নির্যাতিত তাতারদের জন্য কে কথা বলবে?
বিশ্বজুড়ে
সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর নির্যাতন একুশ শতকের অন্যতম মানবাধিকার বিপর্যয়।
চীনে উইঘুর মুসলিমদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধিকারকে কঠিনভাবে দমন করছে
দেশটির সরকার। উইঘুরদের একটি অংশকে জোরপূর্বক কথিত পুনঃশিক্ষা কেন্দ্রে
আটকে রাখা হয়েছে। আবার মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমরা দেশটির সেনাবাহিনী
দ্বারা ভয়াবহ নির্যাতনের মাথায় পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য
হয়েছে। ২০১৭ সালে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশের কক্সবাজারে
আশ্রয় নেয়। মুসলিমদের এসব জাতিগোষ্ঠীর ওপরে যে নির্যাতন চলছে তা বিশ্বজুড়ে
গণমাধ্যমগুলোতে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। তবে এখনো এমন একটি জাতি রয়েছে
যাদেরকে জাতিগতভাবে নিধন করা হচ্ছে। অথচ তাদের বিষয়ে কোনো আলোচনা নেই।
বিশ্বের সেদিকে কোনো নজরও নেই। জাতিটি হচ্ছে ক্রিমিয়ার তাতার মুসলিমরা।
৫ বছর আগে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকে ক্রিমিয়ার প্রায় আড়াই লাখ তাতারদের ওপর নেমে এসেছে ভয়াবহ দুর্যোগ। তাদেরকে কাজ, ভাষা ও সংবাদপত্রের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তবে এটিই ক্রিমিয়ার তাতারদের ওপর নির্যাতনের প্রথম ঘটনা নয়। তাতার জাতি মূলত তুরস্ক থেকে এখানে এসেছে। গত এক শতাব্দী ধরে তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য জোরপূর্বক ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে রুশ শাসনে তাদেরকে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে।
ক্রিমিয়া দ্বীপে তাতাররা প্রথমে বাস করতে শুরু করেন ১৩ শতকে। তখন থেকেই বারবার তাতারদের ওপর বিভিন্ন গোষ্ঠী হামলা চালাতে থাকে। তবে এর পেছনে তাদের সংস্কৃতি বা ধর্ম কোনো কারণ ছিল না। তাদের কাছে ব্যাপক পরিমাণ পানির উৎস থাকায় তাদেরকে টার্গেট করা হয়। ক্রিমিয়া পুরোপুরিভাবে পানি দিয়ে ঘেরা। এর চারদিকে রয়েছে কৃষ্ণসাগর (ব্ল্যাক সি) ও আজভ সাগর। তাই সমুদ্রে সরাসরি প্রবেশের ইচ্ছে থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ক্রিমিয়ার দিকে ক্ষুধার্থ চোখ ছিল রাশিয়ার।
সমস্যার সূচনা হয় ১৭৭০ সালে। সে সময় ক্যাথেরিন দ্যা গ্রেটের নেতৃত্বে ক্রিমিয়া দখল করে রাশিয়া। ক্রিমিয়া তখন অটোমান বা ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। দখলের পর ক্রিমিয়ার প্রধান বন্দরগুলো ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে যায় রাশিয়া। সেখানে রাজনৈতিক অনেক পরিবর্তন আনা হয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ক্রিমিয়ার শাসক তাতার খানকে উচ্ছেদ করে রুশ গভর্নরের হাতে শাসন ছেড়ে দেয়া। ক্যাথেরিন রুশ নাগরিকদের এই দ্বীপে এসে স্থায়ী আবাস গড়ার ব্যবস্থা করে দেন। ফলে প্রথমবারের মতো ক্রিমিয়া থেকে উচ্ছেদ হতে শুরু করেন তাতাররা। দ্বীপটির ৮৫ ভাগই ছিল তাতার জাতির। ১৭৮৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিমিয়াকে নিজের অন্তর্ভুক্ত করে রাশিয়া। ফলে ৮ থেকে ১০ হাজার তাতারকে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্য কোথাও পালিয়ে যেতে হয়।
১৮৫৩ সালে রাশিয়া তার সাম্রাজ্য আরো বড় করার পরিকল্পনা নেয়। ফলে রুশদের থামাতে ওসমানীয়রা সৈন্য মোতায়েন শুরু করে। পরবর্তী দুই বছরে বৃটেন, ফ্রান্স ও সার্ডিনিয়া ওসমানীয়দের সঙ্গে যোগ দেয়। ইতিহাসে এটিই ক্রিমিয়া যুদ্ধ হিসেবে বিখ্যাত হয়ে আছে। এ যুদ্ধেই ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল একজন কিংবদন্তিতে পরিণত হন। এ যুদ্ধে রাশিয়া পরাজিত হয় এবং তাদের ক্ষোভ গিয়ে পড়ে তাতারদের ওপর। তৎকালীন জার সরকার তাতারদের অভিযুক্ত করে তুর্কিদের সাহায্য করার জন্য। শাস্তি হিসেবে তাতারদের ওপর রুশ ভাষা বাধ্যতামূলক করা হয়। সড়কের নাম বদলে রুশ নাম দেয়া হয়। দ্যা ক্রিমিয়ান তাতারস বই থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, রুশ অত্যাচারে ১৮৫০ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে মাত্র ১০ বছরেই ক্রিমিয়ায় তাতারদের সংখ্যা ২ লাখ ৭৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৯৪ হাজারে নেমে আসে। বাকিরা একান্ত বাধ্য হয়ে তখন থেকে গিয়েছিল। তাতাররা রুশ শাসকদের বিশ্বাস করতো না।
এর ১ শতাব্দী পর আরো একজন রুশ শাসকের দৃষ্টি পড়লো ক্রিমিয়ার ওপর। সমাজতন্ত্র রাশিয়ার ভাগ্য পরিবর্তন করলেও তাতারদের জন্য তা দুর্ভোগই ডেকে এনেছিল। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সুপ্রিম লিডার জোসেফ স্তালিন তাতার বুদ্ধিজীবীদের সরিয়ে দিতে শুরু করলেন। এই বুদ্ধিজীবী সমপ্রদায় তাতারদের হারানো ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট ছিল। ১৯২৭ সালে স্তালিন এদেরকে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আলাদা করে ৪০ হাজার তাতারকে তিনি সাইবেরিয়ায় পাঠিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন।
আজ থেকে ৭৫ বছর আগের এই মাসেই এর শুরু হয়েছিল। ২য় বিশ্বযুদ্ধে তাতাররা নাৎসি বাহিনীর পক্ষ নিয়েছিল। জার্মানরা স্বাধীনতা দেয়ার লোভ দেখিয়ে তাতার মুসলিমদের দলে ভেড়ায়। হাজার হাজার তাতার সোভিয়েট রেড আর্মির বিরুদ্ধে নাৎসিদের হয়ে যুদ্ধ করে। ফলে ১৯৪৪ সালের ১৮ই মে স্তালিন আবারো তাতারদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং ক্রিমিয়ার সমুদ্র বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার নির্দেশ দেন। স্তালিন তাতারদের ক্রিমিয়া থেকে সরিয়ে মধ্য এশিয়ার উজবেকিস্তানে সরিয়ে দিতে শুরু করেন। অসুখ ও না খেয়ে এদের মধ্যে অর্ধেক মারা গিয়েছিল পথেই। তবে কয়েক হাজার তাতার ইউরোপ ও তুরস্কে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
১৯৫৪ সালে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ ইউক্রেনকে ক্রিমিয়া উপহার দেন। এরপর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে তাতাররা ক্রিমিয়ায় ফিরতে শুরু করে। তবে ততদিনে ক্রিমিয়ার বেশির ভাগ এলাকা রুশদের দ্বারা জনাকীর্ণ হয়ে গেছে। তারপরেও পুনরায় হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে তাতাররা মেজলিস নামে নিজেদের রাজনৈতিক দল গঠন করে।
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্রিমিয়ায় হামলা চালায় রাশিয়া। ইউক্রেন থেকে উপদ্বীপটির আংশিক দখল নিয়ে নেয়। ওই বছরই মার্চ মাসে ক্রিমিয়ার ভাগ্য নির্ধারণ করতে একটি গণভোটের আয়োজন করে রুশ সরকার- হয়তো ইউক্রেনের সঙ্গে থাকবে বা রাশিয়ান ফেডারেশনের অংশ হয়ে থাকবে। এই গণভোটের পর থেকেই তাতারদের ওপর রুশদের হয়রানি বেড়ে যায়। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুসারে, ওই গণভোট ছিল রুশদের অবৈধ ও সহিংস হামলা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো বিষয়। তাতাররা ওই গণভোটের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। গ্রেপ্তার করা হয় বহু তাতার অধিকারকর্মী ও সাংবাদিককে। কেউ কেউ চিরদিনের জন্য নিখোঁজ হয়ে যান। আর কেউ কেউ প্রাণ হারান।
নিখোঁজ হওয়া সাংবাদিকদের একজন ছিলেন রেশাত আমেতভ। তিনি রুশ অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিলেন। তাকে ক্রিমিয়ার রাজধানী সিমফারোপলের কাউন্সিল অব মিনিস্টারস ভবনের সামনে থেকে অপহরণ করা হয়। দুই সপ্তাহ পর তার নির্যাতিত লাশ খুঁজে পাওয়া যায়। আজ অবধি তার হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করা হয়নি।
রুশ অধিগ্রহণের বছরগুলোতে তাতার পত্রিকা, রেডিও ও টিভি স্টেশনগুলোয় ভাঙচুর চালানো হয়। ক্রিমিয়ার ভাষাভিত্তিক সব পাঠদান নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে ক্রিমীয় তাতার নেতা ও মেজলিস প্রধান মোস্তফা ঝেমিলেভ বিদেশ সফর শেষে ক্রিমিয়ায় প্রবেশ করতে চাইলে তাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এরপর থেকে নির্বাসনে রয়েছেন তিনি। ২০১৬ সালের এপ্রিলে রুশরা মেজলিসকে বিপজ্জনক ও চরমপন্থি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যায়িত করে নিষিদ্ধ করে। এরপর থেকে অগণিত তাতারকে সন্ত্রাসবাদ সমর্থনের অভিযোগে বা মুসলিম দলের সদস্য থাকায় গ্রেপ্তার করেছে রুশরা।
গত ডিসেম্বরে ঝেমিলেভ নিউ ইয়র্কস্থ আমেরিকান এসোসিয়েশন অব ক্রিমিয়ান তাতারে সফর করেন। সেখানে নির্বাসিত তাতারদের উদ্দেশে বলেন, ক্রিমিয়ার অবস্থা শোচনীয়। তিনি আরো জানান, সেখানে বাসরত তাতারদের পরবর্তী প্রজন্মের ভাগ্য নিয়ে তিনি শঙ্কিত। রুশরা তাদের ভুল বোঝাচ্ছে ও তাতার সংস্কৃতি, ভাষা, ইসলাম ধর্ম থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। গত বছর রুশরা বিগ খান মসজিদ নতুন করে সাজিয়েছে। পুরনো টাইলস ও কাঠের কাজ সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত তাতাররা জানিয়েছে যে, তারা ক্রিমিয়ায় বাসরত তাদের পরিবার ও বন্ধুদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা সেখানে প্রতিনিয়ত নিপীড়িত হচ্ছে। অনেকের চাকরি চলে গেছে। তারা বেকার হয়ে জীবনযাপন করছে, নতুন চাকরি পাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা রুশ প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার ভয়ে তাতারদের কাজে নিয়োগ দিচ্ছে না। তাতারদের ব্যবসা ও বাড়িতে হামলা চালানো হয়েছে। কখনো কখনো বাজেয়াপ্ত করে নেয়া হয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রিমিয়ায় মানবাধিকার দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে। রুশ ফেডারেশন কর্তৃপক্ষ ফোর্থ জেনেভা কনভেনশন ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘন করে ক্রিমিয়ার নাগরিকদের ওপর ক্রমাগতভাবে তাদের আইন চাপিয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে ক্রিমিয়ায় তাতারদের সংখ্যা ফের ২ লাখ ৫০ হাজারে পৌঁছেছে। কিন্তু আঠারো শতকে যেখানে তারা ছিল উপদ্বীপটির মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ, সেখানে আজ তারা কেবল ১২ শতাংশ।
জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ), ন্যাটো ও তুরস্ক ক্রিমিয়ায় রুশ অধিগ্রহণের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ও উপদ্বীপটিকে রাশিয়ার অংশ মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ন্যাটো ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের অংশ ঘোষণা করেছে। গত বছর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন রুশদের ক্রিমিয়া থেকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব পাস করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ অবৈধ অধিগ্রহণের দায়ে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কিন্তু এসব পদক্ষেপের কোনোটিই পর্যাপ্ত নয়। রাশিয়া আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। কিন্তু কেউ কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেয়নি, রুশদের জোরপূর্বক প্রত্যাহার তো দূরের কথা। উপরন্তু, রুশ কর্তৃক ক্রিমিয় তাতারদের সংস্কৃতি ও জাতিগত নিধনের ধীর প্রক্রিয়া রুখতেও কেউ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো, পশ্চিমারা ও তাদের মানবাধিকার নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলো নীরব ভূমিকাই পালন করেছে। তারা ক্রিমিয়া ও ক্রিমিয়ার তাতারদের বর্জন করেছে।
(এলমিরা বেরাসিল লিখিত প্রতিবেদনের সমপাদিত ভাবানুবাদ।)
৫ বছর আগে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকে ক্রিমিয়ার প্রায় আড়াই লাখ তাতারদের ওপর নেমে এসেছে ভয়াবহ দুর্যোগ। তাদেরকে কাজ, ভাষা ও সংবাদপত্রের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তবে এটিই ক্রিমিয়ার তাতারদের ওপর নির্যাতনের প্রথম ঘটনা নয়। তাতার জাতি মূলত তুরস্ক থেকে এখানে এসেছে। গত এক শতাব্দী ধরে তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য জোরপূর্বক ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে রুশ শাসনে তাদেরকে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে।
ক্রিমিয়া দ্বীপে তাতাররা প্রথমে বাস করতে শুরু করেন ১৩ শতকে। তখন থেকেই বারবার তাতারদের ওপর বিভিন্ন গোষ্ঠী হামলা চালাতে থাকে। তবে এর পেছনে তাদের সংস্কৃতি বা ধর্ম কোনো কারণ ছিল না। তাদের কাছে ব্যাপক পরিমাণ পানির উৎস থাকায় তাদেরকে টার্গেট করা হয়। ক্রিমিয়া পুরোপুরিভাবে পানি দিয়ে ঘেরা। এর চারদিকে রয়েছে কৃষ্ণসাগর (ব্ল্যাক সি) ও আজভ সাগর। তাই সমুদ্রে সরাসরি প্রবেশের ইচ্ছে থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ক্রিমিয়ার দিকে ক্ষুধার্থ চোখ ছিল রাশিয়ার।
সমস্যার সূচনা হয় ১৭৭০ সালে। সে সময় ক্যাথেরিন দ্যা গ্রেটের নেতৃত্বে ক্রিমিয়া দখল করে রাশিয়া। ক্রিমিয়া তখন অটোমান বা ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। দখলের পর ক্রিমিয়ার প্রধান বন্দরগুলো ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে যায় রাশিয়া। সেখানে রাজনৈতিক অনেক পরিবর্তন আনা হয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ক্রিমিয়ার শাসক তাতার খানকে উচ্ছেদ করে রুশ গভর্নরের হাতে শাসন ছেড়ে দেয়া। ক্যাথেরিন রুশ নাগরিকদের এই দ্বীপে এসে স্থায়ী আবাস গড়ার ব্যবস্থা করে দেন। ফলে প্রথমবারের মতো ক্রিমিয়া থেকে উচ্ছেদ হতে শুরু করেন তাতাররা। দ্বীপটির ৮৫ ভাগই ছিল তাতার জাতির। ১৭৮৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিমিয়াকে নিজের অন্তর্ভুক্ত করে রাশিয়া। ফলে ৮ থেকে ১০ হাজার তাতারকে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্য কোথাও পালিয়ে যেতে হয়।
১৮৫৩ সালে রাশিয়া তার সাম্রাজ্য আরো বড় করার পরিকল্পনা নেয়। ফলে রুশদের থামাতে ওসমানীয়রা সৈন্য মোতায়েন শুরু করে। পরবর্তী দুই বছরে বৃটেন, ফ্রান্স ও সার্ডিনিয়া ওসমানীয়দের সঙ্গে যোগ দেয়। ইতিহাসে এটিই ক্রিমিয়া যুদ্ধ হিসেবে বিখ্যাত হয়ে আছে। এ যুদ্ধেই ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল একজন কিংবদন্তিতে পরিণত হন। এ যুদ্ধে রাশিয়া পরাজিত হয় এবং তাদের ক্ষোভ গিয়ে পড়ে তাতারদের ওপর। তৎকালীন জার সরকার তাতারদের অভিযুক্ত করে তুর্কিদের সাহায্য করার জন্য। শাস্তি হিসেবে তাতারদের ওপর রুশ ভাষা বাধ্যতামূলক করা হয়। সড়কের নাম বদলে রুশ নাম দেয়া হয়। দ্যা ক্রিমিয়ান তাতারস বই থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, রুশ অত্যাচারে ১৮৫০ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে মাত্র ১০ বছরেই ক্রিমিয়ায় তাতারদের সংখ্যা ২ লাখ ৭৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৯৪ হাজারে নেমে আসে। বাকিরা একান্ত বাধ্য হয়ে তখন থেকে গিয়েছিল। তাতাররা রুশ শাসকদের বিশ্বাস করতো না।
এর ১ শতাব্দী পর আরো একজন রুশ শাসকের দৃষ্টি পড়লো ক্রিমিয়ার ওপর। সমাজতন্ত্র রাশিয়ার ভাগ্য পরিবর্তন করলেও তাতারদের জন্য তা দুর্ভোগই ডেকে এনেছিল। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সুপ্রিম লিডার জোসেফ স্তালিন তাতার বুদ্ধিজীবীদের সরিয়ে দিতে শুরু করলেন। এই বুদ্ধিজীবী সমপ্রদায় তাতারদের হারানো ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট ছিল। ১৯২৭ সালে স্তালিন এদেরকে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আলাদা করে ৪০ হাজার তাতারকে তিনি সাইবেরিয়ায় পাঠিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন।
আজ থেকে ৭৫ বছর আগের এই মাসেই এর শুরু হয়েছিল। ২য় বিশ্বযুদ্ধে তাতাররা নাৎসি বাহিনীর পক্ষ নিয়েছিল। জার্মানরা স্বাধীনতা দেয়ার লোভ দেখিয়ে তাতার মুসলিমদের দলে ভেড়ায়। হাজার হাজার তাতার সোভিয়েট রেড আর্মির বিরুদ্ধে নাৎসিদের হয়ে যুদ্ধ করে। ফলে ১৯৪৪ সালের ১৮ই মে স্তালিন আবারো তাতারদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং ক্রিমিয়ার সমুদ্র বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার নির্দেশ দেন। স্তালিন তাতারদের ক্রিমিয়া থেকে সরিয়ে মধ্য এশিয়ার উজবেকিস্তানে সরিয়ে দিতে শুরু করেন। অসুখ ও না খেয়ে এদের মধ্যে অর্ধেক মারা গিয়েছিল পথেই। তবে কয়েক হাজার তাতার ইউরোপ ও তুরস্কে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
১৯৫৪ সালে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ ইউক্রেনকে ক্রিমিয়া উপহার দেন। এরপর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে তাতাররা ক্রিমিয়ায় ফিরতে শুরু করে। তবে ততদিনে ক্রিমিয়ার বেশির ভাগ এলাকা রুশদের দ্বারা জনাকীর্ণ হয়ে গেছে। তারপরেও পুনরায় হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে তাতাররা মেজলিস নামে নিজেদের রাজনৈতিক দল গঠন করে।
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্রিমিয়ায় হামলা চালায় রাশিয়া। ইউক্রেন থেকে উপদ্বীপটির আংশিক দখল নিয়ে নেয়। ওই বছরই মার্চ মাসে ক্রিমিয়ার ভাগ্য নির্ধারণ করতে একটি গণভোটের আয়োজন করে রুশ সরকার- হয়তো ইউক্রেনের সঙ্গে থাকবে বা রাশিয়ান ফেডারেশনের অংশ হয়ে থাকবে। এই গণভোটের পর থেকেই তাতারদের ওপর রুশদের হয়রানি বেড়ে যায়। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুসারে, ওই গণভোট ছিল রুশদের অবৈধ ও সহিংস হামলা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো বিষয়। তাতাররা ওই গণভোটের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। গ্রেপ্তার করা হয় বহু তাতার অধিকারকর্মী ও সাংবাদিককে। কেউ কেউ চিরদিনের জন্য নিখোঁজ হয়ে যান। আর কেউ কেউ প্রাণ হারান।
নিখোঁজ হওয়া সাংবাদিকদের একজন ছিলেন রেশাত আমেতভ। তিনি রুশ অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিলেন। তাকে ক্রিমিয়ার রাজধানী সিমফারোপলের কাউন্সিল অব মিনিস্টারস ভবনের সামনে থেকে অপহরণ করা হয়। দুই সপ্তাহ পর তার নির্যাতিত লাশ খুঁজে পাওয়া যায়। আজ অবধি তার হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করা হয়নি।
রুশ অধিগ্রহণের বছরগুলোতে তাতার পত্রিকা, রেডিও ও টিভি স্টেশনগুলোয় ভাঙচুর চালানো হয়। ক্রিমিয়ার ভাষাভিত্তিক সব পাঠদান নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে ক্রিমীয় তাতার নেতা ও মেজলিস প্রধান মোস্তফা ঝেমিলেভ বিদেশ সফর শেষে ক্রিমিয়ায় প্রবেশ করতে চাইলে তাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এরপর থেকে নির্বাসনে রয়েছেন তিনি। ২০১৬ সালের এপ্রিলে রুশরা মেজলিসকে বিপজ্জনক ও চরমপন্থি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যায়িত করে নিষিদ্ধ করে। এরপর থেকে অগণিত তাতারকে সন্ত্রাসবাদ সমর্থনের অভিযোগে বা মুসলিম দলের সদস্য থাকায় গ্রেপ্তার করেছে রুশরা।
গত ডিসেম্বরে ঝেমিলেভ নিউ ইয়র্কস্থ আমেরিকান এসোসিয়েশন অব ক্রিমিয়ান তাতারে সফর করেন। সেখানে নির্বাসিত তাতারদের উদ্দেশে বলেন, ক্রিমিয়ার অবস্থা শোচনীয়। তিনি আরো জানান, সেখানে বাসরত তাতারদের পরবর্তী প্রজন্মের ভাগ্য নিয়ে তিনি শঙ্কিত। রুশরা তাদের ভুল বোঝাচ্ছে ও তাতার সংস্কৃতি, ভাষা, ইসলাম ধর্ম থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। গত বছর রুশরা বিগ খান মসজিদ নতুন করে সাজিয়েছে। পুরনো টাইলস ও কাঠের কাজ সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত তাতাররা জানিয়েছে যে, তারা ক্রিমিয়ায় বাসরত তাদের পরিবার ও বন্ধুদের নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা সেখানে প্রতিনিয়ত নিপীড়িত হচ্ছে। অনেকের চাকরি চলে গেছে। তারা বেকার হয়ে জীবনযাপন করছে, নতুন চাকরি পাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা রুশ প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার ভয়ে তাতারদের কাজে নিয়োগ দিচ্ছে না। তাতারদের ব্যবসা ও বাড়িতে হামলা চালানো হয়েছে। কখনো কখনো বাজেয়াপ্ত করে নেয়া হয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রিমিয়ায় মানবাধিকার দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে। রুশ ফেডারেশন কর্তৃপক্ষ ফোর্থ জেনেভা কনভেনশন ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘন করে ক্রিমিয়ার নাগরিকদের ওপর ক্রমাগতভাবে তাদের আইন চাপিয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে ক্রিমিয়ায় তাতারদের সংখ্যা ফের ২ লাখ ৫০ হাজারে পৌঁছেছে। কিন্তু আঠারো শতকে যেখানে তারা ছিল উপদ্বীপটির মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ, সেখানে আজ তারা কেবল ১২ শতাংশ।
জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ), ন্যাটো ও তুরস্ক ক্রিমিয়ায় রুশ অধিগ্রহণের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ও উপদ্বীপটিকে রাশিয়ার অংশ মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ন্যাটো ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের অংশ ঘোষণা করেছে। গত বছর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন রুশদের ক্রিমিয়া থেকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব পাস করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ অবৈধ অধিগ্রহণের দায়ে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কিন্তু এসব পদক্ষেপের কোনোটিই পর্যাপ্ত নয়। রাশিয়া আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। কিন্তু কেউ কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেয়নি, রুশদের জোরপূর্বক প্রত্যাহার তো দূরের কথা। উপরন্তু, রুশ কর্তৃক ক্রিমিয় তাতারদের সংস্কৃতি ও জাতিগত নিধনের ধীর প্রক্রিয়া রুখতেও কেউ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো, পশ্চিমারা ও তাদের মানবাধিকার নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলো নীরব ভূমিকাই পালন করেছে। তারা ক্রিমিয়া ও ক্রিমিয়ার তাতারদের বর্জন করেছে।
(এলমিরা বেরাসিল লিখিত প্রতিবেদনের সমপাদিত ভাবানুবাদ।)
No comments