উইঘুর মুসলিমদের ওপর চীনের এত নিপীড়ন কেন? by রবার্ট ডি. কাপলান
পশ্চিম
চীনে তুর্কি উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়ন হলো দেশটির নয়া
সাম্রাজ্যবাদী নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গোপন বন্দিশালায় ১০ লাখ
মানুষকে বন্দী করে রাখার বিষয়টিও এর অন্তর্ভূক্ত। চীনা সাম্রাজ্যের গতিবিধি
বুঝতে পারলেই এই নির্মমতার হেতু উপলব্ধি করা সম্ভব।
শিনজিয়াং, চীনের যে প্রদেশে লাখ লাখ উইঘুরের বসবাস, সেটি অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘নয়া রাজত্ব’। ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিকভাবে এই অঞ্চল পূর্ব তুর্কিস্তান নামে পরিচিত। যদিও চীনা রাষ্ট্র টিকে আছে সাড়ে ৩ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে। কিন্তু শিনজিয়াং প্রথম চীনের কিং রাজবংশের অন্তর্ভূক্ত হয় ১৮ শতাব্দীর মাঝামাঝি। তখন থেকেই এই অঞ্চলের পরিস্থিতি ছিল, বৃটিশ পরিব্রাজক ফিটজরয় ম্যাকলিনের ভাষায়, ‘স্থায়ীভাবে বিরোধপূর্ণ।’
আমি যখন ১৯৯৪ সালে প্রথম শিনজিয়াং সফর করি ও স্থানীয় উইঘুরদের সাক্ষাৎকার নিই, তাদের চোখে জাতিগত হান চীনা দখলদারদের (তাদের ভাষায়) প্রতি বিদ্বেষ ছিল স্পষ্ট। এক উইঘুর তরুণ আমাকে বলেন, ‘এটি তুর্কিস্তান, চীন নয়। চীনারা আমাদের ভাষা শেখে না। আমাদের অনেকেও তাদের ভাষা শেখে না। ব্যক্তিগত পর্যায়ে পর্যন্ত দু’ পক্ষের সম্পর্ক ভালো নয়।’
এরপর থেকে এই সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছে। চীন কেন রাষ্ট্র হিসেবে আরও উদার হয়নি এর একটি গভীর কিন্তু না-বলা কারণ হলো চীনের কর্তৃপরায়ণ নেতৃত্বের মধ্যে জাতিগত বিদ্রোহের আশঙ্কা কাজ করে। আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন একটু উদার হলো তখনই এ ধরণের বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। তাই চীন নিজের রাজনৈতিক কাঠামো বদ্ধ রেখে, কূটনীতি ও অর্থনৈতিক প্রণোদনার মাধ্যমে মধ্য এশিয়ার গভীরে প্রবেশ করেছে। এই অঞ্চলের অনেক দেশ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত ছিল। এখানকার বাসিন্দারাও মূলত উইঘুরদের মতো তুর্কি মুসলিম। তাদেরকে মিত্র বানাতে চীন বর্তমানে এই অঞ্চলে বিপুল অবকাঠামো নির্মাণ করছে। অথচ, দেশটি নিজের মুসলিম সম্প্রদায়কে অনুকূল পরিবেশ দিতে রাজি নয় পাছে ভবিষ্যতে কোনো বিদ্রোহ ঘটে যায়! কিন্তু চীন যে নিজের সীমান্ত ছাড়িয়ে এভাবে গভীরে প্রবেশ করতে চাইছে এর সঙ্গে নিজের ভেতরকার দানবটির এক ধরণের সংযোগ আছে, থাকতেই হবে।
ঐতিহাসিকভাবেই চীন কখনই স্থলভূমিতে সুরক্ষিত ছিল না। বিশেষ করে পশ্চিমাঞ্চলে। ফলে সমুদ্রপথে আগানোর বিলাসিতা করার সুযোগ দেশটির ছিল না। মিং রাজবংশের প্রথম দিকে অ্যাডমিরাল ঝেং হি ভারত মহাসাগরের কিছু এলাকা দখল করেন। সেগুলো ছাড়া নৌ পথে চীনের দুর্বলতা লক্ষণীয়। এখন স্থলভূমিতে চীন বেশ সুরক্ষিত। তাই বর্তমানে দেশটি চায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ নৌ বাহিনীর অধিকারী হতে। এই প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পদক্ষেপ হলো উইঘুর মুসলিমদের নির্যাতন বৃদ্ধি করা। ইউরেশিয়া অঞ্চলজুড়ে ভূমি ও সাগরপথে পরিবহন করিডোর প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে চীন যেই বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ হাতে নিয়েছে সেটি বাস্তবায়নে উইঘুর জনসংখ্যার পূর্ণ অধীনতা আদায় করা প্রয়োজন।
একুশ শতাব্দীর এই সিল্ক রুটের কেন্দ্রবিন্দু হলো মধ্য এশিয়া। সাবেক সোভিয়েতভুক্ত তুর্কি দেশগুলোতে সড়ক, রেলপথ ও জ্বালানি পাইপলাইন নির্মাণের মাধ্যমে চীন সংযুক্ত হবে ইরানের সঙ্গে। রাশিয়াকে হটিয়ে ইউরেশিয়ায় আধিপত্য স্থাপনের যথেষ্ঠ সম্ভাবনা আছে চীন-ইরান অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো মৈত্রীর। কিন্তু এই লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজন উইঘুর সম্প্রদায়ের বশ্যতা। কারণ উপকূলীয় চীন ও মধ্যপ্রাচ্যকে সংযোগকারী এই সকল সড়ক ও জ্বালানি পথকে অবশ্যই শিনজিয়াং-এর মধ্য দিয়েই যেতে হবে।
ঐতিহ্যবাহী উইঘুর সংস্কৃতিকে লঘু করে তুলতে চীনের পরিকল্পনা হলো তাদেরকে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী গৃহের বদলে নির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রিত অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে বাধ্য করা। তাদের লোকজ বাজারকে আধুনিক করা। ২০১৫ সালে আমার পরবর্তী শিনজিয়াং সফরে আমি যেমনটা দেখেছি, চীন চায় শহরগুলোকে নতুন মহাসড়ক ও উচ্চগতির রেলপথের মাধ্যমে সংযুক্ত করতে। চিরাচরিত ‘গাজর-ও-লাঠি’ (পুরস্কৃত করা ও সাজা দেওয়া) নীতির মাধ্যমে চীন হাজার হাজার অবাধ্য উইঘুরকে যেমন বন্দিশালায় রাখছে, তেমনি বাধ্য উইঘুরদের জীবনমানে উন্নতি ঘটাচ্ছে। এই সব কিছুর উদ্দেশ্য হলো উইঘুর মুসলিম সংস্কৃতির অবসান ঘটানো। সবচেয়ে বিরোধপূর্ণ সীমান্ত এলাকায় হান চীনা আধিপত্যের ষোলকলা পূরণ করা।
পশ্চিমা গণমাধ্যমে গুরুত্ব পেয়েছে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশের চীনা ঋণের জালে জর্জরিত হওয়া এবং এর মাধ্যমে দেশগুলোর বন্দর ও মহাসড়কের নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার বিষয়টি। কিন্তু যে বিষয়টি অগোচরে রয়ে গেছে তা হলো ইউরেশিয়াজুড়ে চীনের মহাপরিকল্পনার জাতিগত অধ্যায়টি। এ নিয়ে আরও মনোযোগ আসা দরকার। চীনের সিল্ক রুট পরিকল্পনায় উইঘুরদের মরু ঘর দেশটির সম্ভাব্য দুর্বলতা।
এই প্রক্রিয়ায় যে জাতীয় গৌরব ও জনক্ষোভের বিষয় জড়িত তাকে খাটো করে দেখবেন না। ইউরোপের উপনিবেশবাদীদের কাছ থেকে হং কং ও ম্যাকাও চীন ফেরত নিয়েছে। যার মাধ্যমে চীনের মজ্জায় বিদেশী অনুপ্রবেশের লজ্জাজনক যুগের আনুষ্ঠানিক অবসান হয়। ওদিকে মঙ্গোলিয়ার স্বার্বভৌমত্ব চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থের দ্বারা অনেকখানি ক্ষুণœ হয়েছে। তিব্বতকে পুরোদমে অধীনস্থ করে রাখা হয়েছে। শিনজিয়াং হলো ‘বৃহত্তর চীন’ প্রকৃত অর্থে রূপায়নের ক্ষেত্রে শেষ অজেয় স্থান, যেটিও ক্রমেই পড়তির দিকে। এরপরই চীন পুরোদমে পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় মনোযোগ দিতে পারবে। ফলশ্রুতিতে উন্মুক্ত হয়ে পড়বে ভারত মহাসাগর, যেখানে মিয়ানমার ও জিবুতির মাঝামাঝি নতুন নতুন বন্দর নির্মাণ বা নির্মাণে সহায়তা করছে চীন। কে বলে যে সাম্রাজ্যবাদের যুগ শেষ হয়েছে?
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান প্রায় অর্ধ-পৃথিবী দূরত্বে। ফলে এই নয়া সাম্রাজ্যবাদী উত্থান ঠেকাতে এই দূরত্ব দেশটির জন্য অসুবিধার কারণ। পৃথিবীর পশ্চিম গোলার্ধে একসময় প্রভাব বিস্তার করতো যুক্তরাষ্ট্র। এখন পূর্ব গোলার্ধের ওপর কোনো একক রাষ্ট্র যাতে প্রভাব বলয় তৈরি করতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করার মধ্যে ওয়াশিংটনের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। কিন্তু ইরানের মধ্য দিয়ে যাওয়া চীনা সিল্ক রুট, পাশাপাশি ইউরেশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় নাব্য অঞ্চলে দেশটির নৌ উপস্থিতি থাকলে, পূর্ব গোলার্ধে আধিপত্য বিস্তার করবে চীন।
আমেরিকার বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি, তথা লাভক্ষতির অঙ্কে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে সম্পর্ক নির্ণয় করার যে নীতি, তা এই লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্রই স্বেচ্ছায় ত্যাগ করার শামিল। এই অস্ত্র হলো মুক্ত বাজার অর্থনীতি, সুশীল সমাজ ও মানবাধিকারের মতো আমেরিকান আদর্শে আবদ্ধ মৈত্রী। উইঘুরদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে চীনকে দায়বদ্ধ করাটা দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা নৌবাহিনীকে ঠেকিয়ে দেওয়ার বাস্তববাদী প্রচেষ্টার সঙ্গেই সঙ্গতিপূর্ণ। উইঘুর নিপীড়ন যেমন চীনের মহাপরিকল্পনার অংশ, তেমনি চীনে মানবাধিকারের স্বপক্ষে আমেরিকার অঙ্গিকারও হওয়া উচিৎ আমেরিকার নিজস্ব প্রচেষ্টার অংশ।
(রবার্ট ডি. কাপলান হলেন ‘দ্য রিটার্ন অব মার্কো পোলো’জ ওয়ার্ল্ড: ওয়্যার, স্ট্রেটজি অ্যান্ড আমেরিকান ইন্টারেস্টস ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ বইয়ের লেখক। তিনি সেন্টার ফর অ্যা নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির জ্যেষ্ঠ ফেলো। পাশাপাশি, ইউরেশিয়া গ্রুপের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা। তার এই নিবন্ধ মার্কিন শীর্ষ পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।)
শিনজিয়াং, চীনের যে প্রদেশে লাখ লাখ উইঘুরের বসবাস, সেটি অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘নয়া রাজত্ব’। ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিকভাবে এই অঞ্চল পূর্ব তুর্কিস্তান নামে পরিচিত। যদিও চীনা রাষ্ট্র টিকে আছে সাড়ে ৩ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে। কিন্তু শিনজিয়াং প্রথম চীনের কিং রাজবংশের অন্তর্ভূক্ত হয় ১৮ শতাব্দীর মাঝামাঝি। তখন থেকেই এই অঞ্চলের পরিস্থিতি ছিল, বৃটিশ পরিব্রাজক ফিটজরয় ম্যাকলিনের ভাষায়, ‘স্থায়ীভাবে বিরোধপূর্ণ।’
আমি যখন ১৯৯৪ সালে প্রথম শিনজিয়াং সফর করি ও স্থানীয় উইঘুরদের সাক্ষাৎকার নিই, তাদের চোখে জাতিগত হান চীনা দখলদারদের (তাদের ভাষায়) প্রতি বিদ্বেষ ছিল স্পষ্ট। এক উইঘুর তরুণ আমাকে বলেন, ‘এটি তুর্কিস্তান, চীন নয়। চীনারা আমাদের ভাষা শেখে না। আমাদের অনেকেও তাদের ভাষা শেখে না। ব্যক্তিগত পর্যায়ে পর্যন্ত দু’ পক্ষের সম্পর্ক ভালো নয়।’
এরপর থেকে এই সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছে। চীন কেন রাষ্ট্র হিসেবে আরও উদার হয়নি এর একটি গভীর কিন্তু না-বলা কারণ হলো চীনের কর্তৃপরায়ণ নেতৃত্বের মধ্যে জাতিগত বিদ্রোহের আশঙ্কা কাজ করে। আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন একটু উদার হলো তখনই এ ধরণের বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। তাই চীন নিজের রাজনৈতিক কাঠামো বদ্ধ রেখে, কূটনীতি ও অর্থনৈতিক প্রণোদনার মাধ্যমে মধ্য এশিয়ার গভীরে প্রবেশ করেছে। এই অঞ্চলের অনেক দেশ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত ছিল। এখানকার বাসিন্দারাও মূলত উইঘুরদের মতো তুর্কি মুসলিম। তাদেরকে মিত্র বানাতে চীন বর্তমানে এই অঞ্চলে বিপুল অবকাঠামো নির্মাণ করছে। অথচ, দেশটি নিজের মুসলিম সম্প্রদায়কে অনুকূল পরিবেশ দিতে রাজি নয় পাছে ভবিষ্যতে কোনো বিদ্রোহ ঘটে যায়! কিন্তু চীন যে নিজের সীমান্ত ছাড়িয়ে এভাবে গভীরে প্রবেশ করতে চাইছে এর সঙ্গে নিজের ভেতরকার দানবটির এক ধরণের সংযোগ আছে, থাকতেই হবে।
ঐতিহাসিকভাবেই চীন কখনই স্থলভূমিতে সুরক্ষিত ছিল না। বিশেষ করে পশ্চিমাঞ্চলে। ফলে সমুদ্রপথে আগানোর বিলাসিতা করার সুযোগ দেশটির ছিল না। মিং রাজবংশের প্রথম দিকে অ্যাডমিরাল ঝেং হি ভারত মহাসাগরের কিছু এলাকা দখল করেন। সেগুলো ছাড়া নৌ পথে চীনের দুর্বলতা লক্ষণীয়। এখন স্থলভূমিতে চীন বেশ সুরক্ষিত। তাই বর্তমানে দেশটি চায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ নৌ বাহিনীর অধিকারী হতে। এই প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পদক্ষেপ হলো উইঘুর মুসলিমদের নির্যাতন বৃদ্ধি করা। ইউরেশিয়া অঞ্চলজুড়ে ভূমি ও সাগরপথে পরিবহন করিডোর প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে চীন যেই বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ হাতে নিয়েছে সেটি বাস্তবায়নে উইঘুর জনসংখ্যার পূর্ণ অধীনতা আদায় করা প্রয়োজন।
একুশ শতাব্দীর এই সিল্ক রুটের কেন্দ্রবিন্দু হলো মধ্য এশিয়া। সাবেক সোভিয়েতভুক্ত তুর্কি দেশগুলোতে সড়ক, রেলপথ ও জ্বালানি পাইপলাইন নির্মাণের মাধ্যমে চীন সংযুক্ত হবে ইরানের সঙ্গে। রাশিয়াকে হটিয়ে ইউরেশিয়ায় আধিপত্য স্থাপনের যথেষ্ঠ সম্ভাবনা আছে চীন-ইরান অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো মৈত্রীর। কিন্তু এই লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজন উইঘুর সম্প্রদায়ের বশ্যতা। কারণ উপকূলীয় চীন ও মধ্যপ্রাচ্যকে সংযোগকারী এই সকল সড়ক ও জ্বালানি পথকে অবশ্যই শিনজিয়াং-এর মধ্য দিয়েই যেতে হবে।
ঐতিহ্যবাহী উইঘুর সংস্কৃতিকে লঘু করে তুলতে চীনের পরিকল্পনা হলো তাদেরকে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী গৃহের বদলে নির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রিত অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে বাধ্য করা। তাদের লোকজ বাজারকে আধুনিক করা। ২০১৫ সালে আমার পরবর্তী শিনজিয়াং সফরে আমি যেমনটা দেখেছি, চীন চায় শহরগুলোকে নতুন মহাসড়ক ও উচ্চগতির রেলপথের মাধ্যমে সংযুক্ত করতে। চিরাচরিত ‘গাজর-ও-লাঠি’ (পুরস্কৃত করা ও সাজা দেওয়া) নীতির মাধ্যমে চীন হাজার হাজার অবাধ্য উইঘুরকে যেমন বন্দিশালায় রাখছে, তেমনি বাধ্য উইঘুরদের জীবনমানে উন্নতি ঘটাচ্ছে। এই সব কিছুর উদ্দেশ্য হলো উইঘুর মুসলিম সংস্কৃতির অবসান ঘটানো। সবচেয়ে বিরোধপূর্ণ সীমান্ত এলাকায় হান চীনা আধিপত্যের ষোলকলা পূরণ করা।
পশ্চিমা গণমাধ্যমে গুরুত্ব পেয়েছে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশের চীনা ঋণের জালে জর্জরিত হওয়া এবং এর মাধ্যমে দেশগুলোর বন্দর ও মহাসড়কের নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার বিষয়টি। কিন্তু যে বিষয়টি অগোচরে রয়ে গেছে তা হলো ইউরেশিয়াজুড়ে চীনের মহাপরিকল্পনার জাতিগত অধ্যায়টি। এ নিয়ে আরও মনোযোগ আসা দরকার। চীনের সিল্ক রুট পরিকল্পনায় উইঘুরদের মরু ঘর দেশটির সম্ভাব্য দুর্বলতা।
এই প্রক্রিয়ায় যে জাতীয় গৌরব ও জনক্ষোভের বিষয় জড়িত তাকে খাটো করে দেখবেন না। ইউরোপের উপনিবেশবাদীদের কাছ থেকে হং কং ও ম্যাকাও চীন ফেরত নিয়েছে। যার মাধ্যমে চীনের মজ্জায় বিদেশী অনুপ্রবেশের লজ্জাজনক যুগের আনুষ্ঠানিক অবসান হয়। ওদিকে মঙ্গোলিয়ার স্বার্বভৌমত্ব চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থের দ্বারা অনেকখানি ক্ষুণœ হয়েছে। তিব্বতকে পুরোদমে অধীনস্থ করে রাখা হয়েছে। শিনজিয়াং হলো ‘বৃহত্তর চীন’ প্রকৃত অর্থে রূপায়নের ক্ষেত্রে শেষ অজেয় স্থান, যেটিও ক্রমেই পড়তির দিকে। এরপরই চীন পুরোদমে পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় মনোযোগ দিতে পারবে। ফলশ্রুতিতে উন্মুক্ত হয়ে পড়বে ভারত মহাসাগর, যেখানে মিয়ানমার ও জিবুতির মাঝামাঝি নতুন নতুন বন্দর নির্মাণ বা নির্মাণে সহায়তা করছে চীন। কে বলে যে সাম্রাজ্যবাদের যুগ শেষ হয়েছে?
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান প্রায় অর্ধ-পৃথিবী দূরত্বে। ফলে এই নয়া সাম্রাজ্যবাদী উত্থান ঠেকাতে এই দূরত্ব দেশটির জন্য অসুবিধার কারণ। পৃথিবীর পশ্চিম গোলার্ধে একসময় প্রভাব বিস্তার করতো যুক্তরাষ্ট্র। এখন পূর্ব গোলার্ধের ওপর কোনো একক রাষ্ট্র যাতে প্রভাব বলয় তৈরি করতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করার মধ্যে ওয়াশিংটনের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। কিন্তু ইরানের মধ্য দিয়ে যাওয়া চীনা সিল্ক রুট, পাশাপাশি ইউরেশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় নাব্য অঞ্চলে দেশটির নৌ উপস্থিতি থাকলে, পূর্ব গোলার্ধে আধিপত্য বিস্তার করবে চীন।
আমেরিকার বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি, তথা লাভক্ষতির অঙ্কে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে সম্পর্ক নির্ণয় করার যে নীতি, তা এই লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্রই স্বেচ্ছায় ত্যাগ করার শামিল। এই অস্ত্র হলো মুক্ত বাজার অর্থনীতি, সুশীল সমাজ ও মানবাধিকারের মতো আমেরিকান আদর্শে আবদ্ধ মৈত্রী। উইঘুরদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে চীনকে দায়বদ্ধ করাটা দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা নৌবাহিনীকে ঠেকিয়ে দেওয়ার বাস্তববাদী প্রচেষ্টার সঙ্গেই সঙ্গতিপূর্ণ। উইঘুর নিপীড়ন যেমন চীনের মহাপরিকল্পনার অংশ, তেমনি চীনে মানবাধিকারের স্বপক্ষে আমেরিকার অঙ্গিকারও হওয়া উচিৎ আমেরিকার নিজস্ব প্রচেষ্টার অংশ।
(রবার্ট ডি. কাপলান হলেন ‘দ্য রিটার্ন অব মার্কো পোলো’জ ওয়ার্ল্ড: ওয়্যার, স্ট্রেটজি অ্যান্ড আমেরিকান ইন্টারেস্টস ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ বইয়ের লেখক। তিনি সেন্টার ফর অ্যা নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির জ্যেষ্ঠ ফেলো। পাশাপাশি, ইউরেশিয়া গ্রুপের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা। তার এই নিবন্ধ মার্কিন শীর্ষ পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।)
No comments