কাশেম নাকি সারোয়ার?
‘নব্য জেএমবি’র নেতা মাওলানা আবুল কাশেমকে (৬০) রাজধানীর সেনপাড়া এলাকা থেকে গত বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। এদিকে আদালতে কাশেম দাবি করেছেন, তাঁকে ১০ মাস আগে আটক করে ডিবি কার্যালয়ে রাখা হয়েছিল। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের দাবি, এই কাশেম নব্য জেএমবির আধ্যাত্মিক নেতা, যাঁকে সবাই ‘বড় হুজুর’ বলে ডাকত। গত বছর পুলিশের অভিযানে নিহত তামিম চৌধুরী ও আবুল কাশেমদের যৌথ প্রয়াসে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে নব্য জেএমবির সূচনা হয়। কিন্তু এর আগে গত বছরের ২১ অক্টোবর র্যাব সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিল, ২০১৫ সালের জুলাই মাসে ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করে এই সংগঠনের সূচনা করেন তামিম চৌধুরী ও সারোয়ার জাহান। গত বছরের ৮ অক্টোবর আশুলিয়ায় র্যাবের অভিযানে সারোয়ার জাহান নিহত হন। এই সারোয়ার জাহানই গুলশান হামলায় জড়িত ‘জেএমবির তামিম-সারোয়ার গ্রুপের’ প্রধান বলে দাবি করে র্যাব।
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে আবুল কাশেমকে গ্রেপ্তারের কথা জানান কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ রাজধানীর সেনপাড়া পর্বতা এলাকা থেকে মাওলানা কাশেমকে গ্রেপ্তার করে। তখন তিনি বিকাশের মাধ্যমে দলেরই একজন সমর্থকের পাঠানো ১৫ হাজার টাকা আনতে যাচ্ছিলেন। মনিরুল বলেন, ২০১৫ সালে তাঁরা প্রথম আবুল কাশেমের নাম জানতে পারেন। পরে ২০১৫ সালের শেষের দিকে এবং ২০১৬ সালে হলি আর্টিজানে হামলার আগে-পরে গ্রেপ্তার হওয়া বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ জঙ্গির কাছ থেকেও আবুল কাশেম সম্পর্কে জানতে পারেন। আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে আবুল কাশেম হলি আর্টিজান হামলা অনুমোদন করেছিলেন কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মনিরুল বলেন, ‘আমরা যতটুকু শুনেছি করেছেন। তারপরও তাঁকে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদে আমরা নিশ্চিত হতে পারব।’ তবে গতকাল আদালতে নেওয়া হলে আবুল কাশেম আদালতকে বলেন, হলি আর্টিজান হামলার আগে গত বছরের মে মাসে তাঁকে আটক করে ডিবি কার্যালয়ে রাখা হয়। এ সময় তিনি আদালতকক্ষে থাকা জিয়াউল হক নামের এক আইনজীবীকে দেখিয়ে বলেন, ডিবি কার্যালয়ে থাকার সময় ওই আইনজীবীর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। পরে যোগাযোগ করা হলে আইনজীবী জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্ত্রী জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সে জন্য চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে স্ত্রীসহ তাঁকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেখানে একটি সেলে কাশেমের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। পরে অবশ্য কোনো মামলা ছাড়াই স্ত্রীসহ জিয়াউলকে ছেড়ে দেয় ডিবি। গত বছরের মে মাসে কাশেমকে আটক করার বিষয়ে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, এটা সঠিক নয়। আসামিরা তো অনেক কথাই বলে। তাদের কথা অনেক ক্ষেত্রেই গ্রহণ করা যায় না। কারণ, গতকাল রাতেই তাঁকে ধরা হয়েছে। র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ গত ২১ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ৮ অক্টোবর সাভারের আশুলিয়ায় র্যাবের অভিযানের সময় নিহত সারোয়ার জাহানই নব্য জেএমবিকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তাঁর সাংগঠনিক নাম আবু ইব্রাহিম আল হানিফ। তিনি জানান, সারোয়ারের বাসা থেকে জঙ্গিদের বেশ কিছু সাংগঠনিক চিঠি ও কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়। এগুলোর মধ্যে ছিল নব্য জেএমবি গঠনের একটি ঘোষণাপত্র, যাতে আবু ইব্রাহিম আল হানিফ ও আবু দোজানা নামের দুজনের সই রয়েছে। আবু দোজানা হলেন তামিম চৌধুরী। আইএসের অনলাইন ম্যাগাজিন ‘রুমাইয়া’র এক নিবন্ধেও নিহত তামিম চৌধুরীকে আবু দোজানা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সারোয়ার জাহান আইএসের আরেক সাময়িকী দাবিক-এ প্রকাশিত ‘আবু ইব্রাহিম আল হানিফ’ একই ব্যক্তি কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা। তখন সারোয়ার জাহানকে নব্য জেএমবির তৃতীয় সারির নেতা বলেছিল কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। ‘আবু আল হানিফ’ মাওলানা কাশেমের সাংগঠনিক নাম কি না, জানতে চাইলে গতকাল মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘কাশেমের একটা নাম হচ্ছে শাইখ আবু মোহাম্মদ আইমান হাফিজুল্লাহ।
আরও কী কী নামে তিনি পরিচিত ছিলেন, সেটি জানার চেষ্টা চলবে।’ তিনি বলেন, মাওলানা কাশেম জেএমবির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এর সঙ্গে জড়িত। কয়েক বছর আগে মাওলানা সাইদুর রহমানের (পুরোনো জেএমবির আমির) সঙ্গে তিনি একাধিকবার আদালতে হাজিরার সময়ে গিয়ে দেখা করেছে, এ রকম তথ্যও পাওয়া গেছে। মাদ্রাসাশিক্ষকতার আড়ালে জঙ্গি তৎপরতা আবুল কাশেমের বাড়ি কুড়িগ্রামে। প্রথম আলোর কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিকে জেলার চিলমারী উপজেলার অষ্টমীর চর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তালেব ফকির জানিয়েছেন, তাঁর ইউনিয়নের ডাটিয়ারচরে কাশেমের বাড়ি ছিল, নদীতে সব ভেঙে গেলে তিনি পরিবার নিয়ে রাজীবপুর উপজেলার কোদালকাটি এলাকায় চলে যান। প্রথম আলোর দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, আবুল কাশেম ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে চিরিরবন্দর উপজেলার ওকড়াবাড়ি হামিদিয়া কওমি মাদ্রাসা ও এতিমখানায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ওই মাদ্রাসার বর্তমান অধ্যক্ষ আবদুল খালেক বলেন, কাশেম যখন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন, তাঁর তিন ছেলেও ওই মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছিল। ২০১৬ সালের ৫ মার্চ আবুল কাশেম চাকরি ছেড়ে তিন ছেলেকে নিয়ে চলে যান। অধ্যক্ষের ধারণা, জেএমবির সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবরের কথা জানতে পেরে কাশেম মাদ্রাসা ছেড়ে চলে যান। চিরিরবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আবুল কাশেমের জেএমবি-সম্পৃক্ততার বিষয়ে তাঁদের গত বছরের মার্চে ‘ওপর থেকে’ জানানো হয়। তখন ওই মাদ্রাসায় গিয়ে তাঁরা জানতে পারেন যে তিনি চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে মনিরুল ইসলাম বলেন, জেএমবির আমির মাওলানা সাইদুর রহমান কারাগারে যাওয়ার পর আবুল কাশেম আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে এই সংগঠনের হাল ধরেন। একপর্যায়ে আমির হিসেবেও কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন।
পরবর্তী সময়ে জেএমবির বিদ্রোহী অংশ নব্য জেএমবির আলাদা হওয়ার প্রক্রিয়া যখন শুরু হয়, তখন এই বিদ্রোহী অংশের সঙ্গে যোগ দেন কাশেম। মনিরুল বলেন, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরী দেশে আসার কিছুদিন পরে ২০১৩ সালের শেষ দিকে রাজশাহীতে যে বৈঠক হয়েছিল, সেখানেও আবুল কাশেম উপস্থিত ছিলেন। কাশেমসহ অন্যদের সঙ্গে তামিমের বৈঠক হয়। এই তথ্যটিও কতিপয় বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা ২০১৪ সালের দিকেই পুলিশকে দেয়। তখন তারা কাশেমের নামটা বলতে পারেনি, শুধু বলেছিল কোনো এক মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। মনিরুল বলেন, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী গ্রেপ্তার হওয়ার পর কাশেমের বিস্তারিত ঠিকানা পাওয়া যায়। তখন সেখানে গিয়ে দেখা যায়, তিনি এক থেকে দেড় বছর আগে মাদ্রাসার চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। বাড়ির সঙ্গে, স্বজনের সঙ্গেও ওইভাবে সম্পর্ক নেই। পরে দু-তিন দিন আগে নব্য জেএমবির সদস্য বড় মিজান গ্রেপ্তার হওয়ার পর কাশেমের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সেই সূত্র ধরেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়। রিমান্ড কাশেমকে গত বছরের ২৬ জুলাই কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের ঘটনায় করা মিরপুর থানার একটি মামলায় গতকাল আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে পুলিশ। আদালত সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
No comments