উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দ্বিতীয় বন্যা শুরু
দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আবারও বন্যা শুরু হয়েছে। দেশের ভেতর ও বাইরে ভারি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে গেছে। পাহাড়ি ঢল এবং বৃষ্টির পানি চলে যাচ্ছে নদ-নদীতে। এ কারণেই এই বন্যা পরিস্থিতি। এরই মধ্যে দেশের ১৪টি নদী বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। এ কারণে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, সুনামগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ কয়েকটি জেলার চর, দ্বীপচর ও নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েকশ’ গ্রামের হাজার হাজার মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পরিস্থিতি আগামী এক সপ্তাহ চলতে পারে। বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইমেইলে যুগান্তরকে জানান, ‘মেঘনা অববাহিকায় পানি বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা ধেয়ে আসছে। তিস্তা এবং ধরলা নদীর পানি বাড়ছে। আসামে ভারি বৃষ্টির কারণে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা বেসিনেও পানি বাড়ছে। এসব মিলিয়ে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মৌসুমের দ্বিতীয় ধাপের বন্যা শুরু হল।’ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের (এফএফডব্লিউসি) নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন যুগান্তরকে শনিবার বলেন, এখন যেটা শুরু হয়েছে, সেটা উত্তরাঞ্চলের জন্য এ মৌসুমের দ্বিতীয় বন্যা। আর সিলেট অঞ্চলে তো লেগেই আছে। পানি কমছে-বাড়ছে, এ অবস্থার মধ্যেই আছে সিলেট অঞ্চল। এফএফডব্লিউসি শনিবার সকালে বন্যাসম্পর্কিত পূর্বাভাস প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ১৪টি নদীর পানি দেশের ১৭টি স্থানে বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড দেশের ৯০ পয়েন্টে দেশের সব নদ-নদীর পানি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। এর মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় ৮১ পয়েন্টেই পানির উচ্চতা বেড়েছে। কমেছে মাত্র ৬ পয়েন্টে। বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত নদীগুলো হচ্ছে- কুড়িগ্রামে ধরলা, ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা, বদরগঞ্জে যমুনেশ্বরী, বাহাদুরাবাদ ও সিরাজগঞ্জে যমুনা, ঠাকুরগাঁওয়ে টাঙ্গন, কানাইঘাট ও সুনামগঞ্জে সুরমা, শেওলা পয়েন্টে কুশিয়ারা, সারিঘাটে সারিগোয়াইন, মনু রেলওয়ে সেতু পয়েন্টে মনু নদী, হবিগঞ্জ ও বাল্লায় খোয়াই নদী, কমলগঞ্জে ধলাই, নাকুরগাঁওয়ে ভুগাই, দুর্গাপুরে সোমেশ্বরী এবং জারিয়াজঞ্চাইল পয়েন্টে কংস নদী।
এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি নাকুরগাঁওয়ে। সেখানে ভুগাই নদী বিপদসীমার ২৩৬ সেন্টিমিটার ওপরে বইছে। খোয়াই ১৯৫ সেন্টিমিটার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে হবিগঞ্জে। আবহাওয়া বিভাগ (বিএমডি) এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, দেশের ভেতর বৃষ্টিপাতের প্রবণতা অনেক বেশি। শনিবার দুপুর ১২টার আগের ৩০ ঘণ্টায় শুধু তেঁতুলিয়ায় ৪০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে শনিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত বৃষ্টির পরিমাণ ৩৩২ মিলিমিটার। এমন পরিস্থিতি উত্তরাঞ্চলের অন্য জেলায়ও বিদ্যমান। বৃষ্টির ওই পানি বেশিরভাগই উত্তরের বিভিন্ন নদ-নদীতে প্রবাহিত হয়। সঙ্গে আসছে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানি। সব মিলিয়ে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিএমডি শনিবার সকাল ১০টায় ভারি বর্ষণের পূর্বাভাস জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামে ২৪ ঘণ্টা ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে। এ কারণে চট্টগ্রাম ও সিলেটে কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা আছে। বাংলাদেশের মিঠাপানির প্রধান উৎস তিনটি নদী অববাহিকা। একটি হচ্ছে- মেঘনা অববাহিকা। এটিতে ভারতের মেঘালয়, আসাম, মনিপুর, ত্রিপুরা অঞ্চলের ভারি বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের পানি বহন করে। যার বেশিরভাগ ভারতের বোরাক নদী হয়ে সুরমা-কুশিয়ারার মধ্য দিয়ে মেঘনায় আসে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকা। এতে আসাম, অরুণাচলসহ ভারতের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য রাজ্যের পানি আসে। এছাড়া সিকিমের পানি গজলডোবা হয়ে তিস্তার মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্রেও কিছু যুক্ত হয়। তৃতীয়টি হচ্ছে গঙ্গা-পদ্মা। পশ্চিমবঙ্গ-বিহারসহ ওই এলাকার পানি প্রবাহিত হয় এ অববাহিকায়।’ অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এ তিনটি অববাহিকা যখন একসঙ্গে সক্রিয় হয়, তখন দেশে বড় বন্যা হয়। ১৯৯৮ বা ২০০৪ সালে তা-ই ঘটেছিল। এ বছর মে মাসে সিলেট অঞ্চলে আকস্মিক ও আগাম বন্যা হয়। এরপর থেকে সেখানে বন্যা লেগে আছে। গত জুলাইয়ে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকায় বন্যা হয়। তবে এখন পর্যন্ত গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকায় বন্যার আশঙ্কা নেই। তবে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে যেহেতু যমুনা এসে পদ্মায় মিলেছে, তাই মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুরসহ মধ্য ও নিম্নাঞ্চলে বন্যার পানি পৌঁছাতে পারে। এফএফডব্লিউসির তথ্য অনুযায়ী, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকার পানি ৭২ ঘণ্টা বাড়তে থাকবে। একইভাবে ২৪ ঘণ্টা ধরে সুরম-কুশিয়ারা বা মেঘনা অববাহিকার পানিও বাড়বে। ফলে দেশের উত্তর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকার পানিও বাড়বে। তবে এটা তেমন বন্যা পরিস্থিতি তৈরি করবে না বলে জানান সংস্থাটির নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন। আবহাওয়া অধিদফতর (বিএমডি) বলছে, বঙ্গোপসাগরে কোনো লঘু বা নিন্মচাপ নেই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত আছে মৌসুমি বায়ুর বর্ধিতাংশের অক্ষ। এর একটি অংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। পাশাপাশি বাংলাদেশের ওপর মৌসুমি বায়ু তো সক্রিয় আছেই, যা উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি অবস্থায় বিরাজ করছে। এ দুই মিলিয়ে ব্যাপক বৃষ্টিপাত ঘটাচ্ছে। ৭২ ঘণ্টা এ অবস্থা আরও বিরাজ করবে। আবহাওয়াবিদ রুহুল কুদ্দুস যুগান্তরকে বলেন, শনিবার সকাল ৬টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত ঢাকায় ২২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সকাল ৬টা থেকে ১২টা পর্যন্ত দেশে সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে সীতাকুণ্ডে ২১৮ মিলিমিটার। দেশের অধিকাংশ এলাকায়ই বৃষ্টি হচ্ছে বলে জানান তিনি। যুগান্তর ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
আখাউড়া (ব্রাহ্মণাবাড়িয়া) : আখাউড়া সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো এখন পানিতে ভাসছে। আখাউড়া-আগরতলা সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় স্থলবন্দরগামী যানবাহন বন্ধ হয়ে গেছে। শনিবার সকাল থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর ও ইমিগ্রেশন কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা হয়। এতে বাংলাদেশ-ভারতের পাসপোর্টধারী যাত্রী পারাপার বন্ধ হয়ে যায়। দুই দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যও বন্ধ হয়ে পড়ে। স্থানীয় সংসদ সদস্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের পক্ষ থেকে শনিবার দুপুরে বন্যার্তদের মধ্যে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়।
বান্দরবান : ফের ভয়াবহ বন্যা ও পাহাড় ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বান্দরবান জেলায়। জেলা ও উপজেলা সদরে পৌর কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসনের উদ্যোগে শুক্রবার রাত থেকে দফায় দফায় মাইকিং করে পাহাড়ের পাদদেশে বা উঁচু-নিচু এলাকায় বসবাসরত পরিবারগুলোকে সতর্ক থাকার এবং দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বান্দরবান-রুমা সড়কের দৌলিয়ান পাড়া এলাকায় আবারও পাহাড় ধসের মাটিতে সয়লাব হয়ে পড়েছে সড়কপথ। ফলে শনিবার ভোরবেলা থেকে নিরাপত্তাজনিত কারণে রুমা উপজেলার সঙ্গে বান্দরবান জেলা সদরের মধ্যে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামের নিম্নাঞ্চলে আবারও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় নগরবাসী দুর্ভোগে পড়েছে। জনজবীবনে নেমে আসে স্থবিরতা। চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শনিবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ১৭৪ দশমিক ১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ আরও দু-তিন দিন অব্যাহত থাকতে পারে। এ কারণে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের আশঙ্কাও রয়েছে।
লালমনিরহাট : জেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। তিস্তা, ধরলা নদীর পাশাপাশি ছোট ছোট সানিয়াজান ও সিংঙ্গীমারী নদীর পানিও বিপদসীমার অনেক উপড় দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভেঙে গেছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদীরক্ষা বাঁধ। তবে গত কয়েক দিনের প্রবল বৃষ্টিতে নদী তীরবর্তী এলাকা ছাপিয়ে পৌর শহরের পাশাপাশি গ্রামে গ্রামে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অনেক পরিবার। গোটা জেলায় প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্ধি বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
পঞ্চগড় : পঞ্চগড় জেলার সদর, আটোয়ারী, দেবীগঞ্জ ও বোদা উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বাড়িঘরে পানি ওঠায় বেশ কিছু এলাকার কয়েক হাজার মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। হাজার হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন ধান ডুবে গেছে। এদিকে রেলপথ ডুবে যাওয়ায় পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুর রেলপথের নয়নীবুরুজ এলাকায় ৫০২/১ হতে ৫০৪/৫ এলাকা পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার রেলপথ পানির নিচে ডুবে যাওয়ায় ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
রংপুর, গঙ্গাচড়া ও কাউনিয়া : তিস্তা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। রংপুরের তিন উপজেলার অর্ধশতাধিক চরাঞ্চলের গ্রামে বন্যা দেখা দিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড রংপুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ কন্ট্রোল রুম সূত্র জানায়, রংপুরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত সব নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তিস্তার পানি ‘তিস্তা ব্যারাজ’ পয়েন্টে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার, ঘাঘটের পানি ৫২ সেন্টিমিটার ও যমুনেশ্বরীর পানি ২৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
হবিগঞ্জ ও চুনারুঘাট : হবিগঞ্জে খোয়াই নদীর পানি বিপদসীমার ২১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শনিবার বেলা ১টায় শহরের মাছুলিয়া পয়েন্টে নদীর পানি বিপদসীমার ২১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। চুনারুঘাট উপজেলার সাত ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রামের নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব গ্রামের রাস্তা, পুকুর, ডোবা ও ফসল পানির নিচে রয়েছে। এতে সহস াধিক লোক পানিবন্দি রয়েছে। খোয়াই, করাঙ্গী ও সুতাং নদীর পানি উপচে উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলাদি ও ঘরবাড়ি ডুবে গেছে।
ইসলামপুর (জামালপুর) : জামালপুরে দ্বিতীয় দফা বন্যা দেখা দিয়েছে। যমুনার নদী এবং ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। শনিবার বাহাদুরাবাদঘাট পয়েন্টে যমুনার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এদিকে জামালপুরে দ্বিতীয় দফা বন্যায় ইসলামপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চল বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
সিরাজগঞ্জ : যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সিরাজগঞ্জ শহররক্ষা বাঁধ এলাকায় বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। শনিবার দুপুর ৩টা পর্যন্ত যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডাটা অ্যান্ট্রি অপারেটর আবদুল লতিফ জানান, বৃহস্পতিবার থেকে যমুনা নদীর পানি হঠাৎ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ৪২ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
কমলগঞ্জ ও বড়লেখা (মৌলভীবাজার) : কমলগঞ্জ উপজেলায় ধলাই নদের প্রতিরক্ষা বাঁধের পুরাতন দুটি ভাঙন দিয়ে পানি প্রবেশ করছে ফসলি জমিতে। চার ইউনিয়নের ৩০০ হেক্টর জমির রোপা আমন পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বড়লেখায় হাকালুকি হাওর পাড়ের তালিমপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের বাড়িঘরে বন্যার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।
শেরপুর ও নালিতাবাড়ী : জেলার রাস্তাঘাটে এবং নিচু এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যাওয়ায় ক্লাস হচ্ছে না। বৃষ্টির কারণে মানুষজন রাস্তায় কম বের হচ্ছেন। ব্যবসা-বাণিজ্যেও অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নালিতাকবাড়ী উপজেলার ভোগাই, চেল্লাখালি নদীর পানি অস্বাভাবিক বেড়েছে। শনিবার দুপুর পর্যন্ত ভোগাই নদীর পানি ছিটপাড়া পয়েন্টে ৭৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মধ্য রাতে ভোগাই নদীর হাতিপাগার নয়াবিল, শিমুলতলা, খালভাংগা, নিজপাড়া এলাকায় এবং চেল্লাখালি নদীর গোল্লাপাড় এলাকায় কমপক্ষে ১০ জায়গায় নদীর তীররক্ষা বাঁধ ভেঙে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করে পৌরসভাসহ ৬ ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
দুর্গাপুর (নেত্রকোনা) : দুর্গাপুরে সোমেশ্বরী নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় পৌরসভাসহ সাত ইউনিয়নে বন্যা দেখা দিয়েছে। সরেজমিন দেখা গেছে, পানি বেড়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাট তলিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পানি প্রবেশ করেছে। উপজেলার বিভিন্ন মৎস্য খামারের মাছ ভেসে গেছে। প্লাবিত গ্রামগুলোতে সংকটে রয়েছে জ্বালানি ও গো-খাদ্যের।
পাবনা : পাবনা শহরের অধিকাংশ এলাকা তলিয়ে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে মারাত্মক জলাবদ্ধতা। শহরের নিম্নাঞ্চল তো বটেই পাবনা শহরের প্রধান প্রধান রাস্তাও এখন কাঁদাপানিতে সয়লাব। জলাবদ্ধতা দূরীকরণে পৌরসভার উদ্যোগ নেই। তারা বলছেন সরকারি বরাদ্দ নেই।
ধোবাউড়া, ফুলপুর ও হালুয়াঘাট (ময়মনসিংহ) : ধোবাউড়ায় ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উপজেলার চারটি ইউনিয়ন সম্পূর্ণ প্লাবিত হয়ে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ফুলপুর ও তারাকান্দার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। হালুঘাটে ব্রিজ-কালভার্ট ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সুনামগঞ্জ, জামালগঞ্জ, ছাতক, ধর্মপাশা ও দেলদুয়ার : প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সুরমাসহ সুনামগঞ্জের সবক’টি নদ-নদীর পানি বাড়ছে। এতে জেলার নিম্নাঞ্চলীয় এলাকাগুলো প্লাবিত হচ্ছে। গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ। জামালগঞ্জ ও ছাতক ও ধর্মপাশা উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে গেছে এবং সেই সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। দোয়ারাবাজারে বন্যায় ফসলহানিসহ জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে। উপজেলার সবক’টি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
সিলেট : সিলেট বিভাগের বিভিন্ন স্থানে টানা ভারি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ফের বন্যা দেখা দিয়েছে। প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল। সিলেটের প্রধান তিনটি নদী সুরমা, কুশিয়ারা ও খোয়াইয়ের পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, এ অবস্থা থাকবে বুধবার পর্যন্ত। এতে নিম্নাঞ্চলের লোকজন এখন উদ্বিগ্ন। এবার দফায় দফায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এসব নিম্নাঞ্চলের মানুষ এখন অনেকটা দিশেহারা।
গাইবান্ধা : ২৪ ঘণ্টায় শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের পানি তিস্তামুখ ঘাট পয়েন্টে ৩৫ সেন্টিমিটার, ঘাঘট গাইবান্ধা শহর পয়েন্টে ৩৮ সেন্টিমিটার, তিস্তা সুন্দরগঞ্জ পয়েন্টে ৩০ সেন্টিমিটার এবং করতোয়া নদীর পানি গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালী পয়েন্টে ৫৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে।
খাগড়াছড়ি : খাগড়াছড়ির নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। টানা বর্ষণের কারণে মাইনী নদীর পানি বেড়ে শনিবার ভোরে প্লাবিত হয়েছে দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নের প্রায় আটটি গ্রাম। শনিবার বিকাল পর্যন্ত দীঘিনালা উপজেলার হাজাছড়া, ৩ নম্বর কলোনি এলাকায় পাহাড় ধসে চারটি বাড়ি ধসে পড়েছে। মাটিরাঙ্গা উপজেলায় ধলিয়া নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে গ্রামীণ সড়ক। এতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে উপজেলার চরপাড়া এলাকার মানুষ। ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে নদী তীরবর্তী বসতভিটা ও ফসলি জমি।
মহেশখালী (কক্সবাজার) : কক্সবাজারের উপকূলীয় দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কাঁচা বাড়ি, মাছের ঘের, পাহাড়ি পানের বরজ ও গ্রামীণ অবকাঠামো।
দিনাজপুর : কাহারোল উপজেলার পল্লীতে শনিবার দেয়াল চাপা পড়ে আরোদা রানী দাস নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। আরোদা রানী দাস কাহারোল উপজেলার ৬ নম্বর রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের নয়াবাদ দাসপাড়া গ্রামের সুধীর চন্দ্র দাসের স্ত্রী। এদিকে জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জেলার কয়েক হাজার মানুষ। দিনাজপুর সদর উপজেলায় ভেঙে গেছে আত্রাই নদীর বাঁধ। জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলার রানীগঞ্জে তলিয়ে গেছে দিনাজপুর-ঢাকা মহাসড়ক।
ঠাকুরগাঁও : ঠাকুরগাঁওয়ের পাঁচ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। উজানের ঢলে পনিবন্দি অবস্থায় দিন যাপন করছে কমপক্ষে ১৫ হাজার মানুষ। কাঁচা ও আধাপাকা ২ সহস াধিক ঘরবাড়ি বিনষ্ট হয়েছে। পানির তলে রোপা আমন ধান। তুলা, মৌসুমি শাকসবজি, মরিচসহ বিভিন্ন ফসল তলিয়ে গেছে। শহরের ডিসি বস্তি এলাকার একজন নিখোঁজ হয়েছে। নিখোঁজ যুবককে উদ্ধারের জন্য রংপুর থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঠাকুরগাঁওয়ে রওনা দিয়েছেন।
কুড়িগ্রাম, নাগেশ্বরী, ফুলবাড়ী, চিলমারী, রৌমারী ও উলিপুর : দু’দিন থেকে অবিরাম বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে কুড়িগ্রামের ধরলা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র দুধকুমরসহ ১৬টি নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে আর ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। কুড়িগ্রাম-নাগেশ্বরী সড়কের পাটেশ্বরী, মধ্যকুমোরপুর ও নাগেশ্বরী পেট্রুলপাম্পসহ চার স্থানে রাস্তার ওপর পানি প্রবাহিত হওয়ায় সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। চিলমারী ও ফুলবাড়ী উপজেলার চর ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। উলিপুরে তিস্তা ও ব্রহ্মপূত্র নদের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ফের বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
আখাউড়া (ব্রাহ্মণাবাড়িয়া) : আখাউড়া সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো এখন পানিতে ভাসছে। আখাউড়া-আগরতলা সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় স্থলবন্দরগামী যানবাহন বন্ধ হয়ে গেছে। শনিবার সকাল থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর ও ইমিগ্রেশন কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা হয়। এতে বাংলাদেশ-ভারতের পাসপোর্টধারী যাত্রী পারাপার বন্ধ হয়ে যায়। দুই দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যও বন্ধ হয়ে পড়ে। স্থানীয় সংসদ সদস্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের পক্ষ থেকে শনিবার দুপুরে বন্যার্তদের মধ্যে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়।
বান্দরবান : ফের ভয়াবহ বন্যা ও পাহাড় ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বান্দরবান জেলায়। জেলা ও উপজেলা সদরে পৌর কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসনের উদ্যোগে শুক্রবার রাত থেকে দফায় দফায় মাইকিং করে পাহাড়ের পাদদেশে বা উঁচু-নিচু এলাকায় বসবাসরত পরিবারগুলোকে সতর্ক থাকার এবং দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বান্দরবান-রুমা সড়কের দৌলিয়ান পাড়া এলাকায় আবারও পাহাড় ধসের মাটিতে সয়লাব হয়ে পড়েছে সড়কপথ। ফলে শনিবার ভোরবেলা থেকে নিরাপত্তাজনিত কারণে রুমা উপজেলার সঙ্গে বান্দরবান জেলা সদরের মধ্যে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামের নিম্নাঞ্চলে আবারও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় নগরবাসী দুর্ভোগে পড়েছে। জনজবীবনে নেমে আসে স্থবিরতা। চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শনিবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ১৭৪ দশমিক ১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ আরও দু-তিন দিন অব্যাহত থাকতে পারে। এ কারণে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের আশঙ্কাও রয়েছে।
লালমনিরহাট : জেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। তিস্তা, ধরলা নদীর পাশাপাশি ছোট ছোট সানিয়াজান ও সিংঙ্গীমারী নদীর পানিও বিপদসীমার অনেক উপড় দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভেঙে গেছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নদীরক্ষা বাঁধ। তবে গত কয়েক দিনের প্রবল বৃষ্টিতে নদী তীরবর্তী এলাকা ছাপিয়ে পৌর শহরের পাশাপাশি গ্রামে গ্রামে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অনেক পরিবার। গোটা জেলায় প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্ধি বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
পঞ্চগড় : পঞ্চগড় জেলার সদর, আটোয়ারী, দেবীগঞ্জ ও বোদা উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বাড়িঘরে পানি ওঠায় বেশ কিছু এলাকার কয়েক হাজার মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। হাজার হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন ধান ডুবে গেছে। এদিকে রেলপথ ডুবে যাওয়ায় পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুর রেলপথের নয়নীবুরুজ এলাকায় ৫০২/১ হতে ৫০৪/৫ এলাকা পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার রেলপথ পানির নিচে ডুবে যাওয়ায় ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
রংপুর, গঙ্গাচড়া ও কাউনিয়া : তিস্তা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। রংপুরের তিন উপজেলার অর্ধশতাধিক চরাঞ্চলের গ্রামে বন্যা দেখা দিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড রংপুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ কন্ট্রোল রুম সূত্র জানায়, রংপুরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত সব নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তিস্তার পানি ‘তিস্তা ব্যারাজ’ পয়েন্টে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার, ঘাঘটের পানি ৫২ সেন্টিমিটার ও যমুনেশ্বরীর পানি ২৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
হবিগঞ্জ ও চুনারুঘাট : হবিগঞ্জে খোয়াই নদীর পানি বিপদসীমার ২১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শনিবার বেলা ১টায় শহরের মাছুলিয়া পয়েন্টে নদীর পানি বিপদসীমার ২১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। চুনারুঘাট উপজেলার সাত ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রামের নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব গ্রামের রাস্তা, পুকুর, ডোবা ও ফসল পানির নিচে রয়েছে। এতে সহস াধিক লোক পানিবন্দি রয়েছে। খোয়াই, করাঙ্গী ও সুতাং নদীর পানি উপচে উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলাদি ও ঘরবাড়ি ডুবে গেছে।
ইসলামপুর (জামালপুর) : জামালপুরে দ্বিতীয় দফা বন্যা দেখা দিয়েছে। যমুনার নদী এবং ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। শনিবার বাহাদুরাবাদঘাট পয়েন্টে যমুনার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এদিকে জামালপুরে দ্বিতীয় দফা বন্যায় ইসলামপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চল বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
সিরাজগঞ্জ : যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সিরাজগঞ্জ শহররক্ষা বাঁধ এলাকায় বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। শনিবার দুপুর ৩টা পর্যন্ত যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডাটা অ্যান্ট্রি অপারেটর আবদুল লতিফ জানান, বৃহস্পতিবার থেকে যমুনা নদীর পানি হঠাৎ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ৪২ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
কমলগঞ্জ ও বড়লেখা (মৌলভীবাজার) : কমলগঞ্জ উপজেলায় ধলাই নদের প্রতিরক্ষা বাঁধের পুরাতন দুটি ভাঙন দিয়ে পানি প্রবেশ করছে ফসলি জমিতে। চার ইউনিয়নের ৩০০ হেক্টর জমির রোপা আমন পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বড়লেখায় হাকালুকি হাওর পাড়ের তালিমপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের বাড়িঘরে বন্যার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।
শেরপুর ও নালিতাবাড়ী : জেলার রাস্তাঘাটে এবং নিচু এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যাওয়ায় ক্লাস হচ্ছে না। বৃষ্টির কারণে মানুষজন রাস্তায় কম বের হচ্ছেন। ব্যবসা-বাণিজ্যেও অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নালিতাকবাড়ী উপজেলার ভোগাই, চেল্লাখালি নদীর পানি অস্বাভাবিক বেড়েছে। শনিবার দুপুর পর্যন্ত ভোগাই নদীর পানি ছিটপাড়া পয়েন্টে ৭৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মধ্য রাতে ভোগাই নদীর হাতিপাগার নয়াবিল, শিমুলতলা, খালভাংগা, নিজপাড়া এলাকায় এবং চেল্লাখালি নদীর গোল্লাপাড় এলাকায় কমপক্ষে ১০ জায়গায় নদীর তীররক্ষা বাঁধ ভেঙে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করে পৌরসভাসহ ৬ ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
দুর্গাপুর (নেত্রকোনা) : দুর্গাপুরে সোমেশ্বরী নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় পৌরসভাসহ সাত ইউনিয়নে বন্যা দেখা দিয়েছে। সরেজমিন দেখা গেছে, পানি বেড়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাট তলিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পানি প্রবেশ করেছে। উপজেলার বিভিন্ন মৎস্য খামারের মাছ ভেসে গেছে। প্লাবিত গ্রামগুলোতে সংকটে রয়েছে জ্বালানি ও গো-খাদ্যের।
পাবনা : পাবনা শহরের অধিকাংশ এলাকা তলিয়ে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে মারাত্মক জলাবদ্ধতা। শহরের নিম্নাঞ্চল তো বটেই পাবনা শহরের প্রধান প্রধান রাস্তাও এখন কাঁদাপানিতে সয়লাব। জলাবদ্ধতা দূরীকরণে পৌরসভার উদ্যোগ নেই। তারা বলছেন সরকারি বরাদ্দ নেই।
ধোবাউড়া, ফুলপুর ও হালুয়াঘাট (ময়মনসিংহ) : ধোবাউড়ায় ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উপজেলার চারটি ইউনিয়ন সম্পূর্ণ প্লাবিত হয়ে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ফুলপুর ও তারাকান্দার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। হালুঘাটে ব্রিজ-কালভার্ট ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সুনামগঞ্জ, জামালগঞ্জ, ছাতক, ধর্মপাশা ও দেলদুয়ার : প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সুরমাসহ সুনামগঞ্জের সবক’টি নদ-নদীর পানি বাড়ছে। এতে জেলার নিম্নাঞ্চলীয় এলাকাগুলো প্লাবিত হচ্ছে। গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ। জামালগঞ্জ ও ছাতক ও ধর্মপাশা উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে গেছে এবং সেই সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। দোয়ারাবাজারে বন্যায় ফসলহানিসহ জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে। উপজেলার সবক’টি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
সিলেট : সিলেট বিভাগের বিভিন্ন স্থানে টানা ভারি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ফের বন্যা দেখা দিয়েছে। প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল। সিলেটের প্রধান তিনটি নদী সুরমা, কুশিয়ারা ও খোয়াইয়ের পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, এ অবস্থা থাকবে বুধবার পর্যন্ত। এতে নিম্নাঞ্চলের লোকজন এখন উদ্বিগ্ন। এবার দফায় দফায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এসব নিম্নাঞ্চলের মানুষ এখন অনেকটা দিশেহারা।
গাইবান্ধা : ২৪ ঘণ্টায় শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের পানি তিস্তামুখ ঘাট পয়েন্টে ৩৫ সেন্টিমিটার, ঘাঘট গাইবান্ধা শহর পয়েন্টে ৩৮ সেন্টিমিটার, তিস্তা সুন্দরগঞ্জ পয়েন্টে ৩০ সেন্টিমিটার এবং করতোয়া নদীর পানি গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালী পয়েন্টে ৫৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে।
খাগড়াছড়ি : খাগড়াছড়ির নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। টানা বর্ষণের কারণে মাইনী নদীর পানি বেড়ে শনিবার ভোরে প্লাবিত হয়েছে দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নের প্রায় আটটি গ্রাম। শনিবার বিকাল পর্যন্ত দীঘিনালা উপজেলার হাজাছড়া, ৩ নম্বর কলোনি এলাকায় পাহাড় ধসে চারটি বাড়ি ধসে পড়েছে। মাটিরাঙ্গা উপজেলায় ধলিয়া নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে গ্রামীণ সড়ক। এতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে উপজেলার চরপাড়া এলাকার মানুষ। ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে নদী তীরবর্তী বসতভিটা ও ফসলি জমি।
মহেশখালী (কক্সবাজার) : কক্সবাজারের উপকূলীয় দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কাঁচা বাড়ি, মাছের ঘের, পাহাড়ি পানের বরজ ও গ্রামীণ অবকাঠামো।
দিনাজপুর : কাহারোল উপজেলার পল্লীতে শনিবার দেয়াল চাপা পড়ে আরোদা রানী দাস নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। আরোদা রানী দাস কাহারোল উপজেলার ৬ নম্বর রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের নয়াবাদ দাসপাড়া গ্রামের সুধীর চন্দ্র দাসের স্ত্রী। এদিকে জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জেলার কয়েক হাজার মানুষ। দিনাজপুর সদর উপজেলায় ভেঙে গেছে আত্রাই নদীর বাঁধ। জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলার রানীগঞ্জে তলিয়ে গেছে দিনাজপুর-ঢাকা মহাসড়ক।
ঠাকুরগাঁও : ঠাকুরগাঁওয়ের পাঁচ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। উজানের ঢলে পনিবন্দি অবস্থায় দিন যাপন করছে কমপক্ষে ১৫ হাজার মানুষ। কাঁচা ও আধাপাকা ২ সহস াধিক ঘরবাড়ি বিনষ্ট হয়েছে। পানির তলে রোপা আমন ধান। তুলা, মৌসুমি শাকসবজি, মরিচসহ বিভিন্ন ফসল তলিয়ে গেছে। শহরের ডিসি বস্তি এলাকার একজন নিখোঁজ হয়েছে। নিখোঁজ যুবককে উদ্ধারের জন্য রংপুর থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঠাকুরগাঁওয়ে রওনা দিয়েছেন।
কুড়িগ্রাম, নাগেশ্বরী, ফুলবাড়ী, চিলমারী, রৌমারী ও উলিপুর : দু’দিন থেকে অবিরাম বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে কুড়িগ্রামের ধরলা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র দুধকুমরসহ ১৬টি নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে আর ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। কুড়িগ্রাম-নাগেশ্বরী সড়কের পাটেশ্বরী, মধ্যকুমোরপুর ও নাগেশ্বরী পেট্রুলপাম্পসহ চার স্থানে রাস্তার ওপর পানি প্রবাহিত হওয়ায় সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। চিলমারী ও ফুলবাড়ী উপজেলার চর ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। উলিপুরে তিস্তা ও ব্রহ্মপূত্র নদের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ফের বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
No comments