'ভিন্ন জাতের কারনে আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়'

২৪ বছর বয়সী প্রণয় পেরুমল্লাকে কয়েক দিন আগে ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যের মিরিয়ালগুড়া শহরে মেরে ফেলা হয়।
স্কুল থেকেই যাঁর সঙ্গে প্রেম, সেই অমৃতা বর্ষিণীকেই বিয়ে করেছিলেন প্রণয়।
গর্ভবতী স্ত্রীকে হাসপাতালে ডাক্তার দেখিয়ে বেরিয়ে আসার সময়েই তাঁকে ঘাড়ে কোপ মারা হয়।
পুলিশ বলছে, প্রণয়কে হত্যা করার জন্য পেশাদার খুনী নিয়োগ করেছিল তাঁর স্ত্রী অমৃতার পরিবারই।
এর জন্য এক কোটি ভারতীয় টাকা দেওয়া হয়েছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে। একমাসের বেশী সময় ধরে এই হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
নলগোন্ডা জেলার পুলিশ সুপার এ বি রঙ্গনাথ জানিয়েছেন, অমৃতার বাবা, চাচা, তাদের ড্রাইভার আর বাবার পরিচিত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জেরায় অমৃতার বাবা জানিয়েছেন, প্রণয় নীচু জাতির ছেলে ছিল, পড়াশোনাও ভাল মতো করে নি আর মধ্যবিত্ত লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত।
স্কুলে প্রথম দেখা থেকে শুরু করে চোখের সামনে স্বামীর হত্যা - সব কিছুই অকপটে বিবিসি তেলুগুর সংবাদদাতা দীপ্তি বাথিনীকে অকপটে জানিয়েছেন ২১ বছর বয়সী অমৃতা বর্ষিণী। ৫ মাসের গর্ভবতী অমৃতার সঙ্গে বিবিসি কথা বলেছে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে বসে।
প্রণয় একেবারে নিজের মায়ের মতো আমার খেয়াল রাখত। আমাকে স্নান করিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে খাইয়ে দেওয়া, রান্না করা - সব কিছুই করত ও। আমার রোজকার জীবনের একটা অংশই ছিল প্রণয়।
স্কুলে আমার থেকে একবছরের উঁচু ক্লাসে পড়ত ও। ছোটথেকেই দুজন দুজনকে পছন্দ করতাম। আমি যখন ক্লাস নাইনে, আর ও টেনে, তখনই প্রেম করতে শুরু করি। বেশী কথাবার্তা হত ফোনেই।
দেখবেন, ফেসবুকে একটা ছবি পোস্ট করেছিলাম - আমাদের দুজনের ছোটবেলার ছবি। লিখেছিলাম, 'ছোটবেলার প্রেম যার সঙ্গে, তাকেই বিয়ে করতে পারার থেকে ভাল কিছু হয় না। আমরা সবসময়ে একসঙ্গে থাকার জন্যই যেন জন্মেছি।'
এই যে কমাস পরে যে জন্মাবে, এই পেটে যাকে ধরেছি, এ তো আমাদের দুজনের প্রেমেরই চিহ্ন। প্রণয়কে চিরকাল আমার কাছে এ-ই রেখে দেবে।
প্রথম থেকেই কখনও প্রণয়ের জাতি বা আর্থিক অবস্থার কথা ভাবি নি আমি। আমার কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে আমি ওকে ভালবাসি আর একে অপরকে ভাল বুঝতে পারি।
এটা একটা খুব ছোট শহর তো। সব খবর খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারটাও জেনে গিয়েছিল বাড়িতে। ধমক-ধামক, ভয় দেখানো তো চলতই, গায়ে হাতও পড়েছে আমার বাড়িতে। তখনই আমরা ঠিক করি যে বিয়ে করব।
আমি যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি, সেকেন্ড ইয়ারে, তখনই, ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে আমরা বিয়ে করি। বিয়ের রেজিস্ট্রেশন করাই নি তখন আমরা। আমার বাড়ির লোকজন ব্যাপারটা জানতে পেরে ঘরে বন্ধ করে রেখে দিয়েছিল আমাকে।
আমার কাকা প্রণয়কে ভয় দেখিয়েছিল, আমাকে ডাম্বেল দিয়ে মেরেছিল। সবকিছুই হয়েছিল কিন্তু আমার মায়ের সামনে। আরও প্রায় জনা কুড়ি আত্মীয়স্বজনও সেখানে ছিল। কেউ আমার পাশে দাঁড়ায় নি।
তারপরেই ঘরে আটকিয়ে রাখা হয়। রোজ কিছুটা ভাত আর আচার দেওয়া হত আমাকে খাবার জন্য। সবাই চাইছিল আমি প্রণয়কে যাতে ভুলে যাই। একটাই আপত্তি সবার - প্রণয় তপশীলি জাতির ছেলে।
ছোট থেকেই আমার মা অন্য জাতের বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করতে বারণ করত। কিন্তু সেটা যে এই পর্যায়ে চলে যাবে, ভাবি নি কখনও।
অনেকদিন ঘরে আটকিয়ে রাখার পরে এবছরের ২০ জানুয়ারী আর্য সমাজ মন্দিরে যখন আমরা আবার বিয়ে করতে গেলাম, তখনই প্রণয়কে অতদিন পরে দেখলাম। মাঝের সময়টায় শুধু ফোনে মাঝে মাঝে কথা বলতাম আমরা।
নিজের ফোন ব্যবহার করতে দেওয়া হত না বাড়ি থেকে। তাই শরীর খারাপ হলে ডাক্তার দেখাতে যেতাম হাসপাতালে। সেখানে ডাক্তার বা হাসপাতালের কারও ফোন থেকে খুব কম সময়ের জন্য প্রণয়ের সঙ্গে কথা হত।
কী যে ভাল লাগত ওইটুকু সময়ের জন্য কথা বলতে পেরে! ওই সময়েই আমরা ঠিক করি যে আর্য সমাজে গিয়ে আবার বিয়ে করব, কারণ আগেরবারের বিয়েটার কোনও রেজিস্ট্রেশন করাই নি। কোনও কাগজপত্র কিছুই ছিল না আমাদের।
প্রণয়ের বাড়িতেও অবশ্য কেউ আমাদের বিয়ের ব্যাপারে জানত না। বিয়ের পরেই আমরা চলে গিয়েছিলাম হায়দরাবাদে। দুজনেরই ভয় ছিল যে বাড়ি থেকে চাপ আসবে।
প্রায় মাস দেড়েক হায়দরাবাদে ছিলাম আমরা। ওদিকে আমার বাবা খোঁজ নেওয়ার জন্য কয়েকটা গুণ্ডা ভাড়া করেছিল। তাই আবার আমরা মিরিয়ালগুড়ায় প্রণয়ের বাড়িতে থাকার জন্য ফিরে আসি। ভেবেছিলাম পরিবার পরিজনের মধ্যে থাকলে ভয়ের কিছু থাকবে না।
প্ল্যান করছিলাম যে দুজনেই উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ চলে যাব। কিন্তু এর মধ্যেই আমি গর্ভবতী হয়ে পড়লাম। তাই যতক্ষণ না সন্তানের জন্ম দিচ্ছি, ততদিন এখানেই থেকে যাব, এটাই ঠিক করেছিলাম আমরা। আর তারপরে পড়াশোনার জন্য কানাডা চলে যাওয়ার সব ব্যবস্থাও করা হয়ে গিয়েছিল।
মা হওয়ার জন্য বোধহয় আমার বয়সটা একটু কম। কিন্তু প্রণয় ওর আত্মীয়স্বজনকে বোঝাতে পেরেছিল যে সন্তানের জন্ম দিতে পারলে আমি নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে আরও শক্ত হয়ে লড়তে পারব।
আমার বাড়ির লোকদেরও জানিয়েছিলাম যে মা হতে চলেছি। প্রথম থেকেই ওরা বলছিল গর্ভপাত করিয়ে নেওয়ার জন্য। কদিন আগে গণেশ চতুর্থীর আশীর্বাদ নেওয়ার জন্য বাড়িতে ফোন করেছিলাম। তখন আবারও বলেছিল অ্যাবরশন করানো কথা।
ভয় একটা সবসময়েই ছিল যে আমার বাবা আর তার ভাড়া করা গুণ্ডারা ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। কিন্তু সেটা যে এরকম ভয়ানক হবে, দু:স্বপ্নেও ভাবি নি। সেদিন একটু দেরী করে উঠেছিলাম ঘুম থেকে। এগারোটা নাগাদ। পিঠে একটা ব্যথা হচ্ছিল। আমি প্রণয়কে ডেকেছিলাম। এখনও কানে বাজছে ওর উত্তরটা, 'কন্না, আসছি'।
ও আদর করে আমাকে কন্না বলে ডাকত। আমি জলখাবার খেয়ে নিয়েছিলাম। প্রণয় খায় নি। ও আমাকে আগে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে দুজনে কথা বলছিলাম যে পিঠের ব্যথাটা কী করে সারানো যায়।
এরপরে যখন ডাক্তার ভেতরে ডাকলেন, তখনই আমার বাবা ওই ডাক্তারকে ফোন করেন। গর্ভপাত করানোর ব্যাপারে কথা হয় দুজনের। 'আমি হাসপাতালে নেই' বলে ডাক্তার বাবার ফোনটা কেটে দিয়েছিলেন। তারপরেই বাবার একটা মিসড কল এসেছিল আমার ফোনে।
ডাক্তারকে দেখিয়ে হাসপাতালের বাইরে বেরিয়েছিলাম আমরা। আমি প্রণয়কে কী যেন একটা জিজ্ঞাসা করছিলাম। জবাব না পেয়ে ওর দিকে তাকাতে গিয়ে দেখি ও মাটিতে পড়ে আছে আর একটা লোক ওর ঘাড়ে কোপ মারছে।
সঙ্গে আমার শাশুড়িও ছিলেন। তিনি ওই লোকটাকে ধাক্কা মারা চেষ্টা করেন। হাসপাতালের ভেতরে দৌড়ে যাই আমি লোকদের সাহায্য চাইতে।
কিছুক্ষণ পরে বাবাকে ফোন করেছিলাম। তিনি বললেন, 'আমি কী করতে পারি! হাসপাতালে নিয়ে যাও!' কদিন আগের কয়েকটা ঘটনা এখন মনে পড়ছে একে একে।
কিছুদিন আগে বাবার একটা ছোট অপারেশন হয়েছিল। মা বলেছিল আমি যেন বাবাকে একবার দেখতে যাই। আমি মাকে মিথ্যা বলেছিলাম যে আমরা বেঙ্গালুরু যাচ্ছি। পরের দিন একজন লোক এসেছিল আমার শ্বশুরবাড়িতে। বাইরে একটা গাড়ি দাঁড় করানো ছিল, সেটার ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছিল। অদ্ভুত উচ্চারণ ছিল লোকটার। আমার শ্বশুর তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। এখন মনে হচ্ছে হাসপাতালে যে প্রণয়ের ঘাড়ে কোপ মারছিল, ওই গাড়ির খোঁজ করতে আসা লোকটা সে-ই।
বাবা কিছুদিন আগে থেকেই বোধহয় প্ল্যান করছিল আমাদের বড়সড় ক্ষতি করার। এখনও পর্যন্ত আমার বাড়ির কেউ আমার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলে নি।
মা আগে নিয়মিত ফোন করত। আমার শরীর স্বাস্থ্য কেমন আছে জানতে চাইত। জেনে বুঝেই হোক বা অজান্তে হয়তো সেইসব কথা বাবাকে জানিয়ে দিত মা।
ওরা সকলেই দোষী এই ঘটনার জন্য। ওদের বাড়িতে আর কখনও ফিরব না আমি। প্রণয়ের পরিবারই এখন আমার পরিবার।
আমার শ্বশুর-মশাই মি. বালাস্বামী, প্রণয়ের মা হেমলতা আর ওর ছোটভাই অজয় আমাকে সবসময়ে আগলিয়ে রাখছেন। কখনও একা ছাড়েন না আমাকে।
প্রণয় খুন হয়ে যাওয়ার পরে মাঝে মাঝেই নারী সংগঠন বা দলিত সংগঠনগুলো বাড়িতে আসছে। 'জয় ভীম' বা 'প্রণয় অমর রহে'র মতো স্লোগান দিচ্ছেন ওরা।
ওই স্লোগান শুনেই আমার শাশুড়ির চোখে জল এসে যায়। আমি ওঁকে বোঝানোর চেষ্টা করি যে অজয়ই তো এখন আমার ভাই। আর এই ঘরেই আমার সন্তান জন্ম নেবে।
একটা ফেসবুক পেজ বানিয়েছি আমি 'জাস্টিস ফর প্রণয়' নামে। সমাজ থেকে জাতপাতের ব্যাপারটাই যাতে উঠে যায়, সেই কাজের জন্য ওই পেজটা এখন ব্যবহার করতে চাই আমি।
প্রণয় সবসময়ে বলত প্রেমিক-প্রেমিকার জাত নিয়ে কোনও সমস্যা তৈরী হওয়া উচিত না। জাতপাতের জন্য আমার এত ভুগলাম, এত কষ্ট সহ্য করলাম। কিন্তু সে-ই চলে গেল।
আমার ইচ্ছা আছে ওর একটা মূর্তি শহরের ঠিক মাঝখানে বসাবো। যেখান থেকে যা অনুমতি লাগে যোগাড় করব। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজনরা ভয় পাচ্ছেন যে আমার বাবা আমার অনাগত সন্তান বা শ্বশুরবাড়ির কারও ক্ষতি না করে দেয়।
একই সঙ্গে আমার আর সন্তানের ভবিষ্যতের জন্যও ওরা ভাবছেন। নিজের মেয়ের মতোই দেখেন ওরা আমাকে। আবার এটাও তাঁদের মাথায় ঘুরছে যে আমাকে আর্থিকভাবে স্বাধীন হতে হবে। কিন্তু সেখানে একটাই সমস্যা।
প্রেম-বিয়ে এসব নিয়ে পরিবারের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে আমি তো পড়াশোনাটা ছেড়ে দিয়েছিলাম।
তবে আমি চাই, আমার আর প্রণয়ের সন্তান বেড়ে উঠবে একটা সাম্যের পৃথিবীতে।
সুত্রঃবিবিসি

No comments

Powered by Blogger.