এজেন্টদের শাস্তি হওয়া ভালো দৃষ্টান্ত by প্রতীক বর্ধন

দেশের আর্থিক খাতে বড় বড় দুর্নীতির খবর বেরোনোর পরও যখন কোনো কূলকিনারা হচ্ছে না, তখন আমরা দেখলাম, মোবাইল আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশের সাতজন এজেন্টকে অবৈধভাবে প্রবাসী আয়ের অর্থ লেনদেনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। খবরটি নিঃসন্দেহে ভালো। অন্তত এই অর্থে যে দেশে আর্থিক খাতে নিয়মবহির্ভূত কাজ করে পার পাওয়া যায় না। আবার গ্রেপ্তারই সব নয়, শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু ছোট মাছ ধরার সন্তুষ্টিতে আমরা যেন রাঘব বোয়ালদের কথা ভুলে না যাই। তবে অভিযোগ ওঠার পর বিকাশ এ ব্যাপারে রাখঢাক না করে অভ্যন্তরীণ তদন্তের মাধ্যমে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তুলে দিয়েছে।  প্রতি মাসেই তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মনিটরিং  প্রতিবেদন দিয়ে থাকে। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই এই এজেন্টদের গ্রেপ্তার করা হলো। একই সঙ্গে তারা পত্রিকা ও টেলিভিশনে ক্রমাগত এ নিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে যাচ্ছে। প্রবাসীদের অবৈধ পথে প্রবাসী আয় না পাঠিয়ে বৈধ পথে তা পাঠাতে উৎসাহিত করছে তারা। তবে এটাকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার চেষ্টা তাকে করে যেতে হবে। যা হোক, মূল বিষয় হলো আর্থিক খাতের সুশাসন। দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এই ঋণ আদায়ে এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকারের তেমন তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশের মানুষ মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম এবং কানাডায় বেগমপাড়া বানাচ্ছেন। কিন্তু কারা সেটা করছেন, তাঁদের নাম আমরা জানি না। যে বেসিক ব্যাংকের কেলেঙ্কারি নিয়ে এত কথা, সেই ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে এই সেদিন জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে দুদক। অন্যদিকে ফারমার্স ব্যাংক তো একের পর এক অনিয়মের ভারে ডুবতে বসেছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, ব্যাংকটির আমানতকারীরা টাকা ফেরত না পাওয়ার আশঙ্কায় আছেন। তাঁরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছেন। অন্যদিকে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) বয়স প্রায় সাত বছর হয়ে এল। ইতিমধ্যে খাতটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। দেশে মূলধারার এতগুলো ব্যাংক যেখানে গ্রামে বা সাধারণ মানুষের কাছে যেতে পারেনি, সেখানে অবকাঠামোগত কারণেই এমএফএস অনেক দূর চলে গেছে।
তাদের গ্রাহকের সংখ্যা ছয় কোটির কাছাকাছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে গত নভেম্বর মাসে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসে দৈনিক লেনদেন হয়েছে গড়ে ৯১৯ কোটি ১১ লাখ টাকা। একদিকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, অন্যদিকে ডিজিটাল অর্থনীতি—এ দুটি ক্ষেত্রে এমএফএস আমাদের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। ২০১১ সাল থেকে এমএফএস একটি নীতিমালার ভিত্তিতে চলছে, যা এখন প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পর্যায়ে আছে। তারপর এটি কি কোনো ব্যাংকের শাখা হিসেবে থাকবে, নাকি স্বতন্ত্র কোম্পানি হবে তার ফয়সালা হয়নি। যদিও দেশে এখন এই দুই ধরনের মডেলের অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে এমএফএসের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর খরচ নিয়ে অনেকের আপত্তি আছে। বর্তমানে এমএফএসে ১০০ টাকা পাঠাতে ১ দশমিক ৮৫ শতাংশ খরচ হচ্ছে। কিন্তু মোবাইল কোম্পানিগুলো তাদের নেটওয়ার্ক ব্যবহারের ভাড়া বা ইউএসএসডি খরচ বাবদ বিভিন্ন সময়ে যেসব প্রস্তাব পাঠিয়েছে, তার অর্ধেকও যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে এমএফএসের লেনদেনের খরচ কমবে তো না-ই, বরং তা আরও বেড়ে যাবে। এতে খাতটির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। খরচ বেড়ে গেলে সাধারণ মানুষও এই মাধ্যমে লেনদেন করতে আগ্রহী হবে না। অথচ অনেক প্রযুক্তিবিদই মনে করেন, সামান্য একটি নির্ধারিত মূল্যে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো এই সেবা দিতে পারে। কারণ, এতে তাদের বিশেষ খরচ হয় না। প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এই খরচ আরও কমে আসবে। ইউএসএসডির খরচ নির্ধারণ নিয়ে এ পর্যন্ত বেশ কটি কমিটি গঠিত হলেও একটির সঙ্গে আরেকটির সামঞ্জস্য দেখা যায় না। প্রথমত, ২০১১ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে একটি কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সিগ্যাপকে এই খরচ নির্ধারণের লক্ষ্যে সমীক্ষার দায়িত্ব দিলেও মোবাইল ফোন সেবাদাতাদের বিরোধিতার কারণে তার পক্ষে কাজ করা সম্ভব হয়নি বলে জানা যায়। এরপর টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি গঠিত হয়। তারাও সিদ্ধান্ত নেয়, একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমীক্ষা করানো হবে। সেই কমিটিও এখন পর্যন্ত স্বাধীন প্রতিষ্ঠানকে সমীক্ষার দায়িত্ব দিতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। তাঁরা বলছেন, এমএফএস খাতটি যেন গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। ফলে তাঁরা এখন খেই হারিয়ে ফেলছেন। কয়েক মাস আগে ভারতীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বাংলাদেশ সফরের সময় বলেছেন, নগদ লেনদেনে দুর্নীতির সুযোগ বেশি থাকে এবং অপচয় হয়। ফলে উন্নত দেশগুলোর মতো ভারতেও ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থার ব্যাপক প্রসার ঘটছে। আমাদের দেশেও সীমিত পরিসরে এটি চালু হয়েছে। অর্থনীতিকে আরও দক্ষ করতে এর বিকল্প নেই। ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেন হলে যেহেতু হিসাব রাখা সহজ, সেহেতু এখানে আরও বেশি নজরদারি করা সম্ভব। অবৈধভাবে আসা হুন্ডির গন্তব্যও সে কারণে দ্রুত শনাক্ত করা গেছে। আর কারা সেটা করেছে, তা-ও বের করা গেছে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে প্রবাসীদের ঝামেলাহীনভাবে প্রবাসী আয় পাঠানোর ওপর জোর দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বৈধভাবে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া যায়। এ প্রসঙ্গেই শেষ কথায় আসি, গত বছর প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার অভিযোগে এমএফএসের লেনদেনের সীমা কমিয়ে দেওয়ার কারণে এই খাতের প্রবৃদ্ধির হার কমে গেছে। তাই এই খাত নিয়ে সুদূরপ্রসারী ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা এটা যত তাড়াতাড়ি বুঝব, ততই আমাদের মঙ্গল।
প্রতীক বর্ধন: সাংবাদিক ও অনুবাদক।
bardhanprotik@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.