তিনি নিজেই নাশকতা মামলার আসামি by কাফি কামাল
কিছুটা
কৌতূহল রেখেই রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক
পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী বীরবিক্রম। দিনটি ছিল ২৮শে অক্টোবর ২০১৫।
ঠিক তিন বছর পর ২৭শে অক্টোবর ফের রাজনীতিতে ফিরেছেন। বিএনপির রাজনীতি থেকে
অবসরের সময় তিনি কারণ দেখিয়েছিলেন শারীরিক অসুস্থতা। দলের চেয়ারপারসন
খালেদা জিয়া যখন চিকিৎসার জন্য লন্ডনে অবস্থান করছিলেন তখন তার আচমকা ওই
ঘোষণায় বিস্ময় তৈরি হয়েছিল। রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে সরে দাঁড়ানোর পর নীরবে
কাটিয়েছেন টানা তিনবছর। চলতি সপ্তাহে ফের রাজনীতির দৃশ্যপটে ফিরেছেন তিনি।
তবে, এবার পুরোনো দল বিএনপি নয়, যোগ দিয়েছেন বিকল্পধারায়।
বিএনপিতে সবশেষ তার পদ ছিল ভাইস চেয়ারম্যান এবং তিনি ছিলেন দলটির কূটনীতিক উইংয়ের অঘোষিত প্রধান। বিকল্পধারায় যোগ দেয়ার পরদিনই তিনি পেলেন দলটির অন্যতম নীতিনির্ধারকের আসন।
বিএনপি থেকে পদত্যাগের সময় শারীরিক অসুস্থতার কথা বললেও রাজনীতিতে ফিরে এসে বলছেন ভিন্ন কথা। অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে লেখা চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন- ‘বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমি গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলাম। সে কারণে আমাকে বিভিন্ন সময় দেশে বিদেশে নানাবিধ চিকিৎসা নিতে হয়েছে। বর্তমানে আমার শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি ঘটেছে।
আমার বর্তমান স্বাস্থ্যগত অবস্থার কারণে আমি অনতিবিলম্বে রাজনীতি থেকে অবসর নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অবসর গ্রহণের প্রেক্ষিতে আমি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সকল পদ থেকেও পদত্যাগ করলাম।’ তবে, সে চিঠিতে তিনি রাজনীতিতে ফেরার ইঙ্গিতও দিয়ে রেখেছিলেন। বলেছিলেন- ‘একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার স্বাস্থ্যগত সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে সামনে রেখে দেশ ও জাতীয় কল্যাণে কাজ করার প্রয়াস আমার চিরকাল থাকবে।’ কিন্তু রাজনীতিতে ফিরে তিনি বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে মতবিরোধ সৃষ্টি ও দলটির নাশকতার রাজনীতির কথা। বিএনপি থেকে পদত্যাগের ব্যাপারে কোনো মতপার্থক্য ছিল কী না- গণমাধ্যমের এমন প্রশ্নের জবাবে শমসের মবিন বলেছেন, ‘মতবিরোধ কিছুটা তো অবশ্যই ছিল। যেমন সামপ্রদায়িক রাজনীতির প্রশ্নে। আমি আশা করেছিলাম যে, বর্তমান বাংলাদেশের কথা চিন্তা করে বিএনপি তার কাজেকর্মে এবং তার অবস্থানে আরেকটু অসামপ্রদায়িকতার দিকে চলে আসবে। সেসব বিষয়ে আমি বাধা পাচ্ছিলাম। আমার মনের মতো হচ্ছিল না।
দ্বিতীয়ত, নাশকতার রাজনীতিতে আমি মোটেও বিশ্বাস করি না। সেটা সবধরনের নাশকতা। পেট্রোলবোমা দিয়ে পুড়িয়ে মারা হোক, বা লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মারা হোক।’ রাজনীতিতে ফিরে তিনি বিএনপির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক ও নাশকতার রাজনীতির অভিযোগ তুললেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এলে তিনি পররাষ্ট্র সচিব হন। সে হিসেবে আন্তর্জাতিক বিশ্বে তিনিই পালন করেছেন ওই সরকারের মুখপাত্রের দায়িত্ব। ২০০৫ সালে জোট সরকারের ক্ষমতার শেষদিকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগ পান।
২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরও কিছুদিন তিনি সে দায়িত্ব পালন করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দুইবছর দায়িত্বপালন শেষে ২০০৭ সালে অবসরে গিয়ে তিনি দেশে ফিরে বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দেন ২০০৮ সালে। ২০০৯ সালে দলের ভাইস চেয়ারম্যান হন এবং দলটির কূটনীতিক উইংয়ের মুখ্যব্যক্তি হয়ে উঠেন। ২০০৮ থেকে ২০১৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিএনপির রাজনীতির পক্ষেই বিদেশি কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক মহলে তৎপরতা চালিয়েছেন তিনি। সে সময় আন্দোলনমুখী বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগে মামলা হয়েছে হাজার হাজার। শমসের মবিন চৌধুরী নিজেও একাধিক নাশকতার মামলার আসামি এবং গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগও করেছেন।
২০১০ সালের ২৭শে জানুয়ারি হরতাল পালন করেছিল বিএনপি। হরতাল পালনের সময় মহাখালী থেকে গ্রেপ্তার করে পরদিন তাকে একদিনের রিমান্ডে নিয়েছিল গুলশান থানা পুলিশ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল- হরতালের সময় রাস্তায় পুলিশকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়ার। পরে ২০১০ সালের ২৭শে জুন হরতালের পিকেটিং করার সময় গাড়ি ভাঙচুর, পুলিশের কর্তব্য কাজে ও গাড়ি চলাচলে বাধাদান এবং পুলিশকে গলা টিপে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে দায়েরকৃত এক মামলায় শমসের মবিন চৌধুরীকে আসামি করে গুলশান থানা পুলিশ। ২০১৩ সালের ৩০শে ডিসেম্বর খালেদা জিয়ার বাড়িতে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনারের সঙ্গে বৈঠক থেকে বের হওয়ার পর শমসের মবিনকে গ্রেপ্তার করেছিল ডিবি পুলিশ। পরে রাতেই বেইলি রোডের গোয়েন্দা দপ্তর থেকে বাসায় ফেরেন তিনি। একদিন পর ২০১৪ সালের ১লা জানুয়ারি ফাঁস হয় তারেক রহমানের সঙ্গে তার ফোনালাপ।
২০১৪ সালের ২৪শে ডিসেম্বর রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে ঘটেছিল একটি সংঘর্ষের ঘটনা। সে সময় মেডিকেল কলেজের সামনে নেত্রকোনা-১ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি ছবি বিশ্বাসের গাড়িতে হামলা হয়। হামলায় তিনি আহত ও তার গাড়িটি জ্বালিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় দায়েরকৃত এক মামলায় শমসের মবিন চৌধুরীকে আসামি করা হয়। ২০১৫ সালের ৮ই জানুয়ারি তাকে মহাখালী ডিওএইচএসের বাসভবন থেকে গ্রেপ্তারের পর পাঁচদিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। শমসের মবিনকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেয়ার ঘটনায় ১১ই জানুয়ারি হরতাল পালন করেছিল সিলেট মহানগর বিএনপি। শাহবাগ থানার মামলায় কারাবন্দি থাকার সময় গাড়ি ভাঙচুর, সরকারি কাজে বাধা প্রদানের এক মামলায় ৮ই ফেব্রুয়ারি শমসের মবিনকে চারদিনের রিমান্ডে নিয়েছিল চকবাজার থানা পুলিশ। এখনো তার বিরুদ্ধে চলছে নাশকতার অভিযোগে দায়েরকৃত বেশকিছু মামলার কার্যক্রম। এখন তিনি বিএনপির বিরুদ্ধে নাশকতার রাজনীতির অভিযোগ করলেও ২০০৮ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মহলের কাছে বিএনপির রাজনীতির পক্ষে সাফাই গাওয়ার তিনিই ছিলেন মূল ব্যক্তি। এখন সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতির অভিযোগ করলেও কূটনীতিকদের কাছে দিনের পর দিন বিএনপির অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভাবমূর্তি তুলে ধরেছেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় লেফটেন্যান্ট ছিলেন শমসের মবিন চৌধুরী। যুদ্ধে পাকিস্তানি কমান্ডো বাহিনীর গুলিতে আহত ও আটক হয়ে ক্যান্টনমেন্টে বন্দি ছিলেন তিনি। যুদ্ধে ভূমিকা রাখায় তাকে বীরবিক্রম উপাধি দিয়েছিল সরকার। যুদ্ধাহত হওয়ায় পরবর্তীতে তার চাকরি ন্যস্ত হয়েছিল পররাষ্ট্র দপ্তরে। যুদ্ধাহত একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ বিএনপির রাজনীতি করতে তার সমস্যা হয়েছিল কী না- পদত্যাগের পর গণমাধ্যমের এমন প্রশ্নের জবাবে শমসের মবিন চৌধুরী বলেছিলেন- ‘সমস্যা হলে তো আরো আগেই রাজনীতি ছেড়ে দিতাম।’ শমসের মবিন চৌধুরী রাজনীতিতে ফিরে যোগ দিয়েছেন এমন একটি দলে যে দলের মহাসচিবের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা বিরোধিতার অভিযোগ। সম্প্রতি একটি টেলিভিশন টকশোতে রাজনীতি গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ অভিযোগটি সামনে এনেছেন।
২০১৫ সালের অক্টোবরে তিনি বিএনপির রাজনীতি থেকে অবসরে গেলেও তার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল আরো আগে। ২০১৩ সালের ৩০শে ডিসেম্বর রাতে গ্রেপ্তারের কয়েকঘণ্টা পর ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পাওয়া ও একদিন পর তারেক রহমানের সঙ্গে টেলিফোন আলাপ ফাঁস হওয়ার ঘটনা রাজনৈতিক মহলে জন্ম দিয়েছিল গুঞ্জন। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিএনপির পক্ষে কূটনীতিক মহলে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন শমসের মবিন চৌধুরী। বিএনপিতে একটি গুঞ্জন রয়েছে, সে নির্বাচনকে নিয়মরক্ষার নির্বাচন এবং তিন মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচন হবে- বিদেশি কূটনীতিকদের এমন আশ্বাসের ওপর খালেদা জিয়াকে আস্থাশীল করে তুলতেও মূল ভূমিকাটি পালন করেছিলেন তিনি।
পরে ছবি বিশ্বাসের ওপর হামলা মামলায় সে বছর জানুয়ারি মাসের প্রথম পক্ষে কারাগারে যাওয়ার পর মে মাসে মুক্তি পেয়ে বিএনপির কূটনীতিক তৎপরতা থেকে কয়েক মাস নিষ্ক্রিয় ছিলেন শমসের মবিন চৌধুরী। মুক্তি পাওয়ার পর তাকে আর দেখা যায়নি চেয়ারপারসন কার্যালয়ে। যদিও বিএনপির হয়ে বিদেশি কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন তিনি। ফলে তখন বিএনপি রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন ছিল দলটির আন্তর্জাতিক যোগাযোগ দুর্বল করতেই শমসের মবিনকে গ্রেপ্তার ও কারামুক্তির পর ক্ষমতাসীন মহলই তাকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল। শেষে চাপ থেকেই অবসরে গিয়েছেন তিনি। রাজনীতিতে ফেরার পর তিনি বলেছেন, আগে থেকেই বিকল্পধারা প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ও মতের মিল ছিল। কিন্তু তিনি এমন এক সময়ে রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন এবং বিকল্পধারায় যোগ দিয়েছেন যখন রাজনৈতিক মহলে চলছে নানা টানাপড়েন। নানাপন্থি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে যখন রাজনীতিতে একটি জাতীয় ঐক্য তৈরি হচ্ছে তখন তিনি ফিরেছেন তার বিপরীতে, ক্ষমতাসীনদের অনুকূলে। তার এই ফেরা নিয়েও তৈরি হয়েছে কৌতূহল।
বিএনপিতে সবশেষ তার পদ ছিল ভাইস চেয়ারম্যান এবং তিনি ছিলেন দলটির কূটনীতিক উইংয়ের অঘোষিত প্রধান। বিকল্পধারায় যোগ দেয়ার পরদিনই তিনি পেলেন দলটির অন্যতম নীতিনির্ধারকের আসন।
বিএনপি থেকে পদত্যাগের সময় শারীরিক অসুস্থতার কথা বললেও রাজনীতিতে ফিরে এসে বলছেন ভিন্ন কথা। অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে লেখা চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন- ‘বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমি গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলাম। সে কারণে আমাকে বিভিন্ন সময় দেশে বিদেশে নানাবিধ চিকিৎসা নিতে হয়েছে। বর্তমানে আমার শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি ঘটেছে।
আমার বর্তমান স্বাস্থ্যগত অবস্থার কারণে আমি অনতিবিলম্বে রাজনীতি থেকে অবসর নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অবসর গ্রহণের প্রেক্ষিতে আমি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সকল পদ থেকেও পদত্যাগ করলাম।’ তবে, সে চিঠিতে তিনি রাজনীতিতে ফেরার ইঙ্গিতও দিয়ে রেখেছিলেন। বলেছিলেন- ‘একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার স্বাস্থ্যগত সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে সামনে রেখে দেশ ও জাতীয় কল্যাণে কাজ করার প্রয়াস আমার চিরকাল থাকবে।’ কিন্তু রাজনীতিতে ফিরে তিনি বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে মতবিরোধ সৃষ্টি ও দলটির নাশকতার রাজনীতির কথা। বিএনপি থেকে পদত্যাগের ব্যাপারে কোনো মতপার্থক্য ছিল কী না- গণমাধ্যমের এমন প্রশ্নের জবাবে শমসের মবিন বলেছেন, ‘মতবিরোধ কিছুটা তো অবশ্যই ছিল। যেমন সামপ্রদায়িক রাজনীতির প্রশ্নে। আমি আশা করেছিলাম যে, বর্তমান বাংলাদেশের কথা চিন্তা করে বিএনপি তার কাজেকর্মে এবং তার অবস্থানে আরেকটু অসামপ্রদায়িকতার দিকে চলে আসবে। সেসব বিষয়ে আমি বাধা পাচ্ছিলাম। আমার মনের মতো হচ্ছিল না।
দ্বিতীয়ত, নাশকতার রাজনীতিতে আমি মোটেও বিশ্বাস করি না। সেটা সবধরনের নাশকতা। পেট্রোলবোমা দিয়ে পুড়িয়ে মারা হোক, বা লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মারা হোক।’ রাজনীতিতে ফিরে তিনি বিএনপির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক ও নাশকতার রাজনীতির অভিযোগ তুললেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এলে তিনি পররাষ্ট্র সচিব হন। সে হিসেবে আন্তর্জাতিক বিশ্বে তিনিই পালন করেছেন ওই সরকারের মুখপাত্রের দায়িত্ব। ২০০৫ সালে জোট সরকারের ক্ষমতার শেষদিকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগ পান।
২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরও কিছুদিন তিনি সে দায়িত্ব পালন করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দুইবছর দায়িত্বপালন শেষে ২০০৭ সালে অবসরে গিয়ে তিনি দেশে ফিরে বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দেন ২০০৮ সালে। ২০০৯ সালে দলের ভাইস চেয়ারম্যান হন এবং দলটির কূটনীতিক উইংয়ের মুখ্যব্যক্তি হয়ে উঠেন। ২০০৮ থেকে ২০১৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিএনপির রাজনীতির পক্ষেই বিদেশি কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক মহলে তৎপরতা চালিয়েছেন তিনি। সে সময় আন্দোলনমুখী বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগে মামলা হয়েছে হাজার হাজার। শমসের মবিন চৌধুরী নিজেও একাধিক নাশকতার মামলার আসামি এবং গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগও করেছেন।
২০১০ সালের ২৭শে জানুয়ারি হরতাল পালন করেছিল বিএনপি। হরতাল পালনের সময় মহাখালী থেকে গ্রেপ্তার করে পরদিন তাকে একদিনের রিমান্ডে নিয়েছিল গুলশান থানা পুলিশ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল- হরতালের সময় রাস্তায় পুলিশকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়ার। পরে ২০১০ সালের ২৭শে জুন হরতালের পিকেটিং করার সময় গাড়ি ভাঙচুর, পুলিশের কর্তব্য কাজে ও গাড়ি চলাচলে বাধাদান এবং পুলিশকে গলা টিপে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে দায়েরকৃত এক মামলায় শমসের মবিন চৌধুরীকে আসামি করে গুলশান থানা পুলিশ। ২০১৩ সালের ৩০শে ডিসেম্বর খালেদা জিয়ার বাড়িতে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনারের সঙ্গে বৈঠক থেকে বের হওয়ার পর শমসের মবিনকে গ্রেপ্তার করেছিল ডিবি পুলিশ। পরে রাতেই বেইলি রোডের গোয়েন্দা দপ্তর থেকে বাসায় ফেরেন তিনি। একদিন পর ২০১৪ সালের ১লা জানুয়ারি ফাঁস হয় তারেক রহমানের সঙ্গে তার ফোনালাপ।
২০১৪ সালের ২৪শে ডিসেম্বর রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে ঘটেছিল একটি সংঘর্ষের ঘটনা। সে সময় মেডিকেল কলেজের সামনে নেত্রকোনা-১ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি ছবি বিশ্বাসের গাড়িতে হামলা হয়। হামলায় তিনি আহত ও তার গাড়িটি জ্বালিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় দায়েরকৃত এক মামলায় শমসের মবিন চৌধুরীকে আসামি করা হয়। ২০১৫ সালের ৮ই জানুয়ারি তাকে মহাখালী ডিওএইচএসের বাসভবন থেকে গ্রেপ্তারের পর পাঁচদিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। শমসের মবিনকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেয়ার ঘটনায় ১১ই জানুয়ারি হরতাল পালন করেছিল সিলেট মহানগর বিএনপি। শাহবাগ থানার মামলায় কারাবন্দি থাকার সময় গাড়ি ভাঙচুর, সরকারি কাজে বাধা প্রদানের এক মামলায় ৮ই ফেব্রুয়ারি শমসের মবিনকে চারদিনের রিমান্ডে নিয়েছিল চকবাজার থানা পুলিশ। এখনো তার বিরুদ্ধে চলছে নাশকতার অভিযোগে দায়েরকৃত বেশকিছু মামলার কার্যক্রম। এখন তিনি বিএনপির বিরুদ্ধে নাশকতার রাজনীতির অভিযোগ করলেও ২০০৮ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মহলের কাছে বিএনপির রাজনীতির পক্ষে সাফাই গাওয়ার তিনিই ছিলেন মূল ব্যক্তি। এখন সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতির অভিযোগ করলেও কূটনীতিকদের কাছে দিনের পর দিন বিএনপির অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভাবমূর্তি তুলে ধরেছেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় লেফটেন্যান্ট ছিলেন শমসের মবিন চৌধুরী। যুদ্ধে পাকিস্তানি কমান্ডো বাহিনীর গুলিতে আহত ও আটক হয়ে ক্যান্টনমেন্টে বন্দি ছিলেন তিনি। যুদ্ধে ভূমিকা রাখায় তাকে বীরবিক্রম উপাধি দিয়েছিল সরকার। যুদ্ধাহত হওয়ায় পরবর্তীতে তার চাকরি ন্যস্ত হয়েছিল পররাষ্ট্র দপ্তরে। যুদ্ধাহত একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ বিএনপির রাজনীতি করতে তার সমস্যা হয়েছিল কী না- পদত্যাগের পর গণমাধ্যমের এমন প্রশ্নের জবাবে শমসের মবিন চৌধুরী বলেছিলেন- ‘সমস্যা হলে তো আরো আগেই রাজনীতি ছেড়ে দিতাম।’ শমসের মবিন চৌধুরী রাজনীতিতে ফিরে যোগ দিয়েছেন এমন একটি দলে যে দলের মহাসচিবের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা বিরোধিতার অভিযোগ। সম্প্রতি একটি টেলিভিশন টকশোতে রাজনীতি গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ অভিযোগটি সামনে এনেছেন।
২০১৫ সালের অক্টোবরে তিনি বিএনপির রাজনীতি থেকে অবসরে গেলেও তার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল আরো আগে। ২০১৩ সালের ৩০শে ডিসেম্বর রাতে গ্রেপ্তারের কয়েকঘণ্টা পর ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পাওয়া ও একদিন পর তারেক রহমানের সঙ্গে টেলিফোন আলাপ ফাঁস হওয়ার ঘটনা রাজনৈতিক মহলে জন্ম দিয়েছিল গুঞ্জন। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিএনপির পক্ষে কূটনীতিক মহলে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন শমসের মবিন চৌধুরী। বিএনপিতে একটি গুঞ্জন রয়েছে, সে নির্বাচনকে নিয়মরক্ষার নির্বাচন এবং তিন মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচন হবে- বিদেশি কূটনীতিকদের এমন আশ্বাসের ওপর খালেদা জিয়াকে আস্থাশীল করে তুলতেও মূল ভূমিকাটি পালন করেছিলেন তিনি।
পরে ছবি বিশ্বাসের ওপর হামলা মামলায় সে বছর জানুয়ারি মাসের প্রথম পক্ষে কারাগারে যাওয়ার পর মে মাসে মুক্তি পেয়ে বিএনপির কূটনীতিক তৎপরতা থেকে কয়েক মাস নিষ্ক্রিয় ছিলেন শমসের মবিন চৌধুরী। মুক্তি পাওয়ার পর তাকে আর দেখা যায়নি চেয়ারপারসন কার্যালয়ে। যদিও বিএনপির হয়ে বিদেশি কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন তিনি। ফলে তখন বিএনপি রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন ছিল দলটির আন্তর্জাতিক যোগাযোগ দুর্বল করতেই শমসের মবিনকে গ্রেপ্তার ও কারামুক্তির পর ক্ষমতাসীন মহলই তাকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল। শেষে চাপ থেকেই অবসরে গিয়েছেন তিনি। রাজনীতিতে ফেরার পর তিনি বলেছেন, আগে থেকেই বিকল্পধারা প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ও মতের মিল ছিল। কিন্তু তিনি এমন এক সময়ে রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন এবং বিকল্পধারায় যোগ দিয়েছেন যখন রাজনৈতিক মহলে চলছে নানা টানাপড়েন। নানাপন্থি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে যখন রাজনীতিতে একটি জাতীয় ঐক্য তৈরি হচ্ছে তখন তিনি ফিরেছেন তার বিপরীতে, ক্ষমতাসীনদের অনুকূলে। তার এই ফেরা নিয়েও তৈরি হয়েছে কৌতূহল।
No comments