এ যুগের সিনড্রেলা- সত্য ঘটনা অবলম্বনে by জিনিয়া জাহিদ
রেহানা
আমার ছোটবেলার বান্ধবী। ওরা চার ভাই, চার বোন। রেহানা ছিল ভাইবোনের মধ্যে
ছয় নম্বর। বাবা বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। রেহানা যখন ক্লাস সেভেনে
পড়ে, তখন ওর বাবার চাকরি চলে যায়। হাঁপানির টানের কারণে তিনি ক্লাসে পড়াতে
পারতেন না। বাধ্য হয়েই রেহানার বড় দুই ভাই পড়াশোনা ছেড়ে সংসারের হাল ধরেন।
রেহানা রংপুরের রোকেয়া কলেজে ইসলামের ইতিহাসে অনার্সে ভর্তি হয়। আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে রংপুর ছেড়ে চলে আসি। ভার্সিটির ছুটির ফাঁকে ওর সঙ্গে দেখা হতো।
ধীরে ধীরে রেহানার দুই বোনের বিয়ে হয়ে যায়। বড় দুই ভাইও বিয়ে করেন। বউ দুটি প্রায় সারা দিনই উচ্চ স্বরে ঝগড়া করতেন। মেজ ভাইটির আর্থিক অবস্থা একটু ভালো। তিনি আলাদা বাসা ভাড়া নিয়ে চলে যান। রেহানার ইমিডিয়েট বড় বোনটা কালো আর খুব শুকনা হওয়ার কারণে তার বিয়ে দিতেও ঝামেলা হচ্ছিল। রেহানার বাবা-মা তাই রেহানার বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা শুরু করেন।
রেহানা দেখতে খুবই সুন্দরী। সত্যি বলতে কি, তাদের আট ভাই-বোনের মধ্যে সে সম্পূর্ণ অন্য রকম। এত অভাবের মধ্যেও পড়াশোনা ছেড়ে দেয়নি। খুব মিশুক আর শান্ত স্বভাবের। মাথায় কাপড় দিয়ে চলাফেরা করে।
রেহানা এত সুন্দর হলেও ওর বিয়ের প্রস্তাবগুলো শুনে আমার সত্যি খুব রাগ লাগত। ওর ফ্যামিলির অবস্থা খারাপ হওয়ার জন্যই কি ওর থেকে বয়সে দ্বিগুণ-তিন গুণ, এক বাচ্চার বাপ, ডিভোর্সি কিংবা বিপত্নীক লোকের প্রস্তাব আসবে? কেন কারখানার একটা মেকার, যে এইট পাস, সে একটা অনার্স পড়ুয়া শিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেবে? ভদ্র ফ্যামিলির শিক্ষিত একটি ছেলে, যার একটি ভালো চাকরি আছে এমন প্রস্তাব কেন আসবে না?
আমি নিজেই আমার অনেক আত্মীয়, ভার্সিটির পরিচিতদের অনেকে যাঁরা পাত্রী খোঁজার কথা বলতেন, তাঁদের ওর ছবি দেখিয়েছিলাম। সবাই একবাক্যে ওকে দেখে মুগ্ধ। কিন্তু ফ্যামিলিগতভাবে গেলেই সব বিয়ের কথা থমকে যেত। বাবা কিছু করে না, ভাইয়েরা পরিচয় দেওয়ার মতো নয়, বোনের জামাইগুলো সব কেমন যেন। এহেন ফ্যামিলিতে আত্মীয়তা করতে কেউ-ই আগ্রহী নয়।
সেবার যখন ছুটিতে বাড়ি গেলাম, ও আমাকে পেপারের একটি কাটিং দেখিয়ে বলল, এই চাকরিটার জন্য ও কয়েক মাস আগে অ্যাপ্লাই করেছিল। এখন ইন্টারভিউর চিঠি এসেছে। বাংলাদেশের খুব নামকরা একটি কোম্পানির ছোট একটা পোস্ট। শিক্ষাগত যোগ্যতা এইট পাস!
রেহানা তারপরও এই চাকরিটার জন্য চেষ্টা করতে চায়। ছোট দুই ভাইয়ের পড়ালেখা প্রায় বন্ধ হওয়ার জোগাড়। বাবা-মা দুজনেই অসুস্থ। খাবার জোটে না তো ওষুধ কিনবে কীভাবে।
কিন্তু ইন্টারভিউর জন্য ঢাকা যেতে হবে। বাসভাড়া নেই। ভালো একটা জামা নেই। সস্তা ফুটপাতের স্যান্ডেলটাও ছেঁড়া।
ওকে বললাম, তুই চিন্তা করিস না। আমার সঙ্গেই চল। বাসভাড়া আমি দেব। আমার ভার্সিটির হলে থাকবি। আর কাপড়চোপড় আমার একটা পরে নিস। হলে গেলে তোর পায়ের মাপের স্যান্ডেলের অভাব হবে না। সে রকম দেখলে গাউছিয়া থেকে কিনে নেব।
নভেম্বর মাসের সুন্দর এক সকালে আমরা দুজন ঢাকার পথে রওনা হলাম। ওর ইন্টারভিউ ছিল দুদিন পরে। ইন্টারভিউ বোর্ডে যাওয়ার জন্য ঈদের সাদা থ্রিপিসটা ওকে পরতে দিলাম। গাউছিয়া যাওয়ার টাইম নাই। হলের রত্না আপুর পায়ের সাদা কারুকাজ করা স্যান্ডেল, নিশার সাদা পাথরের কানের দুল আর হালকা মেকআপ রেহানাকে লাগছিল সাদা একটা অপ্সরী।
সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে যথাসময়ে ইন্টারভিউ দিতে নিয়ে গিয়েছিলাম। অনেকক্ষণ পর যখন ও ইন্টারভিউ বোর্ড থেকে বেরিয়ে এল, ম্লান একটা হাসি দিয়ে বলল, নাহ্, হবে না। মামা-চাচা না থাকলে ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি হয় না রে। খামাখা তোর পয়সা নষ্ট করলাম। আমি বললাম, ব্যাপার না। তুই পাস করলে কোথাও না কোথাও এমনিতেই হয়ে যাবে।
দুই দিন পর রেহানা রংপুরে ফিরে যায়।
এর প্রায় দুই মাস পর রেহানার ফোন। হ্যালো বলতেই ওপ্রান্তে চিৎকার করে রেহানা বলে, শোন, আমার চাকরিটা হয়েছে। ফুলটাইম, পারমানেন্ট। সুযোগ-সুবিধা শুনলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবি। আনন্দে চিৎকার দিয়ে বললাম, বলিস কী! কবে জয়েনিং?
এই মাসের ২৫ তারিখ। বিশাল দুই মাইক্রোবাসে করে বাসায় এসে জয়েনিং লেটার দিয়ে গেছে। আমার জয়েনিংয়ের দিন তোকে কিন্তু আসতেই হবে।
আমি বোকার মতো বললাম, মানে কী? হো হো করে হেসে রেহানা বলল, ওই দিনের ইন্টারভিউ বোর্ডে, ভাঙা ঘরের এই ঘুঁটেকুড়ানি ধার করা জামাজুতা পরে রাজা-রানিমা আর রাজপুত্তরের নাকি মন জয় করে নিয়েছে।
রাজা-রানি আমাকে তাদের ছেলের বউ করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। রাজপুত্রও এসেছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম, হয় পাত্র পাগল, না হয় নির্ঘাত কোনো ঘাপলা আছে। কিন্তু পরে সবাই খোঁজখবর নিয়ে জেনেছে, কোনো সমস্যাই নেই। তারা নাকি আমার মতো মেয়েই অনেক দিন ধরে খুঁজছিল। বিয়েতে সমস্ত খরচ তারাই দেবে। এখন তুই বল, আমি কি এ যুগের সিনড্রেলা নই?
ফোন রেখে মনে মনে বললাম, দোয়া করি বড়লোকের রাজপুত্র তোকে যেন তার মনের রানি করে রাখে। এ যুগের নয়, সে যুগের সিনড্রেলার মতোই রেহানা যেন সুখে থাকে আজীবন।
>>>বি. দ্র. প্রিয় পাঠক, এ যুগের সিনড্রেলা কি সত্যি সে যুগের সিনড্রেলার মতো আছে? সে গল্প তোলা থাক আরেক দিনের জন্য।
রেহানা রংপুরের রোকেয়া কলেজে ইসলামের ইতিহাসে অনার্সে ভর্তি হয়। আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে রংপুর ছেড়ে চলে আসি। ভার্সিটির ছুটির ফাঁকে ওর সঙ্গে দেখা হতো।
ধীরে ধীরে রেহানার দুই বোনের বিয়ে হয়ে যায়। বড় দুই ভাইও বিয়ে করেন। বউ দুটি প্রায় সারা দিনই উচ্চ স্বরে ঝগড়া করতেন। মেজ ভাইটির আর্থিক অবস্থা একটু ভালো। তিনি আলাদা বাসা ভাড়া নিয়ে চলে যান। রেহানার ইমিডিয়েট বড় বোনটা কালো আর খুব শুকনা হওয়ার কারণে তার বিয়ে দিতেও ঝামেলা হচ্ছিল। রেহানার বাবা-মা তাই রেহানার বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা শুরু করেন।
রেহানা দেখতে খুবই সুন্দরী। সত্যি বলতে কি, তাদের আট ভাই-বোনের মধ্যে সে সম্পূর্ণ অন্য রকম। এত অভাবের মধ্যেও পড়াশোনা ছেড়ে দেয়নি। খুব মিশুক আর শান্ত স্বভাবের। মাথায় কাপড় দিয়ে চলাফেরা করে।
রেহানা এত সুন্দর হলেও ওর বিয়ের প্রস্তাবগুলো শুনে আমার সত্যি খুব রাগ লাগত। ওর ফ্যামিলির অবস্থা খারাপ হওয়ার জন্যই কি ওর থেকে বয়সে দ্বিগুণ-তিন গুণ, এক বাচ্চার বাপ, ডিভোর্সি কিংবা বিপত্নীক লোকের প্রস্তাব আসবে? কেন কারখানার একটা মেকার, যে এইট পাস, সে একটা অনার্স পড়ুয়া শিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেবে? ভদ্র ফ্যামিলির শিক্ষিত একটি ছেলে, যার একটি ভালো চাকরি আছে এমন প্রস্তাব কেন আসবে না?
আমি নিজেই আমার অনেক আত্মীয়, ভার্সিটির পরিচিতদের অনেকে যাঁরা পাত্রী খোঁজার কথা বলতেন, তাঁদের ওর ছবি দেখিয়েছিলাম। সবাই একবাক্যে ওকে দেখে মুগ্ধ। কিন্তু ফ্যামিলিগতভাবে গেলেই সব বিয়ের কথা থমকে যেত। বাবা কিছু করে না, ভাইয়েরা পরিচয় দেওয়ার মতো নয়, বোনের জামাইগুলো সব কেমন যেন। এহেন ফ্যামিলিতে আত্মীয়তা করতে কেউ-ই আগ্রহী নয়।
সেবার যখন ছুটিতে বাড়ি গেলাম, ও আমাকে পেপারের একটি কাটিং দেখিয়ে বলল, এই চাকরিটার জন্য ও কয়েক মাস আগে অ্যাপ্লাই করেছিল। এখন ইন্টারভিউর চিঠি এসেছে। বাংলাদেশের খুব নামকরা একটি কোম্পানির ছোট একটা পোস্ট। শিক্ষাগত যোগ্যতা এইট পাস!
রেহানা তারপরও এই চাকরিটার জন্য চেষ্টা করতে চায়। ছোট দুই ভাইয়ের পড়ালেখা প্রায় বন্ধ হওয়ার জোগাড়। বাবা-মা দুজনেই অসুস্থ। খাবার জোটে না তো ওষুধ কিনবে কীভাবে।
কিন্তু ইন্টারভিউর জন্য ঢাকা যেতে হবে। বাসভাড়া নেই। ভালো একটা জামা নেই। সস্তা ফুটপাতের স্যান্ডেলটাও ছেঁড়া।
ওকে বললাম, তুই চিন্তা করিস না। আমার সঙ্গেই চল। বাসভাড়া আমি দেব। আমার ভার্সিটির হলে থাকবি। আর কাপড়চোপড় আমার একটা পরে নিস। হলে গেলে তোর পায়ের মাপের স্যান্ডেলের অভাব হবে না। সে রকম দেখলে গাউছিয়া থেকে কিনে নেব।
নভেম্বর মাসের সুন্দর এক সকালে আমরা দুজন ঢাকার পথে রওনা হলাম। ওর ইন্টারভিউ ছিল দুদিন পরে। ইন্টারভিউ বোর্ডে যাওয়ার জন্য ঈদের সাদা থ্রিপিসটা ওকে পরতে দিলাম। গাউছিয়া যাওয়ার টাইম নাই। হলের রত্না আপুর পায়ের সাদা কারুকাজ করা স্যান্ডেল, নিশার সাদা পাথরের কানের দুল আর হালকা মেকআপ রেহানাকে লাগছিল সাদা একটা অপ্সরী।
সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে যথাসময়ে ইন্টারভিউ দিতে নিয়ে গিয়েছিলাম। অনেকক্ষণ পর যখন ও ইন্টারভিউ বোর্ড থেকে বেরিয়ে এল, ম্লান একটা হাসি দিয়ে বলল, নাহ্, হবে না। মামা-চাচা না থাকলে ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি হয় না রে। খামাখা তোর পয়সা নষ্ট করলাম। আমি বললাম, ব্যাপার না। তুই পাস করলে কোথাও না কোথাও এমনিতেই হয়ে যাবে।
দুই দিন পর রেহানা রংপুরে ফিরে যায়।
এর প্রায় দুই মাস পর রেহানার ফোন। হ্যালো বলতেই ওপ্রান্তে চিৎকার করে রেহানা বলে, শোন, আমার চাকরিটা হয়েছে। ফুলটাইম, পারমানেন্ট। সুযোগ-সুবিধা শুনলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবি। আনন্দে চিৎকার দিয়ে বললাম, বলিস কী! কবে জয়েনিং?
এই মাসের ২৫ তারিখ। বিশাল দুই মাইক্রোবাসে করে বাসায় এসে জয়েনিং লেটার দিয়ে গেছে। আমার জয়েনিংয়ের দিন তোকে কিন্তু আসতেই হবে।
আমি বোকার মতো বললাম, মানে কী? হো হো করে হেসে রেহানা বলল, ওই দিনের ইন্টারভিউ বোর্ডে, ভাঙা ঘরের এই ঘুঁটেকুড়ানি ধার করা জামাজুতা পরে রাজা-রানিমা আর রাজপুত্তরের নাকি মন জয় করে নিয়েছে।
রাজা-রানি আমাকে তাদের ছেলের বউ করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। রাজপুত্রও এসেছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম, হয় পাত্র পাগল, না হয় নির্ঘাত কোনো ঘাপলা আছে। কিন্তু পরে সবাই খোঁজখবর নিয়ে জেনেছে, কোনো সমস্যাই নেই। তারা নাকি আমার মতো মেয়েই অনেক দিন ধরে খুঁজছিল। বিয়েতে সমস্ত খরচ তারাই দেবে। এখন তুই বল, আমি কি এ যুগের সিনড্রেলা নই?
ফোন রেখে মনে মনে বললাম, দোয়া করি বড়লোকের রাজপুত্র তোকে যেন তার মনের রানি করে রাখে। এ যুগের নয়, সে যুগের সিনড্রেলার মতোই রেহানা যেন সুখে থাকে আজীবন।
>>>বি. দ্র. প্রিয় পাঠক, এ যুগের সিনড্রেলা কি সত্যি সে যুগের সিনড্রেলার মতো আছে? সে গল্প তোলা থাক আরেক দিনের জন্য।
No comments