মদ, সিগারেট সবই এল
চট্টগ্রাম বন্দরে শুল্ক গোয়েন্দাদের জালে আটকে পড়া দুটি চালানের ১২টি কনটেইনারের সব কটিতেই চোরাচালানের পণ্য পাওয়া গেছে। এসব কনটেইনারের ভেতরে ছিল বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেটের ৩ কোটি ৮৪ লাখ শলাকা, তিনটি ব্র্যান্ডের ৪ হাজার ৭৪টি এইচডি ও এলইডি টেলিভিশন, ১৬ হাজার ১৭০ বোতল মদ ও ২৮১টি ফটোকপি মেশিন। এসব পণ্যের দাম ১৩৪ কোটি টাকা। প্রাণিখাদ্য তৈরির যন্ত্র আমদানির আড়ালে এসব পণ্য আনা হয়েছে। গত রোববার চালানটির প্রথম ছয়টি কনটেইনার খুলে সিগারেট, মদ ও টেলিভিশন পাওয়া যায়। গতকাল সোমবার বাকি ছয়টি কনটেইনার খোলার পর ওই তিন পণ্যের সঙ্গে ফটোকপি মেশিন পাওয়া গেছে। বন্দর চত্বরে গতকাল দুপুরে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান সাংবাদিকদের বলেন, এত বড় জালিয়াতির ঘটনা কারও একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ছাড়াও এতে অনেকের ইন্ধন ছিল। এসব খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তিনি বলেন, বন্দর-কাস্টমসকে ব্যবহার করে অবৈধ পণ্য এনে এখন কেউ পার পাবে না। যারা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। দুটি চালানই এনেছেন ঢাকার খিলক্ষেত এলাকার খোরশেদ আলম নামে একজন আমদানিকারক। হিনান আনহুই এগ্রো এলসি ও এগ্রো বিডি অ্যান্ড জেপি নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে এসব পণ্য আনা হয়। দুই চালানের পণ্য সরবরাহ করেছে চীনের জমরাজ ইন্ডাস্ট্রিজ, যাদের সিঙ্গাপুরেও অফিস রয়েছে। দুই চালানের পণ্যের ঘোষণায় ছিল, এই ১২টি কনটেইনারে থাকবে প্রাণিখাদ্য প্রস্তুতের যন্ত্র। বাস্তবে একটি যন্ত্রও পাওয়া যায়নি। যা পাওয়া গেল শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, দুই চালানে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেটের ৩ কোটি ৮৪ লাখ শলাকা পাওয়া গেছে। সিগারেট আমদানিতে শুল্কায়ন মূল্যের ওপর ৫৯৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ শুল্ক-কর দিতে হয়। অর্থাৎ, সিগারেটের দাম ১০০ টাকা হলে শুল্ক-কর দিতে হবে ৫৯৬ দশমিক ৯৭ টাকা। আবার আমদানিনীতির শর্ত অনুযায়ী, সিগারেটের প্যাকেটে বাংলায় ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ লেখা থাকতে হবে। জব্দ করা সিগারেটে তা না থাকায় এটি আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য। জব্দ করা সিগারেটের মূল্য ৭৪ কোটি টাকা। সিগারেট ছাড়াও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৩২ থেকে ৯০ ইঞ্চি মাপের ৪ হাজার ৭৪টি এইচডি ও এলইডি টেলিভিশন পাওয়া গেছে। টেলিভিশনের শুল্ক-কর ৯০ শতাংশ।
আমদানি মূল্যসহ এসব টেলিভিশনের মূল্য প্রায় ৪৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া নামী-দামি ব্র্যান্ডের মদ পাওয়া গেছে ১৬ হাজার ১৭০ বোতল। আমদানি মূল্যের ওপর মদের মোট শুল্ক-কর দিতে হয় ৬০০ শতাংশ। এর বাইরে ২৮১টি ফটোকপি মেশিন পাওয়া গেছে, যেগুলোর মূল্য ২ কোটি ৭১ লাখ টাকা। মদ ও ফটোকপি মেশিনের মূল্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান বলেন, দুটি চালানে ১৩৪ কোটি টাকা বাজারমূল্যের পণ্য পাওয়া গেলেও ব্যাংকিং চ্যানেলে বড়জোর ১ কোটি টাকা পাঠানো হয়েছে। বাকি টাকা অবৈধ পথে দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। এই চালান আনার ঘটনায় মানি লন্ডারিং হয়েছে। চোরাচালানের ঘটনা ঘটেছে। কাস্টমস আইন ভঙ্গ হয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, চালান দুটি চট্টগ্রাম বন্দরে আসার অন্তত এক সপ্তাহ আগে থেকে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খানের নেতৃত্বে একটি দল নজরদারি শুরু করে। আমদানিকারকও এসব পণ্য জাহাজ থেকে বন্দরে নামানোর পর দ্রুত খালাস করে নেওয়ার সব প্রক্রিয়া প্রায় গুছিয়ে আনেন। তবে শুল্ক গোয়েন্দাদের কৌশলে পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় তা আবার ফেরত নেওয়ার জন্য বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন আমদানিকারক।
সেই আবেদন নাকচ হওয়ার পরই আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের মালিক আত্মগোপনে চলে যান। গতকাল বন্দর চত্বরে কাস্টমস কমিশনার এ এফ এম আবদুল্লাহ খান সাংবাদিকদের বলেন, চালানটি খালাসে নিযুক্ত সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান রাবেয়া অ্যান্ড সন্সের লাইসেন্স বাতিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের লাইসেন্সও বাতিল করা হচ্ছে। আমদানিকারক খোরশেদ আলমের দুটি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানায় কারখানার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি বলে জানান শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। কারখানা না থাকার পরও ব্যাংকে হিসাব ও ঋণপত্র খোলার বিষয়টিকে সন্দেহজনক হিসেবে দেখছেন তাঁরা। নথিপত্রে দেখা যায়, দুই চালানের ঋণপত্র খোলা হয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক থেকে। বন্দর চত্বরে উপস্থিত থাকা আইএফআইসি ব্যাংকের ঢাকার নয়াপল্টন শাখার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মেহেদী হোসেন প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল এই প্রতিষ্ঠানের নামে হিসাব খোলা হয়। এরপর কেরানীগঞ্জের চরগলগলিয়া এলাকায় প্রতিষ্ঠানটির কারখানার প্রাথমিক অবকাঠামো দেখতে পান ব্যাংক কর্মকর্তারা। কারখানার অস্তিত্ব দেখেই শিল্পের যন্ত্র আমদানির ঋণপত্র খোলা হয় বলে তিনি দাবি করেন। কারখানা না থাকার পরও একই প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রপাতি আমদানির ৭১টি কনটেইনার এর আগে কীভাবে খালাস হয়েছে, তারও তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
No comments