মিতব্যয়িতা কৃপণতা নয় by ইকতেদার আহমেদ
মিতব্যয়িতা
ও মিতব্যয় উভয়ই বিশেষ্য। মিতব্যয়িতা অর্থ, প্রয়োজন মতো অথবা হিসাব করে
ব্যয় করা। আবার পরিমিত ব্যয় কিংবা আয় বুঝে ব্যয় করার স্বভাবও মিতব্যয়িতা।
মিতব্যয়িতার বিপরীত শব্দ অমিতব্যয়িতা। একজন ব্যক্তি অপব্যয়ের মাধ্যমে যখন
অর্থ ব্যয় করে, তখন তাকে অমিতব্যয়ী বলা হয়। অপর দিকে অতিমিতব্যয়িতা কৃপণতা
বা কার্পণ্যের সমার্থক। কৃপণ ব্যক্তি সব সময় প্রয়োজন মতো অর্থ ব্যয় থেকে
নিজেকে দূরে রাখে। মিতব্যয়িতা একটি গুণ। মিতব্যয়ী ব্যক্তিকে সবাই পছন্দ
করে। তিনি দেশ ও সমাজের জন্য ভালো ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত। জীবনে চলার পথে
মিতব্যয়ী ব্যক্তিকে খুব কমই অর্থসঙ্কটের মুখাপেক্ষী হতে হয়। তার ব্যক্তি ও
সংসার জীবন সচরাচর সুখময় হয়ে থাকে। অমিতব্যয়ী ব্যক্তি অর্থসঙ্কটে পড়লে
অনেকটা দিশেহারা হয়ে যায়। এ সময় তাকে মূল্যবান সহায়সম্পদ বিক্রি করতে
কোনোরূপ দ্বিধান্বিত হতে দেখা যায় না। অমিতব্যয়ী ব্যক্তির অপরিণামদর্শিতার
কারণে জীবনের সূচনালগ্নে সচ্ছল ছিলেন, এরূপ ব্যক্তিকে মাঝ বয়সে বা
বার্ধক্যে উপনীত হলে অর্থ সঙ্কটের কারণে দুঃখ-দুর্দশার মধ্য দিয়ে শেষ জীবন
অতিবাহিত করতে দেখা যায়। অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে মানুষের মধ্যে তিন ধরনের
প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। এর একটি হলো মিতব্যয়িতা এবং অপর দু’টি
অপব্যয়িতা ও কৃপণতা। ইসলাম ধর্মে অপব্যয় ও কৃপণতাকে নিরুৎসাহিত করে
মিতব্যয়কে উৎসাহিত করা হয়েছে। ইসলাম ধর্ম মতে, মিতব্যয়িতা একটি উত্তম কাজ
এবং মিতব্যয়ী ব্যক্তিদের বলা হয় ‘মধ্যমপন্থী’। ইসলামের শিক্ষা হলো, কৃপণতা ও
অপব্যয় নিন্দনীয় কাজ। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে এমন অনেক সচ্ছল ব্যক্তি দেখা
যায় মিতব্যয়িতার কারণে অনেকে যাদের কৃপণ হিসেবে আখ্যা দেয়ার প্রয়াস পান।
দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের ত্রিশোর্ধ্ব বয়স নয়, এমন একজন ধনাঢ্য ব্যক্তির
নাম অ্যাডাম খো। তাকে ব্যবসায়িক কাজে প্রায়ই বিমানযোগে বিভিন্ন দেশে
যাতায়াত করতে হয়। তার মতো ব্যক্তির আর্থিক অবস্থান, সঙ্গতি ও সামাজিক
মর্যাদাকে বিবেচনায় নেয়া হলে এরূপ ব্যক্তির বিমানের বিজনেস ক্লাশে ভ্রমণ
করার কথা; কিন্তু তিনি বিমানে ভ্রমণকালে সব সময় ইকোনমি ক্লাসের যাত্রী
হিসেবে যাতায়াত করেন। এত ধনী হওয়া সত্ত্বেও ইকোনমি ক্লাসে যাত্রার কারণে
তাকে যখন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, প্রতিবারই তার উত্তর- ‘ইকোনমি ক্লাসে
ভ্রমণের কারণেই আমি এখনো এ বয়সে সিঙ্গাপুরের বিশিষ্ট ধনীদের অন্যতম।’
অ্যাডাম খো প্রায়ই তার বন্ধুমহলে আলাপচারিতায় বলেন- ‘বিলাসিতার কোনো শেষ
নেই। বিলাসিতা কখনো একজন ব্যক্তির তৃপ্তি শেষ করতে পারে না। যেমন আপনি একটি
দামি ব্র্যান্ডের শার্ট কিনলেন, কেনা ও পরা অবধি আপনার আনন্দ।
এরপর কিন্তু
আপনার অপর একটি ব্র্যান্ডের দামি শার্ট পছন্দ হবে, আপনি সেটিও কিনলেন এবং
পরলেন, তারপর আরেকটা- তারপর আরেকটা- এটা আসলে কখনো নিঃশেষিত হয় না এমন একটি
প্রবণতা।’ সুখ সব সময় তৃপ্তির মধ্যে নিহিত। বিলাসিতার আসলে কোনো শেষ নেই।
কোনো বিলাসিতাই অতৃপ্ত ব্যক্তির তৃপ্তি শেষ করতে পারে না। অপর দিকে, একজন
মিতব্যয়ী ব্যক্তি অল্পতেই তুষ্ট। আর এ তুষ্টির মধ্যেই তার জীবনের
অন্তর্নিহিত সুখের গূঢ় রহস্য। অ্যাডাম খো তৃপ্তি বা সুখকে যে আঙ্গিকে
দেখেন, তা বিবেচনায় নেয়া হলে তার আর্থিক সঙ্গতি সত্ত্বেও বিমানের ইকোনমি
ক্লাসের ভ্রমণকে কৃপণতারূপে আখ্যা দেয়ার যুক্তি নেই। ঢাকায় বসবাসরত
চল্লিশোর্ধ্ব বয়সের এক ব্যক্তি কলকাতার উপকণ্ঠে তার দূরসম্পর্কীয় এক
আত্মীয়ের বাড়িতে গেলে দীর্ঘ আলাপচারিতার পর গৃহস্বামী তাকে কলকাতায় কয় দিন
থাকবেন এ কথা জিজ্ঞেস করে বলেন, ‘আজ ঘরে তোমার কাকী মা নেই, তাই তোমাকে চা
দিতে পারলাম না। আরেক দিন এসে চা খেয়ে যেও।’ ঢাকা থেকে আগত ব্যক্তি পরদিনই
দেশে ফিরবেন- এ কথা জানালে ষাটোর্ধ্ব সেই গৃহকর্তা বললেন, তোমার কাকী মা
চিনি যে কোথায় রেখে গেছে তাতো আমি জানি না। তা না হলে আমি নিজেই তোমাকে চা
বানিয়ে খাওয়াতে পারতাম। ঢাকার ব্যক্তিটি যখন বললেন, তিনি ডায়াবেটিসের রোগী,
চিনি ছাড়া চা খান, তখন কলকাতার ভদ্রলোক বললেন, ঘরে চা পাতাও নেই। আর দোকান
থেকে চা পাতা আনতে গেলে যে সময় লাগবে সে সময় পর্যন্ত তো তুমি থাকবে না। আর
তাই পরের বার কলকাতায় এলে চা না খেয়ে কিন্তু যেতে পারবে না।’ আমাদের ঢাকার
ভদ্রলোক রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে, অভিমানে মনে মনে বিড়বিড় করে বলতে থাকলেন-
প্রায় দু’ঘণ্টা সময় ব্যয় করে এক শ’ রুপির কাছাকাছি অর্থ ব্যয় করে কাকার
সঙ্গে দেখা করতে আসা। আবার এখান থেকে ফিরতেও সমপরিমাণ রুপি ও সময় ব্যয় হবে।
তাই কাকা তোমাকে নমস্কার। আর কখনো আমাকে যেন এরূপ অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে
পড়তে না হয়। ঢাকার ভদ্রলোক কলকাতায় বসবাসরত তার কাকার কাছ থেকে চা পানের
নামে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন এটি কৃপণতার জ্বলন্ত উদাহরণ। একটি দেশ ও
সমাজে এরূপ কৃপণ ব্যক্তির যত বেশি আধিক্য পরিলক্ষিত হবে, সে দেশ ও সমাজ তত
বেশি আন্তরিকতাবিহীন মনে করা যায়। বিগত শতকের ৫০ দশকের আগে সৌদি আরব ধনী
দেশ ছিল না। সে সময় সৌদি আরব থেকে সেখানকার দরিদ্র জনমানুষ জীবিকার তাগিদে
অর্থ উপার্জনের জন্য বিভিন্ন মুসলিম দেশে পাড়ি দিত। আমাদের এ দেশ তখন
প্রথমত ব্রিটিশ এবং অতঃপর পাকিস্তানের শাসনাধীন ছিল। এ দেশের সাধারণ
জনমানুষ বিশেষত গ্রামাঞ্চলের মানুষ সুদূর অতীত থেকে ধর্মপরায়ণ। সৌদি
নাগরিকেরা নবীজীর দেশের মানুষ হওয়ায় এবং মুসলমানদের পুণ্যভূমি মক্কা ও
মদিনার ছোঁয়ায় বেড়ে ওঠায় এ দেশের মানুষজন নিজেদের আর্থিক সীমাবদ্ধতা
সত্ত্বেও পরম স্নেহমমতায় তাদের আপ্যায়িত করতেন এবং বিদায়কালে তাদের হাতে
কিছু অর্থ গুঁজে দিয়ে তাদের যাতায়াত ও জীবনযাপন এবং পুণ্যভূমির মসজিদের
জন্য ব্যয়ের অভিলাষ ব্যক্ত করতেন। এ দেশের জনমানুষের ধর্মবিশ্বাসের কারণে
প্রদত্ত অর্থের বেশির ভাগই যে তারা তাদের জীবনযাপনের পেছনে ব্যয় করতেন, এ
কথাটি সে সময় আমাদের গ্রামের সাধারণ জনমানুষের উপলব্ধিতে না এলেও সময়ের
পরিক্রমায় তা এখন এ দেশের মানুষ বুঝতে শিখেছে। অবশ্য, এখন আর তেলের বদৌলতে
আর্থিক অবস্থার চরম উন্নতির কারণে তাদের আর আগের মতো উপলক্ষ নিয়ে আমাদের
দেশে আসার আবশ্যকতা দেখা দেয় না। বরং আমাদের দেশ থেকে জীবিকার সন্ধানে
হতদরিদ্র মানুষজন ভাগ্যোন্নয়নের আশায় সে দেশে পাড়ি জমায়। সে দেশের মানুষের
জীবনযাপন বর্তমানে বিলাসিতায় পরিপূর্ণ। তারা নিত্য আহারের পর যা উচ্ছিষ্ট
থাকে তা দিয়ে পৃথিবীর লাখো দুর্ভিক্ষ পীড়িতের দু’বেলা অন্নের সংস্থান
সম্ভব; কিন্তু তাদের অনেকেই আজ এই বোধশক্তিবিহীন। সহজলভ্য অর্থের আতিশয্যে
তারা মিতব্যয়িতা ও অমিতব্যয়িতার ফারাক বুঝতে অক্ষম। মানুষের জীবন-জীবিকার
জন্য অর্থ অপরিহার্য। মানুষ ভবিষ্যতে সুখে ও নির্বিঘ্নে জীবনযাপনের জন্য
কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ সঞ্চয় করে। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা
বিশ্বাস করেন, বৈধ ও হালাল পন্থায় যারা অর্থ উপার্জন করে আল্লাহ তায়ালার
কাছে তাদের ইবাদত কবুল হয়। কুরআন ও হাদিসে অপব্যয় ও কার্পণ্য পরিহার করে
মিতব্যয়ী হওয়ার জন্য মুমিনদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। পবিত্র কুরআন
মজিদে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন- ‘আর তোমরা খাবে ও পান করবে, কিন্তু অপচয় করবে
না; নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ অপরাপর প্রধান ধর্মমতেও
মিতব্যয়িতাকে প্রাধান্য দিয়ে অমিতব্যয়িতা ও কার্পণ্যকে বর্জনের কথা বলা
হয়েছে। আর তাই ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে অর্থ ও সম্পদের অপচয় না করে প্রত্যেক
মানুষের মিতব্যয়ী হওয়া কর্তব্য। অন্যান্য দিবসের মতো সমগ্র বিশ্বে
আন্তর্জাতিকভাবে মিতব্যয়িতা দিবসও পালিত হয় প্রতি বছর। এ দিবসটি পালনের
উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির কল্যাণে মিতব্যয়ী হওয়ার
বিষয়ে আত্মসচেতনতা সৃষ্টি করা। ১৯২৪ সালে ইতালির মিলানে বিশ্বের বিভিন্ন
আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের প্রথম বিশ্ব কংগ্রেসে গৃহীত সিদ্ধান্ত
অনুযায়ী, দিবসটি পালন শুরু হয়। সেই থেকে বিভিন্ন দেশের আর্থিক
প্রতিষ্ঠানগুলো দিবসটি পালন করে আসছে। আমাদের দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ
জাতীয় সঞ্চয় পরিদফতর প্রতি বছর এ দিবসটি আড়ম্বরে সাথে পালন করে থাকে। অপচয়
পরিহারপূর্বক মিতব্যয় হওয়ার অর্থ, কৃপণতা নয়। ইসলাম ধর্মে মিতব্যয়কে
গুরুত্ব দিয়ে উৎসাহিত করা হলেও কৃপণতাকে তিরস্কার করা হয়েছে। এ বিষয়ে সূরা
বনি ইসরাইলে আল্লাহ পাক বলেন- ‘তুমি বদ্ধমুষ্টি হওয়া থেকে বিরত থাকো এবং
একেবারে মুক্তহস্তও হয়ে যেয়ো না; যদি তা হও, তবে তুমি তিরস্কৃত ও অনুতপ্ত
(নিঃস্ব) হয়ে পড়বে।’ মিতব্যয়িতা একজন মানুষকে সফলতা এনে দেয়। রাসূল সা: তার
সাহাবিদের মিতব্যয়িতার অভ্যাস তৈরি করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এ বিষয়ে রাসূল
সা: এরশাদ করেন- ‘যে ব্যক্তি মিতব্যয়িতা অবলম্বন করে, আল্লাহতায়ালা তাকে
ধনী বানিয়ে দেবেন, আর যে ব্যক্তি মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় করবে, আল্লাহ তাকে
গরিব বানিয়ে দেবেন।’ অমিতব্যয়িতার স্বভাব একবার গড়ে উঠলে তা থেকে বেরিয়ে
আসা সহজ নয়। অমিতব্যয়িতা পাপের কাজ ও মিতব্যয়ের পরিপন্থী। মিতব্যয়িতা
মানুষকে অন্যায় পথে যাওয়া থেকে বিরত করে। অপর দিকে অমিতব্যয়িতা মানুষকে
অন্যায় পথে চলতে ও অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনে উৎসাহ জোগায়। পরিবারের ভরণপোষণের
জন্য যে পরিমাণ ব্যয় প্রয়োজন, সে পরিমাণ ব্যয় করে অবশিষ্টাংশ সঞ্চয় করাই
মিতব্যয়িতা। অনেকে এটা কৃপণতার সাথে তুলনা করে থাকেন। অথচ কৃপণতা হলো
প্রয়োজনের সময়েও খরচ না করা। অপর দিকে মিতব্যয়িতা হলো প্রয়োজন যতটুকু,
ততটুকু ব্যয় করা।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com
No comments