ছোটাচু এবং সোনালি বিকেল by কামাল হোসাইন
হ্যাঁ,
আমরা সবাই ‘বাংলা’ নামের দেশটাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। মায়ের প্রতি যেমন
আমাদের সীমাহীন নির্ভেজাল ভালোবাসা, তেমনই ভালোবাসা এ দেশের মাটির প্রতিও।
আরও ভালোবাসা মানুষ। বাতাস। আকাশ। পাহাড়। ঘাস। ফুল। পাখি। প্রজাপতি। নদী।
আর আদিগন্ত সবুজের প্রতিও...
>>সেদিন বিকেল। সিফাত ওর পড়ার ঘরে পড়ছিল। ঠিক ওই সময় ছোটাচুর ডাক- সিফু, বাবু তুমি কোথায়?
ছোটাচু সিফাতকে ছোট্ট করে একটু মোডিফাই করে ‘সিফু’ বলে ডাকে।
ছোটাচু খুব ছোট্ট করে ডাকলেও সিফাত তা শুনতে পায়। যেন হৃদয়তন্ত্রীতে তা বেজে ওঠে বেহালার সুরে। যেখানেই থাকুক, শুনতে যেন পাবেই, এমন ব্যাপার।
আজও তার ব্যত্যয় ঘটল না।
সে-ও উত্তর করল- ছোটাচু, এই তো আমি, পড়ছি। আসব?
বাড়ির সবার কাছেই সে অত্যন্ত প্রিয়। সবাই ওকে আদর-স্নেহ-ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখে।
তবে ছোটাচু যেন একটু বেশিই ভালোবাসে ওকে।
ওকে না দেখে যেন থাকতে পারে না ছোটাচু। সিফাতও তেমনি ছোটাচুর দারুণ ভক্ত। ছোটাচু বলতে ও অজ্ঞান।
ছোটাচুর সাইকেলটাও সিফাতের আরও একটু আকর্ষণের অন্যতম কারণ। সিফাত যখন সাইকেলে বসতে শিখেছে, সেই ছোটবেলা থেকেই ছোটাচুর সাইকেলে উঠে ঘুরঘুর করে বেড়ানোর অভ্যাস তৈরি হয়েছে তার। যদি ছোটাচু সাইকেল নিয়ে একটু বের হয়েছে, আর ওর চোখে তা পড়েছে, তাহলে ওকে একটু সাইকেলে না চড়িয়ে চলে যাবে, এমন সাধ্যি ছোটাচুর নেই। তাড়াহুড়োর কারণে যদিবা চলে যায়, তাহলে ওর কান্না দেখে কে? বাড়ি মাথায় করবে কেঁদেকেটে।
সাইকেলে চড়তে ও খুব পছন্দ করে। সাইকেল চলবে, আর ও দুলে দুলে আধো বোলে নানারকম ছড়া কাটবে।
সুতরাং প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে তাকে সাইকেলে চড়িয়ে, মামা বিস্কুট, চিপস কিনে দিয়ে তবেই রক্ষে।
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে ছোটাচুর শিয়রের পাশে হাজির হবে। তারপর ছোটাচুর চুল টেনে ঘুম ভাঙাবে। কখনও সখনো সে ছোটাচুর বুকের মধ্যে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে। তারপর একসময় উঠে শুরু হয় ছোটাচুর প্রতিদিনকার চাকরি।
ছোটাচুও সিফাতের এ রকম নানা পদের বায়না, দুষ্টুমিপনায় নিজেকে মিশিয়ে ফেলতে ভালোবাসে খুব।
এতে সামান্য কোনো বিরক্তির কারণও ঘটে না কখনও।
আবার সিফাতের অন্য তিন চাচু এলে ওর আনন্দের পালা আরও বেড়ে দ্বিগুণ থেকে ত্রিগুণ হয়ে যায়। এই তিন চাচু হলো সবুজ চাচু, নাইম চাচু আর সোহাগ চাচু। ওদেরও বেজায় ন্যাওটা সিফাত।
ওদের তিনজন তিন ধরনের গল্প করে সিফাতের সঙ্গে।
একজন রূপকথার গল্প শোনায় তো অন্যজন ভূত-প্রেতের। অপরজন তো কল্পবিজ্ঞানের গল্পে সিফাতকে মাতিয়ে রাখে।
তাই ওরা তিনজন যখন এসে হাজির হয়, তখন সিফাতকে আর পায় কে?
সিফাতের ছোটাচু কাজের মানুষ। নানারকম কাজের সঙ্গে সে জড়িত। এই যেমন গ্রামের মানুষের বই পড়ার জন্য পাঠাগার গড়া। কোথাও কোনো সাঁকো ভেঙে পড়েছে, তা ‘পিচ্চিবাহিনী’ নিয়ে মেরামত করা। কোনো গরিব মানুষ অসুখে পড়েছে, তার চিকিৎসার জন্য পয়সা কালেকশন করা। কেউ টাকার অভাবে পড়াশোনা করতে পারছে না, তার বইপত্র-খাতাকলম কেনার ব্যবস্থা করা। সে যাতে স্কুলে বিনাবেতনে পড়তে পারে, তার জন্য দরখাস্ত লেখাসহ নানাবিধ কাজের সঙ্গে সে সরাসরি জড়িত।
সিফাতের উত্তরে ছোটাচু বলেÑ আয় খোকা।
সিফাত ছোটাচুর উত্তরেরও অপেক্ষা করে না। ছুটতে ছুটতে সে চলে আসে ছোটাচুর ঘরে।
এসেই ছোটাচুর কোলে ধপাস করে বসে পড়ে সে।
হাঁপাতে-হাঁপাতে বলেÑ বল চাচু, কী জন্য ডেকেছ?
পড়াশোনার কী হাল, বাবা?
ভালো চাচু। তবে কী জান চাচু? অঙ্ক নাÑ ও জিনিসটা একদম মাথায় ঢোকে না আমার। কী যে করি!
কী আর করবি। মাথায় ঢোকে না বললেই তো চলবে না। মাথায় ঢোকানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
তা তো বুঝলাম, কিন্তু...
কোনো কিন্তু নয়, অসম্ভব বলে কোনো কথা নেই। বেশি বেশি চর্চা করলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
তাহলে কিন্তু আমাকে অঙ্ক বুঝিয়ে দিতে হবে।
আচ্ছা সে হবে।
আচ্ছা এবার বল, কী জন্য ডেকেছ আমায়?
ছোটাচু বলল, এখন তো বিকেল, সন্ধ্যা হই হই করছে। চল একটু সবুজ মাঠের সবুজের বিশাল সমারোহ দেখে আসি।
সিফাত ছোটাচুর কথায় এককথায় রাজি। ছোটাচুর কেবল বলা দরকার, কোথাও যেতে হবে। ব্যস, এটুকুই যথেষ্ট। কোথায় তা ওর বিবেচ্য নয়, ছোটাচু বলেছে মানে যেতে হবে। বিনাবাক্যে সে রাজি।
বিকেলের কমলা রোদ তখন মাঠে ভেসে যাচ্ছে। হেমন্তের শেষ বিকেলের এই সোনারোদ যেন ওদের গায়ে আদর বুলিয়ে দিচ্ছে। মাঠভরা পাকা ধান তাদের সরব উপস্থিতি যেন ঝনঝন শব্দে জানান দিয়ে যাচ্ছে মাঝে মধ্যে।
ছোটাচু বলল- আজ তোকে আমাদের দেশের গল্প শোনাব।
ছোটাচু শুরু করে ঠিক গল্পের মতো করেই-
সুনীল আকাশ। পেঁজা তুলোর পাহাড়ে ঘেরা। কুয়াশাচ্ছন্ন। আস্তে-আস্তে ফিকে হয়। টুপটুপ শিশির ঝরে পাতায়-ঘাসে। মৃদু হাওয়ায় দোল খায় লাউডগা। জারুল গাছের পাতার ফাঁকে দোয়েলের শিস। পুকুর-ডোবায় আকাশের তারার মতো শাপলা ফোটে। হাসে কুটিকুটি। ঢেউ লেগে আহ্লাদে ফেটে পড়ে। পুব আকাশে চিকচিক উঁকি দেয় সূর্যিমামা। শুরু হয়ে যায় নতুন একটা দিনের।
আদিগন্ত বিস্তৃত আকাশের গায়ে সোনারোদ ঝিকমিক। নদীর ঢেউ খেলে কুলকুল। পাল উড়িয়ে চলে নৌকার সারি। মাঝির কণ্ঠে ভাটিয়ালির মিহি সুর। এক মায়াবী জগৎ। ভালো লাগার দুর্বার হাতছানি।
এমন যে দৃশ্য, তাতে মন ব্যাকুল করে। আকুল হয়।
ছোটাচুর এমন চমৎকার শব্দমালার উচ্চারণে সিফাত যেন কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো হয়ে যায়। কথাগুলো শুনতে ওর ভীষণ ভালো লাগে।
মনে হয় যেন ছোটাচুর বলা কথাগুলো হৃদয়ের কোন গহিন ভেতর থেকে উঠে আসছে।
ছোটাচু মাঝে মধ্যে একটু ঢোঁক গিলে আবার শুরু করে।
শুরু করার আগে সিফাতের দিকে তাকায়। দেখেÑ তার শ্রোতাটি ঠিকমতো শুনছে কিনা।
ছোটাচু একটু থামে। তারপর আবার বলতে থাকেÑ
এই যে চমৎকার স্বপ্নসুন্দর পরিবেশ, সে আমাদের দেশের। প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশের চিরচেনা ছবি। এমন মনকাড়া ছবি বিশ্বের আর কোথাও মেলে না। তাই তো আমরা কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গেয়ে উঠি একটা মিষ্টি গানÑ ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...।’
হ্যাঁ, আমরা সবাই ‘বাংলা’ নামের দেশটাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। মায়ের প্রতি যেমন আমাদের সীমাহীন নির্ভেজাল ভালোবাসা, তেমনই ভালোবাসা এ দেশের মাটির প্রতিও। আরও ভালোবাসা মানুষ। বাতাস। আকাশ। পাহাড়। ঘাস। ফুল। পাখি। প্রজাপতি। নদী। আর আদিগন্ত সবুজের প্রতিও।
কিন্তু এ সোনার দেশটি একদিন আমাদের ছিল না। পাকিস্তান নামের দেশের সঙ্গে যুক্ত ছিল। আর আমাদের এ অংশের নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান।’
আমরা বাঙালি। আমাদের মিষ্টি একটা ভাষা আছে। নাম বাংলা। আর পাকিস্তানিরা ভিনভাষী। তাদের সবকিছুতেই আমাদের সঙ্গে অমিল। চলায়। বলায়। ভাষায়। বলতে পারিস সবকিছুতেই।
মুখের ভাষাটাও তারা কেড়ে নিতে চাইল। এ দেশের মানুষ সমস্বরে ‘না’ বলল।
এ ‘না’কে প্রতিষ্ঠা করতে কারা ভূমিকা রেখেছিল জানিস? এ দেশের অসংখ্য ছাত্র। শিক্ষক। যুবক। জেলে। চাষা। কুলি। মজুর। তাঁতি। মাঝি। আর তোদের চেয়ে একটু বয়সে বড় দামাল কিশোরটিও।
এত লোকের ‘না’ বলা কণ্ঠ তারা আবার থামিয়ে দিতে চাইল। আর এর জন্য আবার এক নয়, দুই নয় দীর্ঘ ৯ মাস লড়াই চলল তাদের সঙ্গে আমাদের।
১৯৭১ সালে সংঘটিত ওই লড়াইয়ের নাম ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধ’। গোটা বাঙালি জাতিই সেদিন ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে মুক্ত হতে চেয়েছিল। তাই অমন নাম। ওরা ওইসব মুক্তিকামী মানুষকে রুখে দিতে নানারকম অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু প্রমাণ হয়েছিলÑ দেশপ্রেমের কাছে সবকিছু নস্যি।
লড়াই করার অর্থ হলোÑ আমরা আর তাদের সঙ্গে থাকতে চাই না। স্বাধীনতা চাই। চলার স্বাধীনতা। বলার স্বাধীনতা। দেখার স্বাধীনতা। ভাবার স্বাধীনতা। ভাষার স্বাধীনতাÑ কেবলই স্বাধীনতা। যে স্বাধীনতা বিশ্বে আমাদের আলাদা করে চেনাবে। আমাদের একটা নিজস্ব মানচিত্র হবে। পতাকা হবে। এ দাবিই ছিল মূল। আমরা বললামÑ ‘আমাদের দাবি মানতে হবে।’
ওরা ‘না’ বলল।
‘না’ বললেই হলো? এ দেশের মানুষ স্বাধীনতার নেশায় মেতে উঠল। জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে গেল। বীরের মতো লড়াই করে রক্ত দিল।
ছোটাচু থামে। তার কথাগুলো কেমন স্বপ্নের মতো মনে হয়। ছোটাচুও যেন সেই স্বপ্নের জগতের এক ‘অন্য মানুষ’ হয়ে গেছে।
সিফাত এগুলো একটু একটু তার বইতে পড়েছে। কিন্তু এমনভাবে তার মাথায় আজ অবধি ঢোকেনি। এজন্যই তো সে ছোটাচুর কাছে অঙ্ক শিখতে চায়। তাহলে এখন থেকে আর পরীক্ষায় তাকে অঙ্কে কম নম্বর পেতে হবে না।
সিফাত ছোটাচুর কথা শুনতে উদগ্রীব। থামল মানেই যেন সব শেষ হয়ে গেল। তাই সে ছোটাচুকে তাড়া দেয়, ছোটাচু তারপর?
ছোটাচু অতিরিক্ত কোনো কথা না বলে আবার শুরু করে-
তারপর কত রক্ত! তারপর ওরা হারল। আমাদের চরম মনোবলের কাছে ওরা পরাজিত হলো।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা নতুন একটা পতাকা পেলাম। আর পেলাম নতুন একটা দেশের ঠিকানা। পেলাম স্বাধীন মানচিত্র। গর্বে আমাদের বুকটা টান টান হলো। তার মানে ওই দিন আমরা পাকিস্তানি দস্যু বাহিনীকে হটিয়ে দিয়ে বিজয় অর্জন করলাম।
আমাদের নতুন দেশটির নাম হলো ‘বাংলাদেশ’। বিশ্বে স্বাধীন দেশ হিসেবে আমরা নতুন করে পরিচিতি পেলাম।
স্বাধীন দেশের লাল-সবুজ পতাকা সেদিন থেকে সগৌরবে পতপত করে আকাশে ওড়ে। ঘোষণা করে তার শ্রেষ্ঠত্বের কথা।
আমাদের এ গর্বের ইতিহাস আর প্রিয় এ দেশটির কথা আমরা কখনও ভুলব না। যাদের রক্ত আর প্রাণের বিনিময়ে এই দেশ, এই মাটি, তাদের মনে রাখব চিরদিন। দেশকে ভালোবেসে প্রতিদিন অন্তত একবার আমরা সবাই বলবÑ ‘প্রিয় বাংলাদেশ, আমি তোমায় ভালোবাসি। যতদিন শরীরে প্রাণ আছে ততদিন ভালোবাসব।’
পূর্ণ গল্পটি শেষ করে নড়েচড়ে বসল ছোটাচু।
ছোটাচু এভাবেই অনেক জ্ঞানের কথা, জানার কথা দারুণ সব গল্পের মাধ্যমে শিখিয়ে দেয়।
যখন গল্পটি শেষ হলো তখন সূর্য প্রায় ডুবুডুবু।
এখন ঘরে ফেরার পালা। একটু বাদে একটু একটু শিশির পড়তে শুরু করবে। এ সময় বাইরে থাকলে ঠান্ডা লাগতে পারে। তাই আর মাঠে বেশিক্ষণ থাকা হলো না। চাচা-ভাইপোতে আবার আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করে বাড়ির দিকে।
তবে সিফাতের কাছে আজকের এ বিকেলটা অন্যরকম হয়ে ওর স্মৃতিতে গেঁথে থাকবে। স্মৃতিময় এ দিনটির কথা কি সে কখনও ভুলতে পারবে?
ছোটাচু সিফাতকে ছোট্ট করে একটু মোডিফাই করে ‘সিফু’ বলে ডাকে।
ছোটাচু খুব ছোট্ট করে ডাকলেও সিফাত তা শুনতে পায়। যেন হৃদয়তন্ত্রীতে তা বেজে ওঠে বেহালার সুরে। যেখানেই থাকুক, শুনতে যেন পাবেই, এমন ব্যাপার।
আজও তার ব্যত্যয় ঘটল না।
সে-ও উত্তর করল- ছোটাচু, এই তো আমি, পড়ছি। আসব?
বাড়ির সবার কাছেই সে অত্যন্ত প্রিয়। সবাই ওকে আদর-স্নেহ-ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখে।
তবে ছোটাচু যেন একটু বেশিই ভালোবাসে ওকে।
ওকে না দেখে যেন থাকতে পারে না ছোটাচু। সিফাতও তেমনি ছোটাচুর দারুণ ভক্ত। ছোটাচু বলতে ও অজ্ঞান।
ছোটাচুর সাইকেলটাও সিফাতের আরও একটু আকর্ষণের অন্যতম কারণ। সিফাত যখন সাইকেলে বসতে শিখেছে, সেই ছোটবেলা থেকেই ছোটাচুর সাইকেলে উঠে ঘুরঘুর করে বেড়ানোর অভ্যাস তৈরি হয়েছে তার। যদি ছোটাচু সাইকেল নিয়ে একটু বের হয়েছে, আর ওর চোখে তা পড়েছে, তাহলে ওকে একটু সাইকেলে না চড়িয়ে চলে যাবে, এমন সাধ্যি ছোটাচুর নেই। তাড়াহুড়োর কারণে যদিবা চলে যায়, তাহলে ওর কান্না দেখে কে? বাড়ি মাথায় করবে কেঁদেকেটে।
সাইকেলে চড়তে ও খুব পছন্দ করে। সাইকেল চলবে, আর ও দুলে দুলে আধো বোলে নানারকম ছড়া কাটবে।
সুতরাং প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে তাকে সাইকেলে চড়িয়ে, মামা বিস্কুট, চিপস কিনে দিয়ে তবেই রক্ষে।
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে ছোটাচুর শিয়রের পাশে হাজির হবে। তারপর ছোটাচুর চুল টেনে ঘুম ভাঙাবে। কখনও সখনো সে ছোটাচুর বুকের মধ্যে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে। তারপর একসময় উঠে শুরু হয় ছোটাচুর প্রতিদিনকার চাকরি।
ছোটাচুও সিফাতের এ রকম নানা পদের বায়না, দুষ্টুমিপনায় নিজেকে মিশিয়ে ফেলতে ভালোবাসে খুব।
এতে সামান্য কোনো বিরক্তির কারণও ঘটে না কখনও।
আবার সিফাতের অন্য তিন চাচু এলে ওর আনন্দের পালা আরও বেড়ে দ্বিগুণ থেকে ত্রিগুণ হয়ে যায়। এই তিন চাচু হলো সবুজ চাচু, নাইম চাচু আর সোহাগ চাচু। ওদেরও বেজায় ন্যাওটা সিফাত।
ওদের তিনজন তিন ধরনের গল্প করে সিফাতের সঙ্গে।
একজন রূপকথার গল্প শোনায় তো অন্যজন ভূত-প্রেতের। অপরজন তো কল্পবিজ্ঞানের গল্পে সিফাতকে মাতিয়ে রাখে।
তাই ওরা তিনজন যখন এসে হাজির হয়, তখন সিফাতকে আর পায় কে?
সিফাতের ছোটাচু কাজের মানুষ। নানারকম কাজের সঙ্গে সে জড়িত। এই যেমন গ্রামের মানুষের বই পড়ার জন্য পাঠাগার গড়া। কোথাও কোনো সাঁকো ভেঙে পড়েছে, তা ‘পিচ্চিবাহিনী’ নিয়ে মেরামত করা। কোনো গরিব মানুষ অসুখে পড়েছে, তার চিকিৎসার জন্য পয়সা কালেকশন করা। কেউ টাকার অভাবে পড়াশোনা করতে পারছে না, তার বইপত্র-খাতাকলম কেনার ব্যবস্থা করা। সে যাতে স্কুলে বিনাবেতনে পড়তে পারে, তার জন্য দরখাস্ত লেখাসহ নানাবিধ কাজের সঙ্গে সে সরাসরি জড়িত।
সিফাতের উত্তরে ছোটাচু বলেÑ আয় খোকা।
সিফাত ছোটাচুর উত্তরেরও অপেক্ষা করে না। ছুটতে ছুটতে সে চলে আসে ছোটাচুর ঘরে।
এসেই ছোটাচুর কোলে ধপাস করে বসে পড়ে সে।
হাঁপাতে-হাঁপাতে বলেÑ বল চাচু, কী জন্য ডেকেছ?
পড়াশোনার কী হাল, বাবা?
ভালো চাচু। তবে কী জান চাচু? অঙ্ক নাÑ ও জিনিসটা একদম মাথায় ঢোকে না আমার। কী যে করি!
কী আর করবি। মাথায় ঢোকে না বললেই তো চলবে না। মাথায় ঢোকানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
তা তো বুঝলাম, কিন্তু...
কোনো কিন্তু নয়, অসম্ভব বলে কোনো কথা নেই। বেশি বেশি চর্চা করলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
তাহলে কিন্তু আমাকে অঙ্ক বুঝিয়ে দিতে হবে।
আচ্ছা সে হবে।
আচ্ছা এবার বল, কী জন্য ডেকেছ আমায়?
ছোটাচু বলল, এখন তো বিকেল, সন্ধ্যা হই হই করছে। চল একটু সবুজ মাঠের সবুজের বিশাল সমারোহ দেখে আসি।
সিফাত ছোটাচুর কথায় এককথায় রাজি। ছোটাচুর কেবল বলা দরকার, কোথাও যেতে হবে। ব্যস, এটুকুই যথেষ্ট। কোথায় তা ওর বিবেচ্য নয়, ছোটাচু বলেছে মানে যেতে হবে। বিনাবাক্যে সে রাজি।
বিকেলের কমলা রোদ তখন মাঠে ভেসে যাচ্ছে। হেমন্তের শেষ বিকেলের এই সোনারোদ যেন ওদের গায়ে আদর বুলিয়ে দিচ্ছে। মাঠভরা পাকা ধান তাদের সরব উপস্থিতি যেন ঝনঝন শব্দে জানান দিয়ে যাচ্ছে মাঝে মধ্যে।
ছোটাচু বলল- আজ তোকে আমাদের দেশের গল্প শোনাব।
ছোটাচু শুরু করে ঠিক গল্পের মতো করেই-
সুনীল আকাশ। পেঁজা তুলোর পাহাড়ে ঘেরা। কুয়াশাচ্ছন্ন। আস্তে-আস্তে ফিকে হয়। টুপটুপ শিশির ঝরে পাতায়-ঘাসে। মৃদু হাওয়ায় দোল খায় লাউডগা। জারুল গাছের পাতার ফাঁকে দোয়েলের শিস। পুকুর-ডোবায় আকাশের তারার মতো শাপলা ফোটে। হাসে কুটিকুটি। ঢেউ লেগে আহ্লাদে ফেটে পড়ে। পুব আকাশে চিকচিক উঁকি দেয় সূর্যিমামা। শুরু হয়ে যায় নতুন একটা দিনের।
আদিগন্ত বিস্তৃত আকাশের গায়ে সোনারোদ ঝিকমিক। নদীর ঢেউ খেলে কুলকুল। পাল উড়িয়ে চলে নৌকার সারি। মাঝির কণ্ঠে ভাটিয়ালির মিহি সুর। এক মায়াবী জগৎ। ভালো লাগার দুর্বার হাতছানি।
এমন যে দৃশ্য, তাতে মন ব্যাকুল করে। আকুল হয়।
ছোটাচুর এমন চমৎকার শব্দমালার উচ্চারণে সিফাত যেন কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো হয়ে যায়। কথাগুলো শুনতে ওর ভীষণ ভালো লাগে।
মনে হয় যেন ছোটাচুর বলা কথাগুলো হৃদয়ের কোন গহিন ভেতর থেকে উঠে আসছে।
ছোটাচু মাঝে মধ্যে একটু ঢোঁক গিলে আবার শুরু করে।
শুরু করার আগে সিফাতের দিকে তাকায়। দেখেÑ তার শ্রোতাটি ঠিকমতো শুনছে কিনা।
ছোটাচু একটু থামে। তারপর আবার বলতে থাকেÑ
এই যে চমৎকার স্বপ্নসুন্দর পরিবেশ, সে আমাদের দেশের। প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশের চিরচেনা ছবি। এমন মনকাড়া ছবি বিশ্বের আর কোথাও মেলে না। তাই তো আমরা কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গেয়ে উঠি একটা মিষ্টি গানÑ ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...।’
হ্যাঁ, আমরা সবাই ‘বাংলা’ নামের দেশটাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। মায়ের প্রতি যেমন আমাদের সীমাহীন নির্ভেজাল ভালোবাসা, তেমনই ভালোবাসা এ দেশের মাটির প্রতিও। আরও ভালোবাসা মানুষ। বাতাস। আকাশ। পাহাড়। ঘাস। ফুল। পাখি। প্রজাপতি। নদী। আর আদিগন্ত সবুজের প্রতিও।
কিন্তু এ সোনার দেশটি একদিন আমাদের ছিল না। পাকিস্তান নামের দেশের সঙ্গে যুক্ত ছিল। আর আমাদের এ অংশের নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান।’
আমরা বাঙালি। আমাদের মিষ্টি একটা ভাষা আছে। নাম বাংলা। আর পাকিস্তানিরা ভিনভাষী। তাদের সবকিছুতেই আমাদের সঙ্গে অমিল। চলায়। বলায়। ভাষায়। বলতে পারিস সবকিছুতেই।
মুখের ভাষাটাও তারা কেড়ে নিতে চাইল। এ দেশের মানুষ সমস্বরে ‘না’ বলল।
এ ‘না’কে প্রতিষ্ঠা করতে কারা ভূমিকা রেখেছিল জানিস? এ দেশের অসংখ্য ছাত্র। শিক্ষক। যুবক। জেলে। চাষা। কুলি। মজুর। তাঁতি। মাঝি। আর তোদের চেয়ে একটু বয়সে বড় দামাল কিশোরটিও।
এত লোকের ‘না’ বলা কণ্ঠ তারা আবার থামিয়ে দিতে চাইল। আর এর জন্য আবার এক নয়, দুই নয় দীর্ঘ ৯ মাস লড়াই চলল তাদের সঙ্গে আমাদের।
১৯৭১ সালে সংঘটিত ওই লড়াইয়ের নাম ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধ’। গোটা বাঙালি জাতিই সেদিন ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে মুক্ত হতে চেয়েছিল। তাই অমন নাম। ওরা ওইসব মুক্তিকামী মানুষকে রুখে দিতে নানারকম অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু প্রমাণ হয়েছিলÑ দেশপ্রেমের কাছে সবকিছু নস্যি।
লড়াই করার অর্থ হলোÑ আমরা আর তাদের সঙ্গে থাকতে চাই না। স্বাধীনতা চাই। চলার স্বাধীনতা। বলার স্বাধীনতা। দেখার স্বাধীনতা। ভাবার স্বাধীনতা। ভাষার স্বাধীনতাÑ কেবলই স্বাধীনতা। যে স্বাধীনতা বিশ্বে আমাদের আলাদা করে চেনাবে। আমাদের একটা নিজস্ব মানচিত্র হবে। পতাকা হবে। এ দাবিই ছিল মূল। আমরা বললামÑ ‘আমাদের দাবি মানতে হবে।’
ওরা ‘না’ বলল।
‘না’ বললেই হলো? এ দেশের মানুষ স্বাধীনতার নেশায় মেতে উঠল। জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে গেল। বীরের মতো লড়াই করে রক্ত দিল।
ছোটাচু থামে। তার কথাগুলো কেমন স্বপ্নের মতো মনে হয়। ছোটাচুও যেন সেই স্বপ্নের জগতের এক ‘অন্য মানুষ’ হয়ে গেছে।
সিফাত এগুলো একটু একটু তার বইতে পড়েছে। কিন্তু এমনভাবে তার মাথায় আজ অবধি ঢোকেনি। এজন্যই তো সে ছোটাচুর কাছে অঙ্ক শিখতে চায়। তাহলে এখন থেকে আর পরীক্ষায় তাকে অঙ্কে কম নম্বর পেতে হবে না।
সিফাত ছোটাচুর কথা শুনতে উদগ্রীব। থামল মানেই যেন সব শেষ হয়ে গেল। তাই সে ছোটাচুকে তাড়া দেয়, ছোটাচু তারপর?
ছোটাচু অতিরিক্ত কোনো কথা না বলে আবার শুরু করে-
তারপর কত রক্ত! তারপর ওরা হারল। আমাদের চরম মনোবলের কাছে ওরা পরাজিত হলো।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা নতুন একটা পতাকা পেলাম। আর পেলাম নতুন একটা দেশের ঠিকানা। পেলাম স্বাধীন মানচিত্র। গর্বে আমাদের বুকটা টান টান হলো। তার মানে ওই দিন আমরা পাকিস্তানি দস্যু বাহিনীকে হটিয়ে দিয়ে বিজয় অর্জন করলাম।
আমাদের নতুন দেশটির নাম হলো ‘বাংলাদেশ’। বিশ্বে স্বাধীন দেশ হিসেবে আমরা নতুন করে পরিচিতি পেলাম।
স্বাধীন দেশের লাল-সবুজ পতাকা সেদিন থেকে সগৌরবে পতপত করে আকাশে ওড়ে। ঘোষণা করে তার শ্রেষ্ঠত্বের কথা।
আমাদের এ গর্বের ইতিহাস আর প্রিয় এ দেশটির কথা আমরা কখনও ভুলব না। যাদের রক্ত আর প্রাণের বিনিময়ে এই দেশ, এই মাটি, তাদের মনে রাখব চিরদিন। দেশকে ভালোবেসে প্রতিদিন অন্তত একবার আমরা সবাই বলবÑ ‘প্রিয় বাংলাদেশ, আমি তোমায় ভালোবাসি। যতদিন শরীরে প্রাণ আছে ততদিন ভালোবাসব।’
পূর্ণ গল্পটি শেষ করে নড়েচড়ে বসল ছোটাচু।
ছোটাচু এভাবেই অনেক জ্ঞানের কথা, জানার কথা দারুণ সব গল্পের মাধ্যমে শিখিয়ে দেয়।
যখন গল্পটি শেষ হলো তখন সূর্য প্রায় ডুবুডুবু।
এখন ঘরে ফেরার পালা। একটু বাদে একটু একটু শিশির পড়তে শুরু করবে। এ সময় বাইরে থাকলে ঠান্ডা লাগতে পারে। তাই আর মাঠে বেশিক্ষণ থাকা হলো না। চাচা-ভাইপোতে আবার আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করে বাড়ির দিকে।
তবে সিফাতের কাছে আজকের এ বিকেলটা অন্যরকম হয়ে ওর স্মৃতিতে গেঁথে থাকবে। স্মৃতিময় এ দিনটির কথা কি সে কখনও ভুলতে পারবে?
No comments