গল্প- মীমাংসিত পথ by আনোয়ারা আল্পনা
আজ
রাতে ঢাকার তাপমাত্রা ছত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গরমের হিসাবের বেলায় এখনও
জুনের চেয়ে জ্যৈষ্ঠ ভালো শোনায়। কিন্তু একশো ডিগ্রিতে জ্বর কেবল শুরু হয়।
তাহলে ছত্রিশ খুব বেশি তো নয়। আর জ্যৈষ্ঠের গরম তো লাগবেই, কত রকমের ফল
পাকবে বলে অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু জ্বর আর ফল পাকাপাকির দোহাইয়ে কাজ হল না,
নিজের নামও ঠাণ্ডা করতে পারল না তুষারকে। লুঙ্গি পরে খালি গায়েও দরদর করে
ঘামতে লাগল সে। ফ্যানের বাতাসে বুকের ঘন লোম হালকা দোলে, কিন্তু চিত হয়ে
শুয়ে থেকেও ঘাম গড়িয়ে পরে বিছানায়। তুষার বুঝতে পারে না, এত গরম লাগা কোনো
অসুখের লক্ষণ কি না—পয়ত্রিশ বছর বয়সে হার্ট বিগড়াবে? মনে করতে চেষ্টা করে,
এমন গরম আগেও লেগেছে কি না। কিন্তু তার মনে হয়, এমন গরম আগে কখনও লাগে নাই।
দিনে একবারই গোসল করে সে, কিন্তু আজ ঘরের লাইট অফ করে, লুঙ্গি খুলে খাটের
উপরে রেখে বাথরুমে ঢুকল। গরম হয়ে আছে বাথরুমের দেয়াল, গোসল না করেই বেরিয়ে
এল। লুঙ্গি, গামছা নিয়ে ডাইনিং লাগোয়া বাথরুমে ঢুকল। এটার দেয়ালে সরাসরি
রোদ লাগে না। মনে হল যেন এটা একটু ঠাণ্ডা। শাওয়ার ছেড়ে মাথা পেতে দাঁড়ালো।
প্রথমে গরম পানি ঝাপিয়ে পড়ল গায়ে, সে সরে দাঁড়াল। মিনিট পাঁচেক পরে খানিক
ঠাণ্ডা পানি এল। আজ সারাদিন ‘ভেজা কাপড় দলাপাকা অবস্থায় শুকানো’ রোদ গেছে।
ছোটবেলায় তুষারের দাদি একদিন গল্প করেছিল, নতুন বউকালে একদিন জ্যৈষ্ঠ মাসের
সকালে বাড়ির পেছনের পুকুরে গোসল করে খড়ির ঘরের পেছনে কাপড় বদলে, ভেজা কাপড়
দলা করে রেখেছিল। শ্বশুর, ভাসুর বেরিয়ে গেলে তবে উঠানের দড়িতে শুকাতে দেন
শাড়ি। সেদিন আর মনে নাই। বিকালে মনে পড়লে গিয়ে দেখেন, দলা পাকানো অবস্থায়ই
শুকিয়ে গেছে শাড়ি।
গোসল শেষ করে গা না মুছেই বেরিয়ে এল তুষার। পুরা বাসার লাইট অফ করে ভেজা গায়ে লুঙ্গি না পরে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে হাঁটাহাঁটি করল কিছুক্ষণ। কেবল আটটা বাজে। আজ অন্যদিনের চেয়ে আগে অফিস থেকে ফিরেছে সে। সোহানা চলে যাওয়ার পর এত তাড়াতাড়ি ফেরে না। অফিসের পরে আড্ডা দিতে যায়, কোনো কোনও দিন একটু আধটু মদও খায়। দশটার পর বাসায় ফেরে। কিন্তু দুইদিন হলো অফিসে কাজ কমে গেছে তার। সপ্তাহ খানেক আগে নতুন একটা ছেলে জয়েন করেছে, হঠাৎ করে। তুষার অবাক হয়ে লক্ষ করেছে, ছেলেটা আইটির! তাদের অফিসে আইটির এত কাজ নেই যে আরো একজন লোক লাগবে। বিকালে ক্যান্টিনে চা খেতে খেতে তার মনে হয়েছে, তাহলে পুরানাদের কেউ ছাঁটাই হচ্ছে? কে?
সাড়ে আটটার দিকে সে সোহানাকে ফোন করল, প্রায় তিন মাস পর। বলল, ‘একটু আসো না, কিছুই ভালো লাগতেছে না আমার।’
সোহানা বলল, ‘মানে কী? তুমি আমাকে আর এভাবে ডাকতে পার?’
তুষার আবার বলল, ‘আসো প্লিজ!’
সোহানা ‘না’ বলে ফোন কেটে দিল।
এবার লুঙ্গিটা পড়ল সে। কিন্তু তবু লাইট জ্বালল না। ওয়্যারড্রবের উপরের ড্রয়ার খুলে একটা কনডমের প্যাকেট নিল। প্যাকেট ছিঁড়ে ডাইনিংয়ের বেসিনে গিয়ে কনডমটা লম্বা করে কল খুলে, কলের মুখে কনডমের মুখ ধরল। খানিক ভরে এলে কনডমের মুখ চেপে ধরে কল বন্ধ করল। তারপর অন্য হাত কনডমসহ উঁচু করা হাতের নিচে ধরল। না পানি পড়ছে ন। মানে এটাও ফুটা নয়। গত তিনমাসে প্রত্যেক রাতে সে একটা করে কনডমের ফুটা চেক করেছে।
তিন মাস আগে বাসা ছাড়ার আগে সোহানার সঙ্গে তার শেষ কথা হয়েছিল, ‘তোমার তাইলে যিশু খ্রিস্ট আসতেছে?’ এটা শুনে একটাও কথা বলে নাই সোহানা। সকালে নাস্তার টেবিলে এই তাদের শেষ কথা। তারপর দুজনেই অফিসে বেরিয়ে গেছে। রাতে ফিরে তুষার দেখেছে, নিজের জামা কাপড় নিয়ে গেছে সোহানা। তিন বছরের সংসার তাদের। এ বাসার অনেক কিছুই তাদের দুইজনের যৌথ টাকায় কেনা। সাতদিন পরে তুষার টেক্সট পাঠাল—‘আসবা না?’ জবাবে সোহানা লিখেছিল—‘ইটস সেপারেশন, যিশু এসে গেলে ডিভোর্স।’ তুষার লিখল, ‘জিনিসপত্র ভাগাভাগি হবে না?’ পরের দিন সোহানা টেক্সট করেছিল, ‘না, বাসা ভাড়া তুমি বেশি দিছ, কাজেই শোধবোধ।’
গোসলের পর কিছুক্ষণ আরাম লেগেছিল, আবার গরম লাগছে। এখন মনে হচ্ছে চল্লিশ-টল্লিশ হয়ে গেছে তাপমাত্রা। তুষার জিভ বের করে কুকুরের মতো হাঁপাতে শুরু করল। মনে মনে ঠিক করল, কাল ব্যাংক একাউন্ট চেক করে দেখবে, হাজার পঞ্চাশেক থাকলে, কালকেই একটা এসি কিনে ফেলবে।
বিয়ের আগেই বলেছিল তুষার, ‘আমরা কিন্তু বাচ্চাকাচ্চা নেব না, ওকে? না হাইসো না, আমি সিরিয়াস। বাচ্চাকাচ্চা সারা জীবনের জন্য চব্বিশ ঘণ্টার ডিউটি। আর বাবা-মা হওয়াকে অত মহান আর আনন্দদায়ক ভাবার কিছু নাই, এটা আরোপিত।’ সোহানা তখন ভেবেছিল, এখন এটা বলছে, বিয়ের পর দেখা যাবে তুষারই বাবা হওয়ার জন্য অস্থির হয়েছে বেশি। কিন্তু বিয়ের পর দেখেছে সত্যিই কনডম ছাড়া একদম নড়ে না সে। পিরিয়ডের পর কয়েক দিনের নিরাপদ সময়েও সে কনডম ছাড়া কাছে আসে না। চার মাস আগে যেদিন সোহানা হাসতে হাসতে বলেছে, ‘আমি প্রেগন্যান্ট’ তখন তুষার বলেছে, ‘হাউ?’ সোহানা চোখ টিপে বলেছে, ‘ফুটা ছিল মনে হয়!’ তারপরের একমাস সোহানা খুব খুশি ছিল, তুষারকে প্রায়ই নাম খুঁজতে বলত। সোহানা যেদিন বাসা ছেড়ে চলে গেল, সেদিন সকালে তুষার বলেছিল, ‘তোমার তাহলে বাবা ছাড়া বেবি আসতেছে? যিশু রিটারন্স?’ তখনই আসলে সোহানা বুঝেছিল তুষার কনডমেই আটকে আছে।
রাত প্রায় এগারোটা বাজে। আবার গোসল করতে ঢুকল তুষার। কিছুতেই গরম কমছে না। ভাবল, প্রেসারটা একটু চেক করা দরকার ছিল মনেহয়। নিচে গলির মাথার রনদা ফার্মেসিটা এখনও খোলা আছে কি না কে জানে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে শার্ট গায়ে দিয়ে লুঙ্গি পরেই নিচে নামল। দারোয়ানকে বলল, ‘গেট লাগাইও না, ওষুধের দোকান থেকে আসতেছি।’ দারোয়ান বলল, ‘ভাইজানের শরীরটা খারাপ? যেই গরম পড়ছে, বাপের জম্মে এমুন দেহি নাই।’ মাথা নেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে তুষার ভাবল, গরম তাইলে আমার একারই লাগতেছে না! ফার্মেসি খোলাই ছিল, ছেলেটা চেনা, যেতে আসতে দেখা হয়। বলল, ‘প্রেসারটা একটু দেইখা দে তো।’
প্রেসার মাপার সময় তুষার খেয়াল করল, থরথর করে হাত কাঁপছে ছেলেটার। মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, মুখটা ভয়ে সাদা। সে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হইছে রে?’ ছেলেটা তুষারের কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলল, আপনার ক্রশফায়ার ঠিক আছে ভাইজান, তাড়াতাড়ি বাসায় যান।’ তুষার অবাক হয়ে বলল, ‘কী বললি?’ ছেলেটা আবারও ফিসফিস করে বলল, ‘কিছু না ভাইজান, বাসায় যান।’ তুষার বলল, ‘কয়েকটা ঘুমের ওসুধ দে, ঘুম আসতেছে না।’ তারপরেই বলল, ‘কনডমে কি ফুটা থাকতে পারে রে?’ ছেলেটা বিড়বিড় করে বলল, ‘মানুষেই ফুটা ফুটা হয়া যায়, আর পেলাস্টিক!’ তারপর চারটা ঘুমের অসুধ দিয়ে বলল, ‘প্রেসক্রিপশন ছাড়া আর দেওন যাইব না।’ ঘুমের অসুধ পকেটে ভরে বাসার দিকে হাঁটতে হাঁটতে তুষারের মনে হল, ছেলেটা আবোল-তাবোল বকতেছিল কেন? বাসার গেটে ঢোকার সময় দারোয়ান বলল, ‘কিচু দেকলেন নাকি ভাইজান?’ তুষার বলল, ‘না, কী দেকব?’ এবার দারোয়ানও বিড়বিড়ালো, ‘মনে হয় পটকার আওয়াজ হুঞ্চিলাম ইট্টু আগে!’ তুষার বলল, ‘খেলা-টেলা আছে মনে হয়।’
বাসায় ঢুকে আবার খালি গা হয়ে গেল সে। মনে হচ্ছে গরম একটু কমেছে। খালি পেটেই দুইটা ঘুমের অসুধ খেয়ে শুয়ে পড়ল। ঘুম বারে বারে এল, ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে গেল। যখন এসে চোখের পাতায় বসে তখন মনে হয় তলিয়ে যাবে, আবার ভুশ করে ভেসে ওঠে। এই চলল কয়েক ঘণ্টা। ভোরের দিকে খানিক গড়াগড়ি করে উঠে পড়ল, ভাবল, অনেকদিন হাঁটতে যাওয়া হয় না, আজ যাই। সোয়া পাঁচটার সময় বেরিয়ে পড়ল সে। রনদা ফার্মেসি পেরিয়ে স্কয়ার হাসপাতালের দিকে যাবে ভাবতে ভাবতে ফার্মেসির থেকে একটু সামনে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। মাটিতে লাল, পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা হয়েছে, তবু কালচে লাল হয়ে আছে। হাঁটতে হাঁটতে দেখল, একটা বন্ধ চায়ের দোকানে টিনের বেড়ায় ‘পাসওয়ার্ড’ নামের এক সিনেমার পোস্টার সাঁটা। স্কয়ার হাসপাতাল পেরিয়ে বত্রিশ নম্বরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবল, অফিসে যাব না আজ, এসি কিনতে যাব। এসি লাগাতে সারাদিনই লাগবে মনে হয়। সাত নম্বর ব্রিজ পেরিয়ে ধানমন্ডি লেকের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কলাবাগান মাঠের উল্টা দিকে দাঁড়িয়ে ভাবল, এখানে কী যেন বেশি আছে। এই সকালবেলা ধানমন্ডি লেক স্বাস্থ্যওয়ালাদের খ্যাক-খ্যাক করে হাসা আর পাই-পাই করে হাঁটার জায়গা, ঘামের লোভে লোভী মানুষের ভীড়ে কলাবাগান মাঠের উল্টা দিকের বেঞ্চিতে বসে আছে এক তপ্ত জুটি। দুইজনে মিলে চল্লিশের বেশি হবে না, কিন্তু ঝগড়া লেগেছে আশি কেজি ওজনের। সারারাত মনে হয় ঘুমায় নাই দুইজন, ওদের পেছেন দিয়ে হাঁটার গতি কমিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তুষার শুনল, ‘পাসওয়ার্ড দাও!’ ঝট করে তার মনে হল, তাহলে এ ধরনের প্রেমের সিনেমাই ওটা?
তারপরেই ভাবল, সোহানা কয়েকমাস আগে অফিসের কাজে সিঙ্গাপুর গেছিল, ও কি ওখান থেকেই স্পারম কিনছে?
হাঁটতে হাঁটতে আট নম্বর ব্রিজের ডানপাশের কোনার কামরাঙ্গা গেট দিয়ে বেরিয়ে, ব্রিজ পেরিয়ে ডানদিকে হাঁটতে হাঁটতে বায়তুল আমান মসজিদের কোনা দিয়ে আবারও ঢুকে পড়ল লেকের সীমানায়। অনেকদিন পর্যন্ত তুষার জানত না এখানে লেক অন্যদিকের তুলনায় বেশি সুন্দর। লেকের ওই পারের সুধা সদন পাহারা দেওয়ার জন্য এখানে একটা তাবু আছে। দুইজন পুলিশ বা আনসার থাকে। পোশাকের রঙ দেখে এখনও নিরাপত্তা বাহিনীর নাম আলাদা করতে পারে না সে। এইখানে লেকের পাড়ের সামান্য অংশ, ডিশের তারের মতো কালো মোটা তার দিয়ে আলাদা করা। বাকি লেক এবং লেকার পাড় আম জনতার জন্য উন্মুক্ত। তুষার ভাবল, আচ্ছা, সুধা সদনে এখন কে থাকে?
রোদ উঠতে শুরু করলে আবার গরম লাগতে থাকল তার। ফিরে যাবার রাস্তা ধরল। আবার সাত নম্বর ব্রিজের দিকে যেতে যেতে ভাবল, দুইটা মসজিদই সুন্দর। সাত নম্বর ব্রিজ পেরিয়ে তাকওয়া আর আট নম্বর ব্রিজ পেরিয়ে বায়তুল আমান। দুইটাই বিশাল আয়তনের। দুই মসজিদে রেষারেষি আছে না কি? না কি, এই বড়লোকদের এলাকায় সত্যিই এত লোকে নামাজ পড়ে? বত্রিশ নম্বরের বকুল গাছগুলার নিচ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবল, সোহানার সঙ্গে একবার দেখা করতে যেতে হবে। একবার কি বলবে, কেনা স্পার্মের বাবা হতে আপত্তি নেই আমার?
বাসায় ফিরে খিচুরি বসিয়ে দিয়ে গোসল করতে ঢুকল তুষার। এবার শোবার ঘরের লাগোয়াটাতেই। গায়ে পানি পড়তেই বুঝতে পারল, পুরা শরীর জুড়ে খিদা লেগেছে। কাল দুপুরের পর থেকে কিছু খাওয়া হয় নাই। নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে একটু যেন পিঠ ব্যথাও করছে, মানে এসিডিটি। নিজেকেই প্রশ্ন করল, সোহানার জন্য বেশি ফাঁকা লাগছে আমার? গোসল করে বেরিয়ে বুঝতে পারল, ক্লান্ত লাগছে খুব। পেট ভরে খিচুরি খেয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল সে।
ঘুম ভাঙল মেরিনা আপার ফোনে—কই তুমি? বসের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে ঘড়ি দেখল, সাড়ে দশটা বাজে। বলল, ‘মেরিনা আপা, আজ অফিসে আসব না, একটু সামলাইয়েন, খুব গরম, এসি কিনতে যাব আজ।’ মেরিনা আপা একটু যেন কী চিন্তা করল, নিঃশ্বাসের শব্দ শুনল সে। বলল, ‘শোনো তুষার, এসি কিনো না, এইতো আষাঢ় মাস এসেই গেল, বৃষ্টি শুরু হবে। সেভিংস শেষ কোরো না, তোমাদের না বেবি আসতেছে?’ দম নিয়ে বলল, ‘নতুন ছেলেটাকে দেখছ? কাজে খুব ভালো।’ তুষার এবার ধুম করে প্রশ্ন করেই ফেলল, ‘আমার চাকরি যাইতেছে?’ ফোনের ওপাশে বসের মুখ কেমন হল ভাবতে চেষ্টা করল সে। মেরিনা আপা বলল, ‘তুমি অফিসে আস, কথা আছে। রাখলাম, বাই।’
অফিসের জন্য রেডি হতে হতে ফোন বাজল আবার। অচেনা নম্বর এবার, ধরল না। তালা লাগিয়ে নিচে নেমে রিক্সায় উঠে একটু আগে আসা নাম্বাটায় ফোন করল। কথা বলল সোহানা, অবাক হল তুষার। সোহানা নম্বর বদলেছে এবং নিজে থেকে ফোন করেছে দুইটাই অবাক করল তাকে। তুষার বলল, ‘নম্বর বদলাইছ নাকি?’ সোহানা বলল, ‘তোমার বাসার নিচে ফার্মেসিটার সামনে কাল রাতে এগারোটার দিকে এক ডাক্তার খুন হয়েছে, জান?’ তুষার প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘আমি তো এগারোটার দিকেই ওই ফার্মেসিতে গেছিলাম, কই কিছু তো দেখি নাই?’ সোহানা বলল, ‘ওই ডাক্তার আমার এক কলিগের হাজবেন্ড।’ তারপর জানতে চাইল, ‘কালরাতে ভালো লাগতেছিল না বললা, এখন কী অবস্থা?’ তুষার বলল, ‘এখন ঠিক আছি, আচ্ছা সোহানা, স্পার্ম কি সিঙ্গাপুর থেকে কিনছ?’ সোহানা ফোন কেটে দিল না, শান্ত গলায় বলল, ‘এই বাচ্চাটা যেভাবেই আসুক, সে তোমার পরিচয় নেবে না, কেন এটা নিয়া ভাবতেছ?’ তুষার বলল, ‘কিন্তু ওর কারণে তুমি চলে গেছ, তোমাকে তো চাই আমি!’ এবার সোহানার গলায় হতাশা, ‘তুমি কী চাও? আমি ওকে নষ্ট করে ফেলি?’ তুষার বলল, ‘না তা চাই না, শুধু বলো ও কীভাবে এসেছে!’ সোহানা বলল, ‘এখন ফোন রাখব, তুষার। বাই।’
অফিসে ঢুকতেই নতুন ছেলেটার সঙ্গে দেখা, হেসে সালাম দিল, বলল, ‘সাবলেটে একটা রুম খুজতেছি ভাইয়া, খোঁজ থাকলে জানায়েন।’ ‘আচ্ছা’ বলে নিজের টেবিলের দিকে যেতে যেতে অবাক হয়ে ভাবল, আমার রিপ্লেসমেন্ট আমার হেল্প চায়! টেবিলে বসতেই চা দিয়ে গেল। চায়ের মগে হাত দিতে না দিতেই মেরিনা আপা এসে বললেন, ‘একটু আমার সঙ্গে আস, নিচে যাই।’ তুষার বলল, ‘চা টা খেয়ে যাই?’ মাথা দুইদিকে নাড়লেন আপা, ‘না, আসো কফি খাওয়াবো।’ অফিসের নিচে নেমে পাশেই একটা কফিশপে বসল তারা। আপা নিজেই কফি নিয়ে এসে বসলেন, চিনি মিশিয়েও দিলেন। বললেন, ‘তুষার, আমি একটা অফিসে কথা বলে রাখছি, কাল সকালে যাবা, হয়ে যাবে।’ তুষার বলল, ‘কিন্তু আমার চাকরি ক্যান গেল, বলবেন না?’ আপা বললেন, ‘অফিস আমাকে বাজেট কমাতে বলছে, নতুন ছেলেটাকে খুব কম বেতনে পেয়ে গেছি।’ তুষার ধুম করে বলল, ‘কনডমে কি ফুটা থাকতে পারে?’ আপা কফির মগ ঠোঁটে তুলেছিলেন, হাত কেঁপে গেল, চুমুক না দিয়েই নামিয়ে রাখলেন, প্রাণপণ চেষ্টা করলেন স্বাভাবিক থাকতে, কফি ছাড়াই ঢোক গিলে বললেন, ‘সোহানা কোথায়?’ তুষার মনে মনে মেরিনা আপার বুদ্ধির প্রশংসা করল, বলল, ‘সোহানা বনশ্রী, মায়ের বাসায়।’ এর পরের প্রশ্ন তো রেডিই, ‘কবে গেছে?’ তুষার কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, ‘তিনমাস।’ ‘বিয়ে ভাঙতেছে তোমাদের?’ সরাসরি এই প্রশ্ন করলেন আপা। তুষার ভাবল, মানে এটা তাহলে বিয়ে ভাঙার মতোই গুরুতর ব্যপার? বলল, ‘আমিতো চাই না, সোহানা মনে হয় চায়।’ আপা বললেন, ‘ভাঙাই ভালো, তোমার মাথায় যদি এটা এসে থাকে, তাহলে একসঙ্গে থাকলে জটিলতা শুধু বাড়বেই।’ তারপরেই ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন, ‘চলো অফিসে যাই।’ কাল কোন অফিসে যেতে হবে সেটা নিয়ে আর কথা হল না।
অফিস থেকে বেরিয়ে আড্ডা দিয়ে রাত দশটার দিকে সে যখন বাসার গলিতে ঢুকল, তখন গলিটা অন্যদিনের চেয়ে ফাঁকা লাগল। ফার্মেসিতে বসে আছে ছেলেটা। তুষারকে দেখে বলল, ‘ঘুম হইছে ভাইজান?’ তুষার দোকানে উঠে গেল, বলল, ‘কাল কী হইছে রে?’ তুষার কালকের মতোই ফিসফিস করে বলল, ‘লোকটা আপনার বাসার ঠিকানা বইলা কোন বাসা জানবার চাইছিল, আমি কইছিলাম, হের পরে দোকান থাইকা রাস্তায় নামার লগে লগে শ্যাষ!’ লোকটা তার বাসা খুঁজেছিল এটা শুনে এত অবাক হল সে, তার গলা দিয়েও ফিসফিস বেরোল তখন—‘কী বলিস!’ ছেলেটা বলল, আইজ পুলিশ আর সাম্বাদিক আইছিল, আমি কাউরে আপনের নাম কই নাই।’
বাসায় এসে চাবি ঘোরাতে গিয়ে দেখল, খোলা, ভেতর থেকে বন্ধ। আবার অবাক হয়ে বেল বাজাল সে। দরজা খুলল সোহানা। খুশি হয়ে হড়বড় করে বলল, ‘তুমি কখন আইলা? আমার চাকরি তো চইলা গেছে! তুমি ছাড়া আর কে খাওয়াবে আমারে!’ সোহানাও হেসে বলল, ‘চাকরি গেল কেন?’ কিন্তু সে কথায় না গিয়ে তুষার বলল, ‘আচ্ছা ওই ডাক্তার আমার বাসার খোঁজ করছিল, জানো?’ সোহানার মুখটা কালো হয়ে গেল এবার, বলল, ‘আমার কলিগ বৃষ্টি আপা আছে না? ওনার হাজবেন্ড আতা ভাই। আমার মুড কেন সব সময় অফ সেটা নিয়ে কয়েকদিন আগে খুব চেপে ধরলেন বৃষ্টি আপা, আমি বলে ফেলেছিলাম, তুমি বলছ যিশু আসতেছে কিনা। তারপর আর জানি না যে উনি সেটা আতা ভাইকে বলেছেন, কাল আপা আতা ভাইকে পাঠাইছিলেন তোমার কাছে, বুঝিয়ে বলতে যে এমন হতে পারে। আজ বৃষ্টি আপা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ওকে কেউ মেরে ফেলতে পারে, বিশ্বাস হয়না আমার—মনে হয় অন্য কেউ ভেবে ভুল করে মেরেছে!’
তুষার চুপ হয়ে গেল, অনেকক্ষণ পরে বলল, ‘এটা কেমন হল, বলতো!’
সোহানা বলল, ‘আলট্রাসনোগ্রাফি করতে দিছিলাম, রিপোর্ট দিছে আজ, ওটা বেবি না টিউমার!’ সোহানাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল তুষার, ‘আয়াম সো স্যরি সোনা!’ তুষারকে জড়িয়ে ধরেই সোহানা বলল, ‘কিন্তু ডিভোর্স হবে, তোমার সঙ্গে থাকব না আমি’।
গোসল শেষ করে গা না মুছেই বেরিয়ে এল তুষার। পুরা বাসার লাইট অফ করে ভেজা গায়ে লুঙ্গি না পরে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে হাঁটাহাঁটি করল কিছুক্ষণ। কেবল আটটা বাজে। আজ অন্যদিনের চেয়ে আগে অফিস থেকে ফিরেছে সে। সোহানা চলে যাওয়ার পর এত তাড়াতাড়ি ফেরে না। অফিসের পরে আড্ডা দিতে যায়, কোনো কোনও দিন একটু আধটু মদও খায়। দশটার পর বাসায় ফেরে। কিন্তু দুইদিন হলো অফিসে কাজ কমে গেছে তার। সপ্তাহ খানেক আগে নতুন একটা ছেলে জয়েন করেছে, হঠাৎ করে। তুষার অবাক হয়ে লক্ষ করেছে, ছেলেটা আইটির! তাদের অফিসে আইটির এত কাজ নেই যে আরো একজন লোক লাগবে। বিকালে ক্যান্টিনে চা খেতে খেতে তার মনে হয়েছে, তাহলে পুরানাদের কেউ ছাঁটাই হচ্ছে? কে?
সাড়ে আটটার দিকে সে সোহানাকে ফোন করল, প্রায় তিন মাস পর। বলল, ‘একটু আসো না, কিছুই ভালো লাগতেছে না আমার।’
সোহানা বলল, ‘মানে কী? তুমি আমাকে আর এভাবে ডাকতে পার?’
তুষার আবার বলল, ‘আসো প্লিজ!’
সোহানা ‘না’ বলে ফোন কেটে দিল।
এবার লুঙ্গিটা পড়ল সে। কিন্তু তবু লাইট জ্বালল না। ওয়্যারড্রবের উপরের ড্রয়ার খুলে একটা কনডমের প্যাকেট নিল। প্যাকেট ছিঁড়ে ডাইনিংয়ের বেসিনে গিয়ে কনডমটা লম্বা করে কল খুলে, কলের মুখে কনডমের মুখ ধরল। খানিক ভরে এলে কনডমের মুখ চেপে ধরে কল বন্ধ করল। তারপর অন্য হাত কনডমসহ উঁচু করা হাতের নিচে ধরল। না পানি পড়ছে ন। মানে এটাও ফুটা নয়। গত তিনমাসে প্রত্যেক রাতে সে একটা করে কনডমের ফুটা চেক করেছে।
তিন মাস আগে বাসা ছাড়ার আগে সোহানার সঙ্গে তার শেষ কথা হয়েছিল, ‘তোমার তাইলে যিশু খ্রিস্ট আসতেছে?’ এটা শুনে একটাও কথা বলে নাই সোহানা। সকালে নাস্তার টেবিলে এই তাদের শেষ কথা। তারপর দুজনেই অফিসে বেরিয়ে গেছে। রাতে ফিরে তুষার দেখেছে, নিজের জামা কাপড় নিয়ে গেছে সোহানা। তিন বছরের সংসার তাদের। এ বাসার অনেক কিছুই তাদের দুইজনের যৌথ টাকায় কেনা। সাতদিন পরে তুষার টেক্সট পাঠাল—‘আসবা না?’ জবাবে সোহানা লিখেছিল—‘ইটস সেপারেশন, যিশু এসে গেলে ডিভোর্স।’ তুষার লিখল, ‘জিনিসপত্র ভাগাভাগি হবে না?’ পরের দিন সোহানা টেক্সট করেছিল, ‘না, বাসা ভাড়া তুমি বেশি দিছ, কাজেই শোধবোধ।’
গোসলের পর কিছুক্ষণ আরাম লেগেছিল, আবার গরম লাগছে। এখন মনে হচ্ছে চল্লিশ-টল্লিশ হয়ে গেছে তাপমাত্রা। তুষার জিভ বের করে কুকুরের মতো হাঁপাতে শুরু করল। মনে মনে ঠিক করল, কাল ব্যাংক একাউন্ট চেক করে দেখবে, হাজার পঞ্চাশেক থাকলে, কালকেই একটা এসি কিনে ফেলবে।
বিয়ের আগেই বলেছিল তুষার, ‘আমরা কিন্তু বাচ্চাকাচ্চা নেব না, ওকে? না হাইসো না, আমি সিরিয়াস। বাচ্চাকাচ্চা সারা জীবনের জন্য চব্বিশ ঘণ্টার ডিউটি। আর বাবা-মা হওয়াকে অত মহান আর আনন্দদায়ক ভাবার কিছু নাই, এটা আরোপিত।’ সোহানা তখন ভেবেছিল, এখন এটা বলছে, বিয়ের পর দেখা যাবে তুষারই বাবা হওয়ার জন্য অস্থির হয়েছে বেশি। কিন্তু বিয়ের পর দেখেছে সত্যিই কনডম ছাড়া একদম নড়ে না সে। পিরিয়ডের পর কয়েক দিনের নিরাপদ সময়েও সে কনডম ছাড়া কাছে আসে না। চার মাস আগে যেদিন সোহানা হাসতে হাসতে বলেছে, ‘আমি প্রেগন্যান্ট’ তখন তুষার বলেছে, ‘হাউ?’ সোহানা চোখ টিপে বলেছে, ‘ফুটা ছিল মনে হয়!’ তারপরের একমাস সোহানা খুব খুশি ছিল, তুষারকে প্রায়ই নাম খুঁজতে বলত। সোহানা যেদিন বাসা ছেড়ে চলে গেল, সেদিন সকালে তুষার বলেছিল, ‘তোমার তাহলে বাবা ছাড়া বেবি আসতেছে? যিশু রিটারন্স?’ তখনই আসলে সোহানা বুঝেছিল তুষার কনডমেই আটকে আছে।
রাত প্রায় এগারোটা বাজে। আবার গোসল করতে ঢুকল তুষার। কিছুতেই গরম কমছে না। ভাবল, প্রেসারটা একটু চেক করা দরকার ছিল মনেহয়। নিচে গলির মাথার রনদা ফার্মেসিটা এখনও খোলা আছে কি না কে জানে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে শার্ট গায়ে দিয়ে লুঙ্গি পরেই নিচে নামল। দারোয়ানকে বলল, ‘গেট লাগাইও না, ওষুধের দোকান থেকে আসতেছি।’ দারোয়ান বলল, ‘ভাইজানের শরীরটা খারাপ? যেই গরম পড়ছে, বাপের জম্মে এমুন দেহি নাই।’ মাথা নেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে তুষার ভাবল, গরম তাইলে আমার একারই লাগতেছে না! ফার্মেসি খোলাই ছিল, ছেলেটা চেনা, যেতে আসতে দেখা হয়। বলল, ‘প্রেসারটা একটু দেইখা দে তো।’
প্রেসার মাপার সময় তুষার খেয়াল করল, থরথর করে হাত কাঁপছে ছেলেটার। মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, মুখটা ভয়ে সাদা। সে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হইছে রে?’ ছেলেটা তুষারের কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলল, আপনার ক্রশফায়ার ঠিক আছে ভাইজান, তাড়াতাড়ি বাসায় যান।’ তুষার অবাক হয়ে বলল, ‘কী বললি?’ ছেলেটা আবারও ফিসফিস করে বলল, ‘কিছু না ভাইজান, বাসায় যান।’ তুষার বলল, ‘কয়েকটা ঘুমের ওসুধ দে, ঘুম আসতেছে না।’ তারপরেই বলল, ‘কনডমে কি ফুটা থাকতে পারে রে?’ ছেলেটা বিড়বিড় করে বলল, ‘মানুষেই ফুটা ফুটা হয়া যায়, আর পেলাস্টিক!’ তারপর চারটা ঘুমের অসুধ দিয়ে বলল, ‘প্রেসক্রিপশন ছাড়া আর দেওন যাইব না।’ ঘুমের অসুধ পকেটে ভরে বাসার দিকে হাঁটতে হাঁটতে তুষারের মনে হল, ছেলেটা আবোল-তাবোল বকতেছিল কেন? বাসার গেটে ঢোকার সময় দারোয়ান বলল, ‘কিচু দেকলেন নাকি ভাইজান?’ তুষার বলল, ‘না, কী দেকব?’ এবার দারোয়ানও বিড়বিড়ালো, ‘মনে হয় পটকার আওয়াজ হুঞ্চিলাম ইট্টু আগে!’ তুষার বলল, ‘খেলা-টেলা আছে মনে হয়।’
বাসায় ঢুকে আবার খালি গা হয়ে গেল সে। মনে হচ্ছে গরম একটু কমেছে। খালি পেটেই দুইটা ঘুমের অসুধ খেয়ে শুয়ে পড়ল। ঘুম বারে বারে এল, ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে গেল। যখন এসে চোখের পাতায় বসে তখন মনে হয় তলিয়ে যাবে, আবার ভুশ করে ভেসে ওঠে। এই চলল কয়েক ঘণ্টা। ভোরের দিকে খানিক গড়াগড়ি করে উঠে পড়ল, ভাবল, অনেকদিন হাঁটতে যাওয়া হয় না, আজ যাই। সোয়া পাঁচটার সময় বেরিয়ে পড়ল সে। রনদা ফার্মেসি পেরিয়ে স্কয়ার হাসপাতালের দিকে যাবে ভাবতে ভাবতে ফার্মেসির থেকে একটু সামনে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। মাটিতে লাল, পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা হয়েছে, তবু কালচে লাল হয়ে আছে। হাঁটতে হাঁটতে দেখল, একটা বন্ধ চায়ের দোকানে টিনের বেড়ায় ‘পাসওয়ার্ড’ নামের এক সিনেমার পোস্টার সাঁটা। স্কয়ার হাসপাতাল পেরিয়ে বত্রিশ নম্বরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবল, অফিসে যাব না আজ, এসি কিনতে যাব। এসি লাগাতে সারাদিনই লাগবে মনে হয়। সাত নম্বর ব্রিজ পেরিয়ে ধানমন্ডি লেকের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কলাবাগান মাঠের উল্টা দিকে দাঁড়িয়ে ভাবল, এখানে কী যেন বেশি আছে। এই সকালবেলা ধানমন্ডি লেক স্বাস্থ্যওয়ালাদের খ্যাক-খ্যাক করে হাসা আর পাই-পাই করে হাঁটার জায়গা, ঘামের লোভে লোভী মানুষের ভীড়ে কলাবাগান মাঠের উল্টা দিকের বেঞ্চিতে বসে আছে এক তপ্ত জুটি। দুইজনে মিলে চল্লিশের বেশি হবে না, কিন্তু ঝগড়া লেগেছে আশি কেজি ওজনের। সারারাত মনে হয় ঘুমায় নাই দুইজন, ওদের পেছেন দিয়ে হাঁটার গতি কমিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তুষার শুনল, ‘পাসওয়ার্ড দাও!’ ঝট করে তার মনে হল, তাহলে এ ধরনের প্রেমের সিনেমাই ওটা?
তারপরেই ভাবল, সোহানা কয়েকমাস আগে অফিসের কাজে সিঙ্গাপুর গেছিল, ও কি ওখান থেকেই স্পারম কিনছে?
হাঁটতে হাঁটতে আট নম্বর ব্রিজের ডানপাশের কোনার কামরাঙ্গা গেট দিয়ে বেরিয়ে, ব্রিজ পেরিয়ে ডানদিকে হাঁটতে হাঁটতে বায়তুল আমান মসজিদের কোনা দিয়ে আবারও ঢুকে পড়ল লেকের সীমানায়। অনেকদিন পর্যন্ত তুষার জানত না এখানে লেক অন্যদিকের তুলনায় বেশি সুন্দর। লেকের ওই পারের সুধা সদন পাহারা দেওয়ার জন্য এখানে একটা তাবু আছে। দুইজন পুলিশ বা আনসার থাকে। পোশাকের রঙ দেখে এখনও নিরাপত্তা বাহিনীর নাম আলাদা করতে পারে না সে। এইখানে লেকের পাড়ের সামান্য অংশ, ডিশের তারের মতো কালো মোটা তার দিয়ে আলাদা করা। বাকি লেক এবং লেকার পাড় আম জনতার জন্য উন্মুক্ত। তুষার ভাবল, আচ্ছা, সুধা সদনে এখন কে থাকে?
রোদ উঠতে শুরু করলে আবার গরম লাগতে থাকল তার। ফিরে যাবার রাস্তা ধরল। আবার সাত নম্বর ব্রিজের দিকে যেতে যেতে ভাবল, দুইটা মসজিদই সুন্দর। সাত নম্বর ব্রিজ পেরিয়ে তাকওয়া আর আট নম্বর ব্রিজ পেরিয়ে বায়তুল আমান। দুইটাই বিশাল আয়তনের। দুই মসজিদে রেষারেষি আছে না কি? না কি, এই বড়লোকদের এলাকায় সত্যিই এত লোকে নামাজ পড়ে? বত্রিশ নম্বরের বকুল গাছগুলার নিচ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবল, সোহানার সঙ্গে একবার দেখা করতে যেতে হবে। একবার কি বলবে, কেনা স্পার্মের বাবা হতে আপত্তি নেই আমার?
বাসায় ফিরে খিচুরি বসিয়ে দিয়ে গোসল করতে ঢুকল তুষার। এবার শোবার ঘরের লাগোয়াটাতেই। গায়ে পানি পড়তেই বুঝতে পারল, পুরা শরীর জুড়ে খিদা লেগেছে। কাল দুপুরের পর থেকে কিছু খাওয়া হয় নাই। নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে একটু যেন পিঠ ব্যথাও করছে, মানে এসিডিটি। নিজেকেই প্রশ্ন করল, সোহানার জন্য বেশি ফাঁকা লাগছে আমার? গোসল করে বেরিয়ে বুঝতে পারল, ক্লান্ত লাগছে খুব। পেট ভরে খিচুরি খেয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল সে।
ঘুম ভাঙল মেরিনা আপার ফোনে—কই তুমি? বসের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে ঘড়ি দেখল, সাড়ে দশটা বাজে। বলল, ‘মেরিনা আপা, আজ অফিসে আসব না, একটু সামলাইয়েন, খুব গরম, এসি কিনতে যাব আজ।’ মেরিনা আপা একটু যেন কী চিন্তা করল, নিঃশ্বাসের শব্দ শুনল সে। বলল, ‘শোনো তুষার, এসি কিনো না, এইতো আষাঢ় মাস এসেই গেল, বৃষ্টি শুরু হবে। সেভিংস শেষ কোরো না, তোমাদের না বেবি আসতেছে?’ দম নিয়ে বলল, ‘নতুন ছেলেটাকে দেখছ? কাজে খুব ভালো।’ তুষার এবার ধুম করে প্রশ্ন করেই ফেলল, ‘আমার চাকরি যাইতেছে?’ ফোনের ওপাশে বসের মুখ কেমন হল ভাবতে চেষ্টা করল সে। মেরিনা আপা বলল, ‘তুমি অফিসে আস, কথা আছে। রাখলাম, বাই।’
অফিসের জন্য রেডি হতে হতে ফোন বাজল আবার। অচেনা নম্বর এবার, ধরল না। তালা লাগিয়ে নিচে নেমে রিক্সায় উঠে একটু আগে আসা নাম্বাটায় ফোন করল। কথা বলল সোহানা, অবাক হল তুষার। সোহানা নম্বর বদলেছে এবং নিজে থেকে ফোন করেছে দুইটাই অবাক করল তাকে। তুষার বলল, ‘নম্বর বদলাইছ নাকি?’ সোহানা বলল, ‘তোমার বাসার নিচে ফার্মেসিটার সামনে কাল রাতে এগারোটার দিকে এক ডাক্তার খুন হয়েছে, জান?’ তুষার প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘আমি তো এগারোটার দিকেই ওই ফার্মেসিতে গেছিলাম, কই কিছু তো দেখি নাই?’ সোহানা বলল, ‘ওই ডাক্তার আমার এক কলিগের হাজবেন্ড।’ তারপর জানতে চাইল, ‘কালরাতে ভালো লাগতেছিল না বললা, এখন কী অবস্থা?’ তুষার বলল, ‘এখন ঠিক আছি, আচ্ছা সোহানা, স্পার্ম কি সিঙ্গাপুর থেকে কিনছ?’ সোহানা ফোন কেটে দিল না, শান্ত গলায় বলল, ‘এই বাচ্চাটা যেভাবেই আসুক, সে তোমার পরিচয় নেবে না, কেন এটা নিয়া ভাবতেছ?’ তুষার বলল, ‘কিন্তু ওর কারণে তুমি চলে গেছ, তোমাকে তো চাই আমি!’ এবার সোহানার গলায় হতাশা, ‘তুমি কী চাও? আমি ওকে নষ্ট করে ফেলি?’ তুষার বলল, ‘না তা চাই না, শুধু বলো ও কীভাবে এসেছে!’ সোহানা বলল, ‘এখন ফোন রাখব, তুষার। বাই।’
অফিসে ঢুকতেই নতুন ছেলেটার সঙ্গে দেখা, হেসে সালাম দিল, বলল, ‘সাবলেটে একটা রুম খুজতেছি ভাইয়া, খোঁজ থাকলে জানায়েন।’ ‘আচ্ছা’ বলে নিজের টেবিলের দিকে যেতে যেতে অবাক হয়ে ভাবল, আমার রিপ্লেসমেন্ট আমার হেল্প চায়! টেবিলে বসতেই চা দিয়ে গেল। চায়ের মগে হাত দিতে না দিতেই মেরিনা আপা এসে বললেন, ‘একটু আমার সঙ্গে আস, নিচে যাই।’ তুষার বলল, ‘চা টা খেয়ে যাই?’ মাথা দুইদিকে নাড়লেন আপা, ‘না, আসো কফি খাওয়াবো।’ অফিসের নিচে নেমে পাশেই একটা কফিশপে বসল তারা। আপা নিজেই কফি নিয়ে এসে বসলেন, চিনি মিশিয়েও দিলেন। বললেন, ‘তুষার, আমি একটা অফিসে কথা বলে রাখছি, কাল সকালে যাবা, হয়ে যাবে।’ তুষার বলল, ‘কিন্তু আমার চাকরি ক্যান গেল, বলবেন না?’ আপা বললেন, ‘অফিস আমাকে বাজেট কমাতে বলছে, নতুন ছেলেটাকে খুব কম বেতনে পেয়ে গেছি।’ তুষার ধুম করে বলল, ‘কনডমে কি ফুটা থাকতে পারে?’ আপা কফির মগ ঠোঁটে তুলেছিলেন, হাত কেঁপে গেল, চুমুক না দিয়েই নামিয়ে রাখলেন, প্রাণপণ চেষ্টা করলেন স্বাভাবিক থাকতে, কফি ছাড়াই ঢোক গিলে বললেন, ‘সোহানা কোথায়?’ তুষার মনে মনে মেরিনা আপার বুদ্ধির প্রশংসা করল, বলল, ‘সোহানা বনশ্রী, মায়ের বাসায়।’ এর পরের প্রশ্ন তো রেডিই, ‘কবে গেছে?’ তুষার কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, ‘তিনমাস।’ ‘বিয়ে ভাঙতেছে তোমাদের?’ সরাসরি এই প্রশ্ন করলেন আপা। তুষার ভাবল, মানে এটা তাহলে বিয়ে ভাঙার মতোই গুরুতর ব্যপার? বলল, ‘আমিতো চাই না, সোহানা মনে হয় চায়।’ আপা বললেন, ‘ভাঙাই ভালো, তোমার মাথায় যদি এটা এসে থাকে, তাহলে একসঙ্গে থাকলে জটিলতা শুধু বাড়বেই।’ তারপরেই ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন, ‘চলো অফিসে যাই।’ কাল কোন অফিসে যেতে হবে সেটা নিয়ে আর কথা হল না।
অফিস থেকে বেরিয়ে আড্ডা দিয়ে রাত দশটার দিকে সে যখন বাসার গলিতে ঢুকল, তখন গলিটা অন্যদিনের চেয়ে ফাঁকা লাগল। ফার্মেসিতে বসে আছে ছেলেটা। তুষারকে দেখে বলল, ‘ঘুম হইছে ভাইজান?’ তুষার দোকানে উঠে গেল, বলল, ‘কাল কী হইছে রে?’ তুষার কালকের মতোই ফিসফিস করে বলল, ‘লোকটা আপনার বাসার ঠিকানা বইলা কোন বাসা জানবার চাইছিল, আমি কইছিলাম, হের পরে দোকান থাইকা রাস্তায় নামার লগে লগে শ্যাষ!’ লোকটা তার বাসা খুঁজেছিল এটা শুনে এত অবাক হল সে, তার গলা দিয়েও ফিসফিস বেরোল তখন—‘কী বলিস!’ ছেলেটা বলল, আইজ পুলিশ আর সাম্বাদিক আইছিল, আমি কাউরে আপনের নাম কই নাই।’
বাসায় এসে চাবি ঘোরাতে গিয়ে দেখল, খোলা, ভেতর থেকে বন্ধ। আবার অবাক হয়ে বেল বাজাল সে। দরজা খুলল সোহানা। খুশি হয়ে হড়বড় করে বলল, ‘তুমি কখন আইলা? আমার চাকরি তো চইলা গেছে! তুমি ছাড়া আর কে খাওয়াবে আমারে!’ সোহানাও হেসে বলল, ‘চাকরি গেল কেন?’ কিন্তু সে কথায় না গিয়ে তুষার বলল, ‘আচ্ছা ওই ডাক্তার আমার বাসার খোঁজ করছিল, জানো?’ সোহানার মুখটা কালো হয়ে গেল এবার, বলল, ‘আমার কলিগ বৃষ্টি আপা আছে না? ওনার হাজবেন্ড আতা ভাই। আমার মুড কেন সব সময় অফ সেটা নিয়ে কয়েকদিন আগে খুব চেপে ধরলেন বৃষ্টি আপা, আমি বলে ফেলেছিলাম, তুমি বলছ যিশু আসতেছে কিনা। তারপর আর জানি না যে উনি সেটা আতা ভাইকে বলেছেন, কাল আপা আতা ভাইকে পাঠাইছিলেন তোমার কাছে, বুঝিয়ে বলতে যে এমন হতে পারে। আজ বৃষ্টি আপা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ওকে কেউ মেরে ফেলতে পারে, বিশ্বাস হয়না আমার—মনে হয় অন্য কেউ ভেবে ভুল করে মেরেছে!’
তুষার চুপ হয়ে গেল, অনেকক্ষণ পরে বলল, ‘এটা কেমন হল, বলতো!’
সোহানা বলল, ‘আলট্রাসনোগ্রাফি করতে দিছিলাম, রিপোর্ট দিছে আজ, ওটা বেবি না টিউমার!’ সোহানাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল তুষার, ‘আয়াম সো স্যরি সোনা!’ তুষারকে জড়িয়ে ধরেই সোহানা বলল, ‘কিন্তু ডিভোর্স হবে, তোমার সঙ্গে থাকব না আমি’।
No comments