সুখের খোঁজে...
ইচ্ছে পূরণ কিংবা নিজের মতো করে একটু থাকা-পরার জন্য অনেক পাকিস্তানি তরুণী যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন। ভিন দেশে গিয়ে এই তরুণীরা সুখের দেখা পেয়েছেন কি না, তা তলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন লেখক ও উন্নয়ন যোগাযোগ পেশাজীবী মাদিহা ওয়ারিস কোরেশি। পাকিস্তানের সেনাঘাঁটিতে বেড়ে উঠেছেন আসনিয়া আসিম। ওয়াশিংটনে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা নিতে তাঁকে মোটেই বেগ পেতে হয়নি। নিজের শহর ইসলামাবাদ থেকে দূরে থাকা আসিমের জন্য নতুন কিছু ছিল না। পড়ালেখার জন্য করাচিতে নারীদের হোস্টেলে চার বছর থেকেছেন তিনি। তাঁর বাবা অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। মা শিক্ষাবিদ। দুজনই উদার মনের মানুষ। উচ্চশিক্ষা ও পেশার ব্যাপারে উচ্চাকাঙ্ক্ষী আসিম বাইরে যেতে চাইতেন। এমনই একসময় বিশ্বব্যাংকের একটি আন্তর্জাতিক রচনা প্রতিযোগিতা জেতেন তিনি। এই সুবাদে ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে কাজের সুযোগ আসে। এমন সুযোগ হাতছাড়া করেননি তিনি। নতুন জায়গায় গিয়ে জীবনের প্রথম চাকরি শুরু ও স্থিতি অর্জনে একটু সময় লাগে। কিন্তু সেখানে একাকী থাকার অভিজ্ঞতাটি ছিল আসিমের জন্য একেবারেই অন্য রকম। কারণ, আমেরিকায় একাকী বসবাস মানে সত্যিকার অর্থেই একাকী। ২০ বছরের মাঝামাঝি বয়সী আসিম ছিলেন অবিবাহিত। একজন অবিবাহিত পাকিস্তানি তরুণীর জন্য একাকী থাকা সহজ কিছু নয়।
তুলনামূলক উদার পরিবারে বেড়ে উঠলেও তাঁর পক্ষে রীতির বাইরে যাওয়া কঠিন ছিল। পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৯৭ শতাংশ মুসলমান। সৌদি আরবের তুলনায় পাকিস্তানি নারীরা অধিক স্বাধীনতা ভোগ করেন। তা সত্ত্বেও দেশটির অধিকাংশ নারীর জীবন ধর্ম ও নিজস্ব সংস্কৃতি দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত। পাকিস্তানি সমাজে বিয়ে ও পরিবার নারীর সম্পূর্ণতার জন্য অপরিহার্য হিসেবে বিবেচিত। এমন প্রেক্ষাপটে একাকী ও স্বাধীনভাবে থাকা নারীর জন্য বেশ ঝক্কির। পাকিস্তানি সাংবাদিক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা বিনা সারোয়ারের মতে, পাকিস্তানি নারীরা দেশে বা দেশের বাইরে নিজের মতো করে থাকছেন। এই প্রবণতা বাড়ছে। তবে এ ক্ষেত্রে পরিবারের সম্মতি থাকার পরও নারীদের ওপর নানামুখী চাপ আসে। নারীদের পরিবারও চাপে পড়ে। একাকী থাকার ধারণাটি পাকিস্তানের সংস্কৃতিতে ভিন্ন চোখে দেখা হয়। একাত্মতা, নিজস্ব সময়—এসবের স্থান পাকিস্তানের সংস্কৃতিতে নেই। পাকিস্তানে নারীরা ব্যক্তিগত ও পেশার স্বাধীনতা খুঁজে পান না। এ কারণে অনেক একাকী (সিঙ্গেল) নারী পশ্চিমা দেশে পাড়ি জমান। পড়ালেখা শেষে দেশে ফেরার পরিবর্তে তাঁরা সেখানে থেকে যেতেই পছন্দ করেন। মাইগ্রেশন পলিসি ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২ লাখ ৭৩ হাজার পাকিস্তানি অভিবাসী আছেন। অনেক পাকিস্তানি নারী বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। পাকিস্তানের যেসব নারী পশ্চিমা দেশে একাকী থাকেন, দেশে থাকা তাঁদের মা-বাবা সামাজিক চাপে পড়েন। আসিম জানান, তাঁর মা-বাবা দারুণ চাপ অনুভব করছিলেন। তাঁরা কীভাবে তাঁদের মেয়েকে একাকী থাকার জন্য ছেড়ে দিতে পারলেন, এমন প্রশ্ন করা হতো। বায়োকেমিস্ট্রি পড়তে বছর দশেক আগে শাহেলা ওয়ানির যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পুরোপুরি সমর্থন করেছিলেন তাঁর মা-বাবা। কিন্তু পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মাস্টার্স শেষে দেশে ফিরে না আসায় তাঁর ওপর চাপ বাড়ে। তিনি পিএইচডি করেন। পরে আইন বিষয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। এমন অবস্থায় পাকিস্তানের বাড়িতে এলে তাঁকে শুনতে হয়: এত শিক্ষিত মেয়ের যোগ্য পাত্র কোথায় মিলবে! শাহেলাকে তাঁর মা-বাবা বাড়িতে ফিরতে বাধ্য করেননি। কিন্তু মেয়ের কারণে তাঁদের চাপের মধ্যে থাকার বিষয়টি অনুভব করতে পারেন শাহেলা। আমেরিকায় যাওয়ার আগে পাঞ্জাবের সায়মা ফেরদৌসকে দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। তাঁর পরিবারে মেয়েদের শিক্ষার চল ছিল না। শিক্ষার উদ্দেশ্যে আমেরিকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে তাঁর মা-বাবা বিস্মিত হয়। শেষ পর্যন্ত মিনেসোটায় আত্মীয়দের সঙ্গে থাকার শর্তে যুক্তরাষ্ট্র যান।
পরে হার্ভার্ডের ফেলোশিপ নিয়ে বোস্টনে চলে যান তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে একাকী থাকাটাও পাকিস্তানি নারীদের জন্য সহজ নয়। তাঁদের জন্য সামাজিকভাবে খাপ খাওয়ানোর বিষয় রয়েছে। আসিম জানালেন, যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর ধর্মীয় কারণে তাঁর নিজেকে সংখ্যালঘু মনে হচ্ছিল। শিক্ষার জন্য ১৯৯২ সালে পাকিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন আমেনা সাঈদ। ব্লুমবার্গ নিউজের এই সাংবাদিক নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে এসে থাকতে হলে ব্যাপকভাবে মানিয়ে চলতে হয়। অচেনা ও পুরোপুরি ভিন্ন সংস্কৃতির কারও সঙ্গে কক্ষ ভাগাভাগির বিষয়টি যে খুব একটা সহজ কাজ নয়, তা উল্লেখ করেন আমেনা। এ প্রসঙ্গে ফেরদৌসও তাঁর বাজে অভিজ্ঞতার কথা জানান। আমেনা ও ফেরদৌসের মতে, আমেরিকায় আসার সবচেয়ে ভালো দিক হলো, বিভিন্ন সংস্কৃতির লোকজনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে মেলামেশায় বিদ্যমান ধ্যানধারণা বদলে মন প্রশস্ত হয়। শাহেলার মতে, যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে চলাফেরার স্বাধীনতায়। পাকিস্তানে এক শৃঙ্খলিত জীবন কাটিয়েছেন শাহেলা। আর যুক্তরাষ্ট্রে এসে স্বাধীনতা পেয়েছেন, স্বনির্ভর হয়েছেন। আসিম জানালেন, বিয়ে ও একাকী থাকার ভীতি নিয়ে ধারণায় আসা বিবর্তনই তাঁর প্রবাসজীবনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন।
No comments