দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ (শেষ পর্ব) by পল স্ট্যানিল্যান্ড
এমনকি
যখন জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ আন্দোলন নির্বাচনে পরাজিত হয় তখন তারা
রাজপথের শক্তিকে অব্যাহতভাবে বেছে নেয়। পাকিস্তানের ধর্মীয় রাজনৈতিক
দলগুলো নির্বাচনে ভয়াবহ পরাজয়ের প্রমাণ রেখেছে। কিন্তু ধর্মীয় সংগঠনগুলো
এখনো তাদের সমর্থকদের গতিশীল করতে সংখ্যালঘু গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে সন্দেহ ও
একগুঁয়েমি দেখাতে পারে। এ বিষয়টিকে কঠোরভাবে নিয়েছেন পাকিস্তানের
প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ধর্ম অবমাননার দায়ে মৃত্যুদণ্ড থেকে বেকসুর খালাস
দিয়েছে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট। সঙ্গে সঙ্গে এর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন
তিনি। এরপরই পদক্ষেপ নিয়েছেন। তেহরিকে লাব্বাইক পাকিস্তানের (টিএলপি)
কয়েকদিনের ভয়াবহ ধর্মীয় আন্দোলনের পর অন্ততপক্ষে প্রতীকী অর্থেও তিনি তাদের
বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে টিএলপি’র পিছু নিয়েছে ইমরান খানের সরকার। কিন্তু শিয়া, খ্রিস্টান, হিন্দু ও আহমাদিদেরকে বহিষ্কারের লক্ষ্য রয়েছে সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠদের। এতে এক ধরনের বিপদ ও ঝুঁকি রয়ে গেছে।
পরাভূত গণতন্ত্র
দক্ষিণ এশিয়ায় নির্বাচনী গণতন্ত্র অস্বস্তিকর এক অবস্থায় সহাবস্থান করে নিরপেক্ষ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে, বিশেষ করে বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে। তীব্র রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা হলে তা রাজনীতিবিদদেরকে তার নিজের সংসদীয় আসনের দিকে মনোযোগ দিতে বাধ্য করে। আদর্শগতভাবে এতে তারা অধিক দায়িত্বশীল হন। কিন্তু এই প্রতিযোগিতা তাদেরকে আদালত, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আইন প্রয়োগকারীদের রাজনীতিকীকরণের দিকে ঠেলে দিতে পারে। শ্রীলঙ্কার শীর্ষ স্থানীয় রাজনীতিকরা সংকটের সময়ে সংবিধানের প্রতি উল্লেখযোগ্য অবজ্ঞা দেখিয়েছেন। তাদের সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডের একটি যুক্তিসঙ্গত একটি সমাধান পেতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শ্রীলঙ্কার বিচার বিভাগ বিস্ময়কর দৃঢ়তার প্রমাণ দিয়েছে। তারা একটি চাপা কঠিন পরীক্ষা মোকাবিলা করেছে, যেটা কখনো প্রথমে ঘটা উচিত ছিল না।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী পক্ষকে পদ্ধতিগতভাবে আঘাত করেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিজয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারণা ও নির্বাচনের দিন প্রাণঘাতী সহিংসতা ও নির্বাচনে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগে এই নির্বাচন ব্যাহত হয়েছে। সরকার এমন আইন পাস করেছে, যাতে মুক্ত মতপ্রকাশকে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে, সাংবাদিক ও ভিন্নমতাবলম্বীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে টার্গেট করতে পুলিশ ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ হিসেবে দলটি ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ও তাদের দ্বারা সৃষ্ট অসহিষ্ণুতা মোকাবিলার কথা বলছে। এর অংশ হিসেবে তারা ইসলামপন্থি বিরোধী দলগুলো যেমন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে।
ভারতেও সরকার জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে হস্তক্ষেপ করেছে বলে অভিযোগ আছে। এর উদ্দেশ্য নরেন্দ্র মোদির দল যেন সুবিধা পায়। এর ফলে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ব্যুরো (সিবিআই) ও রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) নাটকীয়, উচ্চ মাত্রার বিরোধ ও অভ্যন্তরীণ শত্রুতার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। এমন হস্তক্ষেপ বিজেপির পুরনো রীতি ও ভারতের দীর্ঘদিনের ইতিহাস। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শিখর যখন বিজেপি ধরে রাখতে চাইছে তখন রাষ্ট্রীয় অভিজাত প্রতিষ্ঠানের এই সংঘাতময় অবস্থাকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মিলান বৈষ্ণব বর্ণনা করেছেন ‘বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট’ হিসেবে।
দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশই বিপরীত সমস্যার সম্মুখীন। সেখানে নির্বাচিত রাজনীতিকরা স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে যেমন হস্তক্ষেপ করেন তার চেয়ে বেশি নাগরিক রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে স্ব-শাসিত সেনাবাহিনী। পাকিস্তান ও মিয়ানমারে সব রাজনীতির ঊর্ধ্বে সেনাবাহিনী। এ দুটি দেশেই সেনাবাহিনীর দীর্ঘ উপস্থিতির ইতিহাস আছে। দুই দেশেই সেনাবাহিনী জাতীয় রাজনীতিতে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তারা অব্যাহতভাবে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ‘তামাদ’ নামে পরিচিত। তারা নিরাপত্তা সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়গুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। জাতীয় সংসদে তাদের শতকরা ২৫ ভাগ আসনের গ্যারান্টি নিশ্চিত করেছে। তারা রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে নৃশংসতা চালিয়েছে তাতে তারা দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মার জাতিগোষ্ঠীর কাছ থেকে নতুন করে ব্যাপক হারে সমর্থন পেয়েছে। তারা এটাকে দেখে বাঙালি অনুপ্রবেশকারী ও বিদেশিদের নাক গলানো থেকে দেশকে নিরাপদ রাখার যুদ্ধ হিসেবে। সেনাবাহিনী সেখানে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করেছে। মিয়ানমারে সন্ত্রাসবিরোধী (কাউন্টার ইনসার্জেন্সি)-এর বিরুদ্ধে তাদের লড়াই অব্যাহত রেখেছে, বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। বার্মার জাতীয়তাবাদ ঝলসে ওঠার পর নিজেদেরকে তা থেকে বিরত রাখে সেনাবাহিনী। এর মধ্য দিয়ে তারা জাতির সুরক্ষক এমন একটি অবস্থান নিয়ে নিজেদের সুবিধা নিশ্চিত করে। সাবেক স্বৈরশাসকের চেয়ে এটা তাদের এক ভিন্ন কৌশল।
পাকিস্তানে প্রভাব বিস্তার করতে কোনো আনুষ্ঠানিক সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োজন হয় না সেনাবাহিনীর। বিস্তৃতভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময়ে তারা ব্যাপকভাবে ইমরান খানের পেছনে সমর্থন দিয়েছে। তার বিজয়ের পর ধর্ম অবমাননা বিষয়ক রায় নিয়ে যখন টিএলপি আন্দোলন তুঙ্গে তোলে তখন তাতে ইমরান খানের সমঝোতা বা সমাধান প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতা করেন সেনাবাহিনী। ব্যাপকভিত্তিক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে সেনাবাহিনী। এতে তারা বাহ্যিক প্রভাব পাচ্ছে। একই সঙ্গে তারা অবসরপ্রাপ্ত সেনা অভিজাত শ্রেণিকে স্বস্তিকর একটি অবস্থা দিয়ে একটি ভালো অভ্যন্তরীণ স্থান তৈরি করে নিয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, উল্লেখযোগ্য বিদেশি নীতি বিষয়ক সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষেত্রে তারা ভেটো দেয়ার ক্ষমতা রাখে বলে বিশ্বাস করা হয়। বিশেষ করে এ বিষয়টি বেশি প্রয়োগ করা হয় আফগানিস্তান ও ভারতের ক্ষেত্রে। তারা যে ক্ষমতা এক্ষেত্রে প্রয়োগ করে তা করার কথা নির্বাচিত বেসামরিক নেতাদের।
সতর্ক সংকেত
জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা, নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানকে আক্রান্ত করা ও সেনাবাহিনীর অব্যাহত প্রভাবের মতো এসব সমস্যা উদার গণতন্ত্রের জন্য অনেক দিক দিয়েই সুবিধার নয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অভিজ্ঞতা বলে যে, অগ্রগতি ও পশ্চাদ্ধাবনকে আলাদা করা খুব কঠিন।
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা ও প্রধানমন্ত্রী রণিল বিক্রমাসিংহের মধ্যকার সংঘাত কখনো প্রকাশ্যে আসতো না, যদি না তারা ২০১৫ সালের নির্বাচনের পরে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ভীষণভাবে প্রয়োজনীয় সংস্কার পাস না করতেন। ওই সংস্কার অল্প সময়ের মধ্যেই ধ্বংসাত্মক প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা শ্রীলঙ্কার গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করেছে। মিয়ানমারের ভয়াবহ এক আধিপত্যের প্রকাশ বেরিয়ে এসেছে। তবে সেখানে স্বাধীন মিডিয়ার জন্য ভূমিকা রেখেছে, অধিকতর মুক্ত রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অবদান রেখেছে এবং নাগরিক সমাজের জন্য নতুন সম্ভাব্যতা সৃষ্টি করেছে। মিয়ানমার পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। ভারতে নির্বাচন উচ্চ মাত্রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ রয়েছে। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে নতুন করে ইঞ্জিনিয়ারিং করার মধ্যেই নিশ্চিন্তে থাকতে পারে না বিজেপি। সেনাবাহিনীর প্রভাবযুক্ত ও ধর্মীয় উগ্রপন্থার ছায়ার নিচে পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক যে প্রতিযোগিতা তাতে এমন একটি সম্ভাব্য সরকার গঠন করে, যে সরকার তার নাগরিকদের কাছে অধিকতর দায়সম্পন্ন।
দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, কিছু দেশে গণতন্ত্র এখনো আছে, যেমন হাঙ্গেরি। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি একই নয়। সর্বোপরি গণতন্ত্রের বিতর্কিত প্রকৃতি এখানে নজরদারির দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। যারা অন্যান্য গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলেন অব্যাহতভাবে তাদেরকে তা করতে হবে, পশ্চাতে ফেলে আসতে হবে আদর্শগত অধিকারের প্রকল্পের বিরুদ্ধে কথা বলা, যেসব রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানকে খর্ব করেন এবং যেসব প্রতিষ্ঠান জবাবদিহিতা থেকে পালানোর চেষ্টা করে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া।
স্বেচ্ছায় গণতন্ত্রের পক্ষে থাকার বিষয়টি প্রমাণ করে শ্রীলঙ্কার সাংবিধানিক সংকটের বিষয়টি সমাধানের বিষয়। সিরিসেনার ক্ষমতার খেলা সহজেই উতরে যাওয়া যেতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্রের দুটি মূল বিপদ বর্তমান: তা হলো জাতি-জাতীয়তাবাদ এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর লঙ্ঘন। সিরিসেনার লক্ষ্য ছিল দ্রুত একটি সত্য প্রতিষ্ঠা করা, যা সহজে পাল্টানো যাবে না। কিন্তু সাধারণ মানুষ, নাগরিক সমাজ ও রাজনীতিকরা সাংবিধানিক অধিকার সংরক্ষণ করেন। তাদের এই কঠোর লড়াই উৎসাহ ও ক্ষয়িষ্ণু গণতন্ত্রের কথা বলে।
(অনলাইন ডেইলি টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার অনুবাদ)
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে টিএলপি’র পিছু নিয়েছে ইমরান খানের সরকার। কিন্তু শিয়া, খ্রিস্টান, হিন্দু ও আহমাদিদেরকে বহিষ্কারের লক্ষ্য রয়েছে সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠদের। এতে এক ধরনের বিপদ ও ঝুঁকি রয়ে গেছে।
পরাভূত গণতন্ত্র
দক্ষিণ এশিয়ায় নির্বাচনী গণতন্ত্র অস্বস্তিকর এক অবস্থায় সহাবস্থান করে নিরপেক্ষ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে, বিশেষ করে বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে। তীব্র রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা হলে তা রাজনীতিবিদদেরকে তার নিজের সংসদীয় আসনের দিকে মনোযোগ দিতে বাধ্য করে। আদর্শগতভাবে এতে তারা অধিক দায়িত্বশীল হন। কিন্তু এই প্রতিযোগিতা তাদেরকে আদালত, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আইন প্রয়োগকারীদের রাজনীতিকীকরণের দিকে ঠেলে দিতে পারে। শ্রীলঙ্কার শীর্ষ স্থানীয় রাজনীতিকরা সংকটের সময়ে সংবিধানের প্রতি উল্লেখযোগ্য অবজ্ঞা দেখিয়েছেন। তাদের সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডের একটি যুক্তিসঙ্গত একটি সমাধান পেতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শ্রীলঙ্কার বিচার বিভাগ বিস্ময়কর দৃঢ়তার প্রমাণ দিয়েছে। তারা একটি চাপা কঠিন পরীক্ষা মোকাবিলা করেছে, যেটা কখনো প্রথমে ঘটা উচিত ছিল না।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী পক্ষকে পদ্ধতিগতভাবে আঘাত করেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিজয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারণা ও নির্বাচনের দিন প্রাণঘাতী সহিংসতা ও নির্বাচনে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগে এই নির্বাচন ব্যাহত হয়েছে। সরকার এমন আইন পাস করেছে, যাতে মুক্ত মতপ্রকাশকে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে, সাংবাদিক ও ভিন্নমতাবলম্বীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে টার্গেট করতে পুলিশ ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ হিসেবে দলটি ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ও তাদের দ্বারা সৃষ্ট অসহিষ্ণুতা মোকাবিলার কথা বলছে। এর অংশ হিসেবে তারা ইসলামপন্থি বিরোধী দলগুলো যেমন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে।
ভারতেও সরকার জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে হস্তক্ষেপ করেছে বলে অভিযোগ আছে। এর উদ্দেশ্য নরেন্দ্র মোদির দল যেন সুবিধা পায়। এর ফলে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ব্যুরো (সিবিআই) ও রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) নাটকীয়, উচ্চ মাত্রার বিরোধ ও অভ্যন্তরীণ শত্রুতার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। এমন হস্তক্ষেপ বিজেপির পুরনো রীতি ও ভারতের দীর্ঘদিনের ইতিহাস। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শিখর যখন বিজেপি ধরে রাখতে চাইছে তখন রাষ্ট্রীয় অভিজাত প্রতিষ্ঠানের এই সংঘাতময় অবস্থাকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মিলান বৈষ্ণব বর্ণনা করেছেন ‘বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট’ হিসেবে।
দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশই বিপরীত সমস্যার সম্মুখীন। সেখানে নির্বাচিত রাজনীতিকরা স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে যেমন হস্তক্ষেপ করেন তার চেয়ে বেশি নাগরিক রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে স্ব-শাসিত সেনাবাহিনী। পাকিস্তান ও মিয়ানমারে সব রাজনীতির ঊর্ধ্বে সেনাবাহিনী। এ দুটি দেশেই সেনাবাহিনীর দীর্ঘ উপস্থিতির ইতিহাস আছে। দুই দেশেই সেনাবাহিনী জাতীয় রাজনীতিতে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তারা অব্যাহতভাবে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ‘তামাদ’ নামে পরিচিত। তারা নিরাপত্তা সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়গুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। জাতীয় সংসদে তাদের শতকরা ২৫ ভাগ আসনের গ্যারান্টি নিশ্চিত করেছে। তারা রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে নৃশংসতা চালিয়েছে তাতে তারা দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মার জাতিগোষ্ঠীর কাছ থেকে নতুন করে ব্যাপক হারে সমর্থন পেয়েছে। তারা এটাকে দেখে বাঙালি অনুপ্রবেশকারী ও বিদেশিদের নাক গলানো থেকে দেশকে নিরাপদ রাখার যুদ্ধ হিসেবে। সেনাবাহিনী সেখানে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করেছে। মিয়ানমারে সন্ত্রাসবিরোধী (কাউন্টার ইনসার্জেন্সি)-এর বিরুদ্ধে তাদের লড়াই অব্যাহত রেখেছে, বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। বার্মার জাতীয়তাবাদ ঝলসে ওঠার পর নিজেদেরকে তা থেকে বিরত রাখে সেনাবাহিনী। এর মধ্য দিয়ে তারা জাতির সুরক্ষক এমন একটি অবস্থান নিয়ে নিজেদের সুবিধা নিশ্চিত করে। সাবেক স্বৈরশাসকের চেয়ে এটা তাদের এক ভিন্ন কৌশল।
পাকিস্তানে প্রভাব বিস্তার করতে কোনো আনুষ্ঠানিক সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োজন হয় না সেনাবাহিনীর। বিস্তৃতভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময়ে তারা ব্যাপকভাবে ইমরান খানের পেছনে সমর্থন দিয়েছে। তার বিজয়ের পর ধর্ম অবমাননা বিষয়ক রায় নিয়ে যখন টিএলপি আন্দোলন তুঙ্গে তোলে তখন তাতে ইমরান খানের সমঝোতা বা সমাধান প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতা করেন সেনাবাহিনী। ব্যাপকভিত্তিক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে সেনাবাহিনী। এতে তারা বাহ্যিক প্রভাব পাচ্ছে। একই সঙ্গে তারা অবসরপ্রাপ্ত সেনা অভিজাত শ্রেণিকে স্বস্তিকর একটি অবস্থা দিয়ে একটি ভালো অভ্যন্তরীণ স্থান তৈরি করে নিয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, উল্লেখযোগ্য বিদেশি নীতি বিষয়ক সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষেত্রে তারা ভেটো দেয়ার ক্ষমতা রাখে বলে বিশ্বাস করা হয়। বিশেষ করে এ বিষয়টি বেশি প্রয়োগ করা হয় আফগানিস্তান ও ভারতের ক্ষেত্রে। তারা যে ক্ষমতা এক্ষেত্রে প্রয়োগ করে তা করার কথা নির্বাচিত বেসামরিক নেতাদের।
সতর্ক সংকেত
জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা, নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানকে আক্রান্ত করা ও সেনাবাহিনীর অব্যাহত প্রভাবের মতো এসব সমস্যা উদার গণতন্ত্রের জন্য অনেক দিক দিয়েই সুবিধার নয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অভিজ্ঞতা বলে যে, অগ্রগতি ও পশ্চাদ্ধাবনকে আলাদা করা খুব কঠিন।
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা ও প্রধানমন্ত্রী রণিল বিক্রমাসিংহের মধ্যকার সংঘাত কখনো প্রকাশ্যে আসতো না, যদি না তারা ২০১৫ সালের নির্বাচনের পরে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ভীষণভাবে প্রয়োজনীয় সংস্কার পাস না করতেন। ওই সংস্কার অল্প সময়ের মধ্যেই ধ্বংসাত্মক প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা শ্রীলঙ্কার গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করেছে। মিয়ানমারের ভয়াবহ এক আধিপত্যের প্রকাশ বেরিয়ে এসেছে। তবে সেখানে স্বাধীন মিডিয়ার জন্য ভূমিকা রেখেছে, অধিকতর মুক্ত রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অবদান রেখেছে এবং নাগরিক সমাজের জন্য নতুন সম্ভাব্যতা সৃষ্টি করেছে। মিয়ানমার পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। ভারতে নির্বাচন উচ্চ মাত্রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ রয়েছে। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে নতুন করে ইঞ্জিনিয়ারিং করার মধ্যেই নিশ্চিন্তে থাকতে পারে না বিজেপি। সেনাবাহিনীর প্রভাবযুক্ত ও ধর্মীয় উগ্রপন্থার ছায়ার নিচে পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক যে প্রতিযোগিতা তাতে এমন একটি সম্ভাব্য সরকার গঠন করে, যে সরকার তার নাগরিকদের কাছে অধিকতর দায়সম্পন্ন।
দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, কিছু দেশে গণতন্ত্র এখনো আছে, যেমন হাঙ্গেরি। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি একই নয়। সর্বোপরি গণতন্ত্রের বিতর্কিত প্রকৃতি এখানে নজরদারির দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। যারা অন্যান্য গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলেন অব্যাহতভাবে তাদেরকে তা করতে হবে, পশ্চাতে ফেলে আসতে হবে আদর্শগত অধিকারের প্রকল্পের বিরুদ্ধে কথা বলা, যেসব রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানকে খর্ব করেন এবং যেসব প্রতিষ্ঠান জবাবদিহিতা থেকে পালানোর চেষ্টা করে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া।
স্বেচ্ছায় গণতন্ত্রের পক্ষে থাকার বিষয়টি প্রমাণ করে শ্রীলঙ্কার সাংবিধানিক সংকটের বিষয়টি সমাধানের বিষয়। সিরিসেনার ক্ষমতার খেলা সহজেই উতরে যাওয়া যেতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্রের দুটি মূল বিপদ বর্তমান: তা হলো জাতি-জাতীয়তাবাদ এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর লঙ্ঘন। সিরিসেনার লক্ষ্য ছিল দ্রুত একটি সত্য প্রতিষ্ঠা করা, যা সহজে পাল্টানো যাবে না। কিন্তু সাধারণ মানুষ, নাগরিক সমাজ ও রাজনীতিকরা সাংবিধানিক অধিকার সংরক্ষণ করেন। তাদের এই কঠোর লড়াই উৎসাহ ও ক্ষয়িষ্ণু গণতন্ত্রের কথা বলে।
(অনলাইন ডেইলি টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার অনুবাদ)
No comments