ইয়েমেনে লেজে-গোবরে সৌদি জোট! যুদ্ধে বাড়ছে ইরানি প্রভাব: ইসরাইলি বিশেষজ্ঞ
ইসরাইলের দু'জন উচ্চপদস্থ নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বলেছেন, সৌদি নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন জোট ইয়েমেনের চলমান যুদ্ধে জিততে পারবে না।
এ যুদ্ধ চলতে থাকতে সেখানে ইরানি প্রভাব বাড়তে থাকবে বলে যুদ্ধ বন্ধ করার পরামর্শ দিয়ে তারা বলেছেন, অনুকূল শর্ত ও অবস্থা-সাপেক্ষে দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসনের সুযোগ এখনও রয়েছে। তাই আরও বেশি বিপর্যয়ের আগেই যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ এ যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিয়ে সৌদি সরকারকে সাহায্য করা।
গত ২৬ মার্চ সংবাদ মাধ্যম 'দ্যা ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট'-এ এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ওই দুই বিশেষজ্ঞের এইসব কথা।
ডঃ ইয়োএল গুজানস্কি ও আরি হাইস্টাইন-এর লেখা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিন বছরের ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি সরকারের খরচ হয়েছে দশ হাজার কোটি ডলার। এ যুদ্ধ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সৌদিদের সুনাম নষ্ট করেছে এবং ইয়েমেনে ইরানের প্রভাব বিলুপ্ত করার লক্ষ্য অর্জনেও ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে মার্কিন মদদপুষ্ট এ যুদ্ধে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে ইয়েমেনের অবকাঠামো । পুরো দেশটিতে দেখা দিয়েছে দুর্ভিক্ষ ও প্রাণঘাতী নানা রোগের প্রাদুর্ভাব।
ওয়াশিংটনে সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের সাম্প্রতিক সফর এ ধ্বংসাত্মক যুদ্ধাবসানে মার্কিন সরকারের জন্য একটা ভালো সুযোগ বয়ে এনেছে বলে তারা মন্তব্য করেন।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: সৌদি আরবের জন্য ইয়েমেন প্রভাব বিস্তারের এক ঐতিহাসিক টার্গেট এবং জাতীয় নিরাপত্তা ও শান্তির জন্যও এক জটিল ক্ষেত্র। কারণ এ দেশটির সাথে সৌদি আরবের যেমন এক দীর্ঘ ও অদুর্ভেদ্য সীমান্ত রয়েছে ঠিক তেমনি লোহিত সাগরে প্রবেশ পথও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ইয়েমেন। আর ইরানের ক্ষেত্রে ইরাক ও সিরিয়ার সাথে তুলনা করলে ইয়েমেন হচ্ছে দ্বিতীয় পর্যায়ের গুরুত্ববহ দেশ। কিন্তু হুথি মিলিশিয়াদের উপর তুলনামূলক সামান্য অল্প বিনিয়োগ করেই ইরান তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরবের কাছ থেকে এক গুরুত্বপূর্ণ সামরিক,রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করতে পেরেছে।
ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে: হুথিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সামরিক গোয়েন্দা তথ্য এবং লজিস্টিক সাপোর্ট লাভ করছে সৌদি আরব। তাছাড়া এ দেশটির নিরাপত্তা বাজেট হচ্ছে বিশ্বে চতুর্থ বৃহত্তম এবং এর হাতে রয়েছে আধুনিক অস্ত্রভাণ্ডার। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ দেশটির কাছে এর দোরগোড়ায় বিদ্যমান ও উপস্থিত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শত্রুকে পরাজিত করাটা কঠিন ও দুরূহ বলেই মনে হচ্ছে।
ইয়েমেনের রাজধানী সানা ও দেশের আরও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দখলে রাখা ছাড়াও হুথিরা সৌদি আরবে একশ'রও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। এসব ক্ষেপণাস্ত্র ইরানের তৈরি বলে অভিযোগ রয়েছে। হুথিরা ১০০ বর্গ মাইলেরও বেশি সৌদি ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছে।
ওই দুই ইসরাইলি বিশেষজ্ঞ আরও লিখেছেন: সামরিক-নিরাপত্তা বিষয়ক (পূঁজি) বিনিয়োগ এবং যুদ্ধে সামরিক বাহিনীর দক্ষতা ও সাফল্যের মধ্যকার ব্যবধানের কারণে সৌদি বাদশাহ সালমান এবং তাঁর উত্তরাধিকারী যুবরাজ বিন সালমান সৌদি সশস্ত্র বাহিনীর স্টাফ-প্রধান, স্থলবাহিনী প্রধান এবং বিমান প্রতিরক্ষা প্রধানসহ বহু ঊর্ধ্বতন সামরিক ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করতে বাধ্য হয়েছেন।
এসব রদবদলকে সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ার অংশ বলে দেখানো হলেও আসলে তা সৌদি সামরিক বাহিনীর দক্ষতা ও পারদর্শিতা সংক্রান্ত সৌদি অভিজাত শ্রেণীর ক্রমবর্ধমান হতাশাকেই প্রতিফলিত করছে। এ সব পদ পরিবর্তন ও রদবদল কি সৌদি সামরিক কৌশলে জরুরি পরিবর্তন আনবে? যদি পরিবর্তন আসেও তাহলে চলমান যুদ্ধের উপর তার সম্ভাব্য প্রভাব ও ফলাফল দেখার জন্য আরও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে ।
বিশ্লেষণধর্মী এ রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে: তুলনামূলক সাফল্য অর্জন সত্ত্বেও ইয়েমেনে তার কর্মতৎপরতা চালানোর ক্ষেত্রে ইরানও অসুবিধা ও বাধার মুখোমুখি হচ্ছে। পাশ্চাত্যের সহায়তায় আরব দেশগুলোর আরোপিত সামুদ্রিক অবরোধ ইয়েমেনে ঘটনাবলী নিয়ন্ত্রণ করা সংক্রান্ত ইরানের শক্তি ও সামর্থ্যকে সীমিত করছে। তেহরানের পক্ষে সামুদ্রিক অবরোধ ভাঙ্গা সম্ভব নয় বল হুথিদের কাছে চোরাপথে স্বল্পসংখ্যক সামরিক উপদেষ্টা ও বিশেষজ্ঞ, টাকা-পয়সা এবং ক্ষেপণাস্ত্রের যন্ত্রাংশসহ বিভিন্ন ধরণের অস্ত্র পাঠানো ছাড়া আর কোন বিকল্প পথ নেই ইরানের।
ডঃ ইয়োএল গুজানস্কি ও আরি হাইস্টাইন নামের ওই দুই বিশেষজ্ঞ আরও লিখেছেন: একই সময় ইয়েমেন যুদ্ধ প্রধান মুসলিম মিত্রদের সাথে সৌদি আরবের নাজুক সম্পর্কের ধরণও প্রকাশ করেছে। এ দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র-দেশ পাকিস্তান সৌদি আরবকে যুদ্ধে সহায়তা দানের জন্য সৈন্য পাঠানোর বিষয়টি আশ্চর্যজনকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। মিশরের সিসি সরকারও যে এ যুদ্ধে যোগ দিতে বিশাল স্থলবাহিনী পাঠায়নি তা সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে। বরং কায়রো রিয়াদকে সাহায্য করার জন্য মাত্র কয়েক শো সৈন্য ও তিন চারটি ছোট যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়েছে। অথচ সৌদি আরব এই দেশটিতে বহু বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে এবং এ দেশটি সৌদি আরবের জন্য কৌশলগত গভীরতার(strategic depth) মূল্য রাখে।
আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনকি যে সব দেশ সৌদি নেতৃত্বাধীন যুদ্ধে যোগদান করতে রাজি হয়েছিল যুদ্ধ চলাকালে রিয়াদের সাথে তাদেরও স্বার্থ-সংঘাত তৈরি হয়েছে। যেমন: সৌদি ও আরব আমিরাত এমন সব গোষ্ঠী ও বাহিনীকে মদদ দিচ্ছে যারা ইয়েমেনের ভবিষ্যতের ব্যাপারে পরস্পর বিরোধী এবং তা সময় সময় সৌদি ও আমিরাতের স্থানীয় সমর্থকদের মধ্য সংঘর্ষ ও সহিংসতা সৃষ্টি করেছে।
ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে: সৌদি যুবরাজ বিন সালমানের সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং ওয়াশিংটনে সৌদি রাজকীয় সফরকে এ ধ্বংসাত্মক ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী যুদ্ধ বন্ধ করার এক সুযোগ বলে বিবেচনা করত ওয়াশিংটনের উপলব্ধি করা ও ভেবে দেখা উচিৎ: সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট এ যুদ্ধে বিজয়ী হতে পারবে না ।তবে তারা (সৌদি জোট) এ যুদ্ধটাকে অনুকূল শর্ত ও অবস্থা সাপেক্ষে বন্ধ করতে পারে। আর ওয়াশিংটনের উচিৎ এ জোটকে তা করতে সাহায্য করা।
এক সীমিত সময়ের জন্য সৌদি আরবের যুদ্ধে ওয়াশিংটনের বর্ধিত সমর্থনের বিনিময়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উচিৎ এ দাবি করা যে সৌদিরা বেসামরিক প্রাণহানি বন্ধ করার জন্য আরও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেবে এবং যে সব ইয়েমেনি রোগ ও খাদ্যাভাবের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তাদের ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ বাড়িয়ে দেবে।
ডঃ ইয়োএল গুজানস্কি ও আরি হাইস্টাইন আরও লিখেছেন: মার্কিন সহায়তা ও সাপোর্ট তুলে নেয়া হবে- এটা জানানো হলে সৌদিরা যথাসম্ভব শিগগিরই এক রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছতে উদ্বুদ্ধ হবে। আবার একই সময় হুথিদের উপর আঘাত হানা এবং মার্কিন সমর্থন ও সাপোর্ট যে গতিময়তার সৃষ্টি করবে তা ইরান-সমর্থিত হুথিদেরকেও এ যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য করবে। অবশ্য সৌদির প্রতি মার্কিন সমর্থনের সময়সীমা গোপন রাখতে হবে। আর উভয় পক্ষকে যদি যুদ্ধ বন্ধ করতে উদ্বুদ্ধ ও বাধ্য করা হয় তাহলে এক ধরণের রাজনৈতিক আপোষ ও নিষ্পত্তিতে উপনীত হওয়া সম্ভবপর বলে মনে হয়।
ইয়েমেন যুদ্ধ সব পক্ষের জন্যই বিপর্যয় বয়ে এনেছে। আর তাই এ যুদ্ধ বন্ধ করাই হচ্ছে যেমন একদিকে মার্জিত ও চৌকস (smart)বিষয় ঠিক তেমনি অপরপক্ষে এটা হচ্ছে ন্যায় ও যথার্থ বিষয় যা অবশ্যই করা উচিৎ। আর সংঘর্ষ ও নিরাপত্তাহীনতার শিকার অঞ্চলগুলোতে ইরানের হস্তক্ষেপ সবচেয়ে বেশী সফল হচ্ছে বলে যুদ্ধ বন্ধ করার মধ্যেই রয়েছে আঞ্চলিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে ইরানের হস্তক্ষেপ-ক্ষমতা কার্যকরভাবে দুর্বল করার বর্ধিত সুবিধা।
উল্লেখ্য, ডঃ ইয়োএল গুজানস্কি ইসরাইলের Institute for National security studies (INSS)-এর রিসার্চ ফেলো। তিনি পারস্য উপসাগরীয় রাজনীতি-বিশেষজ্ঞ এবং আরি হাইস্টাইন INSS-এর পরিচালকের বিশেষ সহকারী।
[এ প্রতিবেদনে ইয়েমেন - সৌদি আরব যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাশ্চাত্য এবং ইসরাইলের মদদপুষ্ট সৌদি-নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন জোটের পরাজয়,ব্যর্থতা ও শোচনীয় অবস্থার এক সার্বিক চিত্র বেশ ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। লেখকদ্বয় ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক স্ট্যাডিস ইন্সটিটিউটের কর্মকর্তা ও রিসার্চ ফেলো। তাই ইরানকে ইয়েমেনসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে হস্তক্ষেপ করার দোষে দায়ী করা তাদের জন্য খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এটা হচ্ছে সত্যের অপলাপ মাত্র। আসলে ইঙ্গ-মার্কিন-ইসরাইলি-সৌদি-আমিরাতি চক্রই আফগানিস্তান-পাকিস্তান-ইরাক-সিরিয়া-ইয়েমেন-মিসর-তিউনিসিয়া-নাইজেরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অযাচিত হস্তক্ষেপ করছে যা কারো অজানা নয়।
আল-কায়দা,তালিবান, দায়েশ (আইসিস) বোকোহারামসহ বিভিন্ন উগ্র সন্ত্রাসী তাকফিরি ওয়াহহাবি সালাফি গোষ্ঠীগুলো এই অশুভ কুফরি ইবলিসি ইঙ্গ-মার্কিন-ইসরাইলি-সৌদি-আমিরাতি চক্রের অবৈধ সন্তান স্বরূপ। এই অশুভ খবিস ইবলিসি চক্র এসব গোষ্ঠীর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসবাদ সহিংসতা ধর্মীয় বিদ্বেষ ও উগ্রবাদের বিষ-বাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছে।
আজ মুসলিম বিশ্ব এই অশুভ খবিস ইবলিসি কুফরি চক্রের মদদপুষ্ট উগ্র জঙ্গি সন্ত্রাসী তাকফিরি ওয়াহহাবী সালাফি গোষ্ঠী ও গ্রুপগুলোর সন্ত্রাসী কর্মতৎপরতার কারণে ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত এবং আজ বহু মুসলিম দেশ ও রাষ্ট্র ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এ হচ্ছে মুসলিম বিশ্বকে ভেতর থেকে ধ্বংস করে দেয়ার এক মহা-ইবলিসি ষড়যন্ত্র। তাই সমগ্র ইসলামী উম্মাহর উচিৎ এই অশুভ খবিস কুফরি ইঙ্গ-মার্কিন-ইসরাইলি-সৌদি-আমিরাতি চক্রের অশুভ চক্রান্ত সম্পর্কে সঠিকভাবে অবগত হওয়া।]
এ যুদ্ধ চলতে থাকতে সেখানে ইরানি প্রভাব বাড়তে থাকবে বলে যুদ্ধ বন্ধ করার পরামর্শ দিয়ে তারা বলেছেন, অনুকূল শর্ত ও অবস্থা-সাপেক্ষে দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসনের সুযোগ এখনও রয়েছে। তাই আরও বেশি বিপর্যয়ের আগেই যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ এ যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিয়ে সৌদি সরকারকে সাহায্য করা।
গত ২৬ মার্চ সংবাদ মাধ্যম 'দ্যা ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট'-এ এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ওই দুই বিশেষজ্ঞের এইসব কথা।
ডঃ ইয়োএল গুজানস্কি ও আরি হাইস্টাইন-এর লেখা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিন বছরের ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি সরকারের খরচ হয়েছে দশ হাজার কোটি ডলার। এ যুদ্ধ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সৌদিদের সুনাম নষ্ট করেছে এবং ইয়েমেনে ইরানের প্রভাব বিলুপ্ত করার লক্ষ্য অর্জনেও ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে মার্কিন মদদপুষ্ট এ যুদ্ধে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে ইয়েমেনের অবকাঠামো । পুরো দেশটিতে দেখা দিয়েছে দুর্ভিক্ষ ও প্রাণঘাতী নানা রোগের প্রাদুর্ভাব।
ওয়াশিংটনে সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের সাম্প্রতিক সফর এ ধ্বংসাত্মক যুদ্ধাবসানে মার্কিন সরকারের জন্য একটা ভালো সুযোগ বয়ে এনেছে বলে তারা মন্তব্য করেন।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: সৌদি আরবের জন্য ইয়েমেন প্রভাব বিস্তারের এক ঐতিহাসিক টার্গেট এবং জাতীয় নিরাপত্তা ও শান্তির জন্যও এক জটিল ক্ষেত্র। কারণ এ দেশটির সাথে সৌদি আরবের যেমন এক দীর্ঘ ও অদুর্ভেদ্য সীমান্ত রয়েছে ঠিক তেমনি লোহিত সাগরে প্রবেশ পথও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ইয়েমেন। আর ইরানের ক্ষেত্রে ইরাক ও সিরিয়ার সাথে তুলনা করলে ইয়েমেন হচ্ছে দ্বিতীয় পর্যায়ের গুরুত্ববহ দেশ। কিন্তু হুথি মিলিশিয়াদের উপর তুলনামূলক সামান্য অল্প বিনিয়োগ করেই ইরান তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরবের কাছ থেকে এক গুরুত্বপূর্ণ সামরিক,রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করতে পেরেছে।
ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে: হুথিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সামরিক গোয়েন্দা তথ্য এবং লজিস্টিক সাপোর্ট লাভ করছে সৌদি আরব। তাছাড়া এ দেশটির নিরাপত্তা বাজেট হচ্ছে বিশ্বে চতুর্থ বৃহত্তম এবং এর হাতে রয়েছে আধুনিক অস্ত্রভাণ্ডার। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ দেশটির কাছে এর দোরগোড়ায় বিদ্যমান ও উপস্থিত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শত্রুকে পরাজিত করাটা কঠিন ও দুরূহ বলেই মনে হচ্ছে।
ইয়েমেনের রাজধানী সানা ও দেশের আরও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দখলে রাখা ছাড়াও হুথিরা সৌদি আরবে একশ'রও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। এসব ক্ষেপণাস্ত্র ইরানের তৈরি বলে অভিযোগ রয়েছে। হুথিরা ১০০ বর্গ মাইলেরও বেশি সৌদি ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছে।
ওই দুই ইসরাইলি বিশেষজ্ঞ আরও লিখেছেন: সামরিক-নিরাপত্তা বিষয়ক (পূঁজি) বিনিয়োগ এবং যুদ্ধে সামরিক বাহিনীর দক্ষতা ও সাফল্যের মধ্যকার ব্যবধানের কারণে সৌদি বাদশাহ সালমান এবং তাঁর উত্তরাধিকারী যুবরাজ বিন সালমান সৌদি সশস্ত্র বাহিনীর স্টাফ-প্রধান, স্থলবাহিনী প্রধান এবং বিমান প্রতিরক্ষা প্রধানসহ বহু ঊর্ধ্বতন সামরিক ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করতে বাধ্য হয়েছেন।
এসব রদবদলকে সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ার অংশ বলে দেখানো হলেও আসলে তা সৌদি সামরিক বাহিনীর দক্ষতা ও পারদর্শিতা সংক্রান্ত সৌদি অভিজাত শ্রেণীর ক্রমবর্ধমান হতাশাকেই প্রতিফলিত করছে। এ সব পদ পরিবর্তন ও রদবদল কি সৌদি সামরিক কৌশলে জরুরি পরিবর্তন আনবে? যদি পরিবর্তন আসেও তাহলে চলমান যুদ্ধের উপর তার সম্ভাব্য প্রভাব ও ফলাফল দেখার জন্য আরও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে ।
বিশ্লেষণধর্মী এ রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে: তুলনামূলক সাফল্য অর্জন সত্ত্বেও ইয়েমেনে তার কর্মতৎপরতা চালানোর ক্ষেত্রে ইরানও অসুবিধা ও বাধার মুখোমুখি হচ্ছে। পাশ্চাত্যের সহায়তায় আরব দেশগুলোর আরোপিত সামুদ্রিক অবরোধ ইয়েমেনে ঘটনাবলী নিয়ন্ত্রণ করা সংক্রান্ত ইরানের শক্তি ও সামর্থ্যকে সীমিত করছে। তেহরানের পক্ষে সামুদ্রিক অবরোধ ভাঙ্গা সম্ভব নয় বল হুথিদের কাছে চোরাপথে স্বল্পসংখ্যক সামরিক উপদেষ্টা ও বিশেষজ্ঞ, টাকা-পয়সা এবং ক্ষেপণাস্ত্রের যন্ত্রাংশসহ বিভিন্ন ধরণের অস্ত্র পাঠানো ছাড়া আর কোন বিকল্প পথ নেই ইরানের।
ডঃ ইয়োএল গুজানস্কি ও আরি হাইস্টাইন নামের ওই দুই বিশেষজ্ঞ আরও লিখেছেন: একই সময় ইয়েমেন যুদ্ধ প্রধান মুসলিম মিত্রদের সাথে সৌদি আরবের নাজুক সম্পর্কের ধরণও প্রকাশ করেছে। এ দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র-দেশ পাকিস্তান সৌদি আরবকে যুদ্ধে সহায়তা দানের জন্য সৈন্য পাঠানোর বিষয়টি আশ্চর্যজনকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। মিশরের সিসি সরকারও যে এ যুদ্ধে যোগ দিতে বিশাল স্থলবাহিনী পাঠায়নি তা সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে। বরং কায়রো রিয়াদকে সাহায্য করার জন্য মাত্র কয়েক শো সৈন্য ও তিন চারটি ছোট যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়েছে। অথচ সৌদি আরব এই দেশটিতে বহু বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে এবং এ দেশটি সৌদি আরবের জন্য কৌশলগত গভীরতার(strategic depth) মূল্য রাখে।
আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনকি যে সব দেশ সৌদি নেতৃত্বাধীন যুদ্ধে যোগদান করতে রাজি হয়েছিল যুদ্ধ চলাকালে রিয়াদের সাথে তাদেরও স্বার্থ-সংঘাত তৈরি হয়েছে। যেমন: সৌদি ও আরব আমিরাত এমন সব গোষ্ঠী ও বাহিনীকে মদদ দিচ্ছে যারা ইয়েমেনের ভবিষ্যতের ব্যাপারে পরস্পর বিরোধী এবং তা সময় সময় সৌদি ও আমিরাতের স্থানীয় সমর্থকদের মধ্য সংঘর্ষ ও সহিংসতা সৃষ্টি করেছে।
ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে: সৌদি যুবরাজ বিন সালমানের সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং ওয়াশিংটনে সৌদি রাজকীয় সফরকে এ ধ্বংসাত্মক ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী যুদ্ধ বন্ধ করার এক সুযোগ বলে বিবেচনা করত ওয়াশিংটনের উপলব্ধি করা ও ভেবে দেখা উচিৎ: সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট এ যুদ্ধে বিজয়ী হতে পারবে না ।তবে তারা (সৌদি জোট) এ যুদ্ধটাকে অনুকূল শর্ত ও অবস্থা সাপেক্ষে বন্ধ করতে পারে। আর ওয়াশিংটনের উচিৎ এ জোটকে তা করতে সাহায্য করা।
এক সীমিত সময়ের জন্য সৌদি আরবের যুদ্ধে ওয়াশিংটনের বর্ধিত সমর্থনের বিনিময়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উচিৎ এ দাবি করা যে সৌদিরা বেসামরিক প্রাণহানি বন্ধ করার জন্য আরও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেবে এবং যে সব ইয়েমেনি রোগ ও খাদ্যাভাবের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তাদের ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ বাড়িয়ে দেবে।
ডঃ ইয়োএল গুজানস্কি ও আরি হাইস্টাইন আরও লিখেছেন: মার্কিন সহায়তা ও সাপোর্ট তুলে নেয়া হবে- এটা জানানো হলে সৌদিরা যথাসম্ভব শিগগিরই এক রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছতে উদ্বুদ্ধ হবে। আবার একই সময় হুথিদের উপর আঘাত হানা এবং মার্কিন সমর্থন ও সাপোর্ট যে গতিময়তার সৃষ্টি করবে তা ইরান-সমর্থিত হুথিদেরকেও এ যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য করবে। অবশ্য সৌদির প্রতি মার্কিন সমর্থনের সময়সীমা গোপন রাখতে হবে। আর উভয় পক্ষকে যদি যুদ্ধ বন্ধ করতে উদ্বুদ্ধ ও বাধ্য করা হয় তাহলে এক ধরণের রাজনৈতিক আপোষ ও নিষ্পত্তিতে উপনীত হওয়া সম্ভবপর বলে মনে হয়।
ইয়েমেন যুদ্ধ সব পক্ষের জন্যই বিপর্যয় বয়ে এনেছে। আর তাই এ যুদ্ধ বন্ধ করাই হচ্ছে যেমন একদিকে মার্জিত ও চৌকস (smart)বিষয় ঠিক তেমনি অপরপক্ষে এটা হচ্ছে ন্যায় ও যথার্থ বিষয় যা অবশ্যই করা উচিৎ। আর সংঘর্ষ ও নিরাপত্তাহীনতার শিকার অঞ্চলগুলোতে ইরানের হস্তক্ষেপ সবচেয়ে বেশী সফল হচ্ছে বলে যুদ্ধ বন্ধ করার মধ্যেই রয়েছে আঞ্চলিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে ইরানের হস্তক্ষেপ-ক্ষমতা কার্যকরভাবে দুর্বল করার বর্ধিত সুবিধা।
উল্লেখ্য, ডঃ ইয়োএল গুজানস্কি ইসরাইলের Institute for National security studies (INSS)-এর রিসার্চ ফেলো। তিনি পারস্য উপসাগরীয় রাজনীতি-বিশেষজ্ঞ এবং আরি হাইস্টাইন INSS-এর পরিচালকের বিশেষ সহকারী।
[এ প্রতিবেদনে ইয়েমেন - সৌদি আরব যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাশ্চাত্য এবং ইসরাইলের মদদপুষ্ট সৌদি-নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন জোটের পরাজয়,ব্যর্থতা ও শোচনীয় অবস্থার এক সার্বিক চিত্র বেশ ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। লেখকদ্বয় ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক স্ট্যাডিস ইন্সটিটিউটের কর্মকর্তা ও রিসার্চ ফেলো। তাই ইরানকে ইয়েমেনসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে হস্তক্ষেপ করার দোষে দায়ী করা তাদের জন্য খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এটা হচ্ছে সত্যের অপলাপ মাত্র। আসলে ইঙ্গ-মার্কিন-ইসরাইলি-সৌদি-আমিরাতি চক্রই আফগানিস্তান-পাকিস্তান-ইরাক-সিরিয়া-ইয়েমেন-মিসর-তিউনিসিয়া-নাইজেরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অযাচিত হস্তক্ষেপ করছে যা কারো অজানা নয়।
আল-কায়দা,তালিবান, দায়েশ (আইসিস) বোকোহারামসহ বিভিন্ন উগ্র সন্ত্রাসী তাকফিরি ওয়াহহাবি সালাফি গোষ্ঠীগুলো এই অশুভ কুফরি ইবলিসি ইঙ্গ-মার্কিন-ইসরাইলি-সৌদি-আমিরাতি চক্রের অবৈধ সন্তান স্বরূপ। এই অশুভ খবিস ইবলিসি চক্র এসব গোষ্ঠীর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসবাদ সহিংসতা ধর্মীয় বিদ্বেষ ও উগ্রবাদের বিষ-বাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছে।
আজ মুসলিম বিশ্ব এই অশুভ খবিস ইবলিসি কুফরি চক্রের মদদপুষ্ট উগ্র জঙ্গি সন্ত্রাসী তাকফিরি ওয়াহহাবী সালাফি গোষ্ঠী ও গ্রুপগুলোর সন্ত্রাসী কর্মতৎপরতার কারণে ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত এবং আজ বহু মুসলিম দেশ ও রাষ্ট্র ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এ হচ্ছে মুসলিম বিশ্বকে ভেতর থেকে ধ্বংস করে দেয়ার এক মহা-ইবলিসি ষড়যন্ত্র। তাই সমগ্র ইসলামী উম্মাহর উচিৎ এই অশুভ খবিস কুফরি ইঙ্গ-মার্কিন-ইসরাইলি-সৌদি-আমিরাতি চক্রের অশুভ চক্রান্ত সম্পর্কে সঠিকভাবে অবগত হওয়া।]
No comments