জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জন্য শোকগাঁথা by ডেরেক ব্রাউন
স্বৈরাচাররা
যেমনটা হয়ে থাকেন, হোসেন মুহম্মদ এরশাদ ততটা নৃশংস ছিলেন না। তার শাসনামলে
বাংলাদেশ ত্রাস, কারাদণ্ড ও মৃত্যুদণ্ডের জনপদ ছিল না। তবে দেশটা ছিল এমন
যেখানে সর্বত্র যেন সন্দেহ ও নৈরাশ্যের ছাপ। দুর্নীতি পৌঁছে গিয়েছিল দেশের
প্রতিটি কোণায়। ভঙ্গুর রাজনৈতিক কাঠামো আরও ন্যুজ্ব হয়ে গিয়েছিল।
এরশাদ মারা গেছেন ৮৯ বছর বয়সে। আশির দশকের পুরোটা ও নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশ শাসন করে গেছেন তিনি। নেতা হওয়ার ক্ষেত্রে তার একমাত্র যোগ্যতা ছিল এই যে, তিনি ১৯৭৮ সাল থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন। ওই সময় বাংলাদেশ শাসন করছিলেন আরেক সামরিক শাসক, ক্যারিশম্যাটিক জিয়াউর রহমান।
১৯৭৫ সালে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর জিয়া ক্ষমতায় এসেছিলেন। ১৯৮১ সালে ঘাতকদের বুলেট বুকে নেয়ার সময় চলে এল জিয়ার। বিফল ওই অভ্যুত্থান করেছিলেন মধ্যম পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তারা, যাদের কয়েকজন অভ্যুত্থানের সময়ই মারা যান।
শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর যেমনটা হয়েছিল, জিয়ার মৃত্যুর পরও অন্তর্বর্তীকালীন জরুরী প্রশাসন দেশ শাসন করার চেষ্টা করছিল। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী জন্মের পর থেকে উত্থান-পতন ও সহিংসতা ছাড়া খুব কম কিছুই চাক্ষুষ করেছে বাংলাদেশ।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচ এম এরশাদ ছিলেন পেশাদার সেনা কর্মকর্তা। ওই সময় রাজনীতির প্রতি তেমন আগ্রহ তিনি দেখাননি। সাবেক বস জিয়ার মৃত্যুর পর ঝঞ্ঝাটময় সময়েও এরশাদ শক্ত ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। তবে ১৯৮২ সালের শুরুর দিকে তিনি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান ঘটান। দেশে সেনা শাসন আরোপ করেন। নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি ক্ষমতা দখল করার সময় দাবি করেছিলেন (কোনো সন্দেহ নেই যে, বিশ্বাসও করেছিলেন) যে, তিনি সংবিধান রক্ষা করতে ও দেশকে গণতন্ত্রের জন্য নিরাপদ করতেই সামনে এসেছেন।
এরশাদ পরবর্তীতে সেনাপ্রধান পদ ছাড়েন। সামরিক শাসনের অবসান ঘটান। তিনি সংসদ নির্বাচনও আয়োজন করেন। জাতীয় পার্টি (জেপি) নামে দল গঠন করে ওই নির্বাচনে লড়েন। বেসামরিক রাজনীতিতে তখন আধিপত্য ছিল (এখনও আছে) আওয়ামী লীগ ও বিএনপির। যেই দুই দলের প্রধান ব্যক্তি ছিলেন যথাক্রমে মুজিব ও জিয়া।
উপমহাদেশীয় রাজনীতির বংশানুক্রমিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় দল দু’টির নেতৃত্বে আসেন মুজিবের মেয়ে শেখ হাসিনা ও জিয়ার বিধবা স্ত্রী খালেদা জিয়া। এই দুই নারী একে অপরকে দেখতে পারতেন না, কিন্তু তারা এরশাদকে আরও বেশি ঘৃণা করতেন। তারা এরশাদের অধীনে নির্বাচন বর্জন করেন।
১৯৮৮ সালের নির্বাচনে, জাতীয় পার্টি ৩০০ আসনের ২৫১টিতে ‘জয়’ পায়। এর আংশিক কারণ হলো প্রধান দুই দলের বয়কট, আরেক কারণ ছিল স্থূল কারচুপি।
ওই সময় আমি ছিলাম ওই অঞ্চলে গার্ডিয়ানের প্রতিনিধি। তখন আমি জোচ্চুরির পর জোচ্চুরি প্রত্যক্ষ করেছি। ভোটাভুটি স্বাভাবিক ও নিয়মিত দেখাতে শ্রমিকদের ভাড়া করা হয়েছিল। ওই দিনটি যেন মানুষের ঔদাসীন্য ও ক্ষোভের মিশেল ছিল। ঢাকার একটি ভোটকেন্দ্রে দুপুরের আগেই রিটার্নিং কর্মকর্তা ঘোষণা দিলেন, ১০০ শতাংশ ভোট হয়ে গেছে, আর ভোটগ্রহণ করা হবে না। তাকে এই প্রশ্ন করতে যাওয়াটা নিষ্ঠুর হয়ে যেত যে, তার সকল ব্যালট বক্স রাজপথে। ক্ষুদ্ধ লোকজন সেগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে। ওই রাতেই কিছু জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক ও বিদেশী সংবাদদাতা নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিলেন, টার্নআউট কতো হতে পারে, তা নিয়ে। সর্বোচ্চ অনুমান ছিল, ২ শতাংশ।
এই প্রশ্নবিদ্ধ ম্যান্ডেট নিয়ে এরশাদ ক্ষমতায় ফিরলেন, দেশের আধুনিকায়ন ও পুনর্গঠনের কাজে। তার প্রিয় ছিল সিদ্ধান্ত কথিত উপজেলা পদ্ধতির মাধ্যমে তৃণমূলের কাছে ক্ষমতা দেয়া। এগুলো ছিল প্রত্যন্ত এলাকার প্রশাসনিক ইউনিট, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব অর্পিত ছিল এই প্রশাসনে। এতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত ছিল। উপজেলা নেটওয়ার্ক স্থাপিত হয় পূর্বের ৪৬০টি থানা বা পুলিশ স্টেশনের ভিত্তিতে। নিজেদের দুর্দশাগ্রস্থ জীবন নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে সামান্য হলেও সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল ওই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব উপজেলায় আধিপত্য ছিল স্থানীয় ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ও সরকারী কর্মকর্তাদের।
এরশাদ বসবাস করতেন প্রকাণ্ড প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে। তার ছিল নিজস্ব গলফ কোর্স। সবসময় দুর্নীতি নির্মূল নিয়ে প্রগাঢ় ভাষায় কথা বলতেন। দারিদ্রপীড়িত মানুষের কষ্ট নিয়েও তিনি সত্যিকার অর্থে পীড়িত ছিলেন। ১৯৮৭ সালে আমি তার সঙ্গে একটি বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সফর করি। বহু গ্রামে যাই আমরা। প্রত্যেকটা গ্রামে প্রেসিডেন্ট বন্যার বিধ্বস্ততার শিকার এলাকায় যেতেন। তাকে মিনতির সুরে ছুঁতে যাওয়া নারীদের ভদ্রস্থভাবে এড়িয়ে যেতেন। তার পেছনে থাকতো একজন সহযোগী, যার হাতে ছিল নোটভর্তি ব্রিফকেস। এরশাদ নারীদের দিকে ইঙ্গিত দিতেন, আর তাদের হাতে টাকা বিলাতেন ওই সহযোগী।
সেখান থেকে বিরতি নিয়ে আমরা বগুড়া সামরিক ক্যান্টনমেন্টে অফিসার্স মেসে দারুণ কিন্তু একেবারেই বেমানান দুপুরের খাবার খেলাম। আমরা যখন খাচ্ছিলাম, এরশাদের চোখ অশ্রুসজল। তিনি বর্ণনা করছিলেন, যেই ক্ষুদা ও দারিদ্র্য আমরা গ্রামে গ্রামে চাক্ষুষ করলাম। তিনি বিদেশী ত্রাণ চাননি। সতর্কভাবে নিজের পর্যবেক্ষণের কথা বললেন, ‘মানুষ ভিক্ষুককে কিছু দিতে চায় না।’
সমালোচকরা বলেন, ১৯৮৮ সালে, সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে, এরশাদ সংবিধান সংশোধন করে ইসলামকে ধর্মনিরপেক্ষ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের রাষ্ট্রধর্ম বানালেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলার দিনহাটায় জন্মগ্রহণ করেন। তখন সেটি ছিল বৃটিশ শাসিত ভারত। তার পিতার নাম মকবুল হোসেন, মায়ের নাম মাজিদা খাতুন। তার পরিবার বর্তমান বাংলাদেশে অভিবাসী হয়ে আসে ১৯৪৮ সালে। তখন এটি ছিল পাকিস্তানের অংশ।
এরশাদ রংপুরের কারমাইকেল কলেজে ও পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। ১৯৫০ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের কোয়েটায় কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজের পর তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে পদায়ন পান। তবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধে লড়ছিল, তখন তাকে অন্তরীন করা হয়। ১৯৭৩ সালে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়।
বিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘকালের শাসক ছিলেন এরশাদ। কিন্তু দেশের অবস্থা এত উত্তাল ছিল যে, তিনি আজীবন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। ইতিহাসে প্রথম ও একমাত্র নজির গড়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ঐক্যবদ্ধ হয়ে হরতাল ও রাজপথে আন্দোলন করে। সহিংসভাবে হরতাল প্রয়োগও করে। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে, প্রেসিডেন্ট বুঝতে পারলেন তার সময় শেষ। তিনি পদত্যাগ করলেন। তার পরে যেই সরকারগুলো আসলো সেগুলোর নেতৃত্বে ছিলেন খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা।
১৯৯১ সালে এরশাদকে আটক করা হয়। দুর্নীতির অভিযোগে কারান্তরীণ করা হয়। কিন্তু ভেঙ্গে যাওয়ার পরিবর্তে জাতীয় পার্টি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে টিকে যায়। টানা দুই নির্বাচনে এরশাদ ৫টি আসন থেকে নির্বাচন করেন ও প্রত্যেকটি থেকে জয়লাভ করেন, অথচ তখন তিনি কারাগারে। কিন্তু তারপরও তার গৌরবময় দিনগুলো ততদিনে শেষ।
১৯৯৭ সালে তিনি জামিনে মুক্ত হন। এরপর ২০০০ সালে তাকে আবারও ৪ মাসের জন্য জেল দেয়া হয়। ওই সময় তিনি ৫ বছরের জন্য নির্বাচনে অযোগ্য হন। মৃত্যুর সময়, তার বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভ্যুত্থান সমর্থনের অভিযোগে মামলা চলছিল, যেই অভ্যুত্থানে তারই সহকর্মী মেজর জেনারেল আবুল মনজুর নিহত হন।
এরশাদ ১৯৫৬ সালে রওশন এরশাদকে বিয়ে করেন। তিনি ২০০০ সালে বিদিশা সিদ্দিকিকে বিয়ে করেন। ২০১৫ সালে তাদের মধ্যে ডিভোর্স হয়। মৃত্যুর সময় ৩ ছেলে ও ১ মেয়ে রেখে গেছেন তিনি।
এরশাদ মারা গেছেন ৮৯ বছর বয়সে। আশির দশকের পুরোটা ও নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশ শাসন করে গেছেন তিনি। নেতা হওয়ার ক্ষেত্রে তার একমাত্র যোগ্যতা ছিল এই যে, তিনি ১৯৭৮ সাল থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন। ওই সময় বাংলাদেশ শাসন করছিলেন আরেক সামরিক শাসক, ক্যারিশম্যাটিক জিয়াউর রহমান।
১৯৭৫ সালে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর জিয়া ক্ষমতায় এসেছিলেন। ১৯৮১ সালে ঘাতকদের বুলেট বুকে নেয়ার সময় চলে এল জিয়ার। বিফল ওই অভ্যুত্থান করেছিলেন মধ্যম পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তারা, যাদের কয়েকজন অভ্যুত্থানের সময়ই মারা যান।
শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর যেমনটা হয়েছিল, জিয়ার মৃত্যুর পরও অন্তর্বর্তীকালীন জরুরী প্রশাসন দেশ শাসন করার চেষ্টা করছিল। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী জন্মের পর থেকে উত্থান-পতন ও সহিংসতা ছাড়া খুব কম কিছুই চাক্ষুষ করেছে বাংলাদেশ।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচ এম এরশাদ ছিলেন পেশাদার সেনা কর্মকর্তা। ওই সময় রাজনীতির প্রতি তেমন আগ্রহ তিনি দেখাননি। সাবেক বস জিয়ার মৃত্যুর পর ঝঞ্ঝাটময় সময়েও এরশাদ শক্ত ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। তবে ১৯৮২ সালের শুরুর দিকে তিনি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান ঘটান। দেশে সেনা শাসন আরোপ করেন। নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি ক্ষমতা দখল করার সময় দাবি করেছিলেন (কোনো সন্দেহ নেই যে, বিশ্বাসও করেছিলেন) যে, তিনি সংবিধান রক্ষা করতে ও দেশকে গণতন্ত্রের জন্য নিরাপদ করতেই সামনে এসেছেন।
এরশাদ পরবর্তীতে সেনাপ্রধান পদ ছাড়েন। সামরিক শাসনের অবসান ঘটান। তিনি সংসদ নির্বাচনও আয়োজন করেন। জাতীয় পার্টি (জেপি) নামে দল গঠন করে ওই নির্বাচনে লড়েন। বেসামরিক রাজনীতিতে তখন আধিপত্য ছিল (এখনও আছে) আওয়ামী লীগ ও বিএনপির। যেই দুই দলের প্রধান ব্যক্তি ছিলেন যথাক্রমে মুজিব ও জিয়া।
উপমহাদেশীয় রাজনীতির বংশানুক্রমিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় দল দু’টির নেতৃত্বে আসেন মুজিবের মেয়ে শেখ হাসিনা ও জিয়ার বিধবা স্ত্রী খালেদা জিয়া। এই দুই নারী একে অপরকে দেখতে পারতেন না, কিন্তু তারা এরশাদকে আরও বেশি ঘৃণা করতেন। তারা এরশাদের অধীনে নির্বাচন বর্জন করেন।
১৯৮৮ সালের নির্বাচনে, জাতীয় পার্টি ৩০০ আসনের ২৫১টিতে ‘জয়’ পায়। এর আংশিক কারণ হলো প্রধান দুই দলের বয়কট, আরেক কারণ ছিল স্থূল কারচুপি।
ওই সময় আমি ছিলাম ওই অঞ্চলে গার্ডিয়ানের প্রতিনিধি। তখন আমি জোচ্চুরির পর জোচ্চুরি প্রত্যক্ষ করেছি। ভোটাভুটি স্বাভাবিক ও নিয়মিত দেখাতে শ্রমিকদের ভাড়া করা হয়েছিল। ওই দিনটি যেন মানুষের ঔদাসীন্য ও ক্ষোভের মিশেল ছিল। ঢাকার একটি ভোটকেন্দ্রে দুপুরের আগেই রিটার্নিং কর্মকর্তা ঘোষণা দিলেন, ১০০ শতাংশ ভোট হয়ে গেছে, আর ভোটগ্রহণ করা হবে না। তাকে এই প্রশ্ন করতে যাওয়াটা নিষ্ঠুর হয়ে যেত যে, তার সকল ব্যালট বক্স রাজপথে। ক্ষুদ্ধ লোকজন সেগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে। ওই রাতেই কিছু জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক ও বিদেশী সংবাদদাতা নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিলেন, টার্নআউট কতো হতে পারে, তা নিয়ে। সর্বোচ্চ অনুমান ছিল, ২ শতাংশ।
এই প্রশ্নবিদ্ধ ম্যান্ডেট নিয়ে এরশাদ ক্ষমতায় ফিরলেন, দেশের আধুনিকায়ন ও পুনর্গঠনের কাজে। তার প্রিয় ছিল সিদ্ধান্ত কথিত উপজেলা পদ্ধতির মাধ্যমে তৃণমূলের কাছে ক্ষমতা দেয়া। এগুলো ছিল প্রত্যন্ত এলাকার প্রশাসনিক ইউনিট, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব অর্পিত ছিল এই প্রশাসনে। এতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত ছিল। উপজেলা নেটওয়ার্ক স্থাপিত হয় পূর্বের ৪৬০টি থানা বা পুলিশ স্টেশনের ভিত্তিতে। নিজেদের দুর্দশাগ্রস্থ জীবন নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে সামান্য হলেও সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল ওই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব উপজেলায় আধিপত্য ছিল স্থানীয় ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ও সরকারী কর্মকর্তাদের।
এরশাদ বসবাস করতেন প্রকাণ্ড প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে। তার ছিল নিজস্ব গলফ কোর্স। সবসময় দুর্নীতি নির্মূল নিয়ে প্রগাঢ় ভাষায় কথা বলতেন। দারিদ্রপীড়িত মানুষের কষ্ট নিয়েও তিনি সত্যিকার অর্থে পীড়িত ছিলেন। ১৯৮৭ সালে আমি তার সঙ্গে একটি বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সফর করি। বহু গ্রামে যাই আমরা। প্রত্যেকটা গ্রামে প্রেসিডেন্ট বন্যার বিধ্বস্ততার শিকার এলাকায় যেতেন। তাকে মিনতির সুরে ছুঁতে যাওয়া নারীদের ভদ্রস্থভাবে এড়িয়ে যেতেন। তার পেছনে থাকতো একজন সহযোগী, যার হাতে ছিল নোটভর্তি ব্রিফকেস। এরশাদ নারীদের দিকে ইঙ্গিত দিতেন, আর তাদের হাতে টাকা বিলাতেন ওই সহযোগী।
সেখান থেকে বিরতি নিয়ে আমরা বগুড়া সামরিক ক্যান্টনমেন্টে অফিসার্স মেসে দারুণ কিন্তু একেবারেই বেমানান দুপুরের খাবার খেলাম। আমরা যখন খাচ্ছিলাম, এরশাদের চোখ অশ্রুসজল। তিনি বর্ণনা করছিলেন, যেই ক্ষুদা ও দারিদ্র্য আমরা গ্রামে গ্রামে চাক্ষুষ করলাম। তিনি বিদেশী ত্রাণ চাননি। সতর্কভাবে নিজের পর্যবেক্ষণের কথা বললেন, ‘মানুষ ভিক্ষুককে কিছু দিতে চায় না।’
সমালোচকরা বলেন, ১৯৮৮ সালে, সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে, এরশাদ সংবিধান সংশোধন করে ইসলামকে ধর্মনিরপেক্ষ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের রাষ্ট্রধর্ম বানালেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলার দিনহাটায় জন্মগ্রহণ করেন। তখন সেটি ছিল বৃটিশ শাসিত ভারত। তার পিতার নাম মকবুল হোসেন, মায়ের নাম মাজিদা খাতুন। তার পরিবার বর্তমান বাংলাদেশে অভিবাসী হয়ে আসে ১৯৪৮ সালে। তখন এটি ছিল পাকিস্তানের অংশ।
এরশাদ রংপুরের কারমাইকেল কলেজে ও পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। ১৯৫০ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের কোয়েটায় কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজের পর তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে পদায়ন পান। তবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধে লড়ছিল, তখন তাকে অন্তরীন করা হয়। ১৯৭৩ সালে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়।
বিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘকালের শাসক ছিলেন এরশাদ। কিন্তু দেশের অবস্থা এত উত্তাল ছিল যে, তিনি আজীবন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। ইতিহাসে প্রথম ও একমাত্র নজির গড়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ঐক্যবদ্ধ হয়ে হরতাল ও রাজপথে আন্দোলন করে। সহিংসভাবে হরতাল প্রয়োগও করে। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে, প্রেসিডেন্ট বুঝতে পারলেন তার সময় শেষ। তিনি পদত্যাগ করলেন। তার পরে যেই সরকারগুলো আসলো সেগুলোর নেতৃত্বে ছিলেন খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা।
১৯৯১ সালে এরশাদকে আটক করা হয়। দুর্নীতির অভিযোগে কারান্তরীণ করা হয়। কিন্তু ভেঙ্গে যাওয়ার পরিবর্তে জাতীয় পার্টি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে টিকে যায়। টানা দুই নির্বাচনে এরশাদ ৫টি আসন থেকে নির্বাচন করেন ও প্রত্যেকটি থেকে জয়লাভ করেন, অথচ তখন তিনি কারাগারে। কিন্তু তারপরও তার গৌরবময় দিনগুলো ততদিনে শেষ।
১৯৯৭ সালে তিনি জামিনে মুক্ত হন। এরপর ২০০০ সালে তাকে আবারও ৪ মাসের জন্য জেল দেয়া হয়। ওই সময় তিনি ৫ বছরের জন্য নির্বাচনে অযোগ্য হন। মৃত্যুর সময়, তার বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভ্যুত্থান সমর্থনের অভিযোগে মামলা চলছিল, যেই অভ্যুত্থানে তারই সহকর্মী মেজর জেনারেল আবুল মনজুর নিহত হন।
এরশাদ ১৯৫৬ সালে রওশন এরশাদকে বিয়ে করেন। তিনি ২০০০ সালে বিদিশা সিদ্দিকিকে বিয়ে করেন। ২০১৫ সালে তাদের মধ্যে ডিভোর্স হয়। মৃত্যুর সময় ৩ ছেলে ও ১ মেয়ে রেখে গেছেন তিনি।
- *সৈনিক থেকে রাজনীতিবিদ হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জন্ম ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৩০, মৃত্যু ১৪ জুলাই ২০১৯।
- *ড্রেক ব্রাউন ২০১১ সালে মারা গেছেন।
২০০০ সালে ঢাকার আদালত পাড়ায় সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, ছবি: পাভেল রহমান/এরশাদ |
(সংকলিত)
No comments