ভারতে কীভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছিল
১৯৯০ সালের রথযাত্রায় এল কে আদভানি |
ভারতের
রাজনীতিতে এক প্রধান শক্তি হিসেবে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি-র
অবস্থান সুসংহত হয়েছিল 'রথ যাত্রা' নামে এক কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে।
এটি ছিল যাকে বলা হয় এক পরিকল্পিত 'রাজনৈতিক নাটক' - যার লক্ষ্য ছিল ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগণের মনে বিজেপির রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করা।
এই রথযাত্রার পরিকল্পনা করা হয়েছিল জঙ্গী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির এক প্রচারমূলক মিছিল হিসেবে। এর সংগঠক ছিলেন বিজেপির নেতা লাল কৃষ্ণ আদভানি। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, এটা চলবে কয়েক সপ্তাহ জুড়ে এবং ভারতের বিভিন্ন জায়গা হয়ে মোট ৮ হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের পবিত্র শহর অযোধ্যা পর্যন্ত যাবে।
এই রথ যাত্রার মূল দাবি ছিল অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের পক্ষে জনমত সংগঠিত করা। অযোধ্যা শহরের যে জায়গায় এই রামমন্দির নির্মাণের কথা বলা হয়, সেখানেই দেবতা রামচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল বলে হিন্দুরা বিশ্বাস করে। কিন্তু সেখানে মোগল সম্রাট বাবর ষোড়শ শতাব্দীতে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন - যার নাম বাবরি মসজিদ এবং এ কারণে জায়গাটি ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের কাছেও পবিত্র।
পরিকল্পনা করা হয়, রথযাত্রা অযোধ্যায় পৌঁছানোর পর মি. আদভানি সেই বিতর্কিত স্থানটিতে রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন।
সে সময় সাংবাদিক হিসেবে সেই রথযাত্রা প্রত্যক্ষ করেছিলেন আর কে সুধামন। ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে তার পর থেকে কিভাবে বিজেপির উত্থান হয়েছে তাও দেখেছেন তিনি। তিনি কথা বলেছেন বিবিসির ফারহানা হায়দারের সাথে।
মি. সুধামন তখন কাজ করতেন সংবাদ সংস্থা পিটিআইতে। পিটিআই সেই ১৩ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ রথযাত্রা কভার করতে পাঠিয়েছিল তাকে, এবং গুজরাটের সোমনাথ শহর থেকে যখন এই মিছিল শুরু হয়, সেদিন থেকেই সেই রখযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে ভ্রমণ করেছিলেন তিনি।
"বিজেপির তখন এমন একটা রাজনৈতিক আইডিয়ার দরকার ছিল যাতে দলটি টিকে থাকতে এবং বিকশিত হতে পারে। অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের এই কর্মসূচি শুরু করা ছিল মি. আদভানির দিক থেকে এক মাস্টারস্ট্রোক। এর লক্ষ্য ছিল ক্ষমতায় যাবার জন্য ভারতের হিন্দু ভোটকে নিজেদের দিকে টেনে আনা" - বলছিলেন মি. সুধামন।
রথযাত্রার নেতৃত্বে ছিলেন মি. আদভানি তিনি বসেছিলেন একটি ট্রাকে যাকে সাজানো হয়েছিল প্রভু রামচন্দ্রের রথের আকার দিয়ে।
ভোট পাবার জন্যই কি বিজেপি এভাবে ধর্মকে ব্যবহার করেছিল?
প্রশ্ন করা হলে মি. সুধামন বলেন, "হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। এটাই ছিল তাদের রাজনীতির প্রধান অবলম্বন।"
"মি. আদভানির ট্রাকটি বানানো হয়েছিল একটি রথের মতো করে। এর মধ্যে ছিল সবরকম সুযোগ সুবিধা। ছিল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি কক্ষ - যাতে মি. আদভানি জনসভার ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রাম নিতে পারতেন।"
"রথের সামনের দিকটা ছিল খোলা, যেখানে এসে মি. আদভানি জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিতে পারতেন।"
"একটা প্রাচীন যুগের রথের আকৃতিতে বানানো টয়োটা ট্রাকটি দেখতে হয়েছিল বেশ অন্যরকম। এটা সাজানো হয়েছিল রামের ছবি এবং গেরুয়া রঙ দিয়ে - যা বিজেপির রঙ। ফলে ট্রাকটার একটা পৌরাণিক চেহারা ছিল, তবে ভেতরে ছিল সব আধুনিক সুযোগ সুবিধা।"
১৯৯০ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর এই রথযাত্রা শুরু হয়েছিল। যাত্রা শুরুর আগে মন্দিরে পূজো দেন এল কে আদভানি।
আদভানির সাথে এই রথযাত্রায় ছিলেন বিজেপির বেশ কয়েকজন সদস্য - যার মধ্যে ছিলেন উদীয়মান তারকা এবং মি. আদভানির অনুসারী নরেন্দ্র মোদী।
সারা দিন ধরে সেই রথের পেছনে পেছনে চলতো মি. সুধামন সহ একদল সাংবাদিককে বহনকারী যানের বহর।
"যখনই আমরা কোন শহরে পৌঁছাতাম, রথের গতি হয়ে যেতো খুবই ধীর। চারপাশে লোকের ভিড় জমতো, তারা রথের সাথে সাথে হাঁটতে থাকতো। রখটা মাঝে মাঝে বিভিন্ন জায়গায় থামতো, এবং মি. আদভানি বক্তৃতা দিতেন।"
"মি. আদভানির বক্তৃতা ছিল মূলত রামমন্দির এবং কেন এই মন্দির বানাতে হবে - তার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে।"
বিজেপির হিন্দু নেতারা বলতেন, ভারতে তাদের ভাষায় ধর্মনিরপেক্ষতার নামে খুব বেশি মাত্রায় আপোষ করা হয়েছে। তারা বলতেন, এখন সময় এসেছে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কথা বলার ।
মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগ বিজেপি অস্বীকার করতো, কিন্তু তাদের জনসভাগুলো থেকে লোকেরা ঠিক এই বার্তাটি নিয়েই ঘরে ফিরতো।
কেমন সাড়া ফেলেছিল এই রথযাত্রা?
মি. সুধামন বলেন, এটা আসলেই বিপুল সাড়া ফেলেছিল। এতে জনসমাগমও হয়েছিল ব্যাপক।
"এই প্রতিক্রিয়া ছিল স্বাভাবিক, এতে সাজানো কিছু ছিল না। আমি কিছু মহিলাকে দেখেছি, তারা হাতের বালা খুলে আদভানির পায়ের কাছে রেখে বলেছিল, এ থেকে যে অর্থ পাওয়া যাবে তা রাম মন্দির নির্মাণের জন্য ব্যবহার করতে।"
"যতই
দিন যাচ্ছিল, রথযাত্রা ততই জনপ্রিয়তা পাচ্ছিল এবং জনসমাগমও ক্রমাগত
বাড়ছিল। এতে বোঝা যাচ্ছিল যে বিজেপির জনপ্রিয়তা বাড়ছে, এবং এই যাত্রার
মধ্যে দিয়ে মি. আদভানি তার পার্টির পক্ষে জনসমর্থনকে সংহত করতে পেরেছেন। "
এত লোকসমাগম দেখে কি তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন? মি. সুধামনকে এ কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন "হ্যাঁ, এটা সত্যি অপ্রত্যাশিত ছিল, এতে কোন সন্দেহ নেই। এর আগে একমাত্র ইন্দিরা গান্ধী বা রাজীব গান্ধীর মতো নেতাদের পক্ষেই এরকম জনসমাগম ঘটানো সম্ভব ছিল।"
প্রতিদিন ১২ ঘন্টা ধরে উত্তর ও মধ্য ভারতের মধ্যে দিয়ে পথ পরিভ্রমণ করে এই রথযাত্রা। এই অঞ্চলটিকে বর্ণনা করা হয় ভারতের 'হিন্দু হার্টল্যান্ড' হিসেবে। এ অঞ্চলের শহর ও গ্রামগুলোর হাজার হাজার লোক মি. আদভানির বক্তৃতা শুনতে রথযাত্রার পথে জড়ো হয়।
মনে করা হয়, অযোধ্যায় প্রবলভাবে বিতর্কিত রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পথে এই যাত্রা ভারতের আন্ত:ধর্মীয় উত্তেজনাকে উস্কে দিচ্ছিল।
"ভারতের মধ্যঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছিল। আদভানির ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার কারণে তিনি যখন বিহারের সমস্তিপুর পৌঁছালেন, তখন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী তাকে গ্রেফতার করলেন।
সরকারি কর্মকর্তাদের বক্তব্য ছিল, মি. আদভানিকে গ্রেফতার করা ছাড়া তাদের সামনে কোন উপায় ছিল না। কারণ তার এই যাত্রা সহিংসতা উস্কে দেবে এ আশংকা আগে থেকেই ছিল, কারণ একটি ধর্মীয় বিষয়কে এখানে রাজনৈতিক রূপ দেয়া হচ্ছিল এবং দক্ষিণপন্থী হিন্দু মৌলবাদী বিজেপির এই নেতা সে কাজটিই করছিলেন।
রামমন্দির নির্মাণ আন্দোলনের নেতা মি. আদভানি ও তার হাজার হাজার সমর্থককে গ্রেফতার করা হলো। এর ফলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভি পি সিংএর কোয়ালিশন সরকারের প্রতি সমর্থন তুলে নেয় বিজেপি।
ভারত পতিত হয় এক রাজনৈতিক সংকটে।
এর ফলে পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯১ সালেই অনুষ্ঠিত হলো লোকসভা নির্বাচন, এবং তাতে বিজেপির আসনসংখ্যা অনেক বেড়ে গেল।
সাংবাদিক আর কে সুধামন মনে করেন, বিজেপি হয়তো আরো বেশি আসনে জিততো যদি কংগ্রেস নেতা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় নিহত না হতেন।
"যদি রাজীব গান্ধী নিহত না হতেন তাহলে বিজেপি হয়তো আরো বেশি আসনে জিততো। কারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল দুই পর্বে। আর তাতে প্রধান ইস্যুই ছিল রাম মন্দির নির্মাণ।"
"উত্তর ভারতে জনমত জরিপে বিজেপিই এগিয়ে ছিল। কিন্তু যেহেতু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল দুই পর্বে - তাই প্রথম পর্বে যে আসনগুলোতে ভোটগ্রহণ হয়েছিল সেগুলোতে বিজেপি প্রায় একচেটিয়া বিজয় পায়। আর দ্বিতীয় পর্বের ভোট হয়েছিল রাজীব গান্ধী হত্যাকান্ডের পর - সেগুলোতে কংগ্রেস অনেক বেশি আসন পায়। ফলে তারাই সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়।"
এই রথযাত্রার ফলে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালে উগ্র হিন্দু করসেবকরা বাবরি মসজিদ ভেঙে দেয়। ধর্মীয় সহিংসতার কারণে ভারতে এক বিস্ফোরক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় প্রায় ২ হাজার লোক নিহত হয়।
আর কে সুধামন বলছিলেন, তার মতে ১৯৯০ সালের সেই রথযাত্রা ভারতের রাজনীতিকে সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দেয়।
"এটা ছিল এক কর্মসূচি যা আগেকার সব রাজনৈতিক হিসেবনিকেশ পাল্টে দেয়, এবং বিজেপির পক্ষে নিজেদের দলকে গড়ে তোলা সম্ভব হয়।"
"আজ বিজেপি যে ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে তার মূলে রয়েছে সেই রথযাত্রা। এর ফলেই তারা পরিণত হয়েছিল প্রথমে প্রধান বিরোধীদলে, এবং তার পর ক্ষমতাসীন দলে। নিশ্চয়ই এ দলটিকে গড়ে তোলার কৃতিত্ব মি. আদভানির এবং কেউ তা অস্বীকার করতে পারবে না।"
"এতে কোন সন্দেহ নেই যে বিজেপি রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটিয়ে জনগণকে দুভাগ করে ফেলেছে। তবে এটাও ঠিক যে দেশ হিসেবে ভারতের মানুষের মধ্যে মোটামুটিভাবে একটা সহনশীলতা রয়েছে।"
বিজেপি ভারতে প্রথম সরকার গঠন করে ১৯৯৬ সালে, এবং তার পর থেকে তারা একাধিকবার ক্ষমতায় এসেছে।
এটি ছিল যাকে বলা হয় এক পরিকল্পিত 'রাজনৈতিক নাটক' - যার লক্ষ্য ছিল ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগণের মনে বিজেপির রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করা।
এই রথযাত্রার পরিকল্পনা করা হয়েছিল জঙ্গী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির এক প্রচারমূলক মিছিল হিসেবে। এর সংগঠক ছিলেন বিজেপির নেতা লাল কৃষ্ণ আদভানি। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, এটা চলবে কয়েক সপ্তাহ জুড়ে এবং ভারতের বিভিন্ন জায়গা হয়ে মোট ৮ হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের পবিত্র শহর অযোধ্যা পর্যন্ত যাবে।
এই রথ যাত্রার মূল দাবি ছিল অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের পক্ষে জনমত সংগঠিত করা। অযোধ্যা শহরের যে জায়গায় এই রামমন্দির নির্মাণের কথা বলা হয়, সেখানেই দেবতা রামচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল বলে হিন্দুরা বিশ্বাস করে। কিন্তু সেখানে মোগল সম্রাট বাবর ষোড়শ শতাব্দীতে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন - যার নাম বাবরি মসজিদ এবং এ কারণে জায়গাটি ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের কাছেও পবিত্র।
পরিকল্পনা করা হয়, রথযাত্রা অযোধ্যায় পৌঁছানোর পর মি. আদভানি সেই বিতর্কিত স্থানটিতে রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন।
সে সময় সাংবাদিক হিসেবে সেই রথযাত্রা প্রত্যক্ষ করেছিলেন আর কে সুধামন। ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে তার পর থেকে কিভাবে বিজেপির উত্থান হয়েছে তাও দেখেছেন তিনি। তিনি কথা বলেছেন বিবিসির ফারহানা হায়দারের সাথে।
মি. সুধামন তখন কাজ করতেন সংবাদ সংস্থা পিটিআইতে। পিটিআই সেই ১৩ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ রথযাত্রা কভার করতে পাঠিয়েছিল তাকে, এবং গুজরাটের সোমনাথ শহর থেকে যখন এই মিছিল শুরু হয়, সেদিন থেকেই সেই রখযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে ভ্রমণ করেছিলেন তিনি।
"বিজেপির তখন এমন একটা রাজনৈতিক আইডিয়ার দরকার ছিল যাতে দলটি টিকে থাকতে এবং বিকশিত হতে পারে। অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের এই কর্মসূচি শুরু করা ছিল মি. আদভানির দিক থেকে এক মাস্টারস্ট্রোক। এর লক্ষ্য ছিল ক্ষমতায় যাবার জন্য ভারতের হিন্দু ভোটকে নিজেদের দিকে টেনে আনা" - বলছিলেন মি. সুধামন।
রথযাত্রার নেতৃত্বে ছিলেন মি. আদভানি তিনি বসেছিলেন একটি ট্রাকে যাকে সাজানো হয়েছিল প্রভু রামচন্দ্রের রথের আকার দিয়ে।
বিজেপি রামমন্দির ইস্যুতে ধর্মকে ব্যবহার করেই ক্ষমতাসীন হবার পথ তৈরি করে |
প্রশ্ন করা হলে মি. সুধামন বলেন, "হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। এটাই ছিল তাদের রাজনীতির প্রধান অবলম্বন।"
"মি. আদভানির ট্রাকটি বানানো হয়েছিল একটি রথের মতো করে। এর মধ্যে ছিল সবরকম সুযোগ সুবিধা। ছিল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি কক্ষ - যাতে মি. আদভানি জনসভার ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রাম নিতে পারতেন।"
"রথের সামনের দিকটা ছিল খোলা, যেখানে এসে মি. আদভানি জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিতে পারতেন।"
"একটা প্রাচীন যুগের রথের আকৃতিতে বানানো টয়োটা ট্রাকটি দেখতে হয়েছিল বেশ অন্যরকম। এটা সাজানো হয়েছিল রামের ছবি এবং গেরুয়া রঙ দিয়ে - যা বিজেপির রঙ। ফলে ট্রাকটার একটা পৌরাণিক চেহারা ছিল, তবে ভেতরে ছিল সব আধুনিক সুযোগ সুবিধা।"
১৯৯০ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর এই রথযাত্রা শুরু হয়েছিল। যাত্রা শুরুর আগে মন্দিরে পূজো দেন এল কে আদভানি।
আদভানির সাথে এই রথযাত্রায় ছিলেন বিজেপির বেশ কয়েকজন সদস্য - যার মধ্যে ছিলেন উদীয়মান তারকা এবং মি. আদভানির অনুসারী নরেন্দ্র মোদী।
সারা দিন ধরে সেই রথের পেছনে পেছনে চলতো মি. সুধামন সহ একদল সাংবাদিককে বহনকারী যানের বহর।
"যখনই আমরা কোন শহরে পৌঁছাতাম, রথের গতি হয়ে যেতো খুবই ধীর। চারপাশে লোকের ভিড় জমতো, তারা রথের সাথে সাথে হাঁটতে থাকতো। রখটা মাঝে মাঝে বিভিন্ন জায়গায় থামতো, এবং মি. আদভানি বক্তৃতা দিতেন।"
"মি. আদভানির বক্তৃতা ছিল মূলত রামমন্দির এবং কেন এই মন্দির বানাতে হবে - তার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে।"
বিজেপির হিন্দু নেতারা বলতেন, ভারতে তাদের ভাষায় ধর্মনিরপেক্ষতার নামে খুব বেশি মাত্রায় আপোষ করা হয়েছে। তারা বলতেন, এখন সময় এসেছে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কথা বলার ।
মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগ বিজেপি অস্বীকার করতো, কিন্তু তাদের জনসভাগুলো থেকে লোকেরা ঠিক এই বার্তাটি নিয়েই ঘরে ফিরতো।
কেমন সাড়া ফেলেছিল এই রথযাত্রা?
মি. সুধামন বলেন, এটা আসলেই বিপুল সাড়া ফেলেছিল। এতে জনসমাগমও হয়েছিল ব্যাপক।
"এই প্রতিক্রিয়া ছিল স্বাভাবিক, এতে সাজানো কিছু ছিল না। আমি কিছু মহিলাকে দেখেছি, তারা হাতের বালা খুলে আদভানির পায়ের কাছে রেখে বলেছিল, এ থেকে যে অর্থ পাওয়া যাবে তা রাম মন্দির নির্মাণের জন্য ব্যবহার করতে।"
বিজেপির বিরুদ্ধে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগ উঠলেও দলটি তা অস্বীকার করে |
এত লোকসমাগম দেখে কি তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন? মি. সুধামনকে এ কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন "হ্যাঁ, এটা সত্যি অপ্রত্যাশিত ছিল, এতে কোন সন্দেহ নেই। এর আগে একমাত্র ইন্দিরা গান্ধী বা রাজীব গান্ধীর মতো নেতাদের পক্ষেই এরকম জনসমাগম ঘটানো সম্ভব ছিল।"
প্রতিদিন ১২ ঘন্টা ধরে উত্তর ও মধ্য ভারতের মধ্যে দিয়ে পথ পরিভ্রমণ করে এই রথযাত্রা। এই অঞ্চলটিকে বর্ণনা করা হয় ভারতের 'হিন্দু হার্টল্যান্ড' হিসেবে। এ অঞ্চলের শহর ও গ্রামগুলোর হাজার হাজার লোক মি. আদভানির বক্তৃতা শুনতে রথযাত্রার পথে জড়ো হয়।
মনে করা হয়, অযোধ্যায় প্রবলভাবে বিতর্কিত রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পথে এই যাত্রা ভারতের আন্ত:ধর্মীয় উত্তেজনাকে উস্কে দিচ্ছিল।
"ভারতের মধ্যঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছিল। আদভানির ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার কারণে তিনি যখন বিহারের সমস্তিপুর পৌঁছালেন, তখন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী তাকে গ্রেফতার করলেন।
সরকারি কর্মকর্তাদের বক্তব্য ছিল, মি. আদভানিকে গ্রেফতার করা ছাড়া তাদের সামনে কোন উপায় ছিল না। কারণ তার এই যাত্রা সহিংসতা উস্কে দেবে এ আশংকা আগে থেকেই ছিল, কারণ একটি ধর্মীয় বিষয়কে এখানে রাজনৈতিক রূপ দেয়া হচ্ছিল এবং দক্ষিণপন্থী হিন্দু মৌলবাদী বিজেপির এই নেতা সে কাজটিই করছিলেন।
রামমন্দির নির্মাণ আন্দোলনের নেতা মি. আদভানি ও তার হাজার হাজার সমর্থককে গ্রেফতার করা হলো। এর ফলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভি পি সিংএর কোয়ালিশন সরকারের প্রতি সমর্থন তুলে নেয় বিজেপি।
বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণের দাবি ভারতের রাজনীতিতে চরম সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে |
এর ফলে পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯১ সালেই অনুষ্ঠিত হলো লোকসভা নির্বাচন, এবং তাতে বিজেপির আসনসংখ্যা অনেক বেড়ে গেল।
সাংবাদিক আর কে সুধামন মনে করেন, বিজেপি হয়তো আরো বেশি আসনে জিততো যদি কংগ্রেস নেতা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় নিহত না হতেন।
"যদি রাজীব গান্ধী নিহত না হতেন তাহলে বিজেপি হয়তো আরো বেশি আসনে জিততো। কারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল দুই পর্বে। আর তাতে প্রধান ইস্যুই ছিল রাম মন্দির নির্মাণ।"
"উত্তর ভারতে জনমত জরিপে বিজেপিই এগিয়ে ছিল। কিন্তু যেহেতু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল দুই পর্বে - তাই প্রথম পর্বে যে আসনগুলোতে ভোটগ্রহণ হয়েছিল সেগুলোতে বিজেপি প্রায় একচেটিয়া বিজয় পায়। আর দ্বিতীয় পর্বের ভোট হয়েছিল রাজীব গান্ধী হত্যাকান্ডের পর - সেগুলোতে কংগ্রেস অনেক বেশি আসন পায়। ফলে তারাই সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়।"
এই রথযাত্রার ফলে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালে উগ্র হিন্দু করসেবকরা বাবরি মসজিদ ভেঙে দেয়। ধর্মীয় সহিংসতার কারণে ভারতে এক বিস্ফোরক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় প্রায় ২ হাজার লোক নিহত হয়।
আর কে সুধামন বলছিলেন, তার মতে ১৯৯০ সালের সেই রথযাত্রা ভারতের রাজনীতিকে সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দেয়।
"এটা ছিল এক কর্মসূচি যা আগেকার সব রাজনৈতিক হিসেবনিকেশ পাল্টে দেয়, এবং বিজেপির পক্ষে নিজেদের দলকে গড়ে তোলা সম্ভব হয়।"
"আজ বিজেপি যে ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে তার মূলে রয়েছে সেই রথযাত্রা। এর ফলেই তারা পরিণত হয়েছিল প্রথমে প্রধান বিরোধীদলে, এবং তার পর ক্ষমতাসীন দলে। নিশ্চয়ই এ দলটিকে গড়ে তোলার কৃতিত্ব মি. আদভানির এবং কেউ তা অস্বীকার করতে পারবে না।"
"এতে কোন সন্দেহ নেই যে বিজেপি রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটিয়ে জনগণকে দুভাগ করে ফেলেছে। তবে এটাও ঠিক যে দেশ হিসেবে ভারতের মানুষের মধ্যে মোটামুটিভাবে একটা সহনশীলতা রয়েছে।"
বিজেপি ভারতে প্রথম সরকার গঠন করে ১৯৯৬ সালে, এবং তার পর থেকে তারা একাধিকবার ক্ষমতায় এসেছে।
No comments