মেজর মান্নানের প্রতিবাদ আমাদের ব্যাখ্যা

গত ২০শে সেপ্টেম্বর মানবজমিন-এর প্রথম পাতায় ‘মেজর মান্নান স্বাধীনতা বিরোধী’- শীর্ষক সংবাদের বিষয়ে বক্তব্য পাঠিয়েছেন বিকল্প ধারা বাংলাদেশের মহাসচিব মেজর অব. আবদুল মান্নান। নিচে তার বক্তব্যটি হুবহু তুলে ধরা হলো। আমি ১৯৬৮ সালের আগস্ট মাস থেকে ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তান আর্মির ৩য় কমান্ডো ব্যাটালিয়নে পোস্টেড ছিলাম এবং চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ছিলাম। ৭ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত আমি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট-এ ৩ কমান্ডো ব্যাটালিয়ানের রিয়ার হেড কোয়ার্টার এর দায়িত্বে ছিলাম। এই সময় আমার কমান্ডিং অফিস (সিও) কর্নেল জেডএ খান ঢাকায় ইস্টার্ন কমান্ড এ কর্মরত ছিলেন। ওই ১৮দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতির পটভূমিকায় অত্যন্ত ঘটনা বহুল ছিল। সে সময় আমাদের কমান্ডো অফিসারের জন্য কোনো রাজনীতিবিদদের সাথে যোগাযোগ করা নিষেধ ছিল।
একজন বাঙালি হিসেবে আমি এ বিষয়টি মেনে নিতে পারিনি। আনুমানিক ১৪/১৫ মার্চ কুমিল্লা ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার থেকে ঢাকায় অবস্থানরত আমার সিও এর নিকট আমার বিরুদ্ধে ১টি অভিযোগ পাঠানো হয়েছিল, অভিযোগে বলা হয়েছিল যে, আমি আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছি এবং অনতিবিলম্বে আমাকে কমান্ডোর দায়িত্ব থেকে সরানো উচিত।
কারণ তার ১ মাস আগে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা জনাব তোয়াহা আমার সাথে কমান্ডো মেচে দেখা করেছিলেন এবং দুপুরে আমার সাথে খাওয়া খেয়েছিলেন। প্রায় একই সময়ে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মালেক উকিল (পরবর্তীতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহান জাতীয় সংসদের স্পিকার হন) আমার সাথে কুমিল্লা মেচে দেখা করে তার ছেলে গোলাম মহিউদ্দীন লাতু এবং মুজিব বাহিনীর নেতা বেলায়েত হোসেন, যাদের তৎকালীন নোয়াখালীর ডিসিকে লাঞ্ছিত করার দায়ে ৩ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। যা আমি কুমিল্লা ডিভিশনের মার্শাল ‘ল’ এডমিনিস্ট্রেটর ব্রিগেডিয়ার শফি আহমেদকে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করে পুরো সাজা মওকুফ করেছিলাম।
যাই হোক আমার কমান্ডিং অফিসার (সিও) কর্নেল জেডএ খান কুমিল্লা ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার এর অনুরোধ অনুযায়ী আমাকে পাকিস্তানের চেরাটে অবস্থিত হেড কোয়ার্টারে ট্রান্সফারের সুপারিশ করেন সে অনুযায়ী ২৬শে মার্চ তারিখ আমার ট্রান্সফার অর্ডার কুমিল্লায় পৌঁছায়।
২৭শে মার্চ বিকালে পাকিস্তান থেকে আগত ১টি প্লাটুন এর ৩০ জন কমান্ডো, প্রথম কমান্ডো ব্যাটালিয়নের সিও কর্নেল সোলাইমান ও ক্যাপ্টেন সিকান্দার এর নেতৃত্বে চট্টগ্রামে দেওয়ানহাটের মোড়ে কনভয় আকারে যাওয়ার সময় ইপিআর এর এ্যাম্বুশে সবাই নিহত হয়, ৩০ জন কমান্ডো সৈন্য ও ২ জন অফিসারের মৃত্যু একটি ভয়াবহ ঘটনা বিধায় পুরো পাকিস্তান আর্মিতে তোলপাড় শুরু হয় এবং এই এ্যাম্বুশ ঘটনায় আমাকেও সন্দেহ করা হয়। পরের দিন ২৮শে মার্চ সকালে ক্যাপ্টেন সোলেমানের নেতৃত্বে ৩০ জন সৈন্য হেলিকপ্টারযোগে চট্টগ্রাম পাঠানো হয়।
ওই রাতে অর্থাৎ ২৮শে মার্চ রাতে ৩০ জন কমান্ডোর ফোর্স ক্যাপ্টেন সোলেমানের নেতৃত্বে কালুরঘাট রেডিও স্টেশন উড়িয়ে দেয়ার জন্য যাওয়ার পথে বোমা বিস্ফোরণে ২০ জন সৈন্য নিহত হয়। পরপর ২ দিনে ৫২ জন কমান্ডো সৈন্য নিহত হওয়ায় সারা পাকিস্তান আর্মিতে এবং বিশেষ করে তখনকার পূর্ব-পাকিস্তান ইন্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টারে ঝড় উঠে এবং টিক্কা খানের আদেশে আমাকে ২৯ তারিখ সকাল ৯টায় কমান্ডো অপারেশন সেন্টার (ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আদমজী স্কুল) থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট কোয়ার্টার গার্ডে বন্দি করে। একই কোয়ার্টার গার্ডে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিও কর্নেল মাসুদও ছিলেন।
তার সাথে আমার পূর্বের পরিচয় ছিল না এবং সে জানালো তার ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট জয়দেবপুর থেকে বিদ্রোহ করে ইন্ডিয়ার আগরতলায় চলে যায়। তাই তাকে গ্রেপ্তার করে ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট কোয়ার্টার গার্ডে বন্দি করেছে। তখনই আমি কোয়ার্টার গার্ডের হাবিলদারের মাধ্যমে আমার সিও জেডএ খানকে আমার গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানিয়ে এবং আমাকে মুক্ত করার অনুরোধ জানিয়ে ১টি চিঠি পাঠাই। এদিকে আমার পরনের ১ সেট ইউনিফর্ম ছাড়া কোনো কাপড় ছিল না, আমি তখন ইস্টার্ন কমান্ড এ নিয়োগরত মেজর আবদুস ছালাম, পরে বাংলাদেশ আর্মির লে. জেনারেল এবং সিজিএস হয়েছিল এর নিকট ১ সেট স্লিপিং পাজামা চেয়ে গার্ড কমান্ডারকে পাঠালাম, তার বাসা থেকে পাওয়া ১টি সাদা পায়জামা ও সাদা হাফ সার্ট পরেই কোয়ার্টার গার্ডে ২ দিন কাটিয়েছিলাম।
৩০শে মার্চ বিকাল ৪টায় কর্নেল জেডএ খান এবং ইস্টার্ন কমান্ড এ পোস্টেড মেজর আলী আহমদ হঠাৎ করে কোয়ার্টার গার্ডে এসে আমাকে মুক্ত করে সোজা তেজগাঁও বিমানবন্দরে নিয়ে করাচিগামী ১টি পিআইএ ফ্লাইট-এ উঠিয়ে দেয়।
কলম্বো হয়ে প্লেনটি ৩১ তারিখ ভোর ৬টায় করাচি বিমানবন্দরে অবতরণ করে। সেখান থেকে আমি আর্মি ট্রানজিট ক্যাম্প এর সহায়তায় ট্রেনে করে চেরাট কমান্ডো হেড কোয়ার্টারে পৌঁছি। প্রায় ৬ মাস ধরে ৫০ জন সৈন্য ও ২ জন অফিসার নিহত হওয়ার কারণ উদঘাটনের জন্য আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। অবশেষে সেপ্টেম্বর এর শেষ সপ্তাহে আমাকে কমান্ডো হেডকোয়ার্টার থেকে পোস্টেড আউট করে পাঞ্জাব রেজিমেন্ট সেন্টারে বদলি করা হয়, যেহেতু আমি ১ জন আর্টিলারি রেজিমেন্টের কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার ছিলাম, পাঞ্জাব রেজিমেন্ট আমাকে সাদরে গ্রহণ করে নাই এবং আমাকে কোনো ব্যাটালিয়নে পোস্টিংও দেয় নাই। ১ জন এক্সট্রা অফিসার হিসেবেই আমি পাঞ্জাব রেজিমেন্ট সেন্টারে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিলাম। তারপর আমাকে অন্যান্য বাঙালি অফিসারদের সাথে সাঘাই রিপেট্রিয়েশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়।
কমান্ডো হেডকোয়ার্টার-এ ৬ মাস অবস্থান আমার জন্য অত্যন্ত অপমানজনক ও কষ্টকর ছিল। ১ দিন প্রশ্ন-উত্তরকালে ১ জন সিনিয়র কমান্ডো অফিসার (প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ভাগিনা, মেজর বুনিয়াদ হোসেন সাইয়েদ) হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গালিগালাজ করে, আমি প্রতিবাদ করলে সে আরও উত্তেজিত হয়ে “ইউ আর এ বেঙ্গলি ট্রেইটর বাস্টার্ড” বলে আবারও গালি দেয়, আমি বিষয়টি সহ্য করতে না পেরে তাকে আঘাত করি। যেখানে উপস্থিত ৪/৫ জন পাঞ্জাবি অফিসার তার পক্ষে সমর্থন দেয় এবং সবাই আমাকে খুবই তিরস্কার ও গালাগালি করে। পরে কোর্ট অব ইনকোয়ারি হলে সবাই আমাকে দোষারোপ করে এবং ১ জন সিনিয়রকে আঘাত করার দায়ে আমার বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শাল অর্ডার হয়, কমান্ডো হেডকোয়ার্টার থেকে আমার পোস্টেড আউট হওয়ার পর সেই কোর্ট মার্শালের কোনো অগ্রগতি হয়নি।
আমাকে ২ বছর বন্দি অবস্থায় একে একে প্রায় ৮টি রিপেট্রিয়েশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। যেমন মার্দানে দরগাই ফোর্ট, পরে লান্ডিকোথালে সাঘাই ফোর্ট, বান্নুতে খাজুরি ফোর্ট, হাঙ্গুতে মিরালি ফোর্ট, সেখান থেকে কোহাট ফোর্ট, পরে লায়ালপুর জেল, সেখান থেকে বান্নু ক্যান্টনমেন্ট, সেখান থেকে বান্নু জেল। কোন ক্যাম্পের অথরিটিই আমাকে রাখতে চায় নাই। সবাই আমাকে ভয় করতো, কমান্ডো হওয়াটাই আমার অপরাধ ছিল।
’৭২ সনের শেষের দিকে খাজুরি ফোর্টে আটককৃত প্রায় ২০০ অফিসারের সাথে ফোর্ট অথরিটি অফিসারদের ১টি দ্বন্দ্ব হয়, সেটাকে কেন্দ্র করে আমাকেসহ ৫ জন অফিসারকে গ্রেপ্তার করে মীর আলি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ইনকোয়ারি শেষে আমাকে কোহাট ফোর্টে এবং বাকি ৪ জন (ব্রিগেডিয়ার আজিজ, ব্রি. সানোয়ার হুদা, ক্যাপ্টেন সিনহা এবং ক্যাপ্টেন বাহারাম আলী বেগ)-কে সাঘাই ফোর্টে নেয়া হয়। পরে জানতে পারি সাঘাই ফোর্ট অথরিটি আমাকে গ্রহণ করতে অসম্মতি জানায়। কোহাট ফোর্টে জেনারেল নূরউদ্দিন, জেনারেল চিশতি, জেনারেল আমসা আমিনসহ প্রায় ১০০ জন অফিসার ছিলেন।
কোহাট ফোর্ট থেকে লায়ালপুর জেলে পৌঁছার পর ১০ জন অফিসারকে নিয়ে জেল থেকে পালানোর জন্য ১টি সুড়ং খননের জন্য কাজ শুরু করি, যা ৩ মাসে ১৫০ গজ খনন হয়। পালাবার দিন বিকালে পূর্বেকার খাজুরি ফোর্টের মিথ্যা অভিযোগে আমাকে গ্রেপ্তার করে বান্নু ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। বাকি ১০ জন অফিসার ওই সুড়ং পথ দিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসে, তাদের মধ্যে নেভির এডমিরাল তাহের ছিলেন। দীর্ঘ ৬ মাস ধরে কোর্ট মার্শালে বিচার চলে। আমার সাথে একই অভিযোগে ব্রিগেডিয়ার আজিজ ২ নং আসামি হিসেবে ছিল। বিচার শেষে আমাদের ২ জনকে বান্নু জেলে পাঠানো হয়। বান্নু জেলে সাধারণ কয়েদি হিসেবে আমরা ২ জন ৩ মাস ছিলাম এবং রেডক্রসের মাধ্যমে ২৪শে জানুয়ারি ১৯৭৪ সনে বাংলাদেশে আসি।
দীর্ঘ আড়াই বছর পাকিস্তান আর্মির নানা ধরনের অত্যাচারে আমি অতিষ্ঠ ছিলাম, এদিকে বাংলাদেশ আর্মিতেও সিনিয়রটি হিসেবে আমাদের পাকিস্তান ফেরত অফিসারদের প্রকৃত মূল্যায়ন হয়নি, তাই আমি বাংলাদেশ আর্মি থেকে ’৭৫ এর ১৪ই মার্চ স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করি।
আমি দ্বিধাহীনভাবে বলতে চাই যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমার ত্যাগ অপরিসীম ছিল।
মেজর (অব.) আবদুল মান্নান
মহাসচিব
বিকল্পধারা বাংলাদেশ।
আমাদের বক্তব্য: প্রকাশিত সংবাদটি পুরোটাই ছিল লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের উদ্ধৃতি। এতে মানবজমিন-এর কোনো বক্তব্য ছিল না। যমুনা টেলিভিশনের টকশো অনুষ্ঠান ২৪ ঘণ্টায় অংশ নিয়ে তিনি ওই বক্তব্য দেন। অডিও রেকর্ড  থেকে ওই বক্তব্যটি ছাপা হয় যা মানবজমিন-এর হাতে সংরক্ষিত আছে।

No comments

Powered by Blogger.