কলকাতায় ইহুদিদের তৈরি ঊনবিংশ শতকের সিনাগগগুলো দেখভাল করেছে মুসলমানরা by গৌরবিন্দর সিং
কলকাতার জনাকীর্ণ ও ব্যস্ত বাণিজ্যিক এলাকা ব্রাবোর্ন রোডে অবস্থিত নেভ শালোম সিনাগগটিকে খুঁজে পেতে কয়েক মিনিটের বেশি লাগবে না।
মুসলমানদের যত্নের মধ্যে থাকা এই সিনাগগ যেন মরিয়া হয়ে নিজের উপস্থিতি
জানান দেয়ার জন্য লড়াই করছে। এর আশপাশের ফুটপাথগুলো দখল করে নিয়েছে ঘিঞ্জি
দোকানপাট ও সারি সারি হকার। তার মাঝ দিয়ে একটি পায়ে চলা পথ গিয়ে পৌছেছে এই
জমকালো পরিকাঠামোর দোড়গোড়ায়। সারি সারি দোকানের কালো পলিথিনে মোড়া
চালাগুলোর কারণে কোন নবাগত দর্শকের পক্ষে এই ঐতিহ্যবাহী ভবনটির সৌন্দর্য
কল্পনা করা দ্বিগুণ কষ্টকর হয়ে পড়ে।
কলকাতায় ইহুদিদের যে তিনটি উপাসনালয় রয়েছে নেভ শালোম তার একটি। একই
কমপ্লেক্সের মধ্যে মাজেন ডেভিড (১৮৮৪ সালে নির্মিত) ও একটি দূরে বেথ এল
(১৮৫৬ সালে নির্মিত) সিনাগগ রয়েছে। দূর থেকে মাজেন ডেভিডকে কোন ক্লক টাওয়ার
বলে ভুল হতে পারে। তিনটির মধ্যে এটিকেই সেরা মনে হবে এবং এর অভ্যন্তরভাগ
পরিপাটি করে সাজানো।
সিনাগগটিকে মহাদেশীয় রূপ দিতে প্যারিস থেকে ছককাটা মার্বেলের তৈরি মেঝে,
ঝিলিক দেয়া ঝাড়বাতি, স্টেইনড গ্লাসের জানালা ও ফুলের অলংকৃত স্তম্ভ নিয়ে
আসা হয়েছে। সিনাগগের বেদিটির উপরে রয়েছে একটি তারকাখচিত অর্ধগম্বুজ। এটি
স্বর্গের প্রতীক। মাঝে একটি বড় ফলকে ‘টেন কমান্ডমেন্টস’ উৎকীর্ণ।
সিনাগগটিতে ইহুদি আইকনোগ্রাফির বিভিন্ন প্রতীকের সঙ্গে কিছু হিব্রু
লিপিও উৎকীর্ণ রয়েছে। এর মধ্যে আছে মেনোরাহ’র সাত শাখাওয়ালা বাতিদানি।
বেদির উল্টোদিকে দেয়ালের উপরের ভাগটি চমৎকার গোলাকার স্টেইনড গ্লাসে মোড়া।
হলঘরের দুদিক থেকে দুটি সিড়ি উপরের বেলকনির দিকে উঠে গেছে। এই জায়গাটি শুধু
মহিলাদের জন্য। অন্য দুটি সিনাগগও একইরকম মনোমুগ্ধকর।
মজার বিষয় হলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ইহুদিদের এই উপাসনালয়গুলো
দেখভাল করছে মুসলমানরা। অনেকটা গর্বের সঙ্গে সিরাজ খান (৫০) বলেন, অনেক
প্রজন্ম ধরে আমার পরিবার এখানে আছে। আমার বাবা, দাদাও এই সিনাগগের দেখভাল
করেছে। দুই দশকের বেশি সময় আমি এখানে কাজ করছি। ইহুদি সম্প্রদায়ের জন্য কাজ
করতে পারা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। আমরা মানি আল্লাহ এক এবং কাজের
মাধ্যমে আমরা তার এবাদত করছি।
এই নগরীর সঙ্গে ইহুদিদের সম্পর্ক দুই শতকের পুরনো। রঞ্জন দত্ত নামে এক
ইতিহাসপ্রেমী ও ব্লগার কোলকাতায় ইহুদিদের আগমনের উপর আলোকপাত করেছেন।
কলকাতার ইহুদিদের উপর তার লেখা বেশ কিছু ব্লগ রয়েছে। তিনি বলেন, ব্রিটিশ
আমলে এই শহর ছিলো রাজধানী এবং দেশের বাণিজ্যিক কেন্দ্র। ইহুদিসহ বহু বনিক
গোষ্ঠী এখানে বাণিজ্য সুযোগের অনুসন্ধান করতে এসেছে। রেকর্ডে দেখা যায়,
কলকাতায় প্রথম ইহুদি অভিবাসী হিসেবে আগমন ঘটে শালোম আহারন ওবাদিয়াহ কোহেন
নামে আলেপ্পোর এক অধিবাসীর। ১৭৬২ সালে বর্তমান সিরিয়া অঞ্চলে তার জন্ম।
১৭৯৩ সালে সুরাট বন্দরে এসে নিজেকে একজন বনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। পরে
১৭৯৮ সালে কলকাতায় চলে আসেন। শালোমকে কলকাতায় ইহুদি সম্প্রদায়ের
প্রতিষ্ঠাতা বলা যেতে পারে।
দত্ত বলেন, ইরাক থেকে এখানে এসে বসতিস্থাপনকারী ইহুদিদের বাগদাদি ইহুদি
বলা হতো। ব্রিটিশ শাসনামলে তারা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দখল করতে শুরু
করে। শেরিফ ও মেজিস্ট্রেট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে। তাদের অনেকে
সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। ইহুদি নারীরাও শিক্ষিত ছিলো এবং কর্মক্ষেত্রে ছিলো
উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। তাদের অনেকে ডাক্তার ও শিক্ষক ছিলো। ইহুদি সম্প্রদায়
বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা সিনাগগ ও অন্যান্য চোখে পড়ার মতো ভবন তৈরি করে
নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে থাকে।
অল্প দিনের মধ্যেই ইহুদিরা নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে সক্ষম হয়। যদিও
কলকাতায় আসা বিদেশী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে তারা সবার শেষে আসে। একসময়
কলকাতায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার ইহুদি ছিলো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই সংখ্যা
ব্যাপকভাবে কমে গেছে। এখন মাত্র ২০ জনে এসে ঠেকেছে। এদের বেশিরভাগ বৃদ্ধ ও
অক্ষম।
বেশিরভাগ ইহুদি ইসরাইল বা অন্যান্য দেশে চলে গেছে। কিন্তু কলকাতাকেই
নিজের আবাস বলে মনে করেন ৮৯ বছর বয়সী ফ্লাওয়ার সিলিম্যান। তিনি এখানেই থেকে
গেছেন। অশিতিপর এই মানুষটি বলেন, এই শহরেই আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বহু বছর
আমি শিক্ষকতা করেছি। কলকাতাই আমার বাড়ি এখানে আমার অনেক বন্ধু রয়েছে।
বয়স ছাড়া মনোবলের অভাব নেই তার, আন্তরিকতাও প্রচুর।
তার মেয়ে ড. জায়েল কলকাতার ইহুদি সম্প্রদায়ের জন্য
নিবেদিত একটি ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরি করেছেন।
(http://www.jewishcalcutta.in/) সাইটটিতে ইহুদিদের আগমন এবং এই নগরে তাদের
অবদান নিয়ে চিত্তাকর্ষক সব বিবরণ। কলকাতার বর্তমান ইহুদিদের মধ্যে তার
বয়সই সবেচেয়ে কম, ৬৩ বছর। তিনি বলেন, কলকাতার ঐতিহ্য সমৃদ্ধ করতে ইহুদিরা
যে অবদান রেখেছে তা তুলে ধরা জরুরি ছিলো। এই আর্কাইভ গড়ে তোলার পেছনে আমার
মায়ের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বিশ্বব্যাপী তার নেটওয়ার্ক কাজে লেগেছে।
কলকাতার অবশিষ্ট ইহুদিদের জন্য ‘মারা যাচ্ছে’ শব্দটি ব্যবহার করতে জায়েল
নারাজ। তিনি বলেন, আমরা মরছি না, স্থানান্তরিত হচ্ছি। এই নগরিতে যারা
ছিলেন তাদের হৃদয়ে সবসময় কলকাতার নাম থাকবে। আমরা অবস্থান পরিবর্তন করছি
মাত্র।
ভারতের স্বাধীনতা ও ইসরাইল রাষ্ট্রের সৃষ্টিকে কলকাতা থেকে ইহুদিদের চলে
যাওয়ার পেছনে কারণ বলে মনে করেন জায়েল। তার মতে, স্বাধীনতার পর কলকাতা
থেকে ইহুদিদের চলে যাওয়ার পেছনে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক অনেক কারণ রয়েছে।
ব্রিটিশদের ভারত থেকে চলে যাওয়া যখন স্পষ্ট হয়ে উঠলো তখন অনেকে উদ্বিগ্ন
হয়ে পড়ে এই দেশ কোন পথে এগিয়ে যায়, তা নিয়ে। একজন দুজন করে যখন যাওয়া শুরু
করে তখন অন্যরাও দ্রুত তাদের পথ অনুসরণ করে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্রের
জন্মও ছিলো আরেকটি কারণ। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র
থেকেও ইহুদিরা সেখানে গিয়েছে।
কলকাতায় প্রতিবছরই ইহুদি জনসংখ্যা কমছে। ২০১৮ সালে এই সম্প্রদায়ের তিন
সদস্য মারা যান। তাদেরকে কলকাতার ফুলবাগান এলাকায় নারকেলডাঙ্গা মেইন রোডের
পাশে ইহুদি সমাধিক্ষেত্রে সমাহিত করা হয়েছে। এই সামধিক্ষেত্রটি ১৮১২ সালে
তৈরি। এখানে সাত হাজারের বেশি গোর রয়েছে। এর কাছাকাছি থাকেন এমন এক
রাজমিস্ত্রি নেফাজুদ্দিন (৪০) বলেন, এখানে ৭,৫৪৪টি গোর রয়েছে। এর মধ্যে
৮৪৪টি শিশুর। গত বছর তিন বৃদ্ধা মারা গেলে তাদেরকেও এখানে সমাহিত করা হয়।
নিজেদের পূর্বপুরুষদের সমাধি দেখতে মাঝে মধ্যে বিদেশ থেকেও আসেন অনেকে ।
সিনাগগগুলোর পাশাপাশি ২০১৭ সালে এই সমাধিক্ষেত্রের সংস্কার কাজ শুরু হয়।
এতে পাকা পায়েচলা পথ তৈরি ও নতুন করে চুনকাম করা হয়। নেফাজুদ্দিন বলেন,
কয়েক বছর আগে তিনি যখন এখানে আসেন তখন সমাধিক্ষেত্রের চেহারা অন্যরকম ছিলো।
পায়েচলা পথগুলো জঙ্গলে ঢাকা ছিলো। সেখানে প্রবেশের উপায় ছিলো না। বড় বড়
গাছের শেকড় পুরনো কবরগুলো ভেঙ্গে ফেলে। সেগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। কবরের
ফলকগুলো নতুন করা হয়েছে যেন মানুষ সহজে তা খুঁজে পায়।
সমাধিতে প্রবেশের জন্য ইহুদি সম্প্রদায়ের অফিস থেকে অনুমতি গ্রহণের প্রয়োজন হয়।
সিনাগগ ও সমাধি ছাড়াও পার্ক স্টিটে জিউস গার্লস স্কুল ও কোলকাতার
কেন্দ্রস্থলে এসপ্লানেড ম্যানসন এই শহরে ইহুদিদের অবদানকে মনে করিয়ে দেয়।
ইহুদি শিশুদের জন্য ১৮৮১ সালের ১৮ জানুয়ারি স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০’র
দশকে সব সম্প্রদায়ের জন্য স্কুলটি খুলে দেয়া হয়। এখন সেখানে কোন ইহুদি
শিক্ষার্থী বা শিক্ষক নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্কুলের এক স্টাফ বলেন,
এখানে ১,৫০০-এর মতো শিক্ষার্থী রয়েছে। এদের ৯৫% সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো
থেকে আসা। কোন ইহুদি শিক্ষার্থী বা শিক্ষক নেই।
কলকাতায় ইহুদিরা যেসব ব্যবসা শুরু করেছিলো তার একটি ছিলো বেকারি।
এসপ্লানেডের কাছে নিউ মার্কেটের নোহুম এন্ড সন্স বেকারি ১১৬ বছর ধরে
সুস্বাদু খাবার তৈরি করছে। ১৯০২ সালে এক বাগদাদি ইহুদি নোহুম ইসরাইল
মোরদেশাই এই বেকারি প্রতিষ্ঠা করেন। এই বেকারির সাজসজ্জা শুরু থেকে একই রকম
রয়েছে। পুরনো দিনের স্মৃতিবাহী কাঠের ক্যাশবক্সটি এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে।
সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠান ক্রেডিট/ডেভিট কার্ড গ্রহণ করা শুরু করেছে।
কলকাতার ইহুদিদের তৈরি এসপ্লানেড ম্যানসন |
No comments