গণতন্ত্র ও ভারতের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ কোনোটিই লাভবান হয়নি by ভারত ভূষণ
নির্বাচনে
ভূমিধস বিজয় অর্জনের পর শেখ হাসিনা বিদেশ থেকে প্রথম যে দুটি অভিনন্দনসূচক
ফোন পেয়েছেন, সেগুলো এসেছিল ভারত ও চীন থেকে। বাকি বিশ্ব ছিল আরো সতর্ক
ভূমিকায়। তারা এমন একটি নির্বাচনী ফল নিয়ে সংযত ছিলেন যেখানে দেখা যাচ্ছে
যে শেখ হাসিনা অবিশ্বাস্যভাবে ২০১৪ সালের চেয়েও ভালো করেছেন। অথচ, ২০১৪
সালের নির্বাচন বিরোধী দল বর্জন করেছিল। পশ্চিমা বিশ্ব তাই অভিনন্দন
জানানোর বদলে সহিংসতা, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও নির্বাচনের পূর্বে রাজনৈতিক
প্রতিপক্ষের হেনস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের নির্বাচনী ফলাফল
দেশটির গণতন্ত্র কিংবা দক্ষিণ এশিয়া ও অন্যত্র ভারতের দীর্ঘমেয়াদি
স্বার্থ-কোনোটিকেই এগিয়ে নেবে না।
এই নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে বিরোধী জোট, বিশেষ করে বিএনপি ও অন্য দলগুলো যারা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তবে তাদের পুনঃনির্বাচনের দাবি নির্বাচন কমিশন মেনে নেবে এমন সম্ভাবনা কম।
বিরোধী দল এই কমিশনকে দলীয় পক্ষপাতদুষ্ট বলে বর্ণনা করেছে।
শেখ হাসিনার মুকুটে উন্নয়ন নামক পালক আছে। তবে তার নেতৃত্বে যেই রাষ্ট্রযন্ত্র রয়েছে তা কাজ করে মূলত ভয়ভীতি, অসহিষ্ণুতা ও আতঙ্ককে পুঁজি করে। এই রাষ্ট্রযন্ত্র সমালোচকদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করেছে। গণতান্ত্রিক বিতর্ককে সঙ্কুচিত করেছে। আওয়ামী লীগের এই বিরাট কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ বিজয়ের পর গণতান্ত্রিক সুযোগ কেবল আরো সঙ্কুচিতই হতে পারে।
বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ শাসকদলের শত শত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। যারা এখনো বাকি আছেন তারাও হয়তো সামনের দিনগুলোতে কারান্তরীণ হতে পারেন। ফলে বিরোধী দল আরো ধ্বংসের দিকে ধাবিত হতে পারে। রাষ্ট্রের জবরদস্তিমূলক বিভিন্ন সংস্থা নিয়ে যে আতঙ্ক তাতে সরকারের বিরুদ্ধে গণপ্রতিবাদ আরো কোণঠাসা হয়ে পড়বে।
ক্ষমতাসীনদের স্বল্পমেয়াদি লাভের জন্য বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ দীর্ঘমেয়াদের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হলো। বিদায়ী সংসদ ও আসন্ন সংসদ উভয়টিই এক্ষেত্রে ভালো উদাহরণ। প্রথমটি প্রতিনিধিত্বশীল ছিল না। কারণ বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করেছিল। দ্বিতীয়টিকেও তেমনটি ভাবা হবে, ‘ম্যাচ গড়াপেটা’র অভিযোগের কারণে। রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কূটকৌশলের কারণে বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশন উভয়েই তাদের মর্যাদা খুইয়েছে। রাষ্ট্রীয় আদেশ-নিষেধ অনুযায়ী চলছে সংবাদমাধ্যম। রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় পক্ষের কাছ থেকে আক্রমণের শিকার হয়ে বুদ্ধিজীবী ও নির্দলীয় ব্লগাররা এখন জীবন নিয়ে শঙ্কিত।
গণতান্ত্রিক সুরক্ষাকবচের অভাব ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ভিন্নমত দমনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিষয়টি সেসব দেশগুলোর জন্য বিশেষভাবে বিপজ্জনক যেখানে চরমপন্থিদের ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ব্যর্থতার ফলে চরমপন্থি রাজনীতি বিস্তারের জন্য উর্বর ভূমি সৃষ্টি হয়েছে। এরপর মানুষ খুব সহজেই চরমপন্থার দিকে আকৃষ্ট হতে পারে। যেমনটা হয়েছে মিশর ও আলজেরিয়ায়।
বাংলাদেশে যা চলছে তা ভারতের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের অনুকূলে না হওয়ার একটি কারণ হলো চরমপন্থার এই হুমকি। আরো অনেক কারণও আছে।
যদিও চীন ও ভারত উভয়েই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতাকে স্বাগত জানিয়েছে, তবে তাদের এজেন্ডা কিন্তু একেবারে আলাদা। যুক্তরাষ্ট্রকে ও দ্বিতীয়ত ভারতকে ঠেকাতে বাংলাদেশে কৌশলগত ভিত্তি গড়তে চায় চীন। শাসকদলের প্রখ্যাত কিছু পরিবারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে চীন বাংলাদেশের ঘরোয়া রাজনীতিতে যেভাবে ঢুকছে তা দেশটির কৌশলগত লক্ষ্য এগিয়ে নিতে সহায়ক হতে পারে। চীনকে বেশকিছু সুযোগও দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশ হলো চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিআরআই-এ যেই ছয়টি করিডোর রয়েছে (চারটি স্থল ও দুইটি সামুদ্রিক), সেগুলোর মধ্যে একটি সামুদ্রিক করিডোরের অবিচ্ছেদ্য অংশ বাংলাদেশ। এই করিডোর চীনের কুনবিং থেকে মিয়ানমারের কাউকপ্যু বন্দর ও চট্টগ্রাম হয়ে কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত।
ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ ছাড়াও, এই করিডোরের মাধ্যমে চীন বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে ঢুকে পড়ার সুযোগ পাবে। মিয়ানমারের কাউকপ্যু বন্দরের ৮৫ শতাংশ মালিকানা চীনের। এটি হবে একটি জ্বালানি কেন্দ্র। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ৮০ শতাংশ তেল আমদানিতে চীন মালাক্কা প্রণালী ব্যবহার করে। ঝুঁকিপূর্ণ এই প্রণালীর ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে চীন কাউকপ্যু বন্দর নির্মাণ করছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি করা অপরিশোধিত তেল এই বন্দরে সংরক্ষণ করা হবে। পরে সেটি পরিশোধিত হবে সৌদি আরবের অর্থায়নে নির্মিতব্য একটি শোধনাগারে। এছাড়া কাতার থেকে আমদানিকৃত গ্যাসের জন্য কাতার নির্মান করছে একটি মিথেন শোধনাগার। মিয়ানমারের শোয়ে গ্যাসক্ষেত্র থেকে উঠানো গ্যাস এখান থেকেই চীনগামী পাইপলাইনে ঢুকানো হবে। তবে কক্সবাজারের পাশে নির্মিতব্য সোনাদিয়ার গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে বিআরআই’র সংযোগ আপাতত স্থগিত রয়েছে।
নিজের ভূ-কৌশলগত, ভূ-অর্থনৈতিক ও ভূ-জ্বালানি স্বার্থ এবং পদ্মা সেতু, চট্টগ্রাম মহাসড়ক প্রকল্প, ১৩৫০০ মেগাওয়াটের মহেশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো বড় অবকাঠামো প্রকল্পে নিজের বিনিয়োগ রক্ষা করতেই চীন বাংলাদেশে ক্ষমতার ধারাবাহিকতা চায়। মালয়েশিয়ায় সরকার পরিবর্তনের পর তিক্ত অভিজ্ঞতার স্বাদ পেয়েছে চীন। সেখানে মাহাথির মোহাম্মদের নতুন সরকার চীনের ১৫০ কোটি ডলারের পূর্ব-পশ্চিম রেলওয়ে প্রকল্প স্থগিত করেছে।
বাংলাদেশে বিআরআই প্রকল্পে যেই ৪০০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন, তা নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা চায় না দেশটি। এই নির্বাচনের পরই এই বিনিয়োগের কিছু অর্থ চলে আসার কথা বাংলাদেশে। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় চীনের স্বার্থ ছিল। এছাড়া বাংলাদেশে স্বল্প মজুরির শ্রমিক প্রাপ্তির সুবিধা থাকায় চীন চায় তার কিছু শিল্প বাংলাদেশে স্থানান্তরিত করতে। বাংলাদেশ হতে পারে স্বল্পোন্নত দেশগুলো থেকে পশ্চিমা দেশে ‘চীনা’ পণ্য ঢুকানোর প্রবেশ পথ।
বাংলাদেশে চীনের ব্যপক কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থের তুলনায় ভারতের স্বার্থ খুবই কম। ভারত চায় বাংলাদেশ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহীদেরকে আশ্রয় না দিক। জঙ্গিরা যাতে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢুকতে না পারে। বাংলাদেশকে ব্যবহার করে পাকিস্তান যাতে ভারতে জালনোট ঢুকাতে না পারে। এবং অবৈধ অভিবাসন প্রতিরোধ। শেখ হাসিনার সরকার অতীতে এসব ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে। সুতরাং, নয়াদিল্লি আওয়ামী লীগের ধারাবাহিকতায় সমর্থন দিয়েছে। বাংলাদেশে চীনের প্রবেশ নিয়ে ভারতের আপত্তি ছিল। তবে সামনের দিনগুলোতে চীনের প্রভাব আরো বাড়বে। তখন ভারতের ‘ভেটো’ আর থাকবে না। চীনের এই প্রভাববিস্তারের ফলে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র- উভয়ের ভূমিকাই গৌণ হয়ে পড়বে।
এই মহারণ যখন প্রস্ফুটিত হচ্ছে, তখন দেখার বাকি যে ভারতের স্বার্থ বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে যায় কিনা। আর ভারতের প্রধান যেই উদ্বেগের বিষয় সেটি হলো বাংলাদেশে ইসলামী চরমপন্থার উত্থান ও সীমান্তের ওপারে এর প্রভাব। এই একপক্ষীয় নির্বাচনের কারণে হয়তো এই চরমপন্থা নতুন প্রাণ পেল। দীর্ঘমেয়াদে একটি বিস্ফোরক বাংলাদেশের চেয়ে হয়তো একটি স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করাটা সহজতর হতো।
(ভারত ভূষণ একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। তার নিবন্ধটি ভারতের এশিয়ান এইজ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।)
এই নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে বিরোধী জোট, বিশেষ করে বিএনপি ও অন্য দলগুলো যারা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তবে তাদের পুনঃনির্বাচনের দাবি নির্বাচন কমিশন মেনে নেবে এমন সম্ভাবনা কম।
বিরোধী দল এই কমিশনকে দলীয় পক্ষপাতদুষ্ট বলে বর্ণনা করেছে।
শেখ হাসিনার মুকুটে উন্নয়ন নামক পালক আছে। তবে তার নেতৃত্বে যেই রাষ্ট্রযন্ত্র রয়েছে তা কাজ করে মূলত ভয়ভীতি, অসহিষ্ণুতা ও আতঙ্ককে পুঁজি করে। এই রাষ্ট্রযন্ত্র সমালোচকদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করেছে। গণতান্ত্রিক বিতর্ককে সঙ্কুচিত করেছে। আওয়ামী লীগের এই বিরাট কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ বিজয়ের পর গণতান্ত্রিক সুযোগ কেবল আরো সঙ্কুচিতই হতে পারে।
বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ শাসকদলের শত শত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। যারা এখনো বাকি আছেন তারাও হয়তো সামনের দিনগুলোতে কারান্তরীণ হতে পারেন। ফলে বিরোধী দল আরো ধ্বংসের দিকে ধাবিত হতে পারে। রাষ্ট্রের জবরদস্তিমূলক বিভিন্ন সংস্থা নিয়ে যে আতঙ্ক তাতে সরকারের বিরুদ্ধে গণপ্রতিবাদ আরো কোণঠাসা হয়ে পড়বে।
ক্ষমতাসীনদের স্বল্পমেয়াদি লাভের জন্য বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ দীর্ঘমেয়াদের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হলো। বিদায়ী সংসদ ও আসন্ন সংসদ উভয়টিই এক্ষেত্রে ভালো উদাহরণ। প্রথমটি প্রতিনিধিত্বশীল ছিল না। কারণ বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করেছিল। দ্বিতীয়টিকেও তেমনটি ভাবা হবে, ‘ম্যাচ গড়াপেটা’র অভিযোগের কারণে। রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কূটকৌশলের কারণে বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশন উভয়েই তাদের মর্যাদা খুইয়েছে। রাষ্ট্রীয় আদেশ-নিষেধ অনুযায়ী চলছে সংবাদমাধ্যম। রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় পক্ষের কাছ থেকে আক্রমণের শিকার হয়ে বুদ্ধিজীবী ও নির্দলীয় ব্লগাররা এখন জীবন নিয়ে শঙ্কিত।
গণতান্ত্রিক সুরক্ষাকবচের অভাব ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ভিন্নমত দমনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিষয়টি সেসব দেশগুলোর জন্য বিশেষভাবে বিপজ্জনক যেখানে চরমপন্থিদের ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ব্যর্থতার ফলে চরমপন্থি রাজনীতি বিস্তারের জন্য উর্বর ভূমি সৃষ্টি হয়েছে। এরপর মানুষ খুব সহজেই চরমপন্থার দিকে আকৃষ্ট হতে পারে। যেমনটা হয়েছে মিশর ও আলজেরিয়ায়।
বাংলাদেশে যা চলছে তা ভারতের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের অনুকূলে না হওয়ার একটি কারণ হলো চরমপন্থার এই হুমকি। আরো অনেক কারণও আছে।
যদিও চীন ও ভারত উভয়েই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতাকে স্বাগত জানিয়েছে, তবে তাদের এজেন্ডা কিন্তু একেবারে আলাদা। যুক্তরাষ্ট্রকে ও দ্বিতীয়ত ভারতকে ঠেকাতে বাংলাদেশে কৌশলগত ভিত্তি গড়তে চায় চীন। শাসকদলের প্রখ্যাত কিছু পরিবারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে চীন বাংলাদেশের ঘরোয়া রাজনীতিতে যেভাবে ঢুকছে তা দেশটির কৌশলগত লক্ষ্য এগিয়ে নিতে সহায়ক হতে পারে। চীনকে বেশকিছু সুযোগও দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশ হলো চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিআরআই-এ যেই ছয়টি করিডোর রয়েছে (চারটি স্থল ও দুইটি সামুদ্রিক), সেগুলোর মধ্যে একটি সামুদ্রিক করিডোরের অবিচ্ছেদ্য অংশ বাংলাদেশ। এই করিডোর চীনের কুনবিং থেকে মিয়ানমারের কাউকপ্যু বন্দর ও চট্টগ্রাম হয়ে কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত।
ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ ছাড়াও, এই করিডোরের মাধ্যমে চীন বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে ঢুকে পড়ার সুযোগ পাবে। মিয়ানমারের কাউকপ্যু বন্দরের ৮৫ শতাংশ মালিকানা চীনের। এটি হবে একটি জ্বালানি কেন্দ্র। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ৮০ শতাংশ তেল আমদানিতে চীন মালাক্কা প্রণালী ব্যবহার করে। ঝুঁকিপূর্ণ এই প্রণালীর ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে চীন কাউকপ্যু বন্দর নির্মাণ করছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি করা অপরিশোধিত তেল এই বন্দরে সংরক্ষণ করা হবে। পরে সেটি পরিশোধিত হবে সৌদি আরবের অর্থায়নে নির্মিতব্য একটি শোধনাগারে। এছাড়া কাতার থেকে আমদানিকৃত গ্যাসের জন্য কাতার নির্মান করছে একটি মিথেন শোধনাগার। মিয়ানমারের শোয়ে গ্যাসক্ষেত্র থেকে উঠানো গ্যাস এখান থেকেই চীনগামী পাইপলাইনে ঢুকানো হবে। তবে কক্সবাজারের পাশে নির্মিতব্য সোনাদিয়ার গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে বিআরআই’র সংযোগ আপাতত স্থগিত রয়েছে।
নিজের ভূ-কৌশলগত, ভূ-অর্থনৈতিক ও ভূ-জ্বালানি স্বার্থ এবং পদ্মা সেতু, চট্টগ্রাম মহাসড়ক প্রকল্প, ১৩৫০০ মেগাওয়াটের মহেশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো বড় অবকাঠামো প্রকল্পে নিজের বিনিয়োগ রক্ষা করতেই চীন বাংলাদেশে ক্ষমতার ধারাবাহিকতা চায়। মালয়েশিয়ায় সরকার পরিবর্তনের পর তিক্ত অভিজ্ঞতার স্বাদ পেয়েছে চীন। সেখানে মাহাথির মোহাম্মদের নতুন সরকার চীনের ১৫০ কোটি ডলারের পূর্ব-পশ্চিম রেলওয়ে প্রকল্প স্থগিত করেছে।
বাংলাদেশে বিআরআই প্রকল্পে যেই ৪০০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন, তা নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা চায় না দেশটি। এই নির্বাচনের পরই এই বিনিয়োগের কিছু অর্থ চলে আসার কথা বাংলাদেশে। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় চীনের স্বার্থ ছিল। এছাড়া বাংলাদেশে স্বল্প মজুরির শ্রমিক প্রাপ্তির সুবিধা থাকায় চীন চায় তার কিছু শিল্প বাংলাদেশে স্থানান্তরিত করতে। বাংলাদেশ হতে পারে স্বল্পোন্নত দেশগুলো থেকে পশ্চিমা দেশে ‘চীনা’ পণ্য ঢুকানোর প্রবেশ পথ।
বাংলাদেশে চীনের ব্যপক কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থের তুলনায় ভারতের স্বার্থ খুবই কম। ভারত চায় বাংলাদেশ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহীদেরকে আশ্রয় না দিক। জঙ্গিরা যাতে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢুকতে না পারে। বাংলাদেশকে ব্যবহার করে পাকিস্তান যাতে ভারতে জালনোট ঢুকাতে না পারে। এবং অবৈধ অভিবাসন প্রতিরোধ। শেখ হাসিনার সরকার অতীতে এসব ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে। সুতরাং, নয়াদিল্লি আওয়ামী লীগের ধারাবাহিকতায় সমর্থন দিয়েছে। বাংলাদেশে চীনের প্রবেশ নিয়ে ভারতের আপত্তি ছিল। তবে সামনের দিনগুলোতে চীনের প্রভাব আরো বাড়বে। তখন ভারতের ‘ভেটো’ আর থাকবে না। চীনের এই প্রভাববিস্তারের ফলে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র- উভয়ের ভূমিকাই গৌণ হয়ে পড়বে।
এই মহারণ যখন প্রস্ফুটিত হচ্ছে, তখন দেখার বাকি যে ভারতের স্বার্থ বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে যায় কিনা। আর ভারতের প্রধান যেই উদ্বেগের বিষয় সেটি হলো বাংলাদেশে ইসলামী চরমপন্থার উত্থান ও সীমান্তের ওপারে এর প্রভাব। এই একপক্ষীয় নির্বাচনের কারণে হয়তো এই চরমপন্থা নতুন প্রাণ পেল। দীর্ঘমেয়াদে একটি বিস্ফোরক বাংলাদেশের চেয়ে হয়তো একটি স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করাটা সহজতর হতো।
(ভারত ভূষণ একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। তার নিবন্ধটি ভারতের এশিয়ান এইজ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।)
No comments