উন্নয়নের মানে কি করাতকল? by ফারুক ওয়াসিফ
কন্যার
নানির একদিন ইচ্ছা হলো, বাড়ির সামনের ছোট চত্বরটার উন্নয়ন করবেন। তো হুকুম
হলো, বুড়ো ডুমুরগাছটা কাটো। সবুজ ও খয়েরি মার্বেলের মতো ডুমুরে উঠানটা ভরে
থাকে, পরিষ্কার করায় ঝামেলা। মেয়ের মা মৃদু আপত্তি করায় ধমক খেয়ে ফিরে
এসেছেন, মায়ের ছোট ভাই যে মামা, সে-ও গাছটার পক্ষে ওকালতি করে ধরা।
উজানিয়ার নানি জাঁদরেল মহিলা; তাঁর সঙ্গে তর্ক করা আর পাথরে মাথা ঠোকা
সমান। কিন্তু পাঁচ বছরের মেয়েটি অতশত বোঝে না। ডুমুরগাছটা ওর প্রিয়।
বেঁটেখাটো গাছটায় ওঠানামা তার প্রিয় খেলা। গাছ কাটার খবর শুনে সে সোজা
নানির সামনে হাজির।
তো সে গিয়ে নানিকে বলে, ‘আনু, তুমি নাকি ডুমুরগাছ কাটতে বলছ?’
নানির টিভির দিকে মনোযোগ। সেদিকে তাকিয়েই বললেন, ‘হ, কাটা লাগবে।’
: কেন কাটা লাগবে?
: বুড়া হয়ে গেইছে, কাইটে ফেলতে হবে। নাতনি ঝামটি দিয়ে উত্তর দেয়, ‘তুমিও তো বুড়া হয়ে গেছ, তোমারেও কি কাটা লাগবে?’ কথা শুনে নানি লাজওয়াব। ডুমুরগাছটা সে যাত্রায় রক্ষা পেল। বয়স হয়ে গেলেই অথবা অবলা প্রাণ হলেই তাকে কাটা যায় না; এটা শিশুরাই বোঝে শুধু। কারণ তাদের স্বার্থবোধ কম।
দুই. যশোর রোডের উন্নয়ন হবে। দুই লেন থেকে চার লেন হবে। এ জন্য সিদ্ধান্ত হয়েছে দুপাশের গাছগুলো কাটতে হবে। গাছগুলো কালের সাক্ষী। শতাব্দীরও বেশি বছর ধরে তারা যুদ্ধ, মহামারি, দেশভাগ, ঝড় ও মানুষের দস্যুতা সহ্য করে টিকে আছে। রাস্তাটি সম্রাট শের শাহের আমলে বানানো গ্র্যান্ড ট্রাংক রোডের সঙ্গে মিশেছে। মানুষের ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ দেশান্তরের অন্যতম পথ ছিল এটি। মুক্তিযুদ্ধের কোটি শরণার্থীর অনেকেই এই পথে দেশান্তরি হয়েছিল। অনেকের মৃত্যুও হয়েছিল সেই দুঃসহ যাত্রায়। তাদের কবর ও দাহও সম্ভবত এসব গাছের নিচে ও আশপাশেই হয়েছিল। আবার এসব গাছের নিচেই প্রসবশয্যা নিয়েছিলেন অনেক মা। স্বাধীনতার পর এ পথেই আবার তারা ফিরেও এসেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সেই মহাকাব্যিক ট্র্যাজেডি ও এক্সোডাস অভিভূত করেছিল মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গকে। অন্নহারা আশ্রয়হারা ‘দুইটি শিশু দাঁড়িয়ে আছে বৃক্ষছায়/নীরব চোখে আমায় শুধু দেখেই যায়’—লিখেছিলেন তিনি। কত কালজয়ী ঘটনার সাক্ষী এসব গাছ। উন্নয়নঅলারা কি কালের সাক্ষীকে ভয় পান? মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও তো ৪৭ বছরে পা দিল। বুড়ো গাছের মতো তাকেও কি উন্নয়নের ঝকমকিতে কেটেকুটে নতুন বানাবেন তাঁরা? একটি-দুটি নয়, ২ হাজার ৩০০ গাছের মামলা। আর গাছ কি কেবলই গাছ? যশোরের সাবেক জমিদার কালি পোদ্দার তাঁর মায়ের গঙ্গাযাত্রাকে ছায়াঘেরা করতে তিন শতাধিক মেঘ শিরীষগাছ লাগিয়েছিলেন। সেই গাছগুলো প্রায় পৌনে দুই শ বছরের সাক্ষী। অথচ সহজেই গাছগুলোকে অক্ষত রেখে দুপাশে মহাসড়ক তৈরি হতে পারে। পশ্চিম বাংলায়ও তো যশোর রোড গেছে। সীমান্তের পেট্রাপোল থেকে বনগাঁ পর্যন্ত অনেক জায়গায় সেভাবেই সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে (ছবিতে দেখুন)।
তো সে গিয়ে নানিকে বলে, ‘আনু, তুমি নাকি ডুমুরগাছ কাটতে বলছ?’
নানির টিভির দিকে মনোযোগ। সেদিকে তাকিয়েই বললেন, ‘হ, কাটা লাগবে।’
: কেন কাটা লাগবে?
: বুড়া হয়ে গেইছে, কাইটে ফেলতে হবে। নাতনি ঝামটি দিয়ে উত্তর দেয়, ‘তুমিও তো বুড়া হয়ে গেছ, তোমারেও কি কাটা লাগবে?’ কথা শুনে নানি লাজওয়াব। ডুমুরগাছটা সে যাত্রায় রক্ষা পেল। বয়স হয়ে গেলেই অথবা অবলা প্রাণ হলেই তাকে কাটা যায় না; এটা শিশুরাই বোঝে শুধু। কারণ তাদের স্বার্থবোধ কম।
দুই. যশোর রোডের উন্নয়ন হবে। দুই লেন থেকে চার লেন হবে। এ জন্য সিদ্ধান্ত হয়েছে দুপাশের গাছগুলো কাটতে হবে। গাছগুলো কালের সাক্ষী। শতাব্দীরও বেশি বছর ধরে তারা যুদ্ধ, মহামারি, দেশভাগ, ঝড় ও মানুষের দস্যুতা সহ্য করে টিকে আছে। রাস্তাটি সম্রাট শের শাহের আমলে বানানো গ্র্যান্ড ট্রাংক রোডের সঙ্গে মিশেছে। মানুষের ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ দেশান্তরের অন্যতম পথ ছিল এটি। মুক্তিযুদ্ধের কোটি শরণার্থীর অনেকেই এই পথে দেশান্তরি হয়েছিল। অনেকের মৃত্যুও হয়েছিল সেই দুঃসহ যাত্রায়। তাদের কবর ও দাহও সম্ভবত এসব গাছের নিচে ও আশপাশেই হয়েছিল। আবার এসব গাছের নিচেই প্রসবশয্যা নিয়েছিলেন অনেক মা। স্বাধীনতার পর এ পথেই আবার তারা ফিরেও এসেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সেই মহাকাব্যিক ট্র্যাজেডি ও এক্সোডাস অভিভূত করেছিল মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গকে। অন্নহারা আশ্রয়হারা ‘দুইটি শিশু দাঁড়িয়ে আছে বৃক্ষছায়/নীরব চোখে আমায় শুধু দেখেই যায়’—লিখেছিলেন তিনি। কত কালজয়ী ঘটনার সাক্ষী এসব গাছ। উন্নয়নঅলারা কি কালের সাক্ষীকে ভয় পান? মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও তো ৪৭ বছরে পা দিল। বুড়ো গাছের মতো তাকেও কি উন্নয়নের ঝকমকিতে কেটেকুটে নতুন বানাবেন তাঁরা? একটি-দুটি নয়, ২ হাজার ৩০০ গাছের মামলা। আর গাছ কি কেবলই গাছ? যশোরের সাবেক জমিদার কালি পোদ্দার তাঁর মায়ের গঙ্গাযাত্রাকে ছায়াঘেরা করতে তিন শতাধিক মেঘ শিরীষগাছ লাগিয়েছিলেন। সেই গাছগুলো প্রায় পৌনে দুই শ বছরের সাক্ষী। অথচ সহজেই গাছগুলোকে অক্ষত রেখে দুপাশে মহাসড়ক তৈরি হতে পারে। পশ্চিম বাংলায়ও তো যশোর রোড গেছে। সীমান্তের পেট্রাপোল থেকে বনগাঁ পর্যন্ত অনেক জায়গায় সেভাবেই সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে (ছবিতে দেখুন)।
এই সড়কটি ভারত-বাংলাদেশ সড়ক
ট্রানজিটের অংশ। তাই এর সম্প্রসারণ করার প্রকল্প সরকারের একটা বাধ্যবাধকতা।
তারই অংশ হিসেবে গত বছর ভারতীয় অংশের গাছ কাটা শুরু হয়। কিন্তু স্থানীয়
নাগরিক সমাজ ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং সুপ্রিম কোর্টে মামলার জেরে গাছ
কাটা বন্ধ হয়। বাংলাদেশেও সরকারিভাবে গাছ না কাটারই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ২০১৭
সালের ২১ জুলাই প্রকাশিত প্রথম আলোর খবর বলছে, ‘কোনো গাছ না কেটে
পুনর্নির্মাণ করা হবে যশোর-বেনাপোল জাতীয় মহাসড়ক। সড়ক পরিবহন ও সেতু
মন্ত্রণালয় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগকে মন্ত্রণালয়ের
সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী মহাসড়কটির উন্নয়ন প্রকল্প
প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগ। এর আগে
মহাসড়কটির দুই পাশের বিভিন্ন প্রজাতির ২ হাজার ৩১২টি গাছ কাটার সিদ্ধান্ত
নেওয়া হয়।’ সওজ বিভাগ খুলনা জোনের তৎকালীন অতিরিক্ত প্রকৌশলী মো. রুহুল
আমীন তখন বলেছিলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয় ১৩ জুলাই গাছগুলো রেখে
মহাসড়কটি পুনর্নির্মাণের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। সে অনুযায়ী ডিপিপি
সংশোধনের কাজ চলছে। গাছ না কেটেই মহাসড়কটি পুনর্নির্মাণ করা হবে।’ তাহলে ৬
জানুয়ারি উল্টো সিদ্ধান্ত কীভাবে নিল যশোর জেলা প্রশাসন? বৈঠকটির নামও
মশকরামূলক। বৈঠকের ব্যানারে লেখা ছিল, ‘যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক যথাযথ মানের ও
প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ প্রকল্পের আওতায় রাস্তার দুই পার্শ্বে গাছসমূহ
অপসারণের বিষয়ে’। সভায় উপস্থিত প্রশাসক, প্রকৌশলী, জনপ্রতিনিধি ও
রাজনীতিবিদ সবাই ‘জনস্বার্থে গাছ কাটা’ বিষয়ে একমত হন। কাষ্ঠব্যবসায়ী বৃক্ষ
দেখলে প্রাণ ভাবে না, প্রকৃতি দেখে না, দেখে শুধু কাঠ। কাঠ মানে টাকা,
টাকা মানে উন্নয়ন। প্রাণ মানে কী, তা কি তাঁরা জানেন?
কদিন আগেই
অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলতে বাধ্য হয়েছেন, প্রকৃতিবিরোধী উন্নয়ন
করে আমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পানিনিষ্কাশন–ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছি। সঙ্গে এটাও
বলা দরকার, এক আশ্চর্য শ্যামল বনভূমিময় দেশকে আমরা করাতকল বানিয়ে ছাড়ছি।
উন্নয়ন মানে কি করাতকল? উন্নয়ন মানে কি পরশুরামের কুঠার? এটাই এখন চলছে
বাংলাদেশে। যাবতীয় গণবিরোধী কার্যকলাপের নাম দেওয়া হয়েছে ‘জনস্বার্থ’।
নদী-বিল-হাওর-বন ধ্বংস করাকে বলা হচ্ছে উন্নয়ন। সুন্দরবনের বুক ঘেঁষে
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বসানোকে বলা হচ্ছে উন্নয়ন। পাহাড় কাটা, বন কাটাও
উন্নয়ন। আমরা বলছি না কোথাও হাত দেওয়া যাবে না। আমরা বলছি উত্তম বিকল্পের
কথা। বেশি লাভের পথের বদলে আমরা বেশি খরচে বেশি ক্ষতির রাস্তা কেন নিচ্ছি?
পদ্মা সেতুর বিকল্প নেই, কিন্তু যশোর রোডের গাছগুলো কাটার বিকল্প আছে।
দুর্নীতি ও ভুলের কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ থেকে ৭ গুণ পর্যন্ত খরচ করায়
অসুবিধা হয় না, কিন্তু গাছগুলোকে মাঝখানে রেখে দুপাশে সড়ক বানাতে কেন
অসুবিধা! যশোর রোড দেশের সুন্দরতম সড়ক-নিসর্গের একটি। কড়া রোদের দিনে এই
সড়কে ঘন মেঘের মতো ছায়া জমে। ঝুম বৃষ্টির দিনে এর তলায় কোনো পাতা কুড়ানো
কিশোরী কিংবা রাখাল কিশোরের আশ্রয় নেওয়ার দৃশ্য শ্রেষ্ঠতম চিত্রকলা হয়ে
যায়। বিকেলের সোনালি আলোয় বৃক্ষচূড়ায় সোনালি গম্বুজের ঐশী আভা কারও মনে
অলৌকিক অনুভূতির জন্ম দিতে পারে। শীতের কুয়াশা ঘিরে এলে মনে হয় যেন কোনো
শুভ্র সুড়ঙ্গ দিয়ে স্বর্গের দিকে চলেছি। পৃথিবীর কোনো ওয়ান্ডারল্যান্ড বা
বিনোদনপুরী এমন সুন্দর ফিরিয়ে দিতে পারবে?
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@prothom-alo.info
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@prothom-alo.info
No comments