সিলেটে জোড়াখুন: রহস্যময়ী তান্নিকে ঘিরে যত আলোচনা by ওয়েছ খছরু
ছদ্ম
নাম তানিয়া। ‘তান্নি’ নামেও চিনে অনেকেই। একাধিক নাম ব্যবহার করে সিলেটে
আলোচিত তান্নি। সিলেটের মিরাবাজারে মা ও ছেলে খুনের ঘটনার পর থেকে
লাপাত্তা। ইতিমধ্যে পুলিশ বেশ কয়েকজন নারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিন্তু
তান্নিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার খোঁজে ঘুম হারাম পুলিশের। ইতিমধ্যে
পুলিশি রিমান্ডে থাকা নিহত রোকেয়া বেগমের প্রেমিক নাজমুলের কাছ থেকে তান্নি
সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। এক তান্নির খোঁজে সিলেটের অজানা ইয়াবা
সিন্ডিকেটের সন্ধান পেয়েছে। তবে পুলিশ এসব তথ্যের ভিড়ে সবার আগে আলোচিত
জোড়া খুনের রহস্য উদঘাটনে খুঁজে ফিরছে তান্নিকে। কে এই তান্নি? এ প্রশ্নের
অনেক উত্তর ইতিমধ্যে পুলিশ পেয়েছে। তান্নি বহুরূপী। একেক সময় একেক নাম
ব্যবহার করে। সিলেটে তার সিন্ডিকেটের বেশির ভাগ নারীর কাছে সে তানিয়া নামেই
পরিচিত। ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নারীর কাছে সে তান্নি নামেই পরিচিত। এটিই তার
প্রকৃত নাম বলে তার সহযোগীরা নিশ্চিত করেছে। সিলেটে বাসায় নারী দিয়ে
অসামাজিক কাজ করানোর মতো মহিলার সংখ্যা কম নয়। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের
নারীও এই কাজের সঙ্গে জড়িত। নগরীর অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে প্রায় সব
এলাকাই তারা বসবাস করে। এদের মধ্যে কেউ কেউ বিউটি পার্লার, কেউ আবার
রাজনীতির আড়ালে এসব কাজ করে বেড়ান। অনেকেই আছেন প্রবাসীর স্ত্রীর পরিচয়ে
বিলাস বহুল জীবনযাপন করেন। সিলেটের তান্নি তাদেরই একজন। সিলেটে ইয়াবা
নেটওয়ার্কের শীর্ষ পর্যায়ে তান্নির অবস্থান। তার মূল বাড়ি সুনামগঞ্জ। চার
বছর আগে মিনারা নামের এক মহিলার হাত ধরে সিলেট নগরে প্রবেশ করে। বেশ
সুন্দরী। মর্ডান স্টাইলে চলাফেরা করে। শহরতলীর ইসলামপুর এলাকায় বসবাসকারী
মিনারার মাধ্যমে সিলেটে এসে হাইপ্রোপাইল পতিতা হিসেবে পরিচিতি পায়। এরপর
জড়িয়ে পড়ে ইয়াবা ব্যবসায়। ইয়াবার বিশাল বিশাল চালান তার হাত ধরে এসেছে
সিলেটে। এই চালানগুলো মহিলাদের মাধ্যমে অসামাজিক কাজের আড়ালে ব্যবসার
নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছিল। উচ্চবিলাসী তান্নির সঙ্গে মিনারার সম্পর্ক বেশি
দিন টিকেনি। এরই মধ্যে সে সিলেট নগরীতে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে। সঙ্গ পায়
নয়া সড়ক এলাকায় বসবাসকারী দিলারা নামের আরেক মহিলার। তার আগে মিনারার
বদান্যতায় জাকির নামের একজনের সঙ্গে বিয়েও হয় তান্নির। দিলারাও নগরীর আরেক
পরিচিত মুখ। মধ্যবয়সী দিলারার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার পর তান্নি সিলেটে বিভিন্ন
হাইপ্রোপাইল মানুষের ছোঁয়া পায়। একই সঙ্গে ইয়াবা ব্যবসাও চালিয়ে যেতে
থাকে। প্রায় দুই বছর দিলারার সঙ্গে একত্রে ব্যবসা করে তান্নি। এর মধ্যে
তান্নির নেটওয়ার্ক আরো বিস্তৃতি লাভ করে। এক সময় দিলারার সঙ্গেও তার বিরোধ
দেখা দেয়। এই বিরোধের অন্যতম কারণ হচ্ছে ইয়াবার চালানের টাকা ভাগ-বাটোয়ারা।
ব্যবসার টাকা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়ায় তান্নি কয়েক মাস আগে সম্পর্ক গড়ে
সিলেটের মিরাবাজারে নিহত রোকেয়ার সঙ্গে। রোকেয়ার সঙ্গে আগে থেকেই যোগাযোগ
ছিল তার। রোকেয়ার বাসায় সে তানিয়া নামে পরিচিতি পায় এবং সবাই তাকে তানিয়া
বলেই ডাকে। পুলিশসহ এলাকা সূত্রে জানা গেছে, তানিয়া ওরফে তান্নি প্রায় ৭-৮
মাস ধরে রোকেয়ার বাসাতেই বেশির ভাগ সময় থাকতো। রোকেয়া স্থানীয়দের কাছে
তান্নিকে পরিচয় দিত কাজের মহিলা হিসেবে। কিন্তু তান্নি ছিল নিহত রোকেয়ার
ব্যবসায়িক পার্টনার। একই সঙ্গে তান্নির নেটওয়ার্ক বেশি থাকায় সে খদ্দের ধরে
নিয়ে যেত নিহত রোকেয়ার বাসায়। ওখানে তারা ইয়াবা বিক্রি করতো। এমনকি ইয়াবার
চালানও আনা-নেয়া হতো ওখান থেকেও। মিরাবাজারের খারপাড়া এলাকাবাসী জানিয়েছে,
রোকেয়া বেগমের বাসা থেকে প্রায় সময় বোরকাপরা এক মহিলা বের হয়ে যেতেন। তিনি
রোকেয়ার বাসাতেই থাকতেন। মুখ ঢেকে থাকার কারণে কখনোই তার মুখ কেউ দেখেনি।
তবে রোকেয়ার বাসার লোকজন তাকে দেখেছে। নিহত রোকেয়ার প্রেমিক নাজমুলের সঙ্গে
তান্নির সম্পর্ক ছিল গভীর। নাজমুল তার প্রেমিকা রোকেয়া ও তান্নিকে স্ত্রীর
মতো ব্যবহার করতো। ফলে তান্নির সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিল নাজমুলের। রোকেয়ার
বাসায় ইয়াবার ব্যবসার বিস্তৃতি ঘটাতে নাজমুলও সেখানে অংশীদার হয়েছিল বলে
ইতিমধ্যে পুলিশ জেনেছে। নাজমুলের টাকা দিয়ে তারা ইয়াবা নেটওয়ার্ক আরো
শক্তিশালী করে। এ কারণে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে রোকেয়া প্রচুর টাকার মালিক
হয়েছিল। তান্নিও একইভাবে টাকা আয় করেছে। পুলিশ জানায়, রিমান্ডে থাকা
নাজমুলের কাছ থেকে রোকেয়া ও তান্নির অজানা অধ্যায়ের অনেক ঘটনা এখন তাদের
কাছে পরিষ্কার হয়েছে। প্রেমিকা রোকেয়ার হাত ধরে সেও ইয়াবা নেটওয়ার্কে জড়িয়ে
পড়েছিল। এতে করে লাখ লাখ টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে তাদের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ
ছিল। খুনের কয়েক দিন আগে থেকে নাজমুল ও তান্নি নিহত রোকেয়ার বিরুদ্ধে
অবস্থান নিয়েছিল। ইয়াবার টাকা ভাগ-বাটোয়ারার দ্বন্দ্বের জের ধরে তান্নি
এলাকার যুবক কাঞ্চা সুমনসহ কয়েকজনকে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে। পরবর্তীকালে
এলাকার ওই যুবকরা নিহত রোকেয়ার বাসায় আস্তানা গড়ে তুলেছিল। ওদিকে বিয়ে
নিয়ে নাজমুলের সঙ্গেও নিহত রোকেয়ার বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছিল। সিলেটের
কোতোয়ালি থানার ওসি মো. গৌসুল হোসেন গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন,
তানিয়া ওরফে তান্নিকে গতকাল পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তাকে
গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান চলছে। পাশাপাশি রিমান্ডে থাকা নাজমুলকেও
জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যগুলো যাচাইবাছাই করা হচ্ছে বলে
জানান তিনি।
No comments