শোনো শোনো ওশানের গান by নুসরাত সাবিনা
সূর্যোদয় |
গৎবাঁধা
কর্মসূচি তলিয়ে গিয়ে নতুন আয়োজন শুরু হলো। নাসিফ হোটেল বুক করছে। আমি
খাবার প্যাক করছি। আগামীকালের স্কেজুয়ালটা আকাশে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। তাই
আল্লাহ আমাকে দিয়ে সারা দিন ধরে কিমা ভুনা, পরোটা, লাউ ভাজি ইত্যাদি বানিয়ে
নিয়েছেন। তখন আমি জানতাম না, কেন এত বেশি পরিমাণে রান্না করছি পদগুলো!
হোটেলে গিয়ে হোমমেড ফুড খেতে ভালো লাগার নানাবিধ দিক ছিল। যেমন হোমমেড ফুড খাওয়ার তৃপ্তি, অজান্তেই তা প্রস্তুত করতে পারার গর্ব এবং যিনি তা করিয়ে নিয়েছেন তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা। আর খাবারের মধ্যেও স্বর্গীয় একটা ব্যাপার ছিল। তা না হলে সাধারণ লাউ-আলু ভাজি, পরোটা, কিমাতে এত স্বাদ থাকা অস্বাভাবিক। শাব্দিক অর্থেই রাতারাতি ওশন সিটি ভ্রমণের বন্দোবস্ত হয়ে গেল একটা এক রত্তি গল্প প্রসঙ্গে।
গল্পটি শানেনুজুলসহ সংক্ষেপে বর্ণিত হলো।
সাতটি জ্যৈষ্ঠ মাস গত হয়েছে গ্রামে যাইনি। সেই মাসে, যখন এইচএসসি ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল দিয়ে ফ্রি হয়েছি, মেজ চাচা এসে জোর করে আব্বার সম্মতি আদায় করে আমাদের গ্রামে নিয়ে গেলেন। বড় হয়ে সেই প্রথম ও শেষ গ্রাম দেখা। ছোটবেলার স্মৃতিগুলো জীবন্ত হয়ে উঠল। সেই হলদে হাঁসের ছানার হেলাদোলা, সেজ চাচার ধরা ছোট মাছের ছালুন, গাছের আম, কাঁঠাল, ঘরের লালি, গমের ভাত, খেতের কাঁচা মরিচ, দাদি, ফুফু, চাচা, চাচির সঙ্গে বেড়ানো—এসবই স্মরণীয়-বরণীয়। এর মাঝে সবচেয়ে মন কেড়েছিল তিনটা জিনিস—তর্জনী, মধ্যমা ও অনামিকা উঁচিয়ে বললাম নাসিফকে।
এক নম্বর ‘বাতাস’। ঢাকা থেকে রাজশাহী কোচ ভ্রমণের পর লোকাল বাস, তারপর রিকশা। রিকশাটা যখনই শহর ছাড়ল, সবুজের ঘনত্ব বাড়ল, সন্ধ্যা আঁচল নাড়ল, মিকাইল ছাড়ল সেই সুষম হাওয়া, যা ক্ষুধা তৃষ্ণা, ক্লান্তি মোছার ভার নিল। মুমূর্ষু শরীর, মনকে নবজীবন দিল। কী তামসা! বাথরুমেও বেশুমার বাতাস। গোসলে, খাওয়াতে, রাতে উঠানে গপ্পে, গীতে—কোথায় নেই সেই আম, তেঁতুল, নিমপাতাবাহিত শীতল, ঔষধি হাওয়া?
দুই নম্বর ‘প্রশস্ততা’। এত বড় একটা পৃথিবী ও আকাশের মালিক আমি ঢাকায় থাকায় বুঝতেই পারিনি।... আমার আম চটকানি বয়ানের মাঝে ছেদ ফেলে নাসিফ বলল, চলো, আম্মু এই ছুটিতে আমরা শহর ছেড়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যাই।
ওর প্রস্তাবকে উড়িয়েই দিলাম, ধেৎ! বাসা বদলসংক্রান্ত খরচপাতির শেষই হচ্ছে না। প্রয়োজনের তেনা এখনো পেঁচতেই আছে। আর, শাঁখের করাতের ক্যাচরম্যাচর তো আছেই।
টাকার ব্যাপার আমি আর ওয়াসিফ দেখব। শীতের দিন, এখন হোটেল ভাড়া কম, ব্লা-ব্লা-ব্লা বলে নাসিফ আমার সম্মতি নিয়ে বাবা ও ভাইদের কাছে দৌড়াল।
আবহাওয়াও অনুকূলে। ৪৫-৪৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট। ডিসেম্বরের শেষে আল্লাহ যেন আমাদের এই ভ্রমণের জন্যই মিকাইলকে বিশেষ অর্ডার দেন, নো স্নো ফল, নো রেইন ফর বুধ ও বৃহস্পতি।
শুক্রবার বৃষ্টির পূর্বাভাস বিধায় আমরা পরদিন বুধবারকে পবিত্র দিন হিসেবে ঠিক করলাম। বাসা থেকে মাত্র তিন ঘণ্টার ড্রাইভ ওশান সিটি। বিচের ধারে মাইলকে মাইল সারি সারি ওয়াটার ফ্রন্ট হোটেল। প্রতিটা রুমের ব্যালকনি থেকে সাগর দেখা যায়। আমরা কয়তলায় রুম নেব, হলিডে ইনের রিসেপশনিস্ট জিজ্ঞেস করলে, ওদের বাবা টপেস্ট অ্যাভেইলেবল ফ্লোর চায়। ১১ তলার ব্যালকনি থেকে দুনিয়া জোড়া সাগর দেখে মনে হয়, পলকেই অচিন কোনো জগৎ চলে এসেছি! সুলাইমানের প্রাসাদে নিজের সিংহাসন দেখে রানি বিলকিসের চোখ যেমন ছানাবড়া হয়েছিল, তেমনি আমাদের চোখ এই জললোক দেখে।
সাতসকালে ৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইটেও অনেক মানুষ বিচে বেড়াচ্ছে। বোর্ড ওয়াকে বাইকিং, জগিং, রানিং সবই চলছে। কচি রোদের সৌম্য সংক্রমিত হয়েছে সবার মধ্যে। সময়ও চলছে সন্তর্পণে এখানে। তাই মানুষের ফুরসত হয়েছে পরস্পরের দিকে তাকাতে, হাসতে, হাই বলতে। শীতের বেলাভূমি সূর্যোদয়ের মতো শান্ত, পবিত্র। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে একসময় পানির কাছে বসলাম। ডান পাশে বড় বড় পাথরে ধাক্কা খেয়ে সিংহের মতো গর্জন করছে ঢেউ। গায়ে এসে লাগছে পানির ছিটা। এই বিস্তীর্ণ জলতরঙ্গ গিয়ে আছড়ে পড়ছে ইউরোপ, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকায়। এই জলে হাত দিয়ে স্পর্শ করছি স্পেন, মরক্কো, ব্রাজিল।
বিশালতা ও সৌন্দর্য একই সূত্রে গাঁথা সমুদ্রে। এ দুটো গুণের সমাবেশ মানুষের মাঝে বিরল। যে উল্লম্বতায় উঁচু, সে সর্বত্র খাটো খোঁটে, আর আত্মপ্রসাদ চাটে। কেউ নিজকে মহাজ্ঞানী ভেবে অন্যের মূর্খতা মাপে, আর কাঁপে সুখ শিহরণে। কেউবা নিজের গুণটা অন্যের মাঝে অনুপস্থিত দেখে তাকে বেগুন ভেবে পোড়ায়, ভর্তা করে। স্রষ্টার অসংখ্য গুণ বুকে ধারণ করে সাগর এমন সমৃদ্ধ, আর আমরা নিদারুণ দেউলিয়া!
আমি গ্রামের বাতাসের কথা স্মরণ করেছি। আল্লাহ আমাকে সাগরের হাওয়া খাওয়াতে এনেছে। এ স্বর্গীয় হাওয়ার পরশে শরীর, মন, আত্মা পরস্পর দলাদলি ছেড়ে গলাগলি উড়ছে। তার সমাদরে গত দুই সপ্তাহব্যাপী ছ্যাঁচড়া কাশি সমূলে উৎপাটিত হয়েছে। কাঠের ব্যালকনি ফ্রিজ হয়ে আছে শিশির জমে। সেখানে খালি পায়ে, হালকা শালে দাঁড়িয়ে আছি দীর্ঘক্ষণ, তবু শীত লাগছে না। শীতও কি প্রীত হয়ে গেছে অনন্ত ছোঁয়া এই গীত শুনে? মাঝরাতে, চাঁদ ও সাগরের গীতিনকশা রেখে কার বিছানায় যেতে ইচ্ছে হয়? তবু ফজর ও সূর্যোদয়ের প্রত্যাশায় গেলাম। ডান কাতে দেখি, বিছানার নিচ দিয়ে সাগর ডাগর চোখে নাচছে জমকালো কালো শাড়িতে, চাঁদের টিপে।
মুসা কিছুতেই আসবে না। সেদিন ওর বুক ব্যথা, জ্বর ভাব। পরদিন দুপুর বারোটা পর্যন্ত বিছানায়। সবার ডাকাডাকি ব্যর্থ। শেষে পুরো রেডি হয়ে ১৮ বছরের বুড়োকে পটানোর মতো শক্ত কাজ করতে হলো, যার কিছু খুচরো নমুনা:
বিচ হলো প্রেসক্রিপশন মেডিসিন। গাড়িতে আমার কোলে ঘুমিয়ো। হোটেলে গিয়ে সারা দিন রাত শুয়ে থেকো। তোমার বাইরে বের হতে হবে না। বেড়ে গেলে ডাক্তার দেখাব। তুমি ছাড়া আমরা ইনকমপ্লিট। উই ক্যান্ট ইভেন গো উইদাউট ইউ। টাকা পে করা হয়ে গেছে, নন রিফান্ডেবল।
জানি না কোন ঝড়ে বক পড়ল। সে উঠে পাঁচ মিনিটে রেডি হলো। আর সাগরের গানে মুসাই বেশি নেচেছে। একান–ওকান হাসি বিস্তৃত থেকেছে চেহারায়। লিভিং রুমে একাই কুইন সাইজ সোফা বেডটায় কিংয়ের মতো গেজিয়েছে। ইজি চেয়ারে পিসি ইউজ করেছে সাতসকালে, যখন তাকে বোমা মেরেও তোলা যায় না বিছানা থেকে। ডলফিনের ডাইভের মতো ফজর পড়েই বেডে তলিয়ে যায়। সেই মুসা আজ সূর্যোদয়ের জন্য অপেক্ষা করছে ফজর থেকে।
সূর্যটা কি সোনার কাঠি দিগন্তজোড়া, সাগর ও আকাশের ফাঁকে গোঁজা, ঘন আঁধারের বাঁকে, মহারাজার হাতে ধরা, ধরার ঘুম ভাঙাতে? তাই তো রূপকথা হার মেনেছে আজ। ধীরে ধীরে পুরু হয় কাঠিটা। সোনাল আজ কোন গয়না গড়বে এ সোনা দিয়ে? এত তাপাচ্ছে কেন? এই কড়া কমলার চমকে থমকে গেছে প্রতিটা পলক! তারপর, দেখ টিকলির ঝলক পৃথিবীর কপালে। ঠিকরে পড়া আলোর হাসি আকাশে, বাতাসে, সাগরে। সে হাসি দেখে কে ঠিক থাকতে পারে? তাই তো মুসা সাতসকালে ভাইয়ের সঙ্গে বিচে চলে গেল। সেখান থেকে ফিরে এসে ধুমসে কফি বানিয়ে খেলছে। ১৮ বছরের জীবনে আজই সে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সম্পূর্ণ রঙিন কফি প্রস্তুত করেছে। আর হ্যাঁ, গতকালের অসুস্থতার কোনো লক্ষণ আছে মুসার মাঝে? নেই। লক্ষ্মণ সেনের মতো তা পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেছে।
ফেরার পথে ওদের বাবার অনুরোধে গাড়িতে বাজানোর জন্য বাংলা, ইংলিশ, হিন্দি, আরবি, জাপানি কোনো একটা গানও খুঁজে পেলাম না। যে গান ছাড়ি ত্যানা ত্যানা লাগে। কোনো গান টু ওয়ার্ডি, কোনোটা টু মিউজিকি, কোনোটা চড়া তো কোনোটা মিনমিনে।
প্রাণে বাজে সাগরের গান, যা অসীমের পানে টানে।
নুসরাত সাবিনা: শিক্ষক, মন্টিসরি স্কুল, এলকরিজ, মেরিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র।
হোটেলে গিয়ে হোমমেড ফুড খেতে ভালো লাগার নানাবিধ দিক ছিল। যেমন হোমমেড ফুড খাওয়ার তৃপ্তি, অজান্তেই তা প্রস্তুত করতে পারার গর্ব এবং যিনি তা করিয়ে নিয়েছেন তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা। আর খাবারের মধ্যেও স্বর্গীয় একটা ব্যাপার ছিল। তা না হলে সাধারণ লাউ-আলু ভাজি, পরোটা, কিমাতে এত স্বাদ থাকা অস্বাভাবিক। শাব্দিক অর্থেই রাতারাতি ওশন সিটি ভ্রমণের বন্দোবস্ত হয়ে গেল একটা এক রত্তি গল্প প্রসঙ্গে।
গল্পটি শানেনুজুলসহ সংক্ষেপে বর্ণিত হলো।
সাতটি জ্যৈষ্ঠ মাস গত হয়েছে গ্রামে যাইনি। সেই মাসে, যখন এইচএসসি ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল দিয়ে ফ্রি হয়েছি, মেজ চাচা এসে জোর করে আব্বার সম্মতি আদায় করে আমাদের গ্রামে নিয়ে গেলেন। বড় হয়ে সেই প্রথম ও শেষ গ্রাম দেখা। ছোটবেলার স্মৃতিগুলো জীবন্ত হয়ে উঠল। সেই হলদে হাঁসের ছানার হেলাদোলা, সেজ চাচার ধরা ছোট মাছের ছালুন, গাছের আম, কাঁঠাল, ঘরের লালি, গমের ভাত, খেতের কাঁচা মরিচ, দাদি, ফুফু, চাচা, চাচির সঙ্গে বেড়ানো—এসবই স্মরণীয়-বরণীয়। এর মাঝে সবচেয়ে মন কেড়েছিল তিনটা জিনিস—তর্জনী, মধ্যমা ও অনামিকা উঁচিয়ে বললাম নাসিফকে।
এক নম্বর ‘বাতাস’। ঢাকা থেকে রাজশাহী কোচ ভ্রমণের পর লোকাল বাস, তারপর রিকশা। রিকশাটা যখনই শহর ছাড়ল, সবুজের ঘনত্ব বাড়ল, সন্ধ্যা আঁচল নাড়ল, মিকাইল ছাড়ল সেই সুষম হাওয়া, যা ক্ষুধা তৃষ্ণা, ক্লান্তি মোছার ভার নিল। মুমূর্ষু শরীর, মনকে নবজীবন দিল। কী তামসা! বাথরুমেও বেশুমার বাতাস। গোসলে, খাওয়াতে, রাতে উঠানে গপ্পে, গীতে—কোথায় নেই সেই আম, তেঁতুল, নিমপাতাবাহিত শীতল, ঔষধি হাওয়া?
দুই নম্বর ‘প্রশস্ততা’। এত বড় একটা পৃথিবী ও আকাশের মালিক আমি ঢাকায় থাকায় বুঝতেই পারিনি।... আমার আম চটকানি বয়ানের মাঝে ছেদ ফেলে নাসিফ বলল, চলো, আম্মু এই ছুটিতে আমরা শহর ছেড়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যাই।
ওর প্রস্তাবকে উড়িয়েই দিলাম, ধেৎ! বাসা বদলসংক্রান্ত খরচপাতির শেষই হচ্ছে না। প্রয়োজনের তেনা এখনো পেঁচতেই আছে। আর, শাঁখের করাতের ক্যাচরম্যাচর তো আছেই।
টাকার ব্যাপার আমি আর ওয়াসিফ দেখব। শীতের দিন, এখন হোটেল ভাড়া কম, ব্লা-ব্লা-ব্লা বলে নাসিফ আমার সম্মতি নিয়ে বাবা ও ভাইদের কাছে দৌড়াল।
আবহাওয়াও অনুকূলে। ৪৫-৪৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট। ডিসেম্বরের শেষে আল্লাহ যেন আমাদের এই ভ্রমণের জন্যই মিকাইলকে বিশেষ অর্ডার দেন, নো স্নো ফল, নো রেইন ফর বুধ ও বৃহস্পতি।
শুক্রবার বৃষ্টির পূর্বাভাস বিধায় আমরা পরদিন বুধবারকে পবিত্র দিন হিসেবে ঠিক করলাম। বাসা থেকে মাত্র তিন ঘণ্টার ড্রাইভ ওশান সিটি। বিচের ধারে মাইলকে মাইল সারি সারি ওয়াটার ফ্রন্ট হোটেল। প্রতিটা রুমের ব্যালকনি থেকে সাগর দেখা যায়। আমরা কয়তলায় রুম নেব, হলিডে ইনের রিসেপশনিস্ট জিজ্ঞেস করলে, ওদের বাবা টপেস্ট অ্যাভেইলেবল ফ্লোর চায়। ১১ তলার ব্যালকনি থেকে দুনিয়া জোড়া সাগর দেখে মনে হয়, পলকেই অচিন কোনো জগৎ চলে এসেছি! সুলাইমানের প্রাসাদে নিজের সিংহাসন দেখে রানি বিলকিসের চোখ যেমন ছানাবড়া হয়েছিল, তেমনি আমাদের চোখ এই জললোক দেখে।
সাতসকালে ৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইটেও অনেক মানুষ বিচে বেড়াচ্ছে। বোর্ড ওয়াকে বাইকিং, জগিং, রানিং সবই চলছে। কচি রোদের সৌম্য সংক্রমিত হয়েছে সবার মধ্যে। সময়ও চলছে সন্তর্পণে এখানে। তাই মানুষের ফুরসত হয়েছে পরস্পরের দিকে তাকাতে, হাসতে, হাই বলতে। শীতের বেলাভূমি সূর্যোদয়ের মতো শান্ত, পবিত্র। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে একসময় পানির কাছে বসলাম। ডান পাশে বড় বড় পাথরে ধাক্কা খেয়ে সিংহের মতো গর্জন করছে ঢেউ। গায়ে এসে লাগছে পানির ছিটা। এই বিস্তীর্ণ জলতরঙ্গ গিয়ে আছড়ে পড়ছে ইউরোপ, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকায়। এই জলে হাত দিয়ে স্পর্শ করছি স্পেন, মরক্কো, ব্রাজিল।
বিশালতা ও সৌন্দর্য একই সূত্রে গাঁথা সমুদ্রে। এ দুটো গুণের সমাবেশ মানুষের মাঝে বিরল। যে উল্লম্বতায় উঁচু, সে সর্বত্র খাটো খোঁটে, আর আত্মপ্রসাদ চাটে। কেউ নিজকে মহাজ্ঞানী ভেবে অন্যের মূর্খতা মাপে, আর কাঁপে সুখ শিহরণে। কেউবা নিজের গুণটা অন্যের মাঝে অনুপস্থিত দেখে তাকে বেগুন ভেবে পোড়ায়, ভর্তা করে। স্রষ্টার অসংখ্য গুণ বুকে ধারণ করে সাগর এমন সমৃদ্ধ, আর আমরা নিদারুণ দেউলিয়া!
আমি গ্রামের বাতাসের কথা স্মরণ করেছি। আল্লাহ আমাকে সাগরের হাওয়া খাওয়াতে এনেছে। এ স্বর্গীয় হাওয়ার পরশে শরীর, মন, আত্মা পরস্পর দলাদলি ছেড়ে গলাগলি উড়ছে। তার সমাদরে গত দুই সপ্তাহব্যাপী ছ্যাঁচড়া কাশি সমূলে উৎপাটিত হয়েছে। কাঠের ব্যালকনি ফ্রিজ হয়ে আছে শিশির জমে। সেখানে খালি পায়ে, হালকা শালে দাঁড়িয়ে আছি দীর্ঘক্ষণ, তবু শীত লাগছে না। শীতও কি প্রীত হয়ে গেছে অনন্ত ছোঁয়া এই গীত শুনে? মাঝরাতে, চাঁদ ও সাগরের গীতিনকশা রেখে কার বিছানায় যেতে ইচ্ছে হয়? তবু ফজর ও সূর্যোদয়ের প্রত্যাশায় গেলাম। ডান কাতে দেখি, বিছানার নিচ দিয়ে সাগর ডাগর চোখে নাচছে জমকালো কালো শাড়িতে, চাঁদের টিপে।
মুসা কিছুতেই আসবে না। সেদিন ওর বুক ব্যথা, জ্বর ভাব। পরদিন দুপুর বারোটা পর্যন্ত বিছানায়। সবার ডাকাডাকি ব্যর্থ। শেষে পুরো রেডি হয়ে ১৮ বছরের বুড়োকে পটানোর মতো শক্ত কাজ করতে হলো, যার কিছু খুচরো নমুনা:
বিচ হলো প্রেসক্রিপশন মেডিসিন। গাড়িতে আমার কোলে ঘুমিয়ো। হোটেলে গিয়ে সারা দিন রাত শুয়ে থেকো। তোমার বাইরে বের হতে হবে না। বেড়ে গেলে ডাক্তার দেখাব। তুমি ছাড়া আমরা ইনকমপ্লিট। উই ক্যান্ট ইভেন গো উইদাউট ইউ। টাকা পে করা হয়ে গেছে, নন রিফান্ডেবল।
জানি না কোন ঝড়ে বক পড়ল। সে উঠে পাঁচ মিনিটে রেডি হলো। আর সাগরের গানে মুসাই বেশি নেচেছে। একান–ওকান হাসি বিস্তৃত থেকেছে চেহারায়। লিভিং রুমে একাই কুইন সাইজ সোফা বেডটায় কিংয়ের মতো গেজিয়েছে। ইজি চেয়ারে পিসি ইউজ করেছে সাতসকালে, যখন তাকে বোমা মেরেও তোলা যায় না বিছানা থেকে। ডলফিনের ডাইভের মতো ফজর পড়েই বেডে তলিয়ে যায়। সেই মুসা আজ সূর্যোদয়ের জন্য অপেক্ষা করছে ফজর থেকে।
সূর্যটা কি সোনার কাঠি দিগন্তজোড়া, সাগর ও আকাশের ফাঁকে গোঁজা, ঘন আঁধারের বাঁকে, মহারাজার হাতে ধরা, ধরার ঘুম ভাঙাতে? তাই তো রূপকথা হার মেনেছে আজ। ধীরে ধীরে পুরু হয় কাঠিটা। সোনাল আজ কোন গয়না গড়বে এ সোনা দিয়ে? এত তাপাচ্ছে কেন? এই কড়া কমলার চমকে থমকে গেছে প্রতিটা পলক! তারপর, দেখ টিকলির ঝলক পৃথিবীর কপালে। ঠিকরে পড়া আলোর হাসি আকাশে, বাতাসে, সাগরে। সে হাসি দেখে কে ঠিক থাকতে পারে? তাই তো মুসা সাতসকালে ভাইয়ের সঙ্গে বিচে চলে গেল। সেখান থেকে ফিরে এসে ধুমসে কফি বানিয়ে খেলছে। ১৮ বছরের জীবনে আজই সে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সম্পূর্ণ রঙিন কফি প্রস্তুত করেছে। আর হ্যাঁ, গতকালের অসুস্থতার কোনো লক্ষণ আছে মুসার মাঝে? নেই। লক্ষ্মণ সেনের মতো তা পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেছে।
ফেরার পথে ওদের বাবার অনুরোধে গাড়িতে বাজানোর জন্য বাংলা, ইংলিশ, হিন্দি, আরবি, জাপানি কোনো একটা গানও খুঁজে পেলাম না। যে গান ছাড়ি ত্যানা ত্যানা লাগে। কোনো গান টু ওয়ার্ডি, কোনোটা টু মিউজিকি, কোনোটা চড়া তো কোনোটা মিনমিনে।
প্রাণে বাজে সাগরের গান, যা অসীমের পানে টানে।
নুসরাত সাবিনা: শিক্ষক, মন্টিসরি স্কুল, এলকরিজ, মেরিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র।
No comments