রাজশাহীতে বধ্যভূমি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই
যখন জ্ঞান ফিরল, আবদুল মান্নান সরকার দেখলেন তিনি পড়ে আছেন গলিত লাশের স্তূপের ওপরে। তাঁর চোখ ঝাপসা। অনেকক্ষণ কিছু দেখতে পাননি। আস্তে আস্তে চোখ পরিষ্কার হলে দেখলেন, তাঁর শরীরে কোনো কাপড় নেই। লাশের এই স্তূপ একটি নিচু গর্তের মতো জায়গায়। চারপাশে ইটের সারি। সেদিন ছিল ১৯৭১ সালের ২১ অক্টোবরের বিকেল। আবদুল মান্নান নিজেকে যেখানে আবিষ্কার করলেন, তার কিছু দূরেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন জোহা হল। তাঁর মনে পড়ল, ছয় দিন আগে তাঁকে ধরে নিয়ে ওই হলেই আটকে রাখা হয়েছিল। হলটি ছিল পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প বা সামরিক দপ্তর। আসলে নির্যাতন কেন্দ্র। এখানে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে যাদের হত্যা করা হতো, তাদের লাশ ফেলে দেওয়া হতো পেছনের ইটভাটায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপপ্রধান তথ্য কর্মকর্তা সাদেকুল ইসলাম বলেন, জোহা হল নির্মাণের জন্য প্রচুর ইট এনে রাখা হয়েছিল কাছেই নিচু গর্তমতো একটি জায়গায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লোকজনকে হত্যা করে ওই গর্তের মধ্যে ফেলে রাখত।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ওই বধ্যভূমি থেকে বহু মানুষের হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়। সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালার তিনটি আলমারিতে তুলে রাখা হয়েছে। জায়গাটিতে পরে তৈরি করা হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ। স্মৃতিফলকে লেখা রয়েছে: ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ঘাতক পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে যাঁরা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, সেই সব মৃত্যুহীন শহীদ এই গণকবরে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। বাঙালি জাতি তাঁদের অমর স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করছে।’ ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল রাতে পাকিস্তানি বাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলে তাদের ক্যাম্প গড়ে তোলে। বিভিন্ন এলাকা থেকে স্বাধীনতাকামী মানুষকে ধরে এনে এই ক্যাম্পে নির্যাতন করা হতো। তারপর হত্যা করে পাশের বধ্যভূমিতে ফেলে দিয়ে আসা হতো। রাজশাহী নগরের বালিয়াপুকুর এলাকার আবদুল মান্নান সরকারকে তাঁর বাসা থেকে তুলে আনা হয় একাত্তরের ১৬ অক্টোবর ভোররাতে। তখন তাঁর বয়স ছিল ২১ বছর। গত মঙ্গলবার কথা হয় তাঁর সঙ্গে। আঁকশি (প্লাস) দিয়ে তাঁর নখ তুলে ফেলার চেষ্টার কারণে হাত-পায়ের আঙুলগুলো এখনো কুঁকড়ে আছে। তিনি বলেন, চোখ বেঁধে জোহা হলে নিয়ে গিয়ে যখন তাঁর চোখ খুলে দেওয়া হলো, তখন তিনি বুঝতে পারেননি কোথায় আনা হয়েছে। তাঁকে দোতলার একটি ঘরে ছুড়ে দেওয়া হয়। আবদুল মান্নান সরকার জানান, যে ঘরে তাঁকে আটকে রাখা হয়, সেটার মেঝেতে প্রায় দুই ইঞ্চি পুরো হয়ে মানুষের মাথার চুল-রক্ত জমাট বেঁধে ছিল। প্রচণ্ড দুর্গন্ধ। ভালো করে তাকিয়ে দেখেন, তারও আগে বন্দী আরও একজন মেঝেতে পড়ে আছেন। সেই বন্দীর কাছ থেকেই তিনি জানতে পারেন, এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হল। তাঁর সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁর আত্মীয় মীর রহমত আলীকেও। ওই কক্ষে তাঁদের নিয়মিত নির্যাতন করা হতো। বেয়নেট দিয়ে মীর রহমত আলীর একটি চোখ তুলে নেওয়া হয়। পরে তাঁর কী হয়েছিল, আর জানা যায়নি। আবদুল মান্নান সরকার বলেন, ২১ অক্টোবর তাঁকে নিচে মেজর সাহেবের কক্ষে নেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য দিতে তাঁকে প্রচণ্ড নির্যাতন করা হতে থাকে। নির্যাতনের একপর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। যখন জ্ঞান ফেরে, নিজেকে তিনি লাশের স্তূপে আবিষ্কার করেন। আবদুল মান্নান ভাগ্যচক্রে বেঁচে গেছেন।
রাজশাহী শহরের লিয়াকত আলী তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। সদ্য ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হয়েছেন। পাকিস্তানি সেনাদের হাতে আটক হয়ে তিনিও তিন মাস বন্দী ছিলেন জোহা হলে। লিয়াকত আলী বর্তমানে ওয়ার্কার্স পার্টির রাজশাহী মহানগর শাখার সভাপতি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বন্দীদের মধ্য থেকে প্রতিদিন চার-পাঁচজনকে চোখ বেঁধে বাইরে নিয়ে যাওয়া হতো। কিছুক্ষণ পরই গুলির শব্দ শোনা যেত। যাদের নিয়ে যাওয়া হতো, তারা আর ফিরে আসত না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই হলের পূর্ব পাশে বিরাট গণকবর পাওয়া যায়। বধ্যভূমির পাশেই এখন একটি বটগাছ বেড়ে উঠছে। চারজন পুলিশ সদস্য পাহারায় থাকেন। গত মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, চারদিক সুনসান। স্মৃতিস্তম্ভের দুই পাশে বটলব্রাশের সারি। ফুলের বাগানে সালভিয়া, করবী, পপি, ফায়ারবল, গাঁদা ও নয়নতারা। আজ যাঁরা এই সৌম্য স্মৃতিস্তম্ভের সামনে এসে দাঁড়ান, তাঁদের পক্ষে কল্পনাও করা সম্ভব নয়, একাত্তরে কী বীভৎস দৃশ্যের সূচনা হয়েছিল এখানে। তবে যাঁরা প্রাণে বেঁচে ফিরে এসেছেন, আর যাঁরা স্বজনদের খুঁজতে গিয়ে লাশের স্তূপ হাতড়ে বেরিয়েছেন, তাঁদের স্মৃতিতে ওই দুঃস্বপ্নের দৃশ্য আজও জ্বলজ্বল করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও হেরিটেজ বাংলাদেশের ইতিহাস আর্কাইভসের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান বলেন, এই বধ্যভূমিতে মোট কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তা নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি। প্রকৃত অনুসন্ধানের জন্য গণকবরের খননকাজও ঠিকমতো করা হয়নি। তবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমিগুলোর এটি একটি।
No comments