ফারাক্কার প্রভাবে প্রতি বছরই কমে যাচ্ছে পদ্মার পানি সমতলের উচ্চতা, বাড়ছে তাপমাত্রা by আনোয়ার হোসেন
ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে প্রতি বছরই কমে যাচ্ছে দেশের অন্যতম নদী
পদ্মার পানি সমতলের উচ্চতা। যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্য
নদীগুলোর ওপর। ফলে বর্ষা মৌসুমে যেমন বাড়ছে ভাঙনের প্রবণতা, তেমনি শুষ্ক
মৌসুমে ক্রমেই পানির অভাবে মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ
পদ্মার অববাহিকায় থাকা বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
১৯৭৬ সালের ১৬ মে মজলুম
জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে রাজশাহীর ঐতিহাসিক
মাদ্রাসা ময়দান থেকে মারণবাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে লাখো মানুষের লংমার্চ
অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে ওই দিন বাংলার সর্বস্তরের
মানুষ যে গগণবিদারী প্রতিবাদ করেছিল তা কাঁপিয়ে দিয়েছিল দিল্লির শাসকদেরও।
কিন্তু, এর সুফল তুলতে ব্যর্থ হয় শেখ মুজিব পরবর্তী সরকার। তবুও ভারতের
পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী সেদিন ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব
ও এর বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে যে প্রতিবাদ করেছিলেন, তার সেই সাহসী
উচ্চারণ বাংলাদেশের মানুষের অনুপ্রেরণা হয়ে আছে আজও।
ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রত্যক্ষভাবে
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরাঞ্চলের মানুষ তথা উত্তরাঞ্চলসহ
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। ফারাক্কা দিন দিন গ্রাস করছে এ অঞ্চলের মানুষের
অধিকার। সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া মানুষের সংখ্যা যেমন বাড়ছে; তেমনি নিঃস্ব
মানুষগুলোর করুণ আর্তনাদ প্রতিনিয়তই সৃষ্টি করছে শোকাবহ পরিবেশের।
ভারত থেকে বয়ে আসা গঙ্গা নদী বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ঢুকে
পদ্মা নাম ধারণ করে। এই নদীকে কেন্দ্রে করেই একসময় আবর্তিত হতো এই অঞ্চলের
মানুষের জীবন-জীবিকা। তবে সময়ের ব্যবধানে এই নদী এখন এই এলাকার মানুষের
দুর্ভোগের কারণ। ১৯৭৫ সালে ভারত এই নদীর উজানে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পর
বদলে যেতে থাকে এই নদীর গতিপথ। আবার বর্ষা মৌসুমে ছেড়ে দেওয়া পানিতে একদিকে
যেমন নদীগর্ভে বিলীন হয় গ্রামের পর গ্রাম, তেমনি শুষ্ক মৌসুমে মাইলের পর
মাইল পরিণত হয় ধূ-ধূ বালু চরে।
বর্তমানে একাধিক চ্যানেলে বিভক্ত হওয়া এই নদী যেন মাঝে মাঝেই তাড়া করে
বেড়ায় এখানকার বাসিন্দাদের। ভাসিয়ে নিয়ে যায় ঘর-বাড়ি, ফল-ফসলসহ সবকিছু।
বিরূপ আবহাওয়ায় প্রতিবছর যেমন বাড়ছে তাপমাত্রা তেমনি, বসবাসের অনুপযোগী হয়ে
উঠছে এ অঞ্চল। আর নদী পানিশূন্য হওয়ায় কর্মসংস্থান হারাচ্ছে নদী পাড়ের
মানুষেরা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আহসানুল হক
জানান,‘ ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে শুষ্ক মৌসুমে নদী পানিশূন্য থাকায় মাইলের
পর মাইল বালুর চর জেগে ওঠায় তাপমাত্রা প্রতিবছরই বাড়ছে। যা সহ্য করা এখন
আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তাপমাত্রা বাড়ায় নতুন নতুন রোগ-বালাইয়ের
প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়ও।’
একই এলাকার জেলে এজাবুল হক জানান, ‘আগে পদ্মা নদীতে মাছ মেরে সুন্দরভাবে
জীবন-যাপন করেছি। বর্তমানে নদীতে পানি নাই; তাই আর মাছও হয় না। এখন ছেলে
মেয়ে নিয়ে খুব সমস্যার মধ্যে আছি। আর আমাদের জেলেদের এ সমস্যার জন্য দায়ী
ফারাক্কা বাঁধ। ’
সরজমিনে পদ্মা নদীতে মাছ ধরার সময় কথা হয় ইসলামপুর ইউনিয়নের পোড়াগাঁ
গ্রামের জেলে শাহ আলমের সঙ্গে। তিনি জানান,‘ এক সময় এ নদীতে হাজার হাজার
জেলে মাছ ধরতো। মাছ মেরেই সবাই জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতো। কিন্তু এখন আর
সেটা না হওয়ায় এ অঞ্চলের বহু জেলেই অন্য পেশায় চলে গেছে। আমরা যারা এখন মাছ
মারছি তাতে কোনদিন পাইঠের (দিনমজুরি) পয়সা হয় কোনোদিন হয় না। সব মিলিয়ে এ
অঞ্চলের জেলেরা আমরা খুব বিপদে আছি। এ অবস্থার প্রতিকার চাই আমরা।
শিবগঞ্জ উপজেলার সাহাপাড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক জালাল উদ্দিন
বললেন, ‘তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী মরণ বাঁধ
ফারাক্কা উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে আমাদের দুঃখ দিন দিন বাড়ছেই। এ বাঁধ ভারত
সরকার তৈরি করার পর থেকে পদ্মার ভাঙনে বেশ কয়েবার শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা,
দুর্লভপুর, পাঁকা, উজিরপুর, সুন্দরপুর, চরবাগডাঙ্গা, আলাতুলি, দেবিনগর,
শাজাহানপুর, ইসলামপুরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের বেশির ভাগ নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে।
ফলে ভিটে বাড়ি হারিয়ে লক্ষাধিক মানুষকে পথে বসতে হয়েছে।’
সরেজমিনে ওইসব এলাকা ঘোরার সময় এলাকাবাসী জানান, ফারাক্কার বিরূপ
প্রভাবে ধীরে ধীরে মরুকরণের দিকে এগুচ্ছে সীমান্তবর্তী জেলা
চাঁপাইনবাবগঞ্জ। বাঁধের কারণে ইতোমধ্যে পদ্মানদীর নাব্যতা, যৌবন ও ঐতিহ্য
সবই হারিয়েছে। ফলে জেলার অনেক অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দিন দিন নিচে
নেমে যাওয়ায় চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে কৃষিকাজে ব্যবহৃত সেচ প্রকল্পগুলো।
এলাকার কয়েকজন কৃষক জানান, এলাকার মানুষেরা জীবন বাঁচাতে বর্তমানে শত শত
শ্যালো মেশিন বসিয়ে নদীর গভীর তলদেশ থেকে পানি তুলছে। এই পানি দিয়ে হাজার
হাজার কৃষক পদ্মার বুকে ধান, গম ও সবজিসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন করছে।’
গঙ্গা চুক্তি অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমে যে পরিমাণ পানি দেওয়ার কথা; গত ১৮
বছরের বেশিরভাগ সময়ই সেই পরিমাণ পানি দেয়নি ভারত উল্লেখ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আতিকুর রহমান ‘বাংলা ট্রিবিউনকে’
বলেন,‘ ভূমি ও পানি সমতলের সর্বনিম্ন স্তরের যে ব্যবধান সেটা প্রতিবছরই
বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর বৃদ্ধির কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নদীর পাড়ের যে
স্থিতিশীলতা তা হ্রাস পাচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রতিবছরই নদী ভাঙ্গনের তীব্রতা
বাড়ছেই।
তিনি আরও জানান,‘ পানির যে প্রবাহ সেটার সঙ্গে বৃষ্টিপাতের সরাসরি
সর্ম্পক রয়েছে। গত ২০ বছরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ
৩০ থেকে ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে এবং বৃষ্টিপাত হ্রাস পাওয়ার কারণে
তাপমাত্রা মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী
অঞ্চলে ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রা ওঠানামা করছে এবং পরিবেশ ও জীব
বৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ অবস্থায় প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে
পানিচুক্তির সঠিক বাস্তবায়নে সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।’
তৎকালীন লংমার্চে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী ও সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক)
চাঁপাইনবাবগঞ্জ শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম রেজা বলেন, ‘মাওলানা
আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৭৬ সালের ১৬মে সেই ঐতিহাসিক লং
মার্চ যর্থাথ ছিলো। সেইদিন অনেক রাজনীতিবিদই তাঁকে ঠাট্টার চোখে দেখেছিল।
কিন্তু, সেই লং মার্চের ৪৩ বছর পর আজকে আমরা কী দেখছি? দেখছি, দিন দিন কমছে
পদ্মার বুকে পানি। ফারাক্কার প্রভাবে আমাদের দেশের মানুষ মানবেতর জীবন
যাপন করছে। যে তাপ সইবার মতো ক্ষমতা স্রষ্টা আমাদের গায়ের চামড়ায় দেয়নি,
মাথায় দেয়নি, মনে দেয়নি, মগজে-মননশীলতায় দেয়নি তাই আজকে সইতে বাধ্য হচ্ছি।
ফারাক্কা বাঁধের সুষম পানি বণ্টনের যে চুক্তি হয়েছিল, সেইদিন তা সুচারু
রূপে ব্যবহার হয় নাই বলেই আজকের এই পরিণতি। তাই অনতিবিলম্বে ভারতের কাছ
থেকে পানির নায্য হিস্যা নেওয়া হোক এবং ফারাক্কার খারাপ প্রভাবে প্রভাবিত
হয়ে আমরা যে মরুভূমিতে পরিণতি হচ্ছি তা দূর করতে একটা পদক্ষেপ নেওয়া হোক
আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে। প্রয়োজনে এই বিষয়টির শান্তিপূর্ণ সমাধানে জাতিসংঘের
দ্বারস্থ হোক সরকার।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাঙ্খা পয়েন্ট থেকে ফারাক্কা বাঁধের দূরত্ব মাত্র ২০
কিলোমিটার। সংশ্লিষ্টদের মতে, এই বাঁধ নির্মাণের আগে শুষ্ক মৌসুমে ৬০ থেকে
৭০ হাজার কিউসেক পানি আসতো বাংলাদেশে।
তবে এমন পরিস্থিতি বদলাতে পারে যদি সরকার নদী ড্রেজিং করে মাছের উৎপাদন,
সেচ-সুবিধাসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের যুগান্তকারী পরিবর্তনে সচেষ্ট হয়।
সর্বোপরি প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে পানিচুক্তির সঠিক বাস্তবায়নে সরকার
অগ্রণী ভূমিকা নেবে বলে আশা করছেন ভুক্তভোগীরা।
No comments