অরক্ষিত শাহজালালের টার্মিনাল ভবন
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনসহ অন্যান্য স্থাপনার আগুন নেভানোর জন্য নিজস্ব ফায়ার সার্ভিস ইউনিট নেই। স্বয়ংক্রিয়ভাবে আগুন নেভানোর মতো সরঞ্জাম নেই। দ্রুত বের হওয়ার জন্য নেই ইমার্জেন্সি এক্সিট গেট। এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে জনবল ও প্রশিক্ষণের অভাব। ফলে শুক্রবার আগুন লাগার স্থান চিহ্নিত হওয়ার পরও সেখানে এস্টিংগুইশার পুশ করা হয়নি। ঘটনাস্থলের আশপাশেও কোনো ধরনের ফায়ার এস্টিংগুইশার ও ফায়ার হাইড্রেন্ট মেশিনও ছিল না। এসব কারণে ছোট-বড় সব ধরনের আগুন নেভানোর জন্য কেন্দ্রীয় ফায়ার সার্ভিসের ওপরই নির্ভর করতে হয় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে। শুক্রবার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আগুনের ঘটনায় গঠিত দুটি তদন্ত কমিটিই কাজ শুরু করেছে। শনিবার বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এবং ফায়ার সার্ভিসের দুই কমিটির সদস্যরা আলাদাভাবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ওই দিন বেলা দেড়টার দিকে বিমানবন্দরের মূল ভবনের তৃতীয় তলায় এয়ার ইন্ডিয়ার কার্যালয়ে আগুনের সূত্রপাত হয়। জানা গেছে, বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে নিজস্ব ফায়ার সার্ভিস ইউনিট আছে। তবে ইউনিটের মূল কাজ হচ্ছে এয়ারক্রাফট আকাশে উড্ডয়ন বা অবতরণের সময় রানওয়েতে আগুন লাগলে তা নেভানো। টার্মিনাল ভবন বা অন্যান্য স্থাপনায় আগুন লাগলে তা নেভানো এ ইউনিটের কাজ নয়। অভিযোগ আছে, সব সময় রানওয়েতে আগুনের ঘটনা না ঘটায় নিজস্ব এই ফায়ার ইউনিটের অধিকাংশ জনবল বিমানবন্দরের বিভিন্ন ডেস্কে কাজ করছেন।
এ কারণে আগুন লাগলেও অধিকাংশ সময় তাদের পাওয়া যায় না। এয়ারক্রাফটের আগুন নেভানোর কাজে এদের পর্যাপ্ত ট্রেনিং থাকলেও বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন নেভানোর কাজে তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই। তারপরও শুক্রবার পুরো রানওয়ে অরক্ষিত রেখে বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ সবগুলো ফায়ার ইউনিটকে টার্মিনালের আগুন নেভানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। এতে ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) নিয়ম ভঙ্গ করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। আইকাও’র নিয়ম হচ্ছে, যে কোনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে সংলগ্ন পর্যাপ্ত ফায়ার সার্ভিস ইউনিট (দমকল বাহিনী) থাকতে হবে। তারা সার্বক্ষণিক ওই এলাকায় অবস্থান নেবে। কিন্তু শুক্রবার রানওয়ে অরক্ষিত রেখে টার্মিনাল ভবনের আগুন নেভানোর কাজে পুরো টিম কাজে লাগানো হয়। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক একেএম শাকিল নেওয়াজ বলেন, কেপিআই (কি পয়েন্ট ইন্সটলেশন) বা বিশেষ নিরাপত্তা স্থাপনা হিসেবে শাহজালাল বিমানবন্দরের জন্য আলাদা ফায়ার সার্ভিস ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দমকল বাহিনী বেসামরিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার অবহিত করেছেন। একই সঙ্গে শাহজালাল বিমানবন্দরের বিভিন্ন স্থাপনায় আধুনিক অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র স্থাপনের জন্যও তারা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে মৌখিকভাবে জানিয়েছেন। কিন্তু বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক এয়ারলাইন্স মালিক জানান, একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যে ধরনের অগ্নিনির্বাপণী ব্যবস্থা ও সাজসরঞ্জাম থাকা বাধ্যতামূলক, তার কিছুই নেই শাহজালালে। বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, আগুন লাগলে জরুরি বের হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বহির্গমন দরজা বা ইমার্জেন্সি এক্সিট গেট নেই। ফায়ার এসেম্বলি পয়েন্ট নেই (যেখানে আগুন লাগলে দৌড়ে গিয়ে নিরাপদে আশ্রয় নেবে)। আধুনিক বিশ্বের অত্যাধুনিক অগ্নিনির্বাপণী কিটের নামই শোনেনি সিভিল এভিয়েশনের অনেক শীর্ষ কর্মকর্তা। জনবল ও প্রশিক্ষণের অভাব তো রয়েছেই। অনেক আগের কয়েকটি ফায়ার এস্টিংগুইশার ও হাইড্রেন মেশিন ছাড়া তেমন কিছু নেই। মূলত দুর্বল অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাপনার জন্যই শুক্রবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মূল টার্মিনালে তিনতলার একটি রুমে আগুন লাগে। যার ভয়াবহতা তেমন না হলেও আতঙ্কে বিমানবন্দরের সব ধরনের কাজ বন্ধ রাখতে হয় ৪ ঘণ্টা। আগুন লাগার দ্বিতীয় দিন শনিবার ঘটনাস্থল ও বিমানবন্দরের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। আইকাও আইনানুযায়ী এয়ারক্রাফটের আগুন নেভানোর পাশাপাশি (রানওয়ে ফায়ার ইউনিট) বিমানবন্দরের অন্যান্য স্থাপনার আগুন নেভানোর জন্যও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিজস্ব ফায়ার ইউনিট রাখতে হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শাহজালালের টার্মিনাল ভবনের জন্য নিজস্ব কোনো ফায়ার ইউনিট নেই। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত রানওয়ের ফায়ার ইউনিট দিয়েই এসব স্থাপনার আগুন নেভানোর কাজ চলছে। অনেক আগের তৈরি ওই ভবনে অগ্নিনির্বাপণের কোনো আধুনিক সরঞ্জামাদিও নেই। আধুনিক যন্ত্রপাতি বলতে একমাত্র স্মোক ডিটেক্টর রয়েছে শাহজালালের কয়েকটি ফ্লোরে। তাও পর্যাপ্ত নয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে আগুন নেভানোর কোনো সরঞ্জাম নেই। আইকাও আইনানুযায়ী যে কোনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বা যাত্রী অবস্থান করছেন এমন যে কোনো স্থাপনায় স্বয়ংক্রিয় আগুন নেভানোর যন্ত্রপাতি থাকতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্ট্রিংলার মেশিন। প্রতি ১০০ বর্গফুট এলাকায় কমপক্ষে ৪টি স্ট্রিংলার পয়েন্ট রাখার নিয়ম রয়েছে। তাপমাত্রা ৬৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে এসব স্ট্রিংলারের পয়েন্টে থাকা মোমজাতীয় প্লাস্টিক গলে গিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফায়ার ফাইটিং শুরু হবে। প্রতিটি পয়েন্টে পর্যাপ্ত পানি সংরক্ষিত রাখতে হয়।
কিন্তু শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কোনো টার্মিনাল ভবনেই এ ধরনের স্ট্রিংলার পয়েন্ট নেই। পুরনো যেসব যন্ত্রপাতি আছে সেগুলো পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত জনবলও নেই। অভিযোগ আছে, বিমানবন্দরেরর নিরাপত্তার জন্য ২৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে আনা যুক্তরাজ্যের রেডলাইন সিকিউরিটির দেয়া প্রশিক্ষিত অধিকাংশ জনবল শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে বদলি করা হয়েছে। এসব কারণে পুরো বিমানবন্দর এলাকা অরক্ষিত অবস্থায় আছে বলে অভিযোগ করেছেন বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের মালিকরা। এদিকে শুক্রবারের আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা শনিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তদন্ত সংস্থার একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, বড় আগুন নেভানোর জন্য শাহজালালের কোনো ফ্লোরে পর্যাপ্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি ছিল না। ঘটনাস্থলের আশপাশেও কোনো ধরনের ফায়ার এস্টিংগুইশার ও ফায়ার হাইড্রেন্ট মেশিন ছিল না। ঘটনার পরপর বিমানবন্দরের রানওয়েতে নিয়োজিত এয়ারক্রাফটের আগুন নেভানোর কাজে নিয়োজিত ফায়ার সার্ভিস ইউনিট এসে আগুন নেভায়। কোথায় আগুন লেগেছে এটা চিহ্নিত হওয়ার পরও কোনো এস্টিংগুইশার পুশ করা হয়নি। এয়ার ইন্ডিয়ার ওই রুমটি তালাবদ্ধ অবস্থায় ছিল। বিমানবন্দর এপিবিএনের (আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন) একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে ভবনটির দরজা ভেঙে ফেলে। এরপর ফায়ার সার্ভিসের লোকজন পানি ছিটিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। প্রাথমিকভাবে তারা জানতে পেরেছে ওই ভবনে থাকা কম্পিউটারের ইউপিএস (আন ইন্টারাপটেবল পাওয়ার সাপ্লাই) বিস্ফোরণ ঘটে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। শাহজালালের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কাজী ইকবাল করিম শনিবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, গোটা বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত সরঞ্জাম আছে তেমনটা বলা যাবে না। তবে মোটামুটি বলতে পারেন- আগুন লাগার পর প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে যা যা থাকা দরকার সেগুলো আছে। যেমন ২৫০টি ফায়ার এস্টিংগুইশার ও ২৭টি হাইড্রেন। এলার্মিং সিস্টেমও আছে। শুক্রবার এগুলো দিয়েই আগুন নেভানো হয়। প্রথমে বিমানবন্দরের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নিজস্ব সরঞ্জামাদি ব্যবহার করেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। তারপর ফায়ার সার্ভিসের টিম এসে সহযোগিতা করে। যদিও এখানে বড় ধরনের কোনো আগুন ছিল না। তারপরও সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় ত্বরিতগতিতে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করা হয়েছে বিমানবন্দরকে। এদিকে আগুন লাগার ঘটনা তদন্তে কাজ শুরু করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) গঠিত পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির প্রধান বেবিচকের পরিচালক (প্রশাসন) সাইফুল ইসলাম বলেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। আগুন কিভাবে লেগেছে তা জানার চেষ্টা চলছে। শুক্রবার দুপুরে বিমানবন্দরের আগুন বিকালে নিয়ন্ত্রণে আসার পর পাঁচ সদস্যের এই তদন্ত কমিটি গঠন করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। বেবিচক পরিচালক সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিটিতে সংস্থার সহকারী পরিচালক আবু সালেহ মো. খালেদ (অগ্নি), নির্বাহী প্রকৌশলী শাহরিয়ার মোর্শেদ, ডিজিএফআইয়ের প্রতিনিধি হাবিবুর রহমান ও এনএসআইয়ের প্রতিনিধি ননী গোপাল রয়েছেন। এ ঘটনার একদিন পর শনিবার বেবিচকের জনসংযোগ কর্মকর্তা একেএম রেজাউল করিম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ফায়ার কন্ট্রোল মনিটরের আগুনের সূত্র হিসেবে এয়ার ইন্ডিয়া অফিস চিহ্নিত হয়। আগুনে এয়ার ইন্ডিয়া ও পাশের কাতার এয়ারওয়েজের অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে দুটি এয়ারলাইনসের কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্ন রাখতে বিমানবন্দরে সাময়িক ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিমানবন্দরে আগুনের জন্য প্রায় তিন ঘণ্টা বহির্গমন কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এতে অন্তত দেড় ডজন আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বিলম্বিত হয়। তবে ওই সময়ে বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণে কোনো বিঘ্ন ঘটেনি।
No comments