এইচ এম এরশাদের অনন্য আখ্যান by আফসান চৌধুরী
সাবেক
প্রেসিডেন্ট এইচ. এম. এরশাদ দীর্ঘদিন ধরে রোগে ভুগছিলেন এবং তার মৃত্যুর
বিষয়টি কোন আকস্মিক বিষয় ছিল না। তার মৃত্যুতে শোকের উচ্ছ্বাসও তেমন ছিল
না, কারণ সেই অর্থে কোন জনপ্রিয় নেতা তিনি ছিলেন না। সময় বদলেছে, মিডিয়া
তার কীর্তিগাথা প্রচার না করলেও তার শেষকৃত্যের খবর প্রচার করেছে। শেষ
বিচারে তিনি যদি নাও জিতে থাকেন, তার শত্রুতাও সে ক্ষেত্রে জেতেনি এবং যে
সড়কগুলো তাকে পদচ্যুত করার জন্য জ্বলে উঠেছিল একদিন, সেটা অন্য যে কোন
সময়ের চেয়ে মৃতপ্রায় পড়ে আছে এখন।
বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণী তাকে স্বৈরাচার, দুর্নীতিগ্রস্ত, নারীঘেঁষা বিভিন্ন বিশেষণে ডেকেছেন, যেগুলোর এখন আর তেমন মূল্য নেই কারণ বহু ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাই এখন একই রকম, সবাই সেটা জানেন। ইতিহাসে এরশাদের একটা জায়গা রয়েছে। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন তিনি, যে সময়টাতে বিশেষ করে রাজনীতিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটা স্বল্পমেয়াদি উত্থান ও পতনও দেখা গেছে।
এরশাদ বিচারপতি সাত্তারের নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেছিলেন যখন প্রেসিডেন্ট জিয়ার হত্যাকাণ্ডের পর একটা টালমাটাল অবস্থা চলছিল। এরশাদ ক্যু দমন করেছিলেন যদিও বিএনপি পরে জিয়া হত্যার জন্য এরশাদকে দায়ি করেছিল।
কিন্তু বিএনপি এরপরে খুব বেশি স্থায়ী হয়নি এবং শিগগিরই এরশাদ প্রথম রক্তপাতহীন ক্যু-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসেন। তাকে ক্ষমতা থেকে চলে যেতে হয় নাটকীয় একটা পরিস্থিতির মধ্যে যখন মূলত শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নেতৃত্বে মহাসড়কে আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছিল। যে দশকটাকে তিনি শাসন করেছেন, তখন অভিজাত শ্রেণীর ক্ষমতা ভাগাভাগির একটা ফর্মূলাও তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন, যেটা আজ পর্যন্ত টিকে আছে।
এই বিনিময়ের একটা অংশ ছিলেন তিনি।
এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের রাজনীতির শুরুতে বেসামরিক রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বাধীন শাসন ব্যবস্থা ছিল, ১৯৭৫ সালে একদলীয় শাসন প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে যেটার পরিবর্তন শুরু হয়। এই পদক্ষেপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল বেসামরিক ও সামরিক আমলাদের রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করা।
পরবর্তী ধাপের সূচনা হয় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে, শেখ মুজিবের হত্যা এবং সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের পরে। এটা শুধু তার নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ছিল না, বরং রাজনৈতিক সিস্টেমের বাইরের খোলসের আড়ালে যে সহিংসতার বীজ লুকিয়ে ছিল, সেটারই প্রকাশ হয়েছিল এই সময়।
জিয়ার আমলে বেশ কিছু সামরিক ক্যু প্রচেষ্টা এবং কতিপয় রাজনৈতিক গ্রুপকে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। এই সময়টাতেই রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক সিস্টেমকে ব্যবহার করে সম্পদ তৈরির যুগ শুরু হয়। এই সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো প্রাইভেট ব্যাংকের উত্থান। ১৯৭১ সালের এক দশকের মধ্যে, বহু মানুষের একটা প্রাইভেট ব্যাংক চালুর মতো অর্থ জমে গিয়েছিল, যাদের অধিকাংশেরই অবস্থা ছিল করুণ।
ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ছিল বিশাল এবং উদারভাবে সেটা দেয়া হয়েছে এবং সেটা আসলে শোধ দেয়ার কথা ভাবাও হয়নি। যারা আওয়ামী লীগের সময় এই যাত্রায় অংশ নিতে পারেনি, তারা দ্রুত পরের ট্রেনে সওয়ার হয়ে গেছেন। উচ্চবিত্ত শ্রেণী ততদিনে প্রধান জায়গাগুলোতে নিজেদের ক্ষমতা সংহত করতে শুরু করেছে। কিন্তু ক্ষমতার আধিপত্য সেভাবে বেসামরিক ব্যক্তিদের হাতে ছিল না, তা বেসামরিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যতই বিকাশ ঘটুক। জিয়ার আমলে সামরিক বাহিনীর মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব জোরালো ছিল এবং ক্ষমতার লড়াইও যথারীতি বজায় ছিল।
একটি বাদে এই সব বাধাগুলোই পার করেছিলেন জিয়া, কিন্তু তার সেনা সহকর্মীদের একটি গ্রুপের হাতে পতন হয় তার। হঠাৎই সবদিক ভেঙে পড়তে শুরু করে। দুর্বল প্রেসিডেন্ট সাত্তারের অধীনস্ত বিএনপি সরকারকে নিয়ন্ত্রণহীন মনে হতে থাকে। যতই দিন যাচ্ছিল, চারপাশের বলশালী ব্যক্তিদের মধ্যে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এরশাদের অবস্থান তত জোরালো হয়ে উঠছিল।
রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় নিপতিত বিএনপি – যারা তাদের ক্যারিশম্যাটিক নেতা জিয়ার অভাব বোধ করছিল তীব্রভাবে – তাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করেন জেনারেল এরশাদ, যিনি জিয়া হত্যার ঘটনাটি সামলে একটা নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে এনেছিলেন। ক্যু-এর নেতা জিয়ার নেতৃত্বে একটা বেসামরিক শাসনামলের অবসানের পর ব্যারাক থেকে আরেকজন নেতা উঠে এসে দেশের দায়িত্ব নিলেন। পরে তিনিও অনেকটা বেসামরিক রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছিলেন।
সরকার ও প্রতিরোধ
বহু প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসেন এরশাদ। এর মধ্যে কিছু তিনি পূর্ণ করেছিলেন, বহু কিছু পূর্ণ করতে পারেননি, কিন্তু রাষ্ট্রীয় সিস্টেমের অধীনে ধনিক শ্রেণীর উত্থান অব্যাহত থাকে। তবে, এরশাদের মিত্রদের সম্পদ বৃদ্ধির সাথে সাথে এরশাদ তার বেসামরিক রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি (জেপি) গঠন করেন। তবে বেসামরিক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পক্ষ থেকে তখন রাজনৈতিক প্রতিরোধ বাড়তে থাকে, যারা তখন ক্ষমতা থেকে বহু দূরে ছিলেন। এর অর্থ হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণীরও উত্থান হচ্ছিল।
এরশাদ বল প্রয়োগে বিএনপিকে সরিয়ে দিয়েছিলেন এবং তার ক্ষমতা গ্রহণকে হালাল করতে তিনি তাদেরকে ছুড়ে ফেলেছিলেন। বিএনপি তাদের শক্তি ফিরিয়ে আনে এবং একটা আন্দোলন গড়ে তোলে যেটা ছিল অনমনীয় এবং ক্রমেই সেটার শক্তি বাড়তে থাকে। অনেকেই বলেছিলেন যে, প্রেসিডেন্ট জিয়ার বিধবা স্ত্রী হিসেবে সেনাবাহিনীতে খালেদা জিয়ার সমর্থক ছিল কিন্তু যে দিন তিনি এরশাদের বিরোধিতা শুরু করলেন, সেদিন থেকে তার জনসমর্থনও বাড়তে শুরু করলো।
আওয়ামী লীগ সতর্কভাবে বিরোধিতা করেছিল এবং মেপে মেপে পদক্ষেপ নিয়েছিলো তারা কারণ তারা চায়নি যে বিএনপি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসুক। এরশাদ আর বিএনপি উভয়কেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিবেচনা করেছিল তারা।
রাজনৈতিকভাবে জিয়ার অনুকরণ করেছিলেন এরশাদ – জেপি থেকে বিএনপি – কিন্তু সময় বদলে গিয়েছিল। ১৯৮৬ সালের নির্বাচন বিএনপি বয়কট করলেও আওয়ামী লীগ তাতে অংশ নিয়েছিল এবং সেখানেই বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তবতাটা উঠে এসেছিল। এর অর্থ হলো কারো না কারো সাথে জোট গড়তে হবে। এর আরেকটা অর্থ হলো বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ যদি একজোট না হতো, জাতীয় পার্টি এবং এরশাদ তাহলে দীর্ঘসময় টিকে যেতেন।
মধ্যবিত্তের উত্থান?
এই সময়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আকাঙ্ক্ষার উত্থান, যারা বিপুল অর্থের উপর নির্ভর করে এসেছিল, যেটা ততদিনে যথেষ্ট বেড়ে গেছে। এর একটা সূচক হলো প্রাইভেট মিডিয়ার উত্থান, যার অর্থ হলো বিকাশমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে ভাড়া করার মতো অর্থ জমে গেছে ততদিনে। এই গ্রুপ আকারে বিশাল নয় এবং তারা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণও করে না কিন্তু তারা সরব এবং তাদের উপস্থিতি জানান দিয়েছে। তারা রাস্তায় নামার সাহস অর্জন করেছিল এবং সেটাই ছিল মূল বিষয়। শিক্ষিত ও সাহসী, অনেকেই এসেছিলেন ঢাকার বাইরে থেকে, তারা এমন একটা স্টাইল তুলে ধরলেন, যেটা নতুন আগ্রাসী শ্রেণীর জানান দিচ্ছিল।
এটা সত্যি যে বহু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংস্কৃতিবাদী একটা নির্ভরশীলতার চরিত্র গড়ে তুলেছিলেন, যেখানে তারা নিজেদের প্রকল্পের জন্য নব্য ধনিক শ্রেণীর উপর নির্ভর করতেন, কিন্তু এরশাদ এই দুই পক্ষের সাথেই খেলেছেন। তিনি কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে শুরু করেন, বিশেষ করে প্রথাগত অভিজাত প্রভাবের বাইরে, কিন্তু তিনি বাংলাদেশী ধারাটা ভালোই বুঝতেন বলে মনে হয়। তিনি সব পক্ষকেই প্রশ্রয় দিতেন।
একদিকে যখন তিনি কবিদের পিঠ চাপড়াচ্ছেন, অন্যদিকে তখন তাকে ঘন ঘন ওয়াজ মাহফিলে দেখা যাচ্ছিল এবং তিনি মাওলানাদের ঘনিষ্ঠ হয়ে ইসলামকে এমনকি রাষ্ট্রীয় ধর্মও ঘোষণা দিয়ে দিলেন। উভয় পক্ষেই তার বন্ধু ও শত্রু জন্মালো কিন্তু তিনি সজিবভাবে টিকে থাকলেন। আর এরপর আসলো আটরশির পীরের প্রসঙ্গ।
আটরশির পীর + ঢাকার সুন্দরী রমনীরা
আটরশির পীর তার ‘অলৌকিক শক্তি’ দিয়ে বাংলাদেশের বহু মানুষকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিলেন, যখনই এটা জানা গেলো যে এরশাদ তার একজন ‘মুরিদ’। হাজার হাজার মানুষ তখন আটরশির কাছে যেতে শুরু করলো। এরশাদের পদক্ষেপ ছিল অসাধারণ, সচেতনে হোক বা অচেতনে, তিনি জানতেন যে, বাংলাদেশের মানুষ পীরদের ভালোবাসেন এবং সে কারণে তাকেও সবাই ‘শ্রদ্ধা’ করবে, এমনকি মুরিদ হিসেবে তাকে হয়তো ভক্তিও করবে।
অবশ্যই, কিছু লোক আটরশির কাছে এ কারণে যেতেন যে, ওখানে এরশাদ (পড়ুন ক্ষমতা) যান এবং এ কারণে সেটা প্রভাব বিস্তারের একটা বিশাল নেটওয়ার্ক হয়ে ওঠে। কিন্তু পীরের অনুসারীরা সবাই সুবিধাবাদী ছিল না। অনেকেই ছিলেন শুদ্ধবাদী এবং এদের মধ্যে অনেক সাংবাদিকও ছিলেন, তা যে ভাবনা থেকেই সেখানে তারা যান না কেন। এরশাদ যখন সরে গেলেন, তখন পীরের প্রভাবও কমে গেলো যদিও তার তখনও বহু অনুসারী ছিল।
এরশাদের আশেপাশে বহু নারীও ছিল, তা নিজে তিনি যতবার বিয়েই করুন না কেন। যেটা মূল বিষয়, সেটা হলো তার আশেপাশে বহু নারী ছিল যারা তাকে ভালোবাসতো, এদের প্রায় সবাই সুন্দরী ও বিবাহিতা। ক্ষমতা নিঃসন্দেহে একটা শক্তিশালী আসক্তির বিষয় এবং এর বাইরে তিনি কবিতাও লিখতেন। যদিও কবিতাগুলো অত ভালো ছিল না তবে গুজব শোনা গেছে যে, অনেক ভালো কবি তার হয়ে কবিতা লিখে দিতেন।
তাই সেনাবাহিনীর সাথে সাথে ধনী এবং নারীরাও তার পেছনে ছিল এবং কবিদের একটা অংশও তার সাথে ছিল। এরশাদের আর উদ্বিগ্ন হওয়ার কি ছিল? একটা ভুল তিনি করেছিলেন। সেটা হলো দুই নারীর নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক শ্রেণীকে তাদের গণআন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষমতাকে তিনি যথেষ্ট গুরুত্ব দেননি।
দুই নারীর সম্মিলন
এরশাদ বহু শিক্ষার্থীদের প্রলুব্ধ করেছিলেন – যেটা মধ্যবিত্তের শক্তির আঁতুরঘর, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। এই মানুষেরা খালেদা এবং হাসিনার মধ্যে শক্তি দেখতে পেয়েছিলেন – এই দুই রাজনীতিবিদের সেই ক্ষমতা ছিল যার শক্তিতে তারা সড়কে আশাবাদী তরুণদের দিয়ে ভর্তি করে দিতে পারতেন। তাদের সেই ক্যারিশমা ছিল যার বলে তারা আন্দোলনের রাজপথে সবাইকে নিয়ে আসতে পারতেন। প্রাথমিক অনীহার পর, হাসিনা খালেদার সাথে জোট গড়তে সম্মত হন, যার নিজেরও একই রকম অনীহা ছিল। কিন্তু রাজনীতিতে যখন দুজন এক হলেন, তাদের সাথে প্রায় ৮০% মানুষের জনসমর্থন ছিল, তখন এরশাদের তাসের ঘর টলতে শুরু করলো।
অবশ্যই, এরশাদ তার সবচেয়ে বড় শক্তি সেনাবাহিনীর উপর নির্ভর করতে চেষ্টা করলো কিন্তু সেনাবাহিনী তাকে সমর্থন দিতে অস্বীকার করলো। তারা তখন একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভূমিকা রাখছিল এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে আগ্রহী ছিল না। এরশাদ একসময় তাদের প্রতিনিধিত্ব করতেন ঠিক কিন্তু তখন তিনি আরেকজন রাজনীতিবিদ মাত্র। জনগণের বা প্রাতিষ্ঠানিক কোন সমর্থন না থাকায়, সবাই যখন তার পতনের জন্য একত্রিত হলো, এরশাদের তখন পতন হলো। ১৯৯০ সালের শেষটা তার জন্য সবচেয়ে নিষ্প্রভ সময় এর এরপর তাকে জেলে যেতে হলো।
পালাবদলের ধারা?
তার শাসনামলের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা কি?
ক্ষমতার ভিত্তিতে বেসামরিক ও সামরিক শক্তির মধ্যে সঙ্ঘাতের তীব্রতাও কমে গেছে। বরং সেনাবাহিনী যখন এরশাদের পক্ষে ভূমিকা রাখতে অস্বীকার করলো, তখন উভয় শক্তির মধ্যে একটা জোট গঠন প্রায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে গেলো। এরশাদ বা জিয়া যখন ক্ষমতায় আসেন, ১৯৯০ সালের পরিস্থিতি ছিল তার চেয়ে আলাদা। এই শিক্ষাটা ২০০৬ সালে সাময়িকভাবে ভুলে যাওয়া হয়েছিল কিন্তু যখন লক্ষণগুলো বোঝা গেলো যে এক পক্ষে থাকলেই সেটা ভালো কাজ করবে, তখন সামরিক বাহিনী নির্বাচন দিয়ে ২০০৮ সালে সরে গেলো।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগ – এই দুই দলের হাতে ছিল ক্ষমতার চাবিকাঠি এবং তারা একত্র হলো তারা অন্য যে কোন বেসামরিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারতো। পরিস্থিতি এখন বদলে গেছে। বিএনপি ব্যাপকভাবে দুর্বল হয়ে গেছে এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন শ্রেণীর সব পক্ষের মতামত নিয়ে ক্ষমতা চালানোর একটা নীতি মেনে চলছে। বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে যে অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত ছিল, সেটা অধিকাংশই চলে গেছে।
রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে একত্র হতে পারতেন কিন্তু তারা রাজনৈতিক কাঠামোটাকে বদলাতে চাননি, যেটা করতে হলে পরিবর্তিত রাজনীতির সাথে মিল রেখে প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠনের প্রয়োজন হতো। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, যেটা ২০০৬ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল, কিন্তু বিএনপি যখন এটাকে ব্যবহারের চেষ্টা করলো, তখন আন্দোলন ও সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তাদের পতন হলো। পরে আওয়ামী লীগ এটাকে বাতিল করে অন্যদের চাপ দেয়ার শক্তিকে কঠিন করে দিলো কারণ জোটগুলো কোন সঙ্ঘাত চায়নি।
সামরিক বাহিনীও এটা শিখেছে যে, একতরফা সেনা শাসনের সময় চলে গেছে। তারা জিয়া-এরশাদ মডেলের বাইরেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং বেসামরিক সরকারের সহায়তা নিয়ে বিকশিত হওয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। সামরিক বাহিনীর ভেতর থেকে এসে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মতো দল গঠনের সময়ও চলে গেছে। মইন-ফখরু সরকার যে দল গঠনের চেষ্টা করেছিল, সেটা কখনই কাজ করেনি।
আর মধ্যবিত্তের কি হলো?
১৯৯০ সালে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সময় ছিল যখন তারা এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং ২০০৬-০৮ সালে এরাই সামরিক শাসনের বিরোধিতা করে, কিন্তু আর কখনই তারা আলোচনায় আসতে পারেনি। এখন তারা আগের যে কোন সময়ের চেয়ে শক্তিহীন এবং ক্ষমতাসীন শ্রেণী এখন খুব ভালো করে বুঝে গেছে, কিভাবে তাদের ক্ষমতা ও আকাঙ্ক্ষাকে টিকিয়ে রাখতে হয়।
রাজনৈতিক দলগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং আওয়ামী লীগ নিজেকে ক্ষমতাসীন আরও আস্থাশীল প্রতিনিধি হিসেবে গড়ে তুলেছে, যতটা বিএনপি পারেনি। ক্ষমতাসীন শাসকশ্রেণী এখন একটা জোটের সমন্বয় যাদের শীর্ষে রয়েছে সশস্ত্র বাহিনী, এর পরেই রয়েছে ব্যবসায়ী শ্রেণী, এরপরে বেসামরিক আমলা এবং সবশেষে রাজনীতিবিদরা। এই সমীকরণে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কোন স্থান নেই।
এরশাদ কি শেষ হাসি হেসেছেন
এক হিসেবে দেখলে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীই এক দশক ধরে জেগে উঠেছিল এবং এরশাদ পতনে নেতৃত্ব দিয়ে আবার নিজেরাই হারিয়ে গেছে। কবি, চিত্রশিল্পী এবং অধিকার কর্মীরা তখন গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। এখন তাদের আর গুরুত্ব নেই এবং কেবল দলীয় ক্যাডারদের গুরুত্ব রয়েছে। এরশাদের সময় যেমনটা ছিল, সমাজ এখন তার চেয়েও বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং বিশৃঙ্খল, কিন্তু তাতে আর কিছু যায় আসে না। মানুষ এখন যেভাবে বাস করে, ভালোবাসে এবং অর্থ উপার্জন করে, সেটাতে মানুষ আর হতবাক হয় না।
এরশাদ বহু বছর জেলে কাটিয়েছেন, কখনই পূর্ণ ক্ষমতা ফিরে পাননি কিন্তু আওয়ালী লীগের সাথে জোট করে ক্ষমতার কাছাকাছি থেকেছেন এবং আওয়ামী লীগের প্রকল্পে সহযোগির ভূমিকা পালন করেছেন। কেউ কেউ এখনও তাকে ‘স্বৈরাচার এরশাদ’ বলে থাকেন কিন্তু এটা এখন অর্থহীন হয়ে গেছে। প্রায় এক দশক ক্ষমতাসীন দলের মিত্র ছিলেন তিনি এবং তারা তাকে ব্যবহার করেছে।
শেষ পর্যন্ত এরশাদ তার প্রতিশোধটা নিতে পেরেছেন বা শেষ হাসি হেসেছেন। তিনি আসলে কখনই হারিয়ে যাননি এবং তার মৃত্যুর সময় প্রধানমন্ত্রী শোকবার্তা দিয়েছেন যিনি তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলন করেছিলেন। আর এদিকে মধ্যবিত্তি শ্রেণী বিশেষ করে এর শহুরে অংশটি আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি চাপে আছে। তাই সব মিলিয়ে একটা রূপকথার পরিণতি বা অপরিণতি ঘটলো, তা যেটাই বলুন না কেন।
বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণী তাকে স্বৈরাচার, দুর্নীতিগ্রস্ত, নারীঘেঁষা বিভিন্ন বিশেষণে ডেকেছেন, যেগুলোর এখন আর তেমন মূল্য নেই কারণ বহু ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাই এখন একই রকম, সবাই সেটা জানেন। ইতিহাসে এরশাদের একটা জায়গা রয়েছে। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন তিনি, যে সময়টাতে বিশেষ করে রাজনীতিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটা স্বল্পমেয়াদি উত্থান ও পতনও দেখা গেছে।
এরশাদ বিচারপতি সাত্তারের নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেছিলেন যখন প্রেসিডেন্ট জিয়ার হত্যাকাণ্ডের পর একটা টালমাটাল অবস্থা চলছিল। এরশাদ ক্যু দমন করেছিলেন যদিও বিএনপি পরে জিয়া হত্যার জন্য এরশাদকে দায়ি করেছিল।
কিন্তু বিএনপি এরপরে খুব বেশি স্থায়ী হয়নি এবং শিগগিরই এরশাদ প্রথম রক্তপাতহীন ক্যু-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসেন। তাকে ক্ষমতা থেকে চলে যেতে হয় নাটকীয় একটা পরিস্থিতির মধ্যে যখন মূলত শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নেতৃত্বে মহাসড়কে আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছিল। যে দশকটাকে তিনি শাসন করেছেন, তখন অভিজাত শ্রেণীর ক্ষমতা ভাগাভাগির একটা ফর্মূলাও তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন, যেটা আজ পর্যন্ত টিকে আছে।
এই বিনিময়ের একটা অংশ ছিলেন তিনি।
এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের রাজনীতির শুরুতে বেসামরিক রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বাধীন শাসন ব্যবস্থা ছিল, ১৯৭৫ সালে একদলীয় শাসন প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে যেটার পরিবর্তন শুরু হয়। এই পদক্ষেপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল বেসামরিক ও সামরিক আমলাদের রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করা।
পরবর্তী ধাপের সূচনা হয় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে, শেখ মুজিবের হত্যা এবং সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের পরে। এটা শুধু তার নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ছিল না, বরং রাজনৈতিক সিস্টেমের বাইরের খোলসের আড়ালে যে সহিংসতার বীজ লুকিয়ে ছিল, সেটারই প্রকাশ হয়েছিল এই সময়।
জিয়ার আমলে বেশ কিছু সামরিক ক্যু প্রচেষ্টা এবং কতিপয় রাজনৈতিক গ্রুপকে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। এই সময়টাতেই রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক সিস্টেমকে ব্যবহার করে সম্পদ তৈরির যুগ শুরু হয়। এই সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো প্রাইভেট ব্যাংকের উত্থান। ১৯৭১ সালের এক দশকের মধ্যে, বহু মানুষের একটা প্রাইভেট ব্যাংক চালুর মতো অর্থ জমে গিয়েছিল, যাদের অধিকাংশেরই অবস্থা ছিল করুণ।
ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ছিল বিশাল এবং উদারভাবে সেটা দেয়া হয়েছে এবং সেটা আসলে শোধ দেয়ার কথা ভাবাও হয়নি। যারা আওয়ামী লীগের সময় এই যাত্রায় অংশ নিতে পারেনি, তারা দ্রুত পরের ট্রেনে সওয়ার হয়ে গেছেন। উচ্চবিত্ত শ্রেণী ততদিনে প্রধান জায়গাগুলোতে নিজেদের ক্ষমতা সংহত করতে শুরু করেছে। কিন্তু ক্ষমতার আধিপত্য সেভাবে বেসামরিক ব্যক্তিদের হাতে ছিল না, তা বেসামরিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যতই বিকাশ ঘটুক। জিয়ার আমলে সামরিক বাহিনীর মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব জোরালো ছিল এবং ক্ষমতার লড়াইও যথারীতি বজায় ছিল।
একটি বাদে এই সব বাধাগুলোই পার করেছিলেন জিয়া, কিন্তু তার সেনা সহকর্মীদের একটি গ্রুপের হাতে পতন হয় তার। হঠাৎই সবদিক ভেঙে পড়তে শুরু করে। দুর্বল প্রেসিডেন্ট সাত্তারের অধীনস্ত বিএনপি সরকারকে নিয়ন্ত্রণহীন মনে হতে থাকে। যতই দিন যাচ্ছিল, চারপাশের বলশালী ব্যক্তিদের মধ্যে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এরশাদের অবস্থান তত জোরালো হয়ে উঠছিল।
রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় নিপতিত বিএনপি – যারা তাদের ক্যারিশম্যাটিক নেতা জিয়ার অভাব বোধ করছিল তীব্রভাবে – তাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করেন জেনারেল এরশাদ, যিনি জিয়া হত্যার ঘটনাটি সামলে একটা নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে এনেছিলেন। ক্যু-এর নেতা জিয়ার নেতৃত্বে একটা বেসামরিক শাসনামলের অবসানের পর ব্যারাক থেকে আরেকজন নেতা উঠে এসে দেশের দায়িত্ব নিলেন। পরে তিনিও অনেকটা বেসামরিক রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছিলেন।
সরকার ও প্রতিরোধ
বহু প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসেন এরশাদ। এর মধ্যে কিছু তিনি পূর্ণ করেছিলেন, বহু কিছু পূর্ণ করতে পারেননি, কিন্তু রাষ্ট্রীয় সিস্টেমের অধীনে ধনিক শ্রেণীর উত্থান অব্যাহত থাকে। তবে, এরশাদের মিত্রদের সম্পদ বৃদ্ধির সাথে সাথে এরশাদ তার বেসামরিক রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি (জেপি) গঠন করেন। তবে বেসামরিক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পক্ষ থেকে তখন রাজনৈতিক প্রতিরোধ বাড়তে থাকে, যারা তখন ক্ষমতা থেকে বহু দূরে ছিলেন। এর অর্থ হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণীরও উত্থান হচ্ছিল।
এরশাদ বল প্রয়োগে বিএনপিকে সরিয়ে দিয়েছিলেন এবং তার ক্ষমতা গ্রহণকে হালাল করতে তিনি তাদেরকে ছুড়ে ফেলেছিলেন। বিএনপি তাদের শক্তি ফিরিয়ে আনে এবং একটা আন্দোলন গড়ে তোলে যেটা ছিল অনমনীয় এবং ক্রমেই সেটার শক্তি বাড়তে থাকে। অনেকেই বলেছিলেন যে, প্রেসিডেন্ট জিয়ার বিধবা স্ত্রী হিসেবে সেনাবাহিনীতে খালেদা জিয়ার সমর্থক ছিল কিন্তু যে দিন তিনি এরশাদের বিরোধিতা শুরু করলেন, সেদিন থেকে তার জনসমর্থনও বাড়তে শুরু করলো।
আওয়ামী লীগ সতর্কভাবে বিরোধিতা করেছিল এবং মেপে মেপে পদক্ষেপ নিয়েছিলো তারা কারণ তারা চায়নি যে বিএনপি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসুক। এরশাদ আর বিএনপি উভয়কেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিবেচনা করেছিল তারা।
রাজনৈতিকভাবে জিয়ার অনুকরণ করেছিলেন এরশাদ – জেপি থেকে বিএনপি – কিন্তু সময় বদলে গিয়েছিল। ১৯৮৬ সালের নির্বাচন বিএনপি বয়কট করলেও আওয়ামী লীগ তাতে অংশ নিয়েছিল এবং সেখানেই বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তবতাটা উঠে এসেছিল। এর অর্থ হলো কারো না কারো সাথে জোট গড়তে হবে। এর আরেকটা অর্থ হলো বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ যদি একজোট না হতো, জাতীয় পার্টি এবং এরশাদ তাহলে দীর্ঘসময় টিকে যেতেন।
মধ্যবিত্তের উত্থান?
এই সময়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আকাঙ্ক্ষার উত্থান, যারা বিপুল অর্থের উপর নির্ভর করে এসেছিল, যেটা ততদিনে যথেষ্ট বেড়ে গেছে। এর একটা সূচক হলো প্রাইভেট মিডিয়ার উত্থান, যার অর্থ হলো বিকাশমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে ভাড়া করার মতো অর্থ জমে গেছে ততদিনে। এই গ্রুপ আকারে বিশাল নয় এবং তারা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণও করে না কিন্তু তারা সরব এবং তাদের উপস্থিতি জানান দিয়েছে। তারা রাস্তায় নামার সাহস অর্জন করেছিল এবং সেটাই ছিল মূল বিষয়। শিক্ষিত ও সাহসী, অনেকেই এসেছিলেন ঢাকার বাইরে থেকে, তারা এমন একটা স্টাইল তুলে ধরলেন, যেটা নতুন আগ্রাসী শ্রেণীর জানান দিচ্ছিল।
এটা সত্যি যে বহু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংস্কৃতিবাদী একটা নির্ভরশীলতার চরিত্র গড়ে তুলেছিলেন, যেখানে তারা নিজেদের প্রকল্পের জন্য নব্য ধনিক শ্রেণীর উপর নির্ভর করতেন, কিন্তু এরশাদ এই দুই পক্ষের সাথেই খেলেছেন। তিনি কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে শুরু করেন, বিশেষ করে প্রথাগত অভিজাত প্রভাবের বাইরে, কিন্তু তিনি বাংলাদেশী ধারাটা ভালোই বুঝতেন বলে মনে হয়। তিনি সব পক্ষকেই প্রশ্রয় দিতেন।
একদিকে যখন তিনি কবিদের পিঠ চাপড়াচ্ছেন, অন্যদিকে তখন তাকে ঘন ঘন ওয়াজ মাহফিলে দেখা যাচ্ছিল এবং তিনি মাওলানাদের ঘনিষ্ঠ হয়ে ইসলামকে এমনকি রাষ্ট্রীয় ধর্মও ঘোষণা দিয়ে দিলেন। উভয় পক্ষেই তার বন্ধু ও শত্রু জন্মালো কিন্তু তিনি সজিবভাবে টিকে থাকলেন। আর এরপর আসলো আটরশির পীরের প্রসঙ্গ।
আটরশির পীর + ঢাকার সুন্দরী রমনীরা
আটরশির পীর তার ‘অলৌকিক শক্তি’ দিয়ে বাংলাদেশের বহু মানুষকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিলেন, যখনই এটা জানা গেলো যে এরশাদ তার একজন ‘মুরিদ’। হাজার হাজার মানুষ তখন আটরশির কাছে যেতে শুরু করলো। এরশাদের পদক্ষেপ ছিল অসাধারণ, সচেতনে হোক বা অচেতনে, তিনি জানতেন যে, বাংলাদেশের মানুষ পীরদের ভালোবাসেন এবং সে কারণে তাকেও সবাই ‘শ্রদ্ধা’ করবে, এমনকি মুরিদ হিসেবে তাকে হয়তো ভক্তিও করবে।
অবশ্যই, কিছু লোক আটরশির কাছে এ কারণে যেতেন যে, ওখানে এরশাদ (পড়ুন ক্ষমতা) যান এবং এ কারণে সেটা প্রভাব বিস্তারের একটা বিশাল নেটওয়ার্ক হয়ে ওঠে। কিন্তু পীরের অনুসারীরা সবাই সুবিধাবাদী ছিল না। অনেকেই ছিলেন শুদ্ধবাদী এবং এদের মধ্যে অনেক সাংবাদিকও ছিলেন, তা যে ভাবনা থেকেই সেখানে তারা যান না কেন। এরশাদ যখন সরে গেলেন, তখন পীরের প্রভাবও কমে গেলো যদিও তার তখনও বহু অনুসারী ছিল।
এরশাদের আশেপাশে বহু নারীও ছিল, তা নিজে তিনি যতবার বিয়েই করুন না কেন। যেটা মূল বিষয়, সেটা হলো তার আশেপাশে বহু নারী ছিল যারা তাকে ভালোবাসতো, এদের প্রায় সবাই সুন্দরী ও বিবাহিতা। ক্ষমতা নিঃসন্দেহে একটা শক্তিশালী আসক্তির বিষয় এবং এর বাইরে তিনি কবিতাও লিখতেন। যদিও কবিতাগুলো অত ভালো ছিল না তবে গুজব শোনা গেছে যে, অনেক ভালো কবি তার হয়ে কবিতা লিখে দিতেন।
তাই সেনাবাহিনীর সাথে সাথে ধনী এবং নারীরাও তার পেছনে ছিল এবং কবিদের একটা অংশও তার সাথে ছিল। এরশাদের আর উদ্বিগ্ন হওয়ার কি ছিল? একটা ভুল তিনি করেছিলেন। সেটা হলো দুই নারীর নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক শ্রেণীকে তাদের গণআন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষমতাকে তিনি যথেষ্ট গুরুত্ব দেননি।
দুই নারীর সম্মিলন
এরশাদ বহু শিক্ষার্থীদের প্রলুব্ধ করেছিলেন – যেটা মধ্যবিত্তের শক্তির আঁতুরঘর, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। এই মানুষেরা খালেদা এবং হাসিনার মধ্যে শক্তি দেখতে পেয়েছিলেন – এই দুই রাজনীতিবিদের সেই ক্ষমতা ছিল যার শক্তিতে তারা সড়কে আশাবাদী তরুণদের দিয়ে ভর্তি করে দিতে পারতেন। তাদের সেই ক্যারিশমা ছিল যার বলে তারা আন্দোলনের রাজপথে সবাইকে নিয়ে আসতে পারতেন। প্রাথমিক অনীহার পর, হাসিনা খালেদার সাথে জোট গড়তে সম্মত হন, যার নিজেরও একই রকম অনীহা ছিল। কিন্তু রাজনীতিতে যখন দুজন এক হলেন, তাদের সাথে প্রায় ৮০% মানুষের জনসমর্থন ছিল, তখন এরশাদের তাসের ঘর টলতে শুরু করলো।
অবশ্যই, এরশাদ তার সবচেয়ে বড় শক্তি সেনাবাহিনীর উপর নির্ভর করতে চেষ্টা করলো কিন্তু সেনাবাহিনী তাকে সমর্থন দিতে অস্বীকার করলো। তারা তখন একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভূমিকা রাখছিল এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে আগ্রহী ছিল না। এরশাদ একসময় তাদের প্রতিনিধিত্ব করতেন ঠিক কিন্তু তখন তিনি আরেকজন রাজনীতিবিদ মাত্র। জনগণের বা প্রাতিষ্ঠানিক কোন সমর্থন না থাকায়, সবাই যখন তার পতনের জন্য একত্রিত হলো, এরশাদের তখন পতন হলো। ১৯৯০ সালের শেষটা তার জন্য সবচেয়ে নিষ্প্রভ সময় এর এরপর তাকে জেলে যেতে হলো।
পালাবদলের ধারা?
তার শাসনামলের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা কি?
ক্ষমতার ভিত্তিতে বেসামরিক ও সামরিক শক্তির মধ্যে সঙ্ঘাতের তীব্রতাও কমে গেছে। বরং সেনাবাহিনী যখন এরশাদের পক্ষে ভূমিকা রাখতে অস্বীকার করলো, তখন উভয় শক্তির মধ্যে একটা জোট গঠন প্রায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে গেলো। এরশাদ বা জিয়া যখন ক্ষমতায় আসেন, ১৯৯০ সালের পরিস্থিতি ছিল তার চেয়ে আলাদা। এই শিক্ষাটা ২০০৬ সালে সাময়িকভাবে ভুলে যাওয়া হয়েছিল কিন্তু যখন লক্ষণগুলো বোঝা গেলো যে এক পক্ষে থাকলেই সেটা ভালো কাজ করবে, তখন সামরিক বাহিনী নির্বাচন দিয়ে ২০০৮ সালে সরে গেলো।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগ – এই দুই দলের হাতে ছিল ক্ষমতার চাবিকাঠি এবং তারা একত্র হলো তারা অন্য যে কোন বেসামরিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারতো। পরিস্থিতি এখন বদলে গেছে। বিএনপি ব্যাপকভাবে দুর্বল হয়ে গেছে এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন শ্রেণীর সব পক্ষের মতামত নিয়ে ক্ষমতা চালানোর একটা নীতি মেনে চলছে। বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে যে অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত ছিল, সেটা অধিকাংশই চলে গেছে।
রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে একত্র হতে পারতেন কিন্তু তারা রাজনৈতিক কাঠামোটাকে বদলাতে চাননি, যেটা করতে হলে পরিবর্তিত রাজনীতির সাথে মিল রেখে প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠনের প্রয়োজন হতো। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, যেটা ২০০৬ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল, কিন্তু বিএনপি যখন এটাকে ব্যবহারের চেষ্টা করলো, তখন আন্দোলন ও সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তাদের পতন হলো। পরে আওয়ামী লীগ এটাকে বাতিল করে অন্যদের চাপ দেয়ার শক্তিকে কঠিন করে দিলো কারণ জোটগুলো কোন সঙ্ঘাত চায়নি।
সামরিক বাহিনীও এটা শিখেছে যে, একতরফা সেনা শাসনের সময় চলে গেছে। তারা জিয়া-এরশাদ মডেলের বাইরেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং বেসামরিক সরকারের সহায়তা নিয়ে বিকশিত হওয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। সামরিক বাহিনীর ভেতর থেকে এসে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মতো দল গঠনের সময়ও চলে গেছে। মইন-ফখরু সরকার যে দল গঠনের চেষ্টা করেছিল, সেটা কখনই কাজ করেনি।
আর মধ্যবিত্তের কি হলো?
১৯৯০ সালে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সময় ছিল যখন তারা এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং ২০০৬-০৮ সালে এরাই সামরিক শাসনের বিরোধিতা করে, কিন্তু আর কখনই তারা আলোচনায় আসতে পারেনি। এখন তারা আগের যে কোন সময়ের চেয়ে শক্তিহীন এবং ক্ষমতাসীন শ্রেণী এখন খুব ভালো করে বুঝে গেছে, কিভাবে তাদের ক্ষমতা ও আকাঙ্ক্ষাকে টিকিয়ে রাখতে হয়।
রাজনৈতিক দলগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং আওয়ামী লীগ নিজেকে ক্ষমতাসীন আরও আস্থাশীল প্রতিনিধি হিসেবে গড়ে তুলেছে, যতটা বিএনপি পারেনি। ক্ষমতাসীন শাসকশ্রেণী এখন একটা জোটের সমন্বয় যাদের শীর্ষে রয়েছে সশস্ত্র বাহিনী, এর পরেই রয়েছে ব্যবসায়ী শ্রেণী, এরপরে বেসামরিক আমলা এবং সবশেষে রাজনীতিবিদরা। এই সমীকরণে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কোন স্থান নেই।
এরশাদ কি শেষ হাসি হেসেছেন
এক হিসেবে দেখলে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীই এক দশক ধরে জেগে উঠেছিল এবং এরশাদ পতনে নেতৃত্ব দিয়ে আবার নিজেরাই হারিয়ে গেছে। কবি, চিত্রশিল্পী এবং অধিকার কর্মীরা তখন গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। এখন তাদের আর গুরুত্ব নেই এবং কেবল দলীয় ক্যাডারদের গুরুত্ব রয়েছে। এরশাদের সময় যেমনটা ছিল, সমাজ এখন তার চেয়েও বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং বিশৃঙ্খল, কিন্তু তাতে আর কিছু যায় আসে না। মানুষ এখন যেভাবে বাস করে, ভালোবাসে এবং অর্থ উপার্জন করে, সেটাতে মানুষ আর হতবাক হয় না।
এরশাদ বহু বছর জেলে কাটিয়েছেন, কখনই পূর্ণ ক্ষমতা ফিরে পাননি কিন্তু আওয়ালী লীগের সাথে জোট করে ক্ষমতার কাছাকাছি থেকেছেন এবং আওয়ামী লীগের প্রকল্পে সহযোগির ভূমিকা পালন করেছেন। কেউ কেউ এখনও তাকে ‘স্বৈরাচার এরশাদ’ বলে থাকেন কিন্তু এটা এখন অর্থহীন হয়ে গেছে। প্রায় এক দশক ক্ষমতাসীন দলের মিত্র ছিলেন তিনি এবং তারা তাকে ব্যবহার করেছে।
শেষ পর্যন্ত এরশাদ তার প্রতিশোধটা নিতে পেরেছেন বা শেষ হাসি হেসেছেন। তিনি আসলে কখনই হারিয়ে যাননি এবং তার মৃত্যুর সময় প্রধানমন্ত্রী শোকবার্তা দিয়েছেন যিনি তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলন করেছিলেন। আর এদিকে মধ্যবিত্তি শ্রেণী বিশেষ করে এর শহুরে অংশটি আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি চাপে আছে। তাই সব মিলিয়ে একটা রূপকথার পরিণতি বা অপরিণতি ঘটলো, তা যেটাই বলুন না কেন।
No comments