বাচ্চু চেয়ারম্যানের টেলিফোনেই ঋণ
রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা থেকে শর্তভঙ্গ করে ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা চলে গেছে ঋণগ্রহীতার পকেটে। এ ক্ষেত্রে শুধু ব্যাংকের চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর মৌখিক নির্দেশই যথেষ্ট ছিল। কখনও কখনও তিনি টেলিফোন করেও ঋণ ছাড় করার নির্দেশ দিতেন। এ ক্ষেত্রে নিয়ম কানুনের কোনো তোয়াক্কা করা হয়নি। কারও বাধাও তিনি মানতেন না। শুনতেন না কারও ওজর-আপত্তি। এমনকি ঋণ-প্রস্তাব না থাকলেও ঋণ দেয়ার জন্য আগাম বলে দেয়া হতো। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঋণ প্রস্তাব থাকলেও তা ছিল ভুলেভরা ও ত্রুটিপূর্ণ। সংশ্লিষ্ট শাখার দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের ঋণ যাচাই কমিটি নেতিবাচক মতামত দিলেও তা আমলে নেয়া হতো না। মূলত পরিচালনা পর্ষদ ঋণ দেয়ার নামে যা ইচ্ছে তাই করেছে। কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে নিজস্ব লোকজনকেও ঋণ দিয়েছে। আত্মীয়স্বজন ছাড়াও বেশিরভাগ ঋণগ্রহীতা ছিল কমিশন দেয়া পার্টি। অর্থাৎ পরিচালনা পর্ষদকে নগদ কমিশন দিয়ে তথাকথিত ঋণগ্রহীতারা যথেচ্ছ ঋণ নিয়েছেন। এভাবেই সরকারি বেসিক ব্যাংকে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার অর্থ লুণ্ঠনের মহোৎসব ঘটে। আর ঋণের নামে অর্থলুটের এসব ঘটনা ঘটে ২০০৯, ১০, ১১ ও ২০১২ সালে। ওই সময় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। এদিকে ব্যাংকটি বাঁচাতে ইতিমধ্যে জনগণের করের টাকা থেকে কয়েক দফায় সরকার মূলধন জোগান দিয়েছে। যার পরিমাণ ৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে বেসিক ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের মার্চে তা দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। চার বছর তিন মাসে ব্যাংকটি ৬ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা ঋণ দেয়, যার প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকাই নিয়মভঙ্গ করে দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আসলে এসব বিষয় পর্যালোচনা করলে বলতে হবে- বেসিক ব্যাংকে ঋণ বিতরণ করা হয়নি; সরাসরি জনগণের অর্থ লুটপাট করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, বেসিক ব্যাংকে কোনো ঋণ বিতরণ করা হয়নি; জোরপূর্বক তহবিল আত্মসাৎ করা হয়েছে। কারণ টাকা বের করে নেয়ার সময় ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক ও ঋণ যাচাই-বাছাই কমিটির সমর্থন ছিল না। অবশেষে সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুসহ পরিচালনা পর্ষদকে তদন্তের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উচিত হবে পর্ষদকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা। সূত্র বলছে, রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকে অর্থ লুণ্ঠনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুস্পষ্ট ১৬টি পর্যবেক্ষণ রয়েছে। এগুলো হল- স্বামী এবং স্ত্রীকে আলাদাভাবে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে সুকৌশলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিত বড় ঋণসীমা লঙ্ঘন করেছে বেসিক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। খেলাপি ঠেকাতে একের পর এক অনৈতিকভাবে ঋণের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। যদিও সেখানে কোনো ব্যবসায়িক লেনদেন ছিল না। ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা, প্রয়োজনীয়তা, ব্যবসায়িক লেনদেন ও পর্যাপ্ত জামানত ছাড়াই ঋণ দেয়া হয়েছে। এসব ঋণ-প্রস্তাবে সংশ্লিষ্ট শাখা ও হেড অফিস ক্রেডিট কমিটির নেতিবাচক মন্তব্য থাকার পরও পরিচালনা পর্ষদ গায়ের জোরে ঋণ দিয়েছে। এ বিষয়ে শাখার প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশ্ন ছিল- আপত্তি থাকা সত্ত্বেও কেন ঋণ ছাড় করা হয়েছে? জবাবে সংশ্লিষ্ট শাখা ব্যবস্থাপক জানান, ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মৌখিক ও টেলিফোনিক নির্দেশে ঋণ অনুমোদনপত্রের শর্ত পূরণ ছাড়াই অর্থ ছাড় করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংকের পরিচালকের বিশেষ বিবেচনায় দেয়া ঋণের বিপরীতে জামানতকে অতিমূল্যায়িত করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা বাজারমূল্য অপেক্ষা ৩০-৪৫ গুণ বেশি মূল্য ধরা হয়। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে জমির মালিকানা ছাড়াই ব্যাংকের কাছে অন্যের জমি বন্ধক রাখা হয়েছে। এতে বোঝা যায়, ব্যাংক ঋণগ্রহীতাকে ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণের অর্থ অন্য খাতে ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে। জামানতের জমির মালিক নিশ্চিত না করে শুধু বায়নার ওপর ভিত্তি করে ঋণ অনুমোদন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রাহকের ইচ্ছামাফিক ঋণের জামানত পরিবর্তন করা হয়েছে। ঋণ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঋণের টাকা ব্যবসায় ব্যবহার না করে স্বল্পমূল্যের জমি কেনা হয়েছে। এসব জমি আবার জামানত দেখিয়ে ঋণের নামে বিপুল অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে আরও ভয়াবহ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ঋণের জামানত হিসেবে গৃহীত অধিকাংশ জমির মালিকানা কাগজে-কলমে দেখানো হয়েছে। বাস্তবে যার অস্তিত্ব নেই।
এ ছাড়া বেসিক ব্যাংকের সে সময়ের অধিকাংশ খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করে নন-খেলাপি দেখানো হয়েছে। অপরদিকে গ্রাহকের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছাড়াই ঋণ প্রদান, ক্রেডিট ইনফর্মেশন ব্যুরোর (সিআইবি) তথ্য পাওয়ার আগে ঋণ প্রদান এমনকি সিআইবিতে খেলাপি থাকা সত্ত্বেও নতুন করে ঋণ দেয়া হয়েছে। নিজের খেয়াল-খুশিমতো গ্রাহকদের টিওডি (টেম্পোরারি ওভার ড্রাফট) দিয়েছেন শাখা ব্যবস্থাপক। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তিকে নির্ধারিত প্রাপ্যের চেয়ে সাময়িক অতিরিক্ত অর্থ প্রদান। সাধারণত এ ধরনের ঋণ দেয়া হয় পরীক্ষিত, বিশ্বস্ত ও পুরনো গ্রাহকদের। এ ক্ষেত্রে নতুন গ্রাহক বড় অঙ্কের টিওডি ঋণ সুবিধা পাওয়ার বিষয়টিকে খুবই সন্দেহজনক হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গ্রাহকের বিপুল পরিমাণ ঋণ বকেয়া এবং ব্যবসায়িক লেনদেন না থাকার বিষয়টি শাখা থেকে বিস্তারিত জানানোর পরও পরিচালনা পর্ষদ তা আমলে নেয়নি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ঋণ আবেদনের পর গ্রাহক ব্যাংকে হিসাব খুলেছেন এবং হিসাব খোলার স্বল্প সময়ের মধ্যে তাকে বড় অঙ্কের ঋণ দেয়া হয়েছে। এ সময় ৭০-৮০ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ব্যবসা ও আবাসনের মতো অনুৎপাদনশীল খাতে। এসব ঋণ বিতরণে হেড অফিস ক্রেডিট কমিটির আপত্তি ছিল। কিন্তু পরিচালনা পর্ষদ স্বেচ্ছাচারিতা ও নিয়মবহির্ভূতভাবে এসব ঋণ দিয়েছে। এ ছাড়া পর্ষদ নিজস্ব দায়িত্ব থেকে পুরোপরি দূরে ছিল, বরং কাকে কত টাকা ঋণ দেবে, কিভাবে দেবে এবং সেসব ঋণের খেলাপি ঠেকাতে মেয়াদ বাড়ানোসহ যাবতীয় কাজে ব্যস্ত ছিল পরিচালনা পর্ষদ। এতে ব্যাংকটি সার্বিকভাবে গুরুতর এক ঋণঝুঁকির মধ্যে পড়েছে বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া ব্যাংক শাখা চত্বরের জন্য আগাম ও অস্বাভাবিক ভাড়া প্রদান করার মাধ্যমে বিপুল অর্থ অপচয় করা হয়। এদিকে বেসিক ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে। গত এক বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ও হার উভয়ই বেড়েছে। কিন্তু আদায় কমে গেছে। মূলধন ঘাটতি মেটাতে কয়েক দফায় বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান দিয়েও ব্যাংকটির পতন থামানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৬ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬৩৮ কোটি টাকা, যা শতকরা হিসাবে প্রায় ৫৩ ভাগ। এ ছাড়া গত তিন মাসেই (এপ্রিল-জুন) ব্যাংকটি খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে ২১৩ কোটি টাকা। কিন্তু অবলোপনকৃত ঋণের বিপরীতে এক টাকাও আদায় হয়নি। আর তিন মাসে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ২৯১ কোটি টাকা।
কিন্তু আদায়ের হার আগের মতো বাড়েনি। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত তিন মাসে খেলাপি ঋণ আদায় হয়েছে মাত্র ৬০ কোটি টাকা, আর নিয়মিত ঋণ আদায় হয়েছে ৭৮৭ কোটি টাকা। জানতে চাইলে বেসিক ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান আলাউদ্দীন এ মজিদ যুগান্তরকে বলেন, ঋণ আদায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে অনেক গ্রাহককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ তারা ভয়ে পালিয়ে গেছেন। প্রসঙ্গত, নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর ব্যাংকিং খাতে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক নিয়োগ দেয়া শুরু হয়। একই বছরের সেপ্টেম্বরে শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে তিন বছরের জন্য বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে তার নিয়োগ নবায়ন করা হয়। তিনি চেয়ারম্যান থাকাকালে ব্যাংকটিতে ব্যাপক আর্থিক অনিয়ম করেন। চেয়ারম্যানসহ বিভিন্নজনের বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বেসিকের আর্থিক কেলেঙ্কারি প্রকাশ হয় ২০১৩ সালে। জালিয়াতির অভিযোগে ব্যাংকটির ৫৬ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে দুদকের তদন্তে এখন পর্যন্ত বাচ্চুকে দায়ী করা হয়নি। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান, অপ্রতুল জামানতের বিপরীতে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ঋণ দেয়ার জন্য চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকেই দায়ী করা হয়েছে।
No comments