ঈদ স্মৃতির রকমফের by নূরে আলম সিদ্দিকী
আমাদের
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সর্বাধিক প্রসিদ্ধি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন
তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটির মাধ্যমে। ‘মানুষ’ কবিতাটির মধ্যেও লোভী মোল্লাদের
প্রতি তাঁর প্রচণ্ড প্রতিবাদ শুধু তাঁর চির উদ্বেলিত হৃদয়ের সমুদ্রের
উর্মিমালায় উচ্ছ্বসিত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয়, তার অনাবিল অনবদ্য স্নিগ্ধ
মর্মস্পর্শী মানবতার প্রতি অদম্য ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
তাঁর অসংখ্য কালজয়ী প্রেমের বন্দনাকে বাংলা সাহিত্যের সকল কবি এমনকি রবীন্দ্রনাথও বিমুগ্ধ চিত্তে প্রশংসা করেছেন। প্রেমের আকুতিকে অনবদ্য ভাষায় প্রতিভাত করার আত্মতৃপ্তিতেই তিনি নিঃসংকোচে বলতে পেরেছিলেন, “আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দিব না ভুলিতে”।
আমি এখানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের উপর নিবন্ধের সূচনা করছি না। বরং তার অনেক অনবদ্য ও অতুলনীয় মর্মস্পর্শী পঙ্ক্তির মধ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের নানা ভিন্ন ভিন্ন মতের হৃদয়কে স্পর্শ করে যায়, এমন একটি উদ্ধৃতি প্রদান করার জন্যই এই উপক্রমণিকা।
ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে আঘাত, প্রত্যাঘাত, বিদ্রূপ, বিক্ষোভ, অযাচিত এবং অসংগত সমালোচনার নির্মম ও নিষ্ঠুর শিকার মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে তার ছোট্ট একটি পঙ্ক্তি সকলের মনে এমন অনুভূতি ও আকুতি সৃষ্টি করে যে, গান ও কাব্যের জগতে এটি অনন্যসাধারণ ও বিরল। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকল মুসলমানের হৃদয়কে উচ্ছ্বসিত করে উচ্চকিত করে “রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ”। পশ্চিম দিগন্তের বুক চিরে রমজানের শেষে সোনার থালার একটি কণার মতো যখন ঈদের চাঁদের সামান্য আভাও দেখা যায়, তখন সবার মনই গুনগুন করে গেয়ে ওঠে; যা তুলনাবিহীন। শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেরই হৃদয়ে নিজের জ্ঞাতে অজ্ঞাতে পঙ্ক্তিটি মুর্ছিত হতে থাকে আপন মহিমায়।
ঈদের কথা বলতে হলে এতটুকু উপক্রমণিকা কোনোভাবেই এড়ানো যায় না। বিস্তীর্ণ জ্ঞানের পরিধি থাকলে অনেক ভাষা হতে বিশেষ করে ফারসি ভাষার পঙ্ক্তির উদ্ধৃতি দিতে পারতাম।
প্রতিটি মানুষের মতো আমারও জীবনে শৈশব থেকে শুরু করে জীবন সায়াহ্ন পর্যন্ত ৭৩/৭৪টি শুধু রোজার ঈদ এসেছে। একইভাবে কোরবানিরও। আমি বিস্ময়াভিভূত হয়ে উপলদ্ধি করি, বয়সের তারতম্যে ঈদ বা কোরবানির আনন্দে কোনো মারাত্মক ব্যতিক্রম বা ব্যত্যয় আমি অন্তত অনুভব করি না (মুক্তিযুদ্ধকালীন একটি ব্যতিক্রম বাদে)। জীবনের প্রতিটি ঈদ ও কোরবানি আমার জীবনকে আনন্দিত করেছে, উদ্বেলিত করেছে, উচ্ছ্বসিত করেছে। এমনকি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য একটা মমত্ববোধ ও ভালোবাসার উন্মেষ ঘটিয়েছে। এই জীবন সায়াহ্নে সুদূর অতীত আমার শৈশবের দিকে যদি তাকাই, সেখানেও আনন্দের অজস্র ও অফুরন্ত স্মৃতি এখনও আমাকে রোমাঞ্চিত করে, বিমোহিত করে, বিমুগ্ধ করে। সচ্ছল ও সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মের সুবাদে কোনো ঈদেই আমাকে কোনো না পাওয়ার বেদনায় হৃদয়কে এতটুকু ভারাক্রান্ত করেনি। অনেক আত্মীয়-স্বজন। তাদের কাছ থেকে জামা-কাপড়, জুতা, খেলনাসহ অফুরন্ত উপহার পেয়েছি। যতই উপহার পেতাম, সেগুলোকে আমার বিছানায় সাজিয়ে রাখতাম। আমার মা মুচকি হেসে বলতেন, উপহারেই বিছানা ভরিয়ে ফেললে শোবে কোথায়? বাবাও খুব খুশি হতেন আমার উচ্ছ্বাস অনুধাবন করে। বলতেন, ওর উপহারগুলো বিছানাতেই ঘুমাক, ও না হয় আমাদের বিছানায় ঘুমাবে।
কিন্তু মজার কথা হলো, উপহারগুলো তো পরতে হবে! নামাজের কিছু আগে ছাড়া ঈদের কাপড় মা পরতে দিতেন না। তারপরে যখন যেটা পরার অবাধ স্বাধীনতা। মনে হতো একেকটা মিনিট যেন একেকটা ঘণ্টা। ঈদের দিন অনেক ভোরেই ঘুম ভেঙে যেত। তখনও বাড়ির চারপাশে বিভিন্ন পাখির কলরব শুরু হতো না। সেই বয়সেও বুঝতাম, প্রভাত হতে এখনও বাকি। কিন্তু কী করবো? ঘুম তো আসে না ! আবেগ-উচ্ছ্বাসে ভরা মন সুনিবিড় আকাঙ্ক্ষায় অপেক্ষা করতো- সূর্য উঠুক। তখন থেকেই না শুরু হবে ঈদের জামাতের প্রস্তুতি নেয়া। সচ্ছল ও সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান হিসেবে সুগন্ধী সাবান থেকে শুরু করে বিলাসী উপকরণের কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু এই বয়সে এসেও অস্বীকার করবো না, আমার শৈশবের ঈদ বন্ধুদের সঙ্গে কোলাকুলি, নামাজ আদায়, অস্থির চিত্তে অপেক্ষা করা কখন খুৎবা ও মোনাজাত শেষ হবে। পূর্ণ স্বাধীনতায় বয়োজ্যেষ্ঠদের সালাম ও বন্ধুদের সঙ্গে কোলাকুলি করবো। আমার শৈশবের বন্ধুরা প্রায় সকলেই আমাদের বাসায় আসতো। আমার স্নেহশীলা মমতাময়ী মা নিজের সন্তানের মতোই সকলকেই ঈদের জন্য নিজ হাতে তৈরি করা সকল ধরনের মিষ্টান্ন সকলকেই খেতে দিতেন। এবং মজার বিষয় হলো, বন্ধুদের যাদের বাসায় যা কিছুই মিষ্টান্ন হোক না কেন, আমার মায়ের হাতে তৈরি মিষ্টান্ন না খেলে যেন তাদের ঈদ সম্পূর্ণই হতো না। অন্যদিকে বন্ধুদের কেউ একজন অনুপস্থিত থাকলে মায়ের চোখ এড়াতো না। তার কথা আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করতেন। বন্ধুদের নিয়ে খাচ্ছি, খেলছি, দৌড়াদৌড়ি করছি; এরমধ্যে অনুপস্থিত বন্ধুদের ব্যাপারে বারবার প্রশ্ন করায় বিরক্তই লাগতো। মা তো মা-ই।
নতুন কাপড় বা ঈদের অন্যান্য প্রসাধনী মাও অফুরন্ত পেতেন। কিন্তু সেগুলো ব্যবহারের সুযোগ আসতো কম। আপ্যায়নের মাধ্যমে তিনি যে অবর্ণনীয় আনন্দলাভ করতেন, তার চোখ-মুখ খুশিতে জ্বলজ্বল করতো, তা আজও আমার স্মৃতিতে ভাসে। আমি আবারও বলি, সকলের মা-ই মা। কিন্তু আমার মাকে সবসময়ই আমার মনে হতো- তিনি অনন্যা, তিনি অসাধারণ। এই বিশাল জগত জুড়ে আমার মা এমন একজন স্নেহশীলা আবেগাপ্লুত জননী, যার কোন তুলনা নাই। ঈদের দিনে যে বিরাট ধকল, তাতে তার কোন ক্লান্তি কখনোই আমার চোখে পড়ে নাই।
আমাদের পরিবারটি ঠিক যৌথ না হলেও কার্যত আমার চাচাতো ফুফাতো খালাতো ভাই-বোনরা আমার মায়ের খুব কোল-নেওটা ছিল। সন্তান-সম্পর্কিত প্রায় সকলেই মাকে কেউ মা, কেউ আম্মা, কেউ মা-জান বলে ডাকতো। যদিও আমরা দুই সহোদর (এক ভাই, এক বোন) ভাইবোন ছিলাম। আমার মেজো খালা বা চাচী (আব্বা ও চাচা আপন দুই ভাই আম্মা ও খালা আপন দুই বোনের সাথে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আমি শতভাগ নিশ্চিত এটা পারিবারিক প্রস্তাবনায় সংঘটিত হয়েছিল।) মা’কে সকলেই যখন মা বলে ডাকতো, তিনি খুবই ক্ষুব্ধ হয়ে যেতেন। ক্রুদ্ধ হয়ে মাকে ভর্ৎসনা করে বলতেন, তুই কি নিঃসন্তান, বাঁজা? এত রুদ্রমূর্তিতে তীব্র বকাবকি করতেন যে, মা চুপসে যেতেন, ভয়ও পেতেন। কিন্তু নিতান্ত নির্বিকার ও নিশ্চুপ থাকতেন। আমাদের ওই সমস্ত আত্মীয়রা এমনিতে কেউ না কেউ আমাদের বাসায় অনুষ্ঠান ছাড়াই খেতেন। মায়ের হাতের রান্না না খেলে তারা নিতান্তই অতৃপ্ত থাকতেন বলে আমি তাদের মুখেই শুনেছি। এতে আমার অনাগ্রহ ছিল না, কারণ একসঙ্গে বসে বেশ ক’জন মিলে খেতে এমনিতেই ভালো লাগে। পুকুরের রুইমাছের মাথাটি বা বিশেষ পছন্দনীয় মাছটি মা কখনোই আমার পাতে তুলে দেননি। কিন্তু সৌভাগ্য আমার! যার পাতেই তুলে দিতেন, তিনিই ওটা আমাকে দিয়ে দিতেন এবং বাবা ও মা কেউ তাতে আর আপত্তি তুলতেন না। যৌথ পরিবার না হলেও ঈদ ছাড়াও দৈনন্দিন খাওয়াটা অনেকটা যৌথ পরিবেশেই হতো। সাংসারিক সচ্ছলতার কারণে এটা বোধহয় সকলকেই শান্তি, স্বস্তি ও আনন্দ দিতো। এই নিত্য-নৈমিত্তিক স্বাভাবিকতার মধ্যে ঈদের ব্যাপারটা যে আমাদের বাসাই মোটামুটি কেন্দ্রবিন্দু ছিল, এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মাতৃকূল অর্থাৎ আমার খালা-মামারা আমাদের বসতি থেকে অনেক দূরে থাকতেন। তাই ঈদের দিনে চাচাতো ভাই-বোনদের সমাগমই বাসাটাকেমুখর করে রাখতো। অবশ্য কখনো কখনো খালাতে মামাতো ভাইবোনরাও ঈদ করতে আমাদের এখানে আসতো। সেই সাবলীল এবং অকৃত্রিম আনন্দঘন পরিবেশের ঈদ আমাকে আজও রোমাঞ্চিত করে, বিমোহিত করে, বিমুগ্ধ করে। শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের সোপানে যখন পা রাখলাম, পড়াশোনার জন্য আমাকে ঢাকায় চলে আসতে হলো। কিন্তু ঈদের সময় ঢাকায় থাকা আমার জন্য ছিল শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাবার মতো অবস্থা। কখনোই তা করিনি। ঈদে বাড়ি যেতেই হতো। ৫০ দশকের ৫৮/৫৯ সাল থেকে প্রায় স্বাধীনতা পর্যন্ত আমাদের ওখানে (ঝিনাইদহ থেকে ঢাকায় আসার) রাস্তা সুগম ছিল না। অথচ ঝিনাইদহ থেকে কোলকাতায় মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টায় যাওয়া যেতো। ৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের আগে ভিসা পাসপোর্টেরও বালাই ছিল না। ঢাকা থেকে ঝিনাইদহ যেতে হলে ফুলবাড়িয়া স্টেশন থেকে প্রায় ২৩/২৪ ঘণ্টায় চুয়াডাঙ্গা হয়ে যেতে হতো। আমার জীবনের অন্যতম শখ বা বিলাসিতা ট্রেন বা প্লেনের উচ্চতর শ্রেণিতে ভ্রমণ করা। তাই টিফিনের খরচ বাঁচিয়ে হলেও আগে থেকেই ট্রেনের প্রথম শ্রেণির টিকেট কেটে রাখতাম। বলতে সংকোচ নেই, কোনভাবেই প্রথম শ্রেণির দরজাও ঈদের সময় আটকে রাখা যেত না। অসংখ্য যাত্রী প্রথম শ্রেণিতে দরজা খুলে ঢুকে যেত। পুলিশও যেন নির্বিকার থাকতো। তবে এটুকু সৌজন্যবোধ থাকতো যে টিকেট কাটা যাত্রীদের তারা বসার সুযোগ দিতো। আর বাকি পুরো কামরাটি একদম যাত্রীতে ঠাসা, তিলধারণের ঠাঁইও থাকতো না। যাত্রাপথে বাহাদুরাবাদ-সিরাজগঞ্জে ফেরি পারাপার; একটি অদ্ভুত সুন্দর বিলাসবহুল ফেরি। যখন ফেরিতে উঠতাম, তখন সমস্ত অন্তরটা আনন্দে, উচ্ছ্বলতায় ভরে যেত। ওখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে সাধারণ যাত্রীরা ঢুকতেই পারতো না। সিরাজগঞ্জ থেকে ঈশ্বরদী হয়ে চুয়াডাঙ্গায় গিয়ে আমাদের নামতে হতো। চুয়াডাঙ্গায় নামতাম রাত ৯টা/১০টার দিকে। অনেক সময় ঝিনাইদহগামী শেষ বাসটি ছেড়ে দিতো। চুয়াডাঙ্গা স্টেশনে উচ্চশ্রেণির যাত্রীদের বিশ্রামাগারটি ছিল সুসজ্জিত ও মার্জিত। শোয়ার জন্য কোন খাট না থাকলেও কাঠ ও বেতের তৈরি অতি উচ্চমানের ইজি চেয়ার এতই সুন্দর ছিল যে, ঘুমাতে কোনো অসুবিধা হতো না। আমি দু’-একবার সকালের প্রথম বাসটি ধরতে পারিনি। এটি উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, আব্বা এসে অপেক্ষা করতেন ঝিনাইদহের বাসস্টপেজে। প্রতি ঘণ্টায় চুয়াডাঙ্গা থেকে ঝিনাইদহে বাস যেতো। এখন ভাবতে ভীষণ কষ্ট লাগে, ওই এক ঘণ্টা আব্বা কী উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটাতেন। আবার এটি ভাবতে ভালো লাগে যে, ভাগ্যিস, তখন মোবাইল ফোন ছিল না! থাকলে মায়ের কী দশাটাই না হতো!
কলেজে থাকা অবস্থা থেকে শুরু করে ’৬৯ সাল পর্যন্ত আমার বেশ কয়েকটি ঈদ কেটেছে কারাগারের অভ্যন্তরে। ৬৬-এর পর থেকে রাজবন্দী হিসেবেই জেল খেটেছি। আমার একটি ঈদের কথা মনে পড়ে। তখন আমি হাজতী। মামলায় জামিন না দিয়ে ওই কয়দিন আমাকে জেল খাটিয়ে একটা বিদ্বেষপ্রসূত আনন্দ (স্যাডিজম) পেতেন ম্যাজিস্ট্রেটদের কেউ কেউ। এ ব্যাপারে ঘাগু ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট মরহুম আফসার উদ্দিন। আল্লাহ্ তাকে বেহেশ্ত নসীব করুন। এটা অপ্রাসঙ্গিক কি না জানি না, আমাদের যেকোনো মামলায় ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে এসে দাঁড়াতেন তখনকার দিনে প্রথিতযশা ব্যারিস্টার ও এডভোকেটগণ। সর্বজনাব আতাউর রহমান খান (প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী), জহিরউদ্দিন (প্রাক্তন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী), সালাম খান, শাহ্ আজিজুর রহমানসহ অনেকেই। তখন হাইকোর্টে যারা আইনজীবী হিসেবে শুধু প্রসিদ্ধই নন, আইন ব্যবসাও যাদের রমরমা। তারাও একটা অনবদ্য আকর্ষণে এসে ম্যাজিস্ট্রেটের বারান্দায় ভিড় জমাতেন। আমার অনুভূতি আজও শিহরিত হয়, রাজনীতির সেই রোমাঞ্চিত ত্যাগের মহিমায় ভরপুর দিনগুলি কি আবার কখনো অবক্ষয়ের অতলান্তে অবলুপ্ত ক্ষয়িষ্ণু সমাজব্যবস্থায় মৌলিক অধিকার-বিবর্জিত একনায়কতান্ত্রিকতায় আচ্ছাদিত এই বাংলাদেশে ফিরে আসবে?
সেবার হাজতী হিসেবে কারাগারে গেলেও আমাকে জেল হাসপাতালে রাখা হয়। যারা নিরাপত্তা বন্দি নন, অথচ রাজনৈতিক কর্মী, তাদের জন্য এ ব্যবস্থাটি আকাশছোঁয়া পরিতৃপ্তির। যতদূর মনে পড়ে, জেলের অভ্যন্তরে হাসপাতাল চত্বরেই ঈদের জামাত হতো। সেটিও একটি অদ্ভুত অনুভূতির ঈদ। সেই ঈদে মুজিব ভাই কারারুদ্ধ ছিলেন না। কিছু শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক ব্যক্তিত্ব, যাদের সকলেই নন-মুসলিম, তারা ভালো কাপড়- চোপড় পরে কারা অভ্যন্তরে ঈদ চত্বরে আসতেন সবার সঙ্গে মেলামেশার উদগ্র আকাঙ্ক্ষায়। আমার বন্ধু বদিউজ্জামান ঈদের জন্য পায়জামা-পাঞ্জাবী রেখে গিয়েছিল। ঘাটতি, কমতি, বেদনা, ক্লান্তি কোনোকিছুই বোধ করিনি। আর খাওয়া-দাওয়া? আব্বা টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি করে জেলখানার গেটে খাবার নিয়ে আসতেন। ডেপুটি জেলারের রুমে তার সঙ্গে কী হাজতী, কী রাজবন্দী- সকল অবস্থাতেই দেখা করার সুযোগ পেতাম। আওয়ামী লীগের জন্ম থেকেই আমার বাবা প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম। মুজিব ভাইও তাঁকে সম্মান করতেন। মুজিব ভাইয়ের কারাগারের রোজনামচা বইয়ে এ ইঙ্গিত রয়েছে। আমার কিছু অন্তরঙ্গ বন্ধু, তারাও কিছু না কিছু নিয়ে দেখা করতে আসতো। ঈদের দিনে জেল কর্তৃপক্ষও অনেকটা ঢিলেঢালা থাকতো। এখানে ওখানে যাতায়াত অবারিত না হলেও নিয়মকানুন অনেকটা শিথিল ছিল। ঈদের নামাজের শেষে সবারই সবার সঙ্গে কোলাকুলি করার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা পরিলক্ষিত হতো। এটা একটা বিচিত্র ধরনের অনুভূতি ও আবেগতাড়িত নিষ্কলুষ আনন্দ। ৬৬ সালে ৬ দফা প্রদানের পর জুনে কারারুদ্ধ হই রাজবন্দী হিসেবে। তখন রাজনীতিকদের তত্ত্বাবধানে ছিলেন ডেপুটি জেলার তোফাজ্জল হোসেন সাহেব। ভদ্রলোকের বাড়ি রাজশাহীতে। তিনি খুব কুশলী ও বুদ্ধিমান ছিলেন। চাকরি রক্ষার সমস্ত শর্ত পালন করেও তিনি রাজবন্দীদের সঙ্গে একটা সখ্য বজায় রাখতেন। মুজিব ভাইকেও ভীষণ শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন। এবং শুধু তাঁর কেন, তখনকার জেল কর্তৃপক্ষের প্রধান পরিদর্শক থেকে শুরু করে কারাগারের সকল কর্মকর্তারই বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, মুজিব ভাই পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসবেনই। ৬ দফা প্রদানের পর বঙ্গবন্ধু কারাগারের যে কক্ষটিতে অবস্থান করতেন, তখন কক্ষটির নাম ছিল ‘দেওয়ানী’। কারা অভ্যন্তরে অনেকগুলো ঈদ ও কোরবানিতে আমি অংশগ্রহণের সুযোগ পাই। ঈদের দিনে অন্যান্য জায়গায় অবরুদ্ধ রাজবন্দীরা অতি উৎসাহ-উদ্দীপনা, হৃদয়ের উচ্ছ্বাস ও উদ্বেলতা নিয়ে ঈদের জামাতে আসতেন। তাদের উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় থাকতো, শুধুই কোলাকুলি নয়, মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে রাজনৈতিক শলা-পরামর্শ ও তাঁর সিদ্ধান্ত সরাসরি জানা। আমি মুজিব ভাইয়ের অতি সন্নিকটে থাকতাম বলে এই শলাপরামর্শে তেমন কোন আগ্রহ বোধ করতাম না। কিন্তু অন্যান্য সেল ও ওয়ার্ডে থাকা রাজবন্দীদের সঙ্গে কোলাকুলি, কথাবার্তা ও মেলামেশায় যে কী অদ্ভুত আনন্দ পেতাম, তা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। প্রথিতযশা লেখক হলে হয়তো পারতাম। কারাগারের অভ্যন্তরের ঈদের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, রাজবন্দীদের তরফ থেকে সকল সাধারণ কয়েদিদের জন্য বিশেষ খাদ্য পরিবেশন করা হতো। বলতে বাধা নেই, জেল কর্তৃপক্ষের এখানে একটা অকৃত্রিম সহযোগিতা ও সাহায্য থাকতো। রাজবন্দীদের তত্ত্বাবধানে প্রস্তুত করা খাবার সাধারণ হাজতী ও কয়েদিদের যার যার ওয়ার্ডে ও সেলে পাঠিয়ে দেয়া হতো। কয়েদি ও হাজতীরা ঈদে ও কোরবানিতে এই সুস্বাদু খাবার খুবই পরিতৃপ্তির সঙ্গে খেতো এবং তারা প্রতিটি রাজবন্দীকেই বয়স, রাজনৈতিক পরিচয়, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ভীষণভাবে বিনম্র চিত্তে শ্রদ্ধা করতো। ভাবীও ঈদের দিনে প্রচুর খাবার পাঠাতেন। মানিক ভাইয়ের তরফ থেকেও ঈদের দিন জেলখানায় খাবার আসতো। আমার বাবাসহ অনেক রাজবন্দীর পরিবারবর্গের কাছ থেকেও প্রচুর খাবার আসতো। রাজবন্দীদের যিনি প্রতিনিধি ছিলেন, বাইরে থেকে আগত খাদ্যসামগ্রী রাজবন্দীদের বিভিন্ন সেলে ফালতু, পাহারা ও মেটদের জন্য পাঠিয়ে দিতেন। ডিআইজি, জেল সুপার, জেলার, ডেপুটি জেলারসহ কারাগারের প্রায় সকলেই হয় ঈদের জামাতে নতুবা বিভিন্ন স্থানে মুজিব ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করা অনেকটা অবধারিত ছিল। জেলখানার একটি ঈদ আমার জন্য বেদনাদায়ক, মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ছিল। কারণ তার দুই-তিনমাস আগে আমি কারারুদ্ধ অবস্থায় আমার মায়ের মৃত্যু ঘটে এবং কোনভাবেই মৃত্যুশয্যায় শায়িত মাকে দেখার বা পরে মৃত মাকে দাফন করার জন্য শত চেষ্টা সত্ত্বেও আমাকে কোন পেরোল দেয়া হয়নি। সম্ভবত ওই ঈদের জামাতে আমি যাইনি। শৈশব, কৈশোর ও যৌবনে আমার মমতাময়ী মা’কে ঘিরে বিজড়িত স্মৃতি আমার হৃদয়কে প্রচণ্ডভাবে ভারাক্রান্ত করে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আরেকটি ঈদে আমি নামাজ তো পড়ি-ই নাই (আল্লাহ্ আমার গুনাহ মাফ করুন), বরং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আমি একটি প্রচণ্ড উত্তেজক বক্তৃতা করে বলেছিলাম- ঈদের চাঁদ, তুমি আকাশের বক্ষ বিদীর্ণ করে বাংলাদেশে উদিত হয়ো না। আমার ধর্ষিতা বোনের বুক নিংড়ানো আর্তনাদ তোমাকে ধিক্কার দেবে, সন্তান হারানো মায়ের বুকফাঁটা আর্তনাদ তুমি সহ্য করতে পারবে না। কোথায় দাঁড়াবে ঈদের জামাত? বাংলার মাটির সর্বত্রই তো রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। এখানে খুশির জামাত দাঁড়ানোর কোনো অবকাশ নাই। আমার আবেগ, আমার উচ্ছ্বাস, আমার ক্ষোভ, আমার ক্রোধ আমাকে এতখানি আচ্ছন্ন করে যে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ভাষণে আমি তরুণ প্রজন্মকে ঈদের জামাতে অংশ না নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলাম (আবার আমি মহান আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা চাইছি)।
আজ আমি জীবন সায়াহ্নে উপনীত। আমার একমাত্র গুণের দিক থেকে বিবেচনা করলে আমি আজ পঞ্চম প্রজন্মের সিঁড়িতে। আমার নিজের দৌহিত্র-দৌহিত্রী রয়েছে। এবারের ঈদে আমাকে সালামী দেওয়ার মতো কেউ নাই। বরং সালাম করলে প্রায় সকলকেই আমার সালামী দিতে হবে। এটাও ভিন্ন ধরনের আনন্দ; বিচিত্র ধরনের আস্বাদন। আমার দৌহিত্রী-দৌহিত্র সকলেই ঈদের জন্য নানারকমের সাজগোজের সামগ্রী ক্রয়ে এবং উপহার পেতে আহ্লাদিত এবং ব্যস্ত। এই বৃদ্ধ বয়সেও নিজের জন্য ঈদের জামা-কাপড় কিনতে আমারও আগ্রহের ঘাটতি নাই। পৃথিবীর যেখানেই সুন্দর পাঞ্জাবির কাপড় অথবা পাঞ্জাবি পাওয়া যায়, সবসময়ের মতো এবারও সংগ্রহের চেষ্টায় আছি।
মৌলিক অধিকার-বিবর্জিত বাংলাদেশ একটা সংকটকাল অতিক্রম করছে। আমি বিশ্বাস করি, রমজানের সম্মানের খাতিরেই সমুদ্র উপকূলে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র আঘাতের ভয়াবহতা থেকে মহান আল্লাহ্ আমাদের রক্ষা করেছেন। যে জঙ্গি-সন্ত্রাস ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম, সেই আতঙ্কও এবার ঈদের জামাতকে ঘিরে সমগ্র মানুষের। আল্লাহ্র কাছে আমার আকুল ফরিয়াদ, হারাম এই জঙ্গি-সন্ত্রাস থেকে আল্লাহ্ বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সকল ঈদের নামাজ আদায়কারীদের রক্ষা করবেন। আমার আরও ফরিয়াদ, বিপথগামী বিভ্রান্ত ও বিপর্যস্ত মানসিকতার যুবক, যারা বিভ্রান্তির শিকার হয়ে মানুষ হত্যা করে একটা পৈশাচিক আনন্দ ও অনৈতিক পরিতৃপ্তি লাভের ঘনঘোর অমানিশার মধ্যে নিমজ্জিত, আল্লাহ্ তাদেরকে হেদায়েত করুন। তারা আমাদের দীনের পূর্ণতা আনয়নকারী খাতেমুন্নবীর জীবনাদর্শ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুক। এই নিবন্ধে আমি আরেকটি প্রাসঙ্গিক কথা উল্লেখ করতে চাই। জঙ্গি-সন্ত্রাস ইসলামে হারাম এটা সর্বজনবিদিত। কিন্তু এই প্রসঙ্গে জোরালো প্রতিবাদ করার ততখানি সাহস না দেখিয়ে যারা মিনমিন করে কথা বলেন, জানি না তারা জঙ্গি সন্ত্রাসীদের ব্যক্তিগত জিঘাংসায় আতঙ্কিত কি না। তারা প্রায়শই জঙ্গি-সন্ত্রাসের সাথে মৌলবাদ শব্দটি সংযুক্ত করে দেন। এটা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যাই হোক, এই সংযুক্তি বিরাট বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। মৌলবাদের অর্থ হচ্ছে- যেকোনো জিনিসের মৌল বা মূল আদর্শকে অবিকৃত ধারায় অনুসরণ করা। তাই মৌলবাদী বললে শুধু ইসলাম নয়, যেকোন ধর্মানুরাগীর মূল বিশ্বাসের প্রতি কটাক্ষ করা হয়। এটা অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং পরিত্যাজ্য। এখানে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য যে, জেহাদে কাফেরের হাত থেকে অস্ত্র পড়ে গেলে নিরস্ত্র অবস্থায় তার উপর অস্ত্রাঘাত করা মহানবী সম্পূর্ণ নিষেধ করেছেন। এই জীবনমুখী, মানবতাবাদী মূল্যবোধ ইসলামের মূল ও মৌলিক নির্দেশ। এই নির্দেশ অনুসরণ করলে এবং প্রতিটি পরিবার থেকে এটি অনুসরণের সৎ ও শাশ্বত তাগিদ থাকলে পৃথিবীজোড়া জঙ্গি ও সন্ত্রাস থেমে যেত। ঈদকে সামনে রেখে আমি পুনরুল্লেখ করতে চাই- আল-কায়েদা, তালেবান, আইএস-এর মতো জঙ্গি সংগঠনগুলো ক্ষেত্রবিশেষে আমেরিকার সৃষ্টি এবং ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এখন এদের পৃষ্ঠপোষক। অথচ দায়ভার বহন করতে হচ্ছে মুসলমানদের। মোসাদ বিভিন্ন কৌশলে মুসলিম তরুণদের বিভ্রান্ত করে একটা অনৈতিক কূপমণ্ডুকতায় তাদের মগজ ধোলাই করে নিরীহ মানুষের মৃত্যু ঘটাচ্ছে এবং ইসলামের নামে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তাছাড়া মুসলমানরাই অনেক ক্ষেত্রে তাদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এদের হাত থেকে মসজিদ ও ঈদের জামাতও নিরাপদ নয়। সত্যিকার ইসলামিক চিন্তার অনুসারীর দ্বারা মসজিদ ও ঈদের জামাত কখনোই আক্রমণের শিকার হতে পারে না। পৃথিবীর কোনো মানুষ, বিশেষ করে মুসলমানরা তাদের এই বর্বরোচিত ইসলাম-বিরোধী কর্মকাণ্ডে উদ্বিগ্ন থাকতো না।
মহান আল্লাহ্ রক্ষা করেছেন, না হলে গতবছর শোলাকিয়ার ঈদের জামাতে ওদের আক্রমণটি সংঘটিত হতে পারলে যে বীভৎসতার সৃষ্টি হতো, তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। অন্যদিকে পৃথিবীর বিশাল পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কী নিদারুণভাবে বিকৃত হতো- সেটি সহজেই অনুমেয়। সকল মুসলমানের প্রতি আমার বিনম্র অনুরোধ, আসুন এবারের ঈদে আমরা পরম করুণাময় আল্লাহ্র কাছে ফরিয়াদ তুলে ধরি- রমজানের সম্মানে ঈদুল ফিতরের জামাতগুলো নিরাপদ রাখার স্বার্থে ওইসব ভ্রান্ত ও ইসলামের চেতনা-বিচ্যুত সন্ত্রাসীদের হাত থেকে মুসলিম উম্মাহ্কে রক্ষা করুন। ঈদ সকল মুসলমানের জন্য আনন্দ, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের বার্তা বয়ে আনুক। আমীন। সুম্মা আমীন ॥
সূত্র- মানবজমিন ঈদ আনন্দ ২০১৭
তাঁর অসংখ্য কালজয়ী প্রেমের বন্দনাকে বাংলা সাহিত্যের সকল কবি এমনকি রবীন্দ্রনাথও বিমুগ্ধ চিত্তে প্রশংসা করেছেন। প্রেমের আকুতিকে অনবদ্য ভাষায় প্রতিভাত করার আত্মতৃপ্তিতেই তিনি নিঃসংকোচে বলতে পেরেছিলেন, “আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দিব না ভুলিতে”।
আমি এখানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের উপর নিবন্ধের সূচনা করছি না। বরং তার অনেক অনবদ্য ও অতুলনীয় মর্মস্পর্শী পঙ্ক্তির মধ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের নানা ভিন্ন ভিন্ন মতের হৃদয়কে স্পর্শ করে যায়, এমন একটি উদ্ধৃতি প্রদান করার জন্যই এই উপক্রমণিকা।
ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে আঘাত, প্রত্যাঘাত, বিদ্রূপ, বিক্ষোভ, অযাচিত এবং অসংগত সমালোচনার নির্মম ও নিষ্ঠুর শিকার মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে তার ছোট্ট একটি পঙ্ক্তি সকলের মনে এমন অনুভূতি ও আকুতি সৃষ্টি করে যে, গান ও কাব্যের জগতে এটি অনন্যসাধারণ ও বিরল। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকল মুসলমানের হৃদয়কে উচ্ছ্বসিত করে উচ্চকিত করে “রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ”। পশ্চিম দিগন্তের বুক চিরে রমজানের শেষে সোনার থালার একটি কণার মতো যখন ঈদের চাঁদের সামান্য আভাও দেখা যায়, তখন সবার মনই গুনগুন করে গেয়ে ওঠে; যা তুলনাবিহীন। শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেরই হৃদয়ে নিজের জ্ঞাতে অজ্ঞাতে পঙ্ক্তিটি মুর্ছিত হতে থাকে আপন মহিমায়।
ঈদের কথা বলতে হলে এতটুকু উপক্রমণিকা কোনোভাবেই এড়ানো যায় না। বিস্তীর্ণ জ্ঞানের পরিধি থাকলে অনেক ভাষা হতে বিশেষ করে ফারসি ভাষার পঙ্ক্তির উদ্ধৃতি দিতে পারতাম।
প্রতিটি মানুষের মতো আমারও জীবনে শৈশব থেকে শুরু করে জীবন সায়াহ্ন পর্যন্ত ৭৩/৭৪টি শুধু রোজার ঈদ এসেছে। একইভাবে কোরবানিরও। আমি বিস্ময়াভিভূত হয়ে উপলদ্ধি করি, বয়সের তারতম্যে ঈদ বা কোরবানির আনন্দে কোনো মারাত্মক ব্যতিক্রম বা ব্যত্যয় আমি অন্তত অনুভব করি না (মুক্তিযুদ্ধকালীন একটি ব্যতিক্রম বাদে)। জীবনের প্রতিটি ঈদ ও কোরবানি আমার জীবনকে আনন্দিত করেছে, উদ্বেলিত করেছে, উচ্ছ্বসিত করেছে। এমনকি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য একটা মমত্ববোধ ও ভালোবাসার উন্মেষ ঘটিয়েছে। এই জীবন সায়াহ্নে সুদূর অতীত আমার শৈশবের দিকে যদি তাকাই, সেখানেও আনন্দের অজস্র ও অফুরন্ত স্মৃতি এখনও আমাকে রোমাঞ্চিত করে, বিমোহিত করে, বিমুগ্ধ করে। সচ্ছল ও সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মের সুবাদে কোনো ঈদেই আমাকে কোনো না পাওয়ার বেদনায় হৃদয়কে এতটুকু ভারাক্রান্ত করেনি। অনেক আত্মীয়-স্বজন। তাদের কাছ থেকে জামা-কাপড়, জুতা, খেলনাসহ অফুরন্ত উপহার পেয়েছি। যতই উপহার পেতাম, সেগুলোকে আমার বিছানায় সাজিয়ে রাখতাম। আমার মা মুচকি হেসে বলতেন, উপহারেই বিছানা ভরিয়ে ফেললে শোবে কোথায়? বাবাও খুব খুশি হতেন আমার উচ্ছ্বাস অনুধাবন করে। বলতেন, ওর উপহারগুলো বিছানাতেই ঘুমাক, ও না হয় আমাদের বিছানায় ঘুমাবে।
কিন্তু মজার কথা হলো, উপহারগুলো তো পরতে হবে! নামাজের কিছু আগে ছাড়া ঈদের কাপড় মা পরতে দিতেন না। তারপরে যখন যেটা পরার অবাধ স্বাধীনতা। মনে হতো একেকটা মিনিট যেন একেকটা ঘণ্টা। ঈদের দিন অনেক ভোরেই ঘুম ভেঙে যেত। তখনও বাড়ির চারপাশে বিভিন্ন পাখির কলরব শুরু হতো না। সেই বয়সেও বুঝতাম, প্রভাত হতে এখনও বাকি। কিন্তু কী করবো? ঘুম তো আসে না ! আবেগ-উচ্ছ্বাসে ভরা মন সুনিবিড় আকাঙ্ক্ষায় অপেক্ষা করতো- সূর্য উঠুক। তখন থেকেই না শুরু হবে ঈদের জামাতের প্রস্তুতি নেয়া। সচ্ছল ও সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান হিসেবে সুগন্ধী সাবান থেকে শুরু করে বিলাসী উপকরণের কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু এই বয়সে এসেও অস্বীকার করবো না, আমার শৈশবের ঈদ বন্ধুদের সঙ্গে কোলাকুলি, নামাজ আদায়, অস্থির চিত্তে অপেক্ষা করা কখন খুৎবা ও মোনাজাত শেষ হবে। পূর্ণ স্বাধীনতায় বয়োজ্যেষ্ঠদের সালাম ও বন্ধুদের সঙ্গে কোলাকুলি করবো। আমার শৈশবের বন্ধুরা প্রায় সকলেই আমাদের বাসায় আসতো। আমার স্নেহশীলা মমতাময়ী মা নিজের সন্তানের মতোই সকলকেই ঈদের জন্য নিজ হাতে তৈরি করা সকল ধরনের মিষ্টান্ন সকলকেই খেতে দিতেন। এবং মজার বিষয় হলো, বন্ধুদের যাদের বাসায় যা কিছুই মিষ্টান্ন হোক না কেন, আমার মায়ের হাতে তৈরি মিষ্টান্ন না খেলে যেন তাদের ঈদ সম্পূর্ণই হতো না। অন্যদিকে বন্ধুদের কেউ একজন অনুপস্থিত থাকলে মায়ের চোখ এড়াতো না। তার কথা আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করতেন। বন্ধুদের নিয়ে খাচ্ছি, খেলছি, দৌড়াদৌড়ি করছি; এরমধ্যে অনুপস্থিত বন্ধুদের ব্যাপারে বারবার প্রশ্ন করায় বিরক্তই লাগতো। মা তো মা-ই।
নতুন কাপড় বা ঈদের অন্যান্য প্রসাধনী মাও অফুরন্ত পেতেন। কিন্তু সেগুলো ব্যবহারের সুযোগ আসতো কম। আপ্যায়নের মাধ্যমে তিনি যে অবর্ণনীয় আনন্দলাভ করতেন, তার চোখ-মুখ খুশিতে জ্বলজ্বল করতো, তা আজও আমার স্মৃতিতে ভাসে। আমি আবারও বলি, সকলের মা-ই মা। কিন্তু আমার মাকে সবসময়ই আমার মনে হতো- তিনি অনন্যা, তিনি অসাধারণ। এই বিশাল জগত জুড়ে আমার মা এমন একজন স্নেহশীলা আবেগাপ্লুত জননী, যার কোন তুলনা নাই। ঈদের দিনে যে বিরাট ধকল, তাতে তার কোন ক্লান্তি কখনোই আমার চোখে পড়ে নাই।
আমাদের পরিবারটি ঠিক যৌথ না হলেও কার্যত আমার চাচাতো ফুফাতো খালাতো ভাই-বোনরা আমার মায়ের খুব কোল-নেওটা ছিল। সন্তান-সম্পর্কিত প্রায় সকলেই মাকে কেউ মা, কেউ আম্মা, কেউ মা-জান বলে ডাকতো। যদিও আমরা দুই সহোদর (এক ভাই, এক বোন) ভাইবোন ছিলাম। আমার মেজো খালা বা চাচী (আব্বা ও চাচা আপন দুই ভাই আম্মা ও খালা আপন দুই বোনের সাথে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আমি শতভাগ নিশ্চিত এটা পারিবারিক প্রস্তাবনায় সংঘটিত হয়েছিল।) মা’কে সকলেই যখন মা বলে ডাকতো, তিনি খুবই ক্ষুব্ধ হয়ে যেতেন। ক্রুদ্ধ হয়ে মাকে ভর্ৎসনা করে বলতেন, তুই কি নিঃসন্তান, বাঁজা? এত রুদ্রমূর্তিতে তীব্র বকাবকি করতেন যে, মা চুপসে যেতেন, ভয়ও পেতেন। কিন্তু নিতান্ত নির্বিকার ও নিশ্চুপ থাকতেন। আমাদের ওই সমস্ত আত্মীয়রা এমনিতে কেউ না কেউ আমাদের বাসায় অনুষ্ঠান ছাড়াই খেতেন। মায়ের হাতের রান্না না খেলে তারা নিতান্তই অতৃপ্ত থাকতেন বলে আমি তাদের মুখেই শুনেছি। এতে আমার অনাগ্রহ ছিল না, কারণ একসঙ্গে বসে বেশ ক’জন মিলে খেতে এমনিতেই ভালো লাগে। পুকুরের রুইমাছের মাথাটি বা বিশেষ পছন্দনীয় মাছটি মা কখনোই আমার পাতে তুলে দেননি। কিন্তু সৌভাগ্য আমার! যার পাতেই তুলে দিতেন, তিনিই ওটা আমাকে দিয়ে দিতেন এবং বাবা ও মা কেউ তাতে আর আপত্তি তুলতেন না। যৌথ পরিবার না হলেও ঈদ ছাড়াও দৈনন্দিন খাওয়াটা অনেকটা যৌথ পরিবেশেই হতো। সাংসারিক সচ্ছলতার কারণে এটা বোধহয় সকলকেই শান্তি, স্বস্তি ও আনন্দ দিতো। এই নিত্য-নৈমিত্তিক স্বাভাবিকতার মধ্যে ঈদের ব্যাপারটা যে আমাদের বাসাই মোটামুটি কেন্দ্রবিন্দু ছিল, এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মাতৃকূল অর্থাৎ আমার খালা-মামারা আমাদের বসতি থেকে অনেক দূরে থাকতেন। তাই ঈদের দিনে চাচাতো ভাই-বোনদের সমাগমই বাসাটাকেমুখর করে রাখতো। অবশ্য কখনো কখনো খালাতে মামাতো ভাইবোনরাও ঈদ করতে আমাদের এখানে আসতো। সেই সাবলীল এবং অকৃত্রিম আনন্দঘন পরিবেশের ঈদ আমাকে আজও রোমাঞ্চিত করে, বিমোহিত করে, বিমুগ্ধ করে। শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের সোপানে যখন পা রাখলাম, পড়াশোনার জন্য আমাকে ঢাকায় চলে আসতে হলো। কিন্তু ঈদের সময় ঢাকায় থাকা আমার জন্য ছিল শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাবার মতো অবস্থা। কখনোই তা করিনি। ঈদে বাড়ি যেতেই হতো। ৫০ দশকের ৫৮/৫৯ সাল থেকে প্রায় স্বাধীনতা পর্যন্ত আমাদের ওখানে (ঝিনাইদহ থেকে ঢাকায় আসার) রাস্তা সুগম ছিল না। অথচ ঝিনাইদহ থেকে কোলকাতায় মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টায় যাওয়া যেতো। ৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের আগে ভিসা পাসপোর্টেরও বালাই ছিল না। ঢাকা থেকে ঝিনাইদহ যেতে হলে ফুলবাড়িয়া স্টেশন থেকে প্রায় ২৩/২৪ ঘণ্টায় চুয়াডাঙ্গা হয়ে যেতে হতো। আমার জীবনের অন্যতম শখ বা বিলাসিতা ট্রেন বা প্লেনের উচ্চতর শ্রেণিতে ভ্রমণ করা। তাই টিফিনের খরচ বাঁচিয়ে হলেও আগে থেকেই ট্রেনের প্রথম শ্রেণির টিকেট কেটে রাখতাম। বলতে সংকোচ নেই, কোনভাবেই প্রথম শ্রেণির দরজাও ঈদের সময় আটকে রাখা যেত না। অসংখ্য যাত্রী প্রথম শ্রেণিতে দরজা খুলে ঢুকে যেত। পুলিশও যেন নির্বিকার থাকতো। তবে এটুকু সৌজন্যবোধ থাকতো যে টিকেট কাটা যাত্রীদের তারা বসার সুযোগ দিতো। আর বাকি পুরো কামরাটি একদম যাত্রীতে ঠাসা, তিলধারণের ঠাঁইও থাকতো না। যাত্রাপথে বাহাদুরাবাদ-সিরাজগঞ্জে ফেরি পারাপার; একটি অদ্ভুত সুন্দর বিলাসবহুল ফেরি। যখন ফেরিতে উঠতাম, তখন সমস্ত অন্তরটা আনন্দে, উচ্ছ্বলতায় ভরে যেত। ওখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে সাধারণ যাত্রীরা ঢুকতেই পারতো না। সিরাজগঞ্জ থেকে ঈশ্বরদী হয়ে চুয়াডাঙ্গায় গিয়ে আমাদের নামতে হতো। চুয়াডাঙ্গায় নামতাম রাত ৯টা/১০টার দিকে। অনেক সময় ঝিনাইদহগামী শেষ বাসটি ছেড়ে দিতো। চুয়াডাঙ্গা স্টেশনে উচ্চশ্রেণির যাত্রীদের বিশ্রামাগারটি ছিল সুসজ্জিত ও মার্জিত। শোয়ার জন্য কোন খাট না থাকলেও কাঠ ও বেতের তৈরি অতি উচ্চমানের ইজি চেয়ার এতই সুন্দর ছিল যে, ঘুমাতে কোনো অসুবিধা হতো না। আমি দু’-একবার সকালের প্রথম বাসটি ধরতে পারিনি। এটি উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, আব্বা এসে অপেক্ষা করতেন ঝিনাইদহের বাসস্টপেজে। প্রতি ঘণ্টায় চুয়াডাঙ্গা থেকে ঝিনাইদহে বাস যেতো। এখন ভাবতে ভীষণ কষ্ট লাগে, ওই এক ঘণ্টা আব্বা কী উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটাতেন। আবার এটি ভাবতে ভালো লাগে যে, ভাগ্যিস, তখন মোবাইল ফোন ছিল না! থাকলে মায়ের কী দশাটাই না হতো!
কলেজে থাকা অবস্থা থেকে শুরু করে ’৬৯ সাল পর্যন্ত আমার বেশ কয়েকটি ঈদ কেটেছে কারাগারের অভ্যন্তরে। ৬৬-এর পর থেকে রাজবন্দী হিসেবেই জেল খেটেছি। আমার একটি ঈদের কথা মনে পড়ে। তখন আমি হাজতী। মামলায় জামিন না দিয়ে ওই কয়দিন আমাকে জেল খাটিয়ে একটা বিদ্বেষপ্রসূত আনন্দ (স্যাডিজম) পেতেন ম্যাজিস্ট্রেটদের কেউ কেউ। এ ব্যাপারে ঘাগু ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট মরহুম আফসার উদ্দিন। আল্লাহ্ তাকে বেহেশ্ত নসীব করুন। এটা অপ্রাসঙ্গিক কি না জানি না, আমাদের যেকোনো মামলায় ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে এসে দাঁড়াতেন তখনকার দিনে প্রথিতযশা ব্যারিস্টার ও এডভোকেটগণ। সর্বজনাব আতাউর রহমান খান (প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী), জহিরউদ্দিন (প্রাক্তন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী), সালাম খান, শাহ্ আজিজুর রহমানসহ অনেকেই। তখন হাইকোর্টে যারা আইনজীবী হিসেবে শুধু প্রসিদ্ধই নন, আইন ব্যবসাও যাদের রমরমা। তারাও একটা অনবদ্য আকর্ষণে এসে ম্যাজিস্ট্রেটের বারান্দায় ভিড় জমাতেন। আমার অনুভূতি আজও শিহরিত হয়, রাজনীতির সেই রোমাঞ্চিত ত্যাগের মহিমায় ভরপুর দিনগুলি কি আবার কখনো অবক্ষয়ের অতলান্তে অবলুপ্ত ক্ষয়িষ্ণু সমাজব্যবস্থায় মৌলিক অধিকার-বিবর্জিত একনায়কতান্ত্রিকতায় আচ্ছাদিত এই বাংলাদেশে ফিরে আসবে?
সেবার হাজতী হিসেবে কারাগারে গেলেও আমাকে জেল হাসপাতালে রাখা হয়। যারা নিরাপত্তা বন্দি নন, অথচ রাজনৈতিক কর্মী, তাদের জন্য এ ব্যবস্থাটি আকাশছোঁয়া পরিতৃপ্তির। যতদূর মনে পড়ে, জেলের অভ্যন্তরে হাসপাতাল চত্বরেই ঈদের জামাত হতো। সেটিও একটি অদ্ভুত অনুভূতির ঈদ। সেই ঈদে মুজিব ভাই কারারুদ্ধ ছিলেন না। কিছু শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক ব্যক্তিত্ব, যাদের সকলেই নন-মুসলিম, তারা ভালো কাপড়- চোপড় পরে কারা অভ্যন্তরে ঈদ চত্বরে আসতেন সবার সঙ্গে মেলামেশার উদগ্র আকাঙ্ক্ষায়। আমার বন্ধু বদিউজ্জামান ঈদের জন্য পায়জামা-পাঞ্জাবী রেখে গিয়েছিল। ঘাটতি, কমতি, বেদনা, ক্লান্তি কোনোকিছুই বোধ করিনি। আর খাওয়া-দাওয়া? আব্বা টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি করে জেলখানার গেটে খাবার নিয়ে আসতেন। ডেপুটি জেলারের রুমে তার সঙ্গে কী হাজতী, কী রাজবন্দী- সকল অবস্থাতেই দেখা করার সুযোগ পেতাম। আওয়ামী লীগের জন্ম থেকেই আমার বাবা প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম। মুজিব ভাইও তাঁকে সম্মান করতেন। মুজিব ভাইয়ের কারাগারের রোজনামচা বইয়ে এ ইঙ্গিত রয়েছে। আমার কিছু অন্তরঙ্গ বন্ধু, তারাও কিছু না কিছু নিয়ে দেখা করতে আসতো। ঈদের দিনে জেল কর্তৃপক্ষও অনেকটা ঢিলেঢালা থাকতো। এখানে ওখানে যাতায়াত অবারিত না হলেও নিয়মকানুন অনেকটা শিথিল ছিল। ঈদের নামাজের শেষে সবারই সবার সঙ্গে কোলাকুলি করার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা পরিলক্ষিত হতো। এটা একটা বিচিত্র ধরনের অনুভূতি ও আবেগতাড়িত নিষ্কলুষ আনন্দ। ৬৬ সালে ৬ দফা প্রদানের পর জুনে কারারুদ্ধ হই রাজবন্দী হিসেবে। তখন রাজনীতিকদের তত্ত্বাবধানে ছিলেন ডেপুটি জেলার তোফাজ্জল হোসেন সাহেব। ভদ্রলোকের বাড়ি রাজশাহীতে। তিনি খুব কুশলী ও বুদ্ধিমান ছিলেন। চাকরি রক্ষার সমস্ত শর্ত পালন করেও তিনি রাজবন্দীদের সঙ্গে একটা সখ্য বজায় রাখতেন। মুজিব ভাইকেও ভীষণ শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন। এবং শুধু তাঁর কেন, তখনকার জেল কর্তৃপক্ষের প্রধান পরিদর্শক থেকে শুরু করে কারাগারের সকল কর্মকর্তারই বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, মুজিব ভাই পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসবেনই। ৬ দফা প্রদানের পর বঙ্গবন্ধু কারাগারের যে কক্ষটিতে অবস্থান করতেন, তখন কক্ষটির নাম ছিল ‘দেওয়ানী’। কারা অভ্যন্তরে অনেকগুলো ঈদ ও কোরবানিতে আমি অংশগ্রহণের সুযোগ পাই। ঈদের দিনে অন্যান্য জায়গায় অবরুদ্ধ রাজবন্দীরা অতি উৎসাহ-উদ্দীপনা, হৃদয়ের উচ্ছ্বাস ও উদ্বেলতা নিয়ে ঈদের জামাতে আসতেন। তাদের উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় থাকতো, শুধুই কোলাকুলি নয়, মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে রাজনৈতিক শলা-পরামর্শ ও তাঁর সিদ্ধান্ত সরাসরি জানা। আমি মুজিব ভাইয়ের অতি সন্নিকটে থাকতাম বলে এই শলাপরামর্শে তেমন কোন আগ্রহ বোধ করতাম না। কিন্তু অন্যান্য সেল ও ওয়ার্ডে থাকা রাজবন্দীদের সঙ্গে কোলাকুলি, কথাবার্তা ও মেলামেশায় যে কী অদ্ভুত আনন্দ পেতাম, তা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। প্রথিতযশা লেখক হলে হয়তো পারতাম। কারাগারের অভ্যন্তরের ঈদের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, রাজবন্দীদের তরফ থেকে সকল সাধারণ কয়েদিদের জন্য বিশেষ খাদ্য পরিবেশন করা হতো। বলতে বাধা নেই, জেল কর্তৃপক্ষের এখানে একটা অকৃত্রিম সহযোগিতা ও সাহায্য থাকতো। রাজবন্দীদের তত্ত্বাবধানে প্রস্তুত করা খাবার সাধারণ হাজতী ও কয়েদিদের যার যার ওয়ার্ডে ও সেলে পাঠিয়ে দেয়া হতো। কয়েদি ও হাজতীরা ঈদে ও কোরবানিতে এই সুস্বাদু খাবার খুবই পরিতৃপ্তির সঙ্গে খেতো এবং তারা প্রতিটি রাজবন্দীকেই বয়স, রাজনৈতিক পরিচয়, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ভীষণভাবে বিনম্র চিত্তে শ্রদ্ধা করতো। ভাবীও ঈদের দিনে প্রচুর খাবার পাঠাতেন। মানিক ভাইয়ের তরফ থেকেও ঈদের দিন জেলখানায় খাবার আসতো। আমার বাবাসহ অনেক রাজবন্দীর পরিবারবর্গের কাছ থেকেও প্রচুর খাবার আসতো। রাজবন্দীদের যিনি প্রতিনিধি ছিলেন, বাইরে থেকে আগত খাদ্যসামগ্রী রাজবন্দীদের বিভিন্ন সেলে ফালতু, পাহারা ও মেটদের জন্য পাঠিয়ে দিতেন। ডিআইজি, জেল সুপার, জেলার, ডেপুটি জেলারসহ কারাগারের প্রায় সকলেই হয় ঈদের জামাতে নতুবা বিভিন্ন স্থানে মুজিব ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করা অনেকটা অবধারিত ছিল। জেলখানার একটি ঈদ আমার জন্য বেদনাদায়ক, মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ছিল। কারণ তার দুই-তিনমাস আগে আমি কারারুদ্ধ অবস্থায় আমার মায়ের মৃত্যু ঘটে এবং কোনভাবেই মৃত্যুশয্যায় শায়িত মাকে দেখার বা পরে মৃত মাকে দাফন করার জন্য শত চেষ্টা সত্ত্বেও আমাকে কোন পেরোল দেয়া হয়নি। সম্ভবত ওই ঈদের জামাতে আমি যাইনি। শৈশব, কৈশোর ও যৌবনে আমার মমতাময়ী মা’কে ঘিরে বিজড়িত স্মৃতি আমার হৃদয়কে প্রচণ্ডভাবে ভারাক্রান্ত করে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আরেকটি ঈদে আমি নামাজ তো পড়ি-ই নাই (আল্লাহ্ আমার গুনাহ মাফ করুন), বরং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আমি একটি প্রচণ্ড উত্তেজক বক্তৃতা করে বলেছিলাম- ঈদের চাঁদ, তুমি আকাশের বক্ষ বিদীর্ণ করে বাংলাদেশে উদিত হয়ো না। আমার ধর্ষিতা বোনের বুক নিংড়ানো আর্তনাদ তোমাকে ধিক্কার দেবে, সন্তান হারানো মায়ের বুকফাঁটা আর্তনাদ তুমি সহ্য করতে পারবে না। কোথায় দাঁড়াবে ঈদের জামাত? বাংলার মাটির সর্বত্রই তো রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। এখানে খুশির জামাত দাঁড়ানোর কোনো অবকাশ নাই। আমার আবেগ, আমার উচ্ছ্বাস, আমার ক্ষোভ, আমার ক্রোধ আমাকে এতখানি আচ্ছন্ন করে যে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ভাষণে আমি তরুণ প্রজন্মকে ঈদের জামাতে অংশ না নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলাম (আবার আমি মহান আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা চাইছি)।
আজ আমি জীবন সায়াহ্নে উপনীত। আমার একমাত্র গুণের দিক থেকে বিবেচনা করলে আমি আজ পঞ্চম প্রজন্মের সিঁড়িতে। আমার নিজের দৌহিত্র-দৌহিত্রী রয়েছে। এবারের ঈদে আমাকে সালামী দেওয়ার মতো কেউ নাই। বরং সালাম করলে প্রায় সকলকেই আমার সালামী দিতে হবে। এটাও ভিন্ন ধরনের আনন্দ; বিচিত্র ধরনের আস্বাদন। আমার দৌহিত্রী-দৌহিত্র সকলেই ঈদের জন্য নানারকমের সাজগোজের সামগ্রী ক্রয়ে এবং উপহার পেতে আহ্লাদিত এবং ব্যস্ত। এই বৃদ্ধ বয়সেও নিজের জন্য ঈদের জামা-কাপড় কিনতে আমারও আগ্রহের ঘাটতি নাই। পৃথিবীর যেখানেই সুন্দর পাঞ্জাবির কাপড় অথবা পাঞ্জাবি পাওয়া যায়, সবসময়ের মতো এবারও সংগ্রহের চেষ্টায় আছি।
মৌলিক অধিকার-বিবর্জিত বাংলাদেশ একটা সংকটকাল অতিক্রম করছে। আমি বিশ্বাস করি, রমজানের সম্মানের খাতিরেই সমুদ্র উপকূলে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র আঘাতের ভয়াবহতা থেকে মহান আল্লাহ্ আমাদের রক্ষা করেছেন। যে জঙ্গি-সন্ত্রাস ইসলামে সম্পূর্ণ হারাম, সেই আতঙ্কও এবার ঈদের জামাতকে ঘিরে সমগ্র মানুষের। আল্লাহ্র কাছে আমার আকুল ফরিয়াদ, হারাম এই জঙ্গি-সন্ত্রাস থেকে আল্লাহ্ বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সকল ঈদের নামাজ আদায়কারীদের রক্ষা করবেন। আমার আরও ফরিয়াদ, বিপথগামী বিভ্রান্ত ও বিপর্যস্ত মানসিকতার যুবক, যারা বিভ্রান্তির শিকার হয়ে মানুষ হত্যা করে একটা পৈশাচিক আনন্দ ও অনৈতিক পরিতৃপ্তি লাভের ঘনঘোর অমানিশার মধ্যে নিমজ্জিত, আল্লাহ্ তাদেরকে হেদায়েত করুন। তারা আমাদের দীনের পূর্ণতা আনয়নকারী খাতেমুন্নবীর জীবনাদর্শ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুক। এই নিবন্ধে আমি আরেকটি প্রাসঙ্গিক কথা উল্লেখ করতে চাই। জঙ্গি-সন্ত্রাস ইসলামে হারাম এটা সর্বজনবিদিত। কিন্তু এই প্রসঙ্গে জোরালো প্রতিবাদ করার ততখানি সাহস না দেখিয়ে যারা মিনমিন করে কথা বলেন, জানি না তারা জঙ্গি সন্ত্রাসীদের ব্যক্তিগত জিঘাংসায় আতঙ্কিত কি না। তারা প্রায়শই জঙ্গি-সন্ত্রাসের সাথে মৌলবাদ শব্দটি সংযুক্ত করে দেন। এটা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যাই হোক, এই সংযুক্তি বিরাট বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। মৌলবাদের অর্থ হচ্ছে- যেকোনো জিনিসের মৌল বা মূল আদর্শকে অবিকৃত ধারায় অনুসরণ করা। তাই মৌলবাদী বললে শুধু ইসলাম নয়, যেকোন ধর্মানুরাগীর মূল বিশ্বাসের প্রতি কটাক্ষ করা হয়। এটা অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং পরিত্যাজ্য। এখানে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য যে, জেহাদে কাফেরের হাত থেকে অস্ত্র পড়ে গেলে নিরস্ত্র অবস্থায় তার উপর অস্ত্রাঘাত করা মহানবী সম্পূর্ণ নিষেধ করেছেন। এই জীবনমুখী, মানবতাবাদী মূল্যবোধ ইসলামের মূল ও মৌলিক নির্দেশ। এই নির্দেশ অনুসরণ করলে এবং প্রতিটি পরিবার থেকে এটি অনুসরণের সৎ ও শাশ্বত তাগিদ থাকলে পৃথিবীজোড়া জঙ্গি ও সন্ত্রাস থেমে যেত। ঈদকে সামনে রেখে আমি পুনরুল্লেখ করতে চাই- আল-কায়েদা, তালেবান, আইএস-এর মতো জঙ্গি সংগঠনগুলো ক্ষেত্রবিশেষে আমেরিকার সৃষ্টি এবং ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এখন এদের পৃষ্ঠপোষক। অথচ দায়ভার বহন করতে হচ্ছে মুসলমানদের। মোসাদ বিভিন্ন কৌশলে মুসলিম তরুণদের বিভ্রান্ত করে একটা অনৈতিক কূপমণ্ডুকতায় তাদের মগজ ধোলাই করে নিরীহ মানুষের মৃত্যু ঘটাচ্ছে এবং ইসলামের নামে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তাছাড়া মুসলমানরাই অনেক ক্ষেত্রে তাদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এদের হাত থেকে মসজিদ ও ঈদের জামাতও নিরাপদ নয়। সত্যিকার ইসলামিক চিন্তার অনুসারীর দ্বারা মসজিদ ও ঈদের জামাত কখনোই আক্রমণের শিকার হতে পারে না। পৃথিবীর কোনো মানুষ, বিশেষ করে মুসলমানরা তাদের এই বর্বরোচিত ইসলাম-বিরোধী কর্মকাণ্ডে উদ্বিগ্ন থাকতো না।
মহান আল্লাহ্ রক্ষা করেছেন, না হলে গতবছর শোলাকিয়ার ঈদের জামাতে ওদের আক্রমণটি সংঘটিত হতে পারলে যে বীভৎসতার সৃষ্টি হতো, তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। অন্যদিকে পৃথিবীর বিশাল পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কী নিদারুণভাবে বিকৃত হতো- সেটি সহজেই অনুমেয়। সকল মুসলমানের প্রতি আমার বিনম্র অনুরোধ, আসুন এবারের ঈদে আমরা পরম করুণাময় আল্লাহ্র কাছে ফরিয়াদ তুলে ধরি- রমজানের সম্মানে ঈদুল ফিতরের জামাতগুলো নিরাপদ রাখার স্বার্থে ওইসব ভ্রান্ত ও ইসলামের চেতনা-বিচ্যুত সন্ত্রাসীদের হাত থেকে মুসলিম উম্মাহ্কে রক্ষা করুন। ঈদ সকল মুসলমানের জন্য আনন্দ, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের বার্তা বয়ে আনুক। আমীন। সুম্মা আমীন ॥
সূত্র- মানবজমিন ঈদ আনন্দ ২০১৭
No comments