আবহমান বাঙালিত্ব রয়ে গেছে সেই আগের জায়গাতেই অনড়, অপাপবিদ্ধ। বাঙালির সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে এই আগ্রাসী এবং ভিখারি-মানসিকতার বাইরে বসেই। সেই সংস্কৃতি শেষ পর্যমত্ম পুষ্টি জুগিয়েছে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে। চিরায়ত আখ্যানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাঙালির মুক্তির আখ্যান। এটাই বাঙালির প্রাণশক্তির সত্যিকারের উৎস।
শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজনই কেবল নয়, সকল গল্প-উপন্যাসই বাঙালির চিরায়ত আখ্যান ও জীবনের সম্প্রসারণ। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের সাহিত্যের আধুনিক-প্রগতিশীল-ধর্মনিরপেক্ষ ধারাটির অন্যতম পথিকৃৎ।
শওকত আলীর লেখালেখির শুরু গত শতকের পাঁচের দশকে। নিজেকে আলাদা করে এবং উজ্জ্বলভাবে চিনিয়েছেন ষাটের দশকে। তারপর নিজেকেই নিজে ছাড়িয়ে গেছেন নতুন নতুন লেখার মাধ্যমে আমৃত্যু।
কেমন পরিবেশে লিখতে শুরু করেছিলেন শওকত আলী?
আর কেন এবং কীভাবে এই ভূখণ্ডেরগল্প শওকত আলীদের হাত ধরে অন্য এক রূপ লাভ করল কলকাতাকেন্দ্রিক কথাসাহিত্যকে পাশ কাটিয়ে? তিরিশ, চলিস্নশ এবং পঞ্চাশের দশকে এ-ভূখণ্ডেরআর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার কথা বিবেচনায় নিলে বোঝা যাবে শওকত আলীদের লড়াই ছিল কত ধরনের ফ্রন্টে।
আজকের বাংলাদেশ, তখনকার পূর্ববঙ্গ, মূলত ছিল কৃষক-অধ্যুষিত অঞ্চল। সকল জমিদারি এবং বড় জোতের মালিক ছিলেন ব্রিটিশ-সখ্যসূত্রে উচ্চবর্ণের বাঙালি হিন্দু এবং অবাঙালি আশরাফ গোত্রের মুসলমানরা। তারা বাস করতেন কলকাতায় বা দিলিস্নতে। বাঙালি জাতির হয়ে সব ভাবনাচিমত্মা এবং সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেরচিরস্থায়ী বন্দোবসত্ম নিয়েছিলেন কলকাতার বাবু এবং সাহেবশ্রেণি। তারা যে সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, তার সঙ্গে পূর্ববঙ্গীয় কৃষকসমাজের কোনো মিল ছিল না, থাকার কথাও নয়। ফলে আধুনিক সাহিত্যের অনুপ্রবেশ এ-অঞ্চলে ঘটেছিল খুবই ছোট একটি শহুরে অংশের মধ্যে। ভারত-বিভক্তির পরে যদিও বাঙালি-আত্মাকে বিভক্ত করা যায়নি, তারপরও সমাজ এবং রাজনৈতিক বাসত্মবতা দুই দেশের বাঙালির মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে চিমত্মাকর্ম এবং সৃজনের ভিন্নতা এনে দিয়েছে। ভারতীয় বাঙালিরা সেদেশে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিয়ে একটি নিরুপদ্রব জীবনকে গ্রহণ করেছেন। তারা মনোযোগ দিয়েছেন ভারতীয় জাতীয় পুঁজি বিকাশের পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে একটি বড়সড় মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম দিতে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে না নিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে অচিমত্মনীয় ভাষা-আন্দোলনের জন্ম দিয়েছেন। পাকিসত্মান এবং বাংলাদেশ আমলেও সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েও সেই শাসনকে বারবার বিদূরিত করে গণতন্ত্রের সংগ্রামে জয়ী হওয়ার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে। বস্ত্তত ভঙ্গুর গণতন্ত্রকে সবসময় রক্ষা করতে না পারলেও সামরিক স্বৈরাচারকে বারবার গণতান্ত্রিক সংগ্রামে পরাজিত করার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষের সমান আর কারো নেই পৃথিবীতে। তারপর রয়েছে একের পর এক আন্দোলনের ঢেউ। বাষট্টির শিক্ষা-আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, টর্নেডো-ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ এবং সর্বোপরি একাত্তরের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের অর্জন ও উত্তরাধিকার পুরোপুরি বাংলাদেশের বাঙালির। এসব অভিজ্ঞতা থেকে ভারতীয় বাঙালি বঞ্চিত। ফলে তাদের রচিত ছোটগল্পে জীবন যেভাবে ধরা পড়বে, বাংলাদেশের গল্পে জীবনের জঙ্গমতা তার চেয়ে ভিন্ন হবেই।
এছাড়া রয়েছে পার্থক্যের অন্য একটি সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক মাত্রাও। এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পরেও, মাত্র এক দশক আগে পর্যমত্ম, বাংলাসাহিত্যের মূলধারা বলতে বিনা প্রশ্নে বোঝানো হতো ভারতের বাংলাভাষী অধ্যুষিত প্রদেশ পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাকেন্দ্রিক সাহিত্যকেই। আমাদের এই বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডেরমানুষ হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথম বাঙালির নিজস্ব স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হলেও বাংলা-সম্পর্কিত ‘সবকিছু’র দায়িত্ব গ্রহণের জন্য মানসিকভাবে তৈরি হতে সময় নেওয়া হয়েছে প্রচুর। একই কথা প্রযোজ্য এদেশের লেখকদের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশ নামক বাঙালির একমাত্র স্বাধীন ভূমির অধিবাসী হিসেবে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের ধারণ-বাহন-রক্ষণ-সৃজনের প্রধান দায়ভার যে আমাদেরই – এই সত্য বুঝে উঠতে এবং সেই দায়িত্ব পালনের যোগ্য হয়ে উঠতে বেদনাদায়কভাবে বেশি সময় নিয়েছেন এদেশের কবি-সাহিত্যিকরা। তাই কিছুদিন আগে পর্যমত্মও বাংলাসাহিত্যের প্রধান স্রোতধারা বলতে কলকাতাকেন্দ্রিক পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যকেই বোঝানো হতো। বর্তমানেও এ-মনোভঙ্গি পুরোপুরি অপসৃত হয়েছে, এমনটি নিঃসংশয়ে বলা যায় না।
পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য যে এতদিন ধরে মূল স্রোতধারা হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে, অথবা সত্যি সত্যিই পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতাই যে ছিল বাংলাসাহিত্যের প্রধান কেন্দ্র, তার পেছনে ঐতিহাসিক, প্রযুক্তিগত, সাংস্কৃতিক এবং লগ্নিবিষয়ক নানাবিধ কারণ বিদ্যমান। ব্রিটিশ আমলে ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্যের আধুনিক ধারার সঙ্গে পরিচিত হয়ে-ওঠার সুযোগ পেয়েছিলেন কেবলমাত্র কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী এবং সাহিত্যিকবৃন্দ। পরিচিত হওয়ার পাশাপাশি সে-ধারার রচনাকুশলতা অর্জনও সম্ভব হয়েছিল তাদের পক্ষেই। অবিভক্ত ভারত এবং অবিভক্ত বাংলার অর্থনীতি ও সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র হওয়ায় কলকাতাতেই প্রধানত বিকশিত হয়েছিল সংবাদপত্র, সাময়িকপত্র এবং প্রকাশনা শিল্প। পত্রপত্রিকা তো বটেই, পুসত্মক প্রকাশনা ও বিপণনের মূল বা একমাত্র কেন্দ্র হওয়ায় সারাদেশের লেখক-শিল্পীরা কলকাতাকেই বেছে নিতেন নিজেদের অবস্থান এবং কর্মক্ষেত্র হিসেবে। দেশের অন্যত্র, বিশেষ করে ঢাকা, রংপুর, রাজশাহী ও নদীয়া অঞ্চল থেকে কিছু সাময়িকপত্র ও গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও তা কখনো কলকাতার সমতুল্য গুরুত্ব অর্জন করতে পারেনি। বাংলার বাইরে, বিশেষ করে ত্রিপুরা, আসাম, বিহার ও উড়িষ্যা অঞ্চলে বাংলাসাহিত্যের চর্চা হলেও সেগুলিকে প্রবাসী সাহিত্যের তকমা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। ১৯৪৭ সালের ভারতভাগ এবং বাংলাভাগের পরেও অক্ষুণ্ণ থেকেছে কলকাতার একক প্রাধান্য। প্রকাশনা, ছাপা, বাঁধাই এবং বিপণনের প্রায় সব কাঠামোই পড়েছিল কলকাতার ভাগে। ঢাকাকে শুরু করতে হয়েছিল শূন্য হাতে। তৃতীয়ত, ঢাকা তথা বাংলাদেশ ব্রিটিশের কবল থেকে মুক্ত হলেও স্বাধীনতা অর্জনের পরিবর্তে পরিণত হয়েছিল পশ্চিম পাকিসত্মানের উপনিবেশে। পাকিসত্মানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাচর্চাকে সুনজরে দেখেনি, বরং তাকে দমাতে চেষ্টা করেছে সর্বাত্মকভাবে। চতুর্থত, ব্রাহ্মণ্যবাদী লেখকদের দ্বারা এত বছর সাংস্কৃতিক ও মানসিকভাবে নিগৃহীত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় অবহেলিত বাঙালি মুসলমান লেখকদের একটি বড় অংশ পাকিসত্মানি জোশে আত্মহারা হয়ে বাংলাসাহিত্যের উত্তরাধিকারকেই অস্বীকার করে মুসলমানি পাকিসত্মানি বাংলাসাহিত্য সৃষ্টির অলীক চেষ্টায় মেতে উঠে এই ভূখ– সাহিত্যের প্রকৃত বিকাশকে কঠিনতর করে তুলেছিলেন। পঞ্চমত, বাঙালি মুসলমান তথা বাংলাদেশে বসবাসরত লেখকদের সামগ্রিকভাবে সাহিত্যপ্রতিভায় উনতা ছিল লক্ষণীয়। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে, বিশেষ করে বাহান্নর ভাষা-আন্দোলনের পরে বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান কবি-সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটলেও প্রয়োজনীয় সংখ্যার তুলনায় তা ছিল বেদনাদায়কভাবে কম। আর ড. মুহম্মদ শহীদুলস্নাহ্র মতো ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি বিবেচনায় নিয়েও নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, সমালোচনা সাহিত্য তখন গড়েই ওঠেনি আদৌ। ফলে প্রতিভাবান লেখকবৃন্দ না পারতেন স্বদেশে চিহ্নিত হতে, না পারতেন প্রচারের আলোয় আলোকিত হতে। তদুপরি কোনো বহুল প্রচারিত এবং মানসম্মত নিয়মিত সাহিত্য পত্রিকার অনুপস্থিতির কারণে, এবং একই সঙ্গে প্রকাশনা ও বিপণনের ব্যবস্থা না থাকার কারণে তারা নিজ দেশের সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, সচেতন পাঠকসমাজের কাছে পৌঁছতেও ব্যর্থ হচ্ছিলেন প্রতিনিয়ত। পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে (১৯৫৭ সালে) সমকাল প্রকাশিত হলেও তা যথেষ্টর বিবেচনায় ছিল নেহায়েতই অপ্রতুল। তাই ঢাকার কবি-গল্পকারদের তখনো নিজেদের লেখা ছাপার জন্য প্রধানত নির্ভর করতে হতো কলকাতার স্বনামধন্য পত্রিকাগুলির ওপরেই। তারা সামত্মবনাসূচক কিছু লেখা ছাপাতেন বটে, তবে তা কেবল নিজেদের লেখকদের লেখা ছাপার পরে ফাঁকা জায়গা থাকলে।
এতসব প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের নিজস্ব ধারা সৃষ্টি করতে হয়েছে শওকত আলীদের।
পঞ্চাশের দশকে এই দেশে সংঘটিত হয়েছে ভাষা-আন্দোলনের মতো যুগামত্মকারী ঘটনা। পূর্ববাংলা বা বাংলাদেশ নামের এই ভূখ– ভাষা-আন্দোলনের পরে কোনো কিছুই আর আগের মতো থাকেনি। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত পাকিসত্মান নামক রাষ্ট্রটির প্রতি বাঙালির মোহ ফিকে হতে শুরু করেছিল সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই। সেই মোহ থেকে বাংলাদেশের মানুষ পুরোপুরি মুক্তিলাভ করে ভাষা-আন্দোলনের মাধ্যমে। ভাষা-আন্দোলনের মাধ্যমেই বাংলাদেশের মানুষ পৃথিবীবাসীকে এই সংকেত পাঠায় যে, বাঙালি নিজস্ব একটি রাষ্ট্র গঠনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আর সেই রাষ্ট্রগঠনে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ থাকবে প্রধান প্রভাবকের ভূমিকায়। বাংলাদেশের গল্পকাররা ভাষা-আন্দোলনে সাড়া দিয়েছিলেন আমত্মরিকভাবে। এমনকি লেখকদের অনেকেই ছিলেন এই আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক এবং কর্মী। ভাষা-আন্দোলনের সব সাহিত্যিক দলিলকে ধারণ করতে হাসান হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে এগিয়ে এলেন প্রগতিশীল লেখক ও কবিরা। বাহান্নর শহীদদের রক্তের দাগ শুকানোর আগেই একুশের প্রথম সংকলন প্রকাশিত হলো হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায়। সেই সংকলন আজো পৃথিবীতে মুক্তিকামী মানুষের অন্যতম প্রধান সৃজনশীল দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। ভাষা-আন্দোলনের মাধ্যমে এদেশের কবি-সাহিত্যিকরা এই উপলব্ধিতেও পৌঁছালেন যে, বাংলা সাহিত্যের চর্চা কেবলমাত্র আর সাহিত্যচর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, তা এখন বাঙালি জাতিসত্তা রক্ষার এক মহান বিপস্নবী দায়িত্বেও পরিণত হয়েছে। এই দায়িত্ব পালনে শৈথিল্য দেখালে ইতিহাস কাউকেই ক্ষমা করবে না। ফলে লেখকরা সর্বাত্মকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সাহিত্যকর্মে। ফল্গুধারা পরিণত হলো মুক্তধারায়। অসংখ্য সৃষ্টি ও ফসলে ভরে উঠল বাংলার সাহিত্যজমিন। গল্প-লেখকদের তো পিছিয়ে থাকার প্রশ্নই আসে না। কারণ, তাঁরা ততদিনে বুঝে গেছেন যে, বাংলার মানুষ একটি সম্মানজনক ও গণতান্ত্রিক জীবনের জন্য আবহমান কাল ধরে যে-লড়াই চালিয়ে আসছে, সে-লড়াইকে জীবমত্ম ধরে রাখার সবচেয়ে কার্যকর সাহিত্যমাধ্যম হচ্ছে ছোটগল্প। পঞ্চাশের দশকের সব গল্পকারই আমৃত্যু সৃষ্টিমুখর। অনেকে পরবর্তী সময়ে গল্প লেখা থেকে সরে অন্য রচনায় মনোনিবেশ করেছেন। কিন্তু সৃষ্টিশীলতার অঙ্গীকার থেকে পিছু হটেননি কেউ-ই। এই দশকে আবির্ভূত উজ্জ্বল গল্পকার শওকত আলী।
ষাটের দশকে হঠাৎ করেই যেন গল্প এবং গল্পকারের ব্যাপ্তি প্রসারিত হয় অনেকগুণ। কি সংখ্যায় কি বৈচিত্র্যে কি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় – সবক্ষেত্রেই ছোটগল্প যেন আমূল পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছিল। রাজনৈতিক-সামাজিক টালমাটাল ঢেউয়ের মধ্যে যেমন এই দশকেই বাঙালি মুসলমান সমাজের মধ্যে, বিকৃত পথে হলেও, একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সব শর্ত পূরণ হয়, তেমনি ছোটগল্পের ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে সূচনা হয় একটি ভিন্ন ভূগোল এবং ভিন্ন কণ্ঠের। এই প্রথম লেখকদের কেউ কেউ উপলব্ধি করতে শুরু করেন যে, তাঁদের বাংলাদেশের মানুষের গল্প লিখতে হবে, যে-গল্পগুলো ইউরোপীয় নয়, পশ্চিমবঙ্গীয় নয়। ষাটের দশকের গল্পগুলোর মধ্যে অনেকগুলো প্রবণতা ছিল, যা এই দশকের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রবণতাসমূহের সমানুপাতী।
প্রথমত, ষাটের দশকের উজ্জ্বল ছোটগল্পগুলো প্রধানত প্রকাশিত হয়েছিল লিটল ম্যাগাজিনে। ফলে এক ধরনের অপ্রাতিষ্ঠানিকতার পরিচয় এই গল্পগুলির অবয়বে খুঁজে পাওয়া যায়। যেহেতু লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত, তাই কিছুটা পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ ছিল। সবসময়ই সেগুলো শিল্পোত্তীর্ণ এমনটি বলা যাবে না। তবে এই অর্থে একে ইতিবাচক বলতেই হবে যে, একটি নিরীক্ষা-পরবর্তী সময়ে আরো নিরীক্ষার দরজা উন্মুক্ত করে দেয়। দ্বিতীয়ত, ষাটের দশক প্রধানত কেটেছে আইয়ুবী স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে। সে-সময় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল নিষিদ্ধ। তাই ষাটের লেখকদের কথনরীতিতে আনতে হয় পরিবর্তন। অপ্রত্যক্ষ কথনের মাধ্যমে গল্প-নির্মাণ। এর ফলে আবার জীবনবিমুখ শিল্প-সর্বস্বতার একটি প্রবণতাও দানা বেঁধেছিল এ-দশকে। তৃতীয়ত, ষাটের লেখকদের একটি বড় সাফল্য হচ্ছে, গল্পের ভাষাকে উপযুক্তরূপে গড়ে তুলতে পারা। ষাটের প্রধান গল্পকাররা শব্দের শক্তি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তাই তাঁরা প্রত্যেকেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভাষাশিল্পীও বটে। এই দশকে শওকত আলী একের পর এক সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেকে চেনাচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে।
-------দুই------
এতসব সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-মনসত্মাত্ত্বিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শওকত আলী এবং তাঁর সঙ্গীরা বাংলাদেশের সাহিত্যকে নিয়ে এসেছেন আধুনিক প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষতার ধারায়। এবং অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এ-ধারাটিই আজকের বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির মূলধারা হিসেবে প্রবহমান। পশ্চাৎপদ সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার কথা বিবেচনায় নিলে এ এক মহাবিপস্নবই বটে। এটি কীভাবে সম্ভব হলো?
সম্ভব হয়েছে শওকত আলী এবং তাঁর সঙ্গীদের প্রতিভা, পরিশ্রম এবং স্বচ্ছ দৃষ্টি আয়ত্ত করার মধ্য দিয়ে। তাঁরা ইংরেজি সাহিত্যের আধুনিকতা ও মানবিক ধারাটির সঙ্গে সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন বাঙালির চিরায়ত আখ্যানসমূহের।
হাজার বছর বয়সী একটি জাতির আখ্যান আসলে সেই জাতির সত্যিকারের প্রাণস্পন্দন। সেই প্রাণস্পন্দন কোনোদিনই লুপ্ত হয়নি বাঙালির। সমাজের ওপরতলার মানুষকে আপাতদৃষ্টিতে সবকিছুর নিয়ন্ত্রক মনে হলেও জাতিকে ধারণ করে রাখে অমত্ম্যবাসী কর্মীসমাজ। ইউরোপীয় শিক্ষা তথা সাহিত্য-সংস্কৃতির আগ্রাসন সেই তলা পর্যমত্ম পৌঁছতে পারেনি। আবার তারও আগে তুর্কি আগ্রাসনও এই পর্যমত্ম শেকড় বিছাতে পারেনি। ব্রিটিশ যুগে শরীয়তপন্থীদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি আমাদের অনেক ঋণ। কিন্তু এই শরিয়া-আন্দোলনও পরাজিত হয়েছে প্রকৃতিনিষ্ঠ বাঙালির আখ্যানকাব্যের শরীরে ফাটল ধরাতে। শেষ পর্যমত্ম বাঙালির আখ্যান তাই ধর্মনিরপেক্ষই থেকে গেছে, এবং গড়ে দিয়েছে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত। ধর্মনিরপেক্ষতার চেয়েও শক্তিশালী একটি ধারা রয়েছে বাঙালির আখ্যানের। সেটি হচ্ছে সর্বধর্মের সমন্বয়বাদী আখ্যান। পৃথিবীর ইতিহাসে এর কোনো তুলনা পাওয়া যাবে না। বাঙালি তার মাটিতে আশ্রয় দিয়েছে আর্যদের, শক-হূন-মোগলদের, পাঠানদের, বৌদ্ধ-জৈনদের, তুর্কি-ইরানি-আরবীয়দের। তাদের দিয়েছে নিজের থালার অন্ন-ব্যঞ্জনের ভাগ, নিজের সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছে তাদের, নিজের ধর্মপরায়ণতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে দেয়নি অতিথিদের ধর্মবিশ্বাসকে। তাই সকল ধর্মবিশ্বাসের বাইরের আবরণটিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে খুঁজে নিতে হয়েছে ভেতরের অমত্মর্নিহিত আদর্শটিকে। সেখান থেকে যেসব অভিন্ন উপাদান সংগৃহীত হয়েছে – যেমন সকল মানুষের প্রতি ভালোবাসা, প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান, অন্যের ধর্মাচরণে বাধা না দেওয়া, নির্বাণ বা প্রশামিত্মর জন্য ধর্ম-অবলম্বন – এসবকে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে অভিন্ন ধর্মবিশ্বাসের কথকতা-কাব্য-পাঁচালি-পুঁথি। বিভেদের বিভ্রামিত্ম এসেছে কখনো কখনো, কিন্তু সমন্বয়ের সাফল্যই শেষকথা। আর আছে ভালোবাসা। ব্যক্তির জন্য ভালোবাসা, কৌমের জন্য ভালোবাসা, যে কাছে আসছে তার জন্যই ভালোবাসা, বৃক্ষের জন্য, বৃষ্টির জন্য, পিঁপড়ের জন্য, পাখির জন্য, মাছের জন্য, গায়ে পরশ বুলিয়ে বয়ে যাওয়া ঝিরঝিরে বাতাসের জন্য, প্রাণদায়ী বৃষ্টির জন্য, বিপাকে পড়া শত্রম্নর জন্যও, সর্বোপরি গর্ভধারিণী এবং হৃদয়ধারিণী মায়েদের জন্য। লিখিত হয়নি এসব আখ্যান। রচিত হয়েছে কৌমের কোনো প্রাজ্ঞ বৃদ্ধ বা তরুণের মুখে, সঞ্চিত এবং পরিশীলিত হয়েছে বুকের মধ্যে, তারপর সঞ্চারিত হয়েছে মুখের বয়ান হিসেবে আরেকজনের কাছে, পরবর্তী জন ধারণ করেছে সে-আখ্যানকে, পুষে রেখেছে বুকের মধ্যে, তারপর ছড়িয়ে দিয়েছে পর্যটনে গিয়ে, পশুশিকারে গিয়ে, মৎস্যশিকারে গিয়ে, কৃষিক্ষেত্রে গিয়ে, ‘জলকে চল’তে গিয়ে, নাইয়রে গিয়ে। মুখে মুখে সৃষ্টি, বুকে বুকে সঞ্চয়ন, বুকে বুকে বহন, মুখে মুখে সঞ্চালন – এ-প্রক্রিয়ায় হাজার বছর ধরে সৃষ্টি হয়েছে এবং বাহিত হয়ে এসেছে বাঙালির আখ্যান। বিদেশি আগ্রাসন পারেনি এসব আখ্যান বন্ধ করতে, ঔপনিবেশিকতা পারেনি এসবের প্রবাহ রুদ্ধ করতে। মধ্যবিত্ত এবং ওপরতলার বাঙালির একটা অংশ শাসকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইংরেজ হতে চেয়েছে, পাঞ্জাবি হতে চেয়েছে, তুর্কি হতে চেয়েছে, পারসি হতে চেয়েছে, আরবীয় হতে চেয়েছে। কিন্তু আবহমান বাঙালিত্ব রয়ে গেছে সেই আগের জায়গাতেই অনড়, অপাপবিদ্ধ। বাঙালির সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে এই আগ্রাসী এবং ভিখারি-মানসিকতার বাইরে বসেই। সেই সংস্কৃতি শেষ পর্যমত্ম পুষ্টি জুগিয়েছে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে। চিরায়ত আখ্যানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাঙালির মুক্তির আখ্যান। এটাই বাঙালির প্রাণশক্তির সত্যিকারের উৎস।
শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজনই কেবল নয়, সকল গল্প-উপন্যাসই বাঙালির চিরায়ত আখ্যান ও জীবনের সম্প্রসারণ। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের সাহিত্যের আধুনিক-প্রগতিশীল-ধর্মনিরপেক্ষ ধারাটির অন্যতম পথিকৃৎ।
No comments