‘হবু প্রধানমন্ত্রী’ হলেন দেশদ্রোহী

ইয়াহিয়া খান ঢাকায় নেমে বিজয়ী দলের নেতা শেখ মুজিবু্র রহমানকে হবু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু সেটি তাঁর মনের কথা ছিল কি না, সে বিষয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। তিনি যদি নির্বাচনী ফল সানন্দে গ্রহণই করবেন, তাহলে গোয়েন্দাপ্রধানের ওপর খেপে যাবেন কেন? কেনই বা পিপিপি নেতা ভুট্টোর সঙ্গে লারকানা ষড়যন্ত্রে মিলিত হবেন? করাচির পথে ঢাকা ত্যাগের আগে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান অবজারভার সম্পাদক আবদুস সালামকে একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেন, যাতে তিনি আলোচনা ভেঙে যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করেন। ইয়াহিয়ার দাবি, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাস্তবতার ভিত্তিতে সমস্যাগুলো সমাধান করতেই তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা করতে ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাদের নেতাকে মীমাংসায় পৌঁছাতে দেয়নি। আরশাদ সামি লিখেছেন, ‘আমরা করাচি পৌঁছানোর পরই জেনারেল পীরজাদা চাইছিলেন প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর সঙ্গে দেখা করুন। পীরজাদা আমাকে দুবার ডেকে জানতে চান এ ব্যাপারে ভুট্টোর পক্ষ থেকে কোনো অনুরোধ এসেছে কি না কিংবা প্রেসিডেন্ট নিজে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন কি না।
একদিন সকালে ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি নিজেই আমাকে বললেন, প্রেসিডেন্ট ভবনে ভুট্টোর সম্মানে একটি ছোট নৈশভোজের আয়োজন করা হবে।’ আইয়ুবের পতনের পর ইয়াহিয়া-ভুট্টোর মধ্যে যে আঁতাত গড়ে উঠেছিল, সেটি আবার পুনর্জীবিত হলো এবং এই আঁতাতই পাকিস্তান ও ইয়াহিয়াকে বিপর্যয়ের দিক ঠেলে দিল। এই ব্যক্তিগত নৈশভোজে ভুট্টো জুনগড়ের নবাব মোহাম্মদ দিলওয়ার খানজি ও বেগম জুনাগড়কে নিয়ে এসেছিলেন। সেই নৈশভোজে ইয়াহিয়া ও বেগম জুনাগড়ের সখ্য সম্পর্কে সামি লিখেছেন, ‘আকর্ষণীয় বেগম জুনাগড়ের অঙ্গভঙ্গির ওপর ইয়াহিয়ার প্রলুব্ধ চাহনি নিবদ্ধ ছিল। প্রত্যুত্তরে বেগম জুনাগড় এমনভাবে তাকালেন, যাতে অনুমোদনের চেয়ে বেশি কিছু ছিল।’ পরের সপ্তাহে ইয়াহিয়া ভুট্টোর লারকানার বাড়িতে গেলে সেখানেও জুনাগড় দম্পতি যোগ দেন। লারকানায় ভুট্টো ইয়াহিয়ার কাছে জানতে চান, মুজিব ও আওয়ামী লীগ চরমপন্থা নিলে তাঁর কাছে কী বিকল্প থাকবে? ইয়াহিয়া জবাব দিলেন, ‘মাত্র দুটি। এক. জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা, যাতে রাজনীতিকেরাই তাঁদের অরাজকতা দূর করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান ভাঙার দায়ে মুজিবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।’ এরপর ইয়াহিয়া পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করবে?’ ভুট্টোর জবাব ছিল, ‘কখনো না, কখনো না।’ তিনি আরও যোগ করলেন, ‘পাকিস্তান ভাঙার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের নীলনকশা আছে। কিন্তু আমি পাকিস্তান ভাঙার দায় নিতে পারি না।’ লারকানা বৈঠকের পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং জেনারেলদের মধ্যে তাঁর নিজস্ব চক্রটি ইতিমধ্যে সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। দলের ভেতরের লোকদের মতে, আওয়ামী লীগ ও মুজিব সরকার গঠন করলে ভুট্টো ও পিপিপি সংসদীয় ভূমিকা রাখতে এবং বিরোধী দলের আসনে বসতে ইচ্ছুক নয়। দুই দলই পৃথকভাবে সরকার গঠনে আগ্রহী।
এ প্রসঙ্গে ভুট্টো বলেছিলেন, ‘এ ধার হাম ও ধার তোম।’ তুমি পূর্বাংশ নিয়ে থাকো, আর আমি পশ্চিমাংশ। প্রস্তাবটি আওয়ামী লীগের জন্য খানিকটা রাজনৈতিক সুযোগ এনে দেয়। অন্যদিকে ইয়াহিয়া চক্রের সামরিক অভিযানের প্রস্তুতিও চলতে থাকে। সামি খানের ভাষ্য, ‘আমরা প্রায়ই পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শক্তি যাচাই করতে সদর দপ্তরে যেতাম এবং আওয়ামী লীগেই চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে বাড়তি কী প্রয়োজন, তা খতিয়ে দেখতাম। এটি জানা কথা যে পূর্ব পাকিস্তান সামরিক দিক দিয়ে ছিল খুবই ভঙ্গুর।’ এর পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের সেনাবাহিনীর দুই অংশে সমান ভাগ করলে ভারতের শক্তিশালী বাহিনীর কাছে তা অধিকতর দুর্বল হতো যেকোনো অংশের জন্য। ভারতীয় বাহিনী সহজেই পশ্চিম পাকিস্তানকে ধ্বংস করে দিতে পারত।’ অর্থাৎ পাকিস্তানি শাসকেরা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা পশ্চিম পাকিস্তানের শক্তির ওপরই নির্ভরশীল করে রেখেছিল। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে নাকি এই কৌশল কাজে লেগেছিল। কিন্তু সামরিক দিক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে দুর্বল রাখার কারণে যে বাঙালিদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছিল, সেটি সামি খানসহ পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তারা আমলেই আনেননি। আওয়ামী লীগের ছয় দফা জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল পঁয়ষট্টির যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের অরক্ষিত থাকা। এর আগে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে টেলিফোন আলাপে শেখ মুজিব সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘ছয় দফা অপরিবর্তনীয় ও চূড়ান্ত।’
জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠানেও তিনি ঘোষণা করেন, ছয় দফা এখন জনগণের সম্পত্তি। এটি পরিবর্তনের ক্ষমতা কারও নেই। সামি স্বীকার করেছেন, ‘এটাই অগণতান্ত্রিক রীতি, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে তিনি সেই দাবি করতেই পারেন।’ কিন্তু পাকিস্তানি শাসকেরা গণতান্ত্রির রীতির তোয়াক্কা করতেন না। মুজিবের সঙ্গে টেলিফোনে কথা শেষ হতেই ইয়াহিয়ার পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাডমিরাল গভর্নর আহসানকে সংযোগ লাগিয়ে দিতে বলেন। প্রেসিডেন্ট তাঁকে বললেন, ‘মুজিবের কণ্ঠ খুবই অবাধ্যতার সুর।’ এরপর তিনি ইয়াকুব আলী খানের সঙ্গে কথা বলেন। মধ্য ফেব্রুয়ারিতে রাওয়ালপিন্ডিতে সেনা কর্মকর্তাদের বৈঠকেই সামরিক অভিযানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। ২৫ মার্চ সামরিক অভিযানের পর ইয়াহিয়া খান বেতার–টিভিতে দেওয়া ভাষণে শেখ মুজিবকে দেশদ্রোহী বা বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিহিত করেন। তাঁর হবু প্রধানমন্ত্রী হলেন ট্রেইটর। তবে তাঁর শেষ রক্ষা হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পাকিস্তানি বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের পর তিনি নিজেও ক্ষমতাচ্যুত হন। ইয়াহিয়া যেভাবে আইয়ুবকে হটিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন, ভুট্টোও একইভাবে তাঁকে মসনদ থেকে বিতাড়িত করেন। আগামী কিস্তিতে সে বিষয়ে বিস্তারিত থাকবে। তার আগে আইয়ুবের এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সামি খান দুই পীরের যে ঘটনা বিবৃত করেছেন, সেটাই এখানে তুলে ধরছি। ‘প্রেসিডেন্টের এডিসি হিসেবে যোগদানের (১ এপ্রিল ১৯৬৬) পরপরই যখন আমি কাজ শিখছি মাত্র, একদিন সকালে প্রবেশফটক থেকে টেলিফোনে জানানো হলো, দেউল শরিফের পীর সাহেব এসেছেন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে।
তাঁর সঙ্গে শ-খানেক অনুসারী আছেন। নিরাপত্তাকর্মী জিজ্ঞেস করলেন, নির্ধারিত সময়সূচির দুই ঘণ্টা আগে তিনি এসেছেন, তাঁকে আসতে দেওয়া হবে কি না। আমি আমার সহকর্মী লে. খালিদ মিরের পরামর্শ চাইছিলাম। তিনি হাসলেন এবং জানালেন, প্রেসিডেন্ট সত্যিকারভাবে কোনো পীরে বিশ্বাস করেন না। অন্য রাজনীতিকদের ব্যাপারে তাঁর যতটা আগ্রহ, তাঁদের প্রতি তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। আমার উচিত তাঁকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া। তবে তিনি আমাকে সজাগ করে দিয়ে বললেন, নির্ধারিত সময়ের আগে যেন পীর সাহেব সরাসরি প্রেসিডেন্ট অফিসে যেতে না পারেন। তিনি আরও যোগ করলেন, ‘তুমি দেখতে পাচ্ছ সামি, পীর সাহেব শ-খানেক বা দুই শ লোক নিয়ে আসেন এবং প্রেসিডেন্ট মধ্যাহ্নভোজের জন্য অফিস ত্যাগ করার পর জায়গা ছেড়ে যান, এটাই তাঁদের বৈশিষ্ট্য।’ ‘এর মাধ্যমে তাঁরা অনুসারীদের বোঝাতে চান যে প্রেসিডেন্ট নিজেও পীর সাহেবের অনুগত এবং তিনি প্রাতঃরাশে তাঁকে আমন্ত্রণ জানান এবং দুপুরের খাবারও তাঁর সঙ্গে খান। প্রেসিডেন্ট আরও বেশি সময় তাঁকে সেখানে রাখতে চেয়েছিলেন; কিন্তু বাইরে অপেক্ষমাণ শিষ্যদের কারণেই তিনি চলে এসেছেন। ‘নির্দেশনামতে, আমি শুধু পীর সাহেবকে ভেতরে আসার অনুমতি দিতে বলি, তাঁর সঙ্গীদের নয়। কয়েক মিনিট পর আবারও ফটক থেকে জানানো হলো, মানকি শরিফের পীর সাহেব এসেছেন। তাঁকেও প্রেসিডেন্ট সাক্ষাতের অনুমতি দিয়েছেন। আগের মতোই তাঁকে আসার অনুমতি দিলাম। ‘সাড়ে আটটায় দুই পীর প্রেসিডেন্টের অতিথিকক্ষে এলেন। তাঁদের একজনের নির্ধারিত সময় ১০টা, আরেকজনের সাড়ে ১০টা। দ
বিতীয় পীর আসার আধা ঘণ্টা পর আমার অফিসের বাইরে শোরগোল শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি দ্রুত বেরিয়ে এলাম এবং দেখতে পেলাম যে অতিথিকক্ষে দুই পীর মল্লযুদ্ধে রত। আমি তাঁদের দুজনকে বিচ্ছিন্ন করতে চেষ্টা করলাম। তাঁরা এক হাতে একে অন্যের দাড়ি ধরে আছেন, আরেক হাতে জামার কলার। তাঁদের পদযুগলও অলস বসে ছিল না। পা দিয়ে তাঁরা ক্যাঙারুর মতো একে অন্যকে লাথি মারছেন। আমি যখন তাঁদের নিবৃত্ত করতে পারছিলাম না, তখন নিরাপত্তাকর্মীদের ডাকলাম। তাঁরা কার্যত বন্দুকের মুখে তাঁদের বিচ্ছিন্ন করলেন। এরপর আমি বিষয়টি প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মোহাম্মদ রাফিকে জানালাম। তিনি তাঁদের থামালেন এবং কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মীকে এনে নির্দেশনা দিলেন যে তাঁরা যদি একে অন্যকে মারতে যান, তাহলে তাঁদের গ্রেপ্তার করে স্থানীয় থানায় নিয়ে যাওয়া হবে। প্রেসিডেন্ট অতিথিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষ করলে সামরিক সচিব আমাকে নিয়ে তাঁর কাছে বিষয়টি জানালেন। উত্তেজনা শেষ হলে দেউল শরিফের পীরকে আনার জন্য প্রেসিডেন্ট আমাকে হুকুম দিলেন। যদিও তখনো তাঁরা শান্ত হননি। এর ১০ মিনিট পর মানকি পীরকে আনা হলো। আমি যখন দ্বিতীয় পীরকে নিয়ে এলাম, প্রথম পীর গজগজ করতে লাগলেন। প্রেসিডেন্ট তাঁকে থামিয়ে দিলেন এবং তাঁদের দুজনকে পরস্পরের সঙ্গে হাত মেলাতে এবং ক্ষমা চাইতে বললেন। দুজনই অস্বীকৃতি জানালেন। এরপর প্রেসিডেন্ট আমাকে উদ্দেশ করে নিরাপত্তাকর্মীদের ডেকে দুজনকে হাতকড়া পরাতে এবং প্রেসিডেন্ট ভবনে গোলযোগ করার জন্য স্থানীয় থানায় গিয়ে মামলা ঠুকতে বললেন। এতে কাজ হলো। প্রেসিডেন্ট কথা শেষ না করতেই দুই পীর উঠে দাঁড়ালেন। একে অন্যের কাছে মাফ চাইলেন। এরপর তাঁরা প্রেসিডেন্টের ডেস্কের সামনে দুটি সোফায় বসলেন। তিনি উভয় পীরকে প্রেসিডেন্ট ভবন ত্যাগ করতে বললেন, যদিও তাঁরা নির্ধারিত সময় পর্যন্ত থাকতে চেয়েছিলেন।
তাঁদের আর কখনো প্রেসিডেন্ট ভবনে দেখা যায়নি।’
আগামীকাল: ‘ইয়াহিয়া বললেন, খেলা শেষ’
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.